২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। এয়ারফোর্স ওয়ান বিমান থেকে হাত ধরাধরি করে দিল্লির বিমানবন্দরে নামলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তাঁর স্ত্রী মিশেল। মিশেলের হাঁটু পর্যন্ত নীল ফ্লোরাল প্রিন্ট ড্রেস আর ম্যাচিং কোটের নিখুঁত পারিপাট্য নিমেষে চোখ টেনে নিয়েছিল ভারতের ফ্যাশন গুরুদের। এই পোশাক যিনি ডিজাইন করেছিলেন, তাঁর নাম বিভু মহাপাত্র। জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা উড়িষ্যার রাউরকেলায়,বর্তমানে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে নিজস্ব স্টোর। তৎকালীন ফার্স্ট লেডি ছাড়াও অসংখ্য তারকার পছন্দের তালিকায় এই ভারতীয় ডিজাইনার। গিনেথ প্যালট্রো, লুপিতা নিয়োঙ্গো, হিলারি সোয়াঙ্ক, গ্লেন ক্লোজ়-এর মতো হলিউড তারকারা বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ফাংশন ও অন্যত্র প্রায়ই বেছে নিয়েছেন বিভুর পোষাক। নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকের রানওয়েতেও অনায়াস বিচরণ বিভু মহাপাত্রের। তাঁর আকর্ষণীয় প্রিন্টের কাজ, লেসের ব্যবহার, নিখুঁত কাট নজর কেড়েছে নিউ ইয়র্কের সোশ্যালাইটদের।

Michelle Obama in Naeem Khan Couture
নঈম খানের পোশাকে মিশেল ওবামা

ততদিনে ফ্যাশন আইকন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত মিশেল ওবামা। সত্যি বলতে কী, জ্যাকি কেনেডির পর যে ফার্স্ট লেডির ‘স্টাইল’ ফ্যাশন ম্যাগাজিনে গুরুত্ব পেতে শুরু করে, তিনি মিশেল ওবামা। এই মিশেলেরই আর এক পছন্দের ডিজাইনারের নাম নঈম খান। ভারতের বরেলিতে, রাজকীয় দর্জি পরিবারে জন্ম নঈমুদ্দীন খানের। বাবা এবং ঠাকুরদা দু’জনেই ছিলেন রাজদরবারের খাস ‘ডিজাইনার’। পোশাকের খুঁটিনাটি তাই আগাগোড়াই নঈমের রক্তে। আর খানিকটা পারিবারিক রাজকীয় ধারা বজায় রেখেই, নঈমের তৈরি পশ্চিমী পোশাকের পরতে পরতে সূক্ষ্ম সূচের কাজ, চুমকি, ভেলভেট, লেপার্ড প্রিন্টের জৌলুস। ২০১৬ সালে ভারত-ভুটান-নেপাল সফরে আসা ডাচেস অফ কেমব্রিজ নঈম খানের তৈরি পোশাকে তাজমহল দেখতে যান। সাদার ওপর নীল সুতোর কাজ করা এই পোশাক অভাবনীয় সাড়া ফেলে ফ্যাশন দুনিয়ায়।

kate-middleton-taj-mahal-Naeem-Khan
ডাচেস অফ কেমব্রিজ কেট মিডলটনের পরনে নঈম খানের ফ্লোরাল পোশাক

বিভু মহাপাত্র কিংবা নঈম খানের পোশাক বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বেছে নিয়েছেন বলে তাঁরা বিশেষভাবে আলোচিত হলেও, এঁরা এখন আর একা নন। বেশ কয়েকজন ভারতীয় ডিজাইনার এখন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন জগতে পরিচিত নাম। মণীশ অরোরা, ফাল্গুনি শেন পিকক, সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, আবু জানি-সন্দীপ খোসলার মতো ডিজাইনারের পোশাক ভারতীয় অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভুত ক্রেতাদের বাইরেও নিয়মিত জায়গা করে নিচ্ছে।

sabyasachi fashion show
সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের ফ্যাশন শো

সব্যসাচী এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এইচ অ্যান্ড এম-এর যৌথ উদ্যোগে পরিবেশিত পোশাকের কালেকশন বাজারে লঞ্চ হবার কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ বিক্রি হয়ে যায়। অর্থাৎ শুধুমাত্র তারকা কিংবা সেলেব নয়, সাধারণ দেশি বিদেশি মধ্য ও উচ্চবিত্ত ক্রেতার মধ্যেও ভারতীয় ডিজাইনারদের ব্যাপারে স্পষ্টতই একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ভারতীয় ফ্যাশনের পক্ষে এ অত্যন্ত সুখবর। তবে ভারতে ফ্যাশনের ক্ষেত্রটা বছর তিরিশেক আগেও এরকম ছিল না। আসুন কয়েক দশক পিছিয়ে যাই।

Ritu Kumar store in Quest Mall KOlkata
কলকাতার এক শপিং মলে ঋতু কোমারের ফ্যাশন বিপণি

১৯৬৯ সালে ঋতু কুমার যখন দিল্লিতে তাঁর প্রথম দোকান খোলেন, ভারতে তখন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বলতে আসলে কিছুই ছিল না। কাপড় উৎপাদনের একটা বড় বাজার ছিল, কিন্তু সেই বাজারে তখন পলিয়েস্টারের রমরমা। বিমল, বম্বে ডাইং, গার্ডেন ভ্যারেলির মতো কোম্পানির কাপড় ছিল সহজলভ্য। ভারতের দেশজ বুননশৈলী, প্রিন্ট, ডাই, কারিগরী তখন কালের গর্ভে সুপ্ত। ব্রিটিশ শাসকদের বদান্যতায়, ভারতের বাজার ছেয়ে গেছে মিলের কাপড়ে। পেটের ভাতের জোগান দিতে অনেক তাঁতি ও কারিগর খুঁজে নিয়েছেন অন্য পেশা। বংশ পরম্পরায় চলে আসা হাতের কাজ ভুলে গেছে পরবর্তী প্রজন্ম। ঋতুর মতো কিছু ডিজাইনার এবং আশা সারাভাই-এর মতো কিছু অ্যাকটিভিস্ট নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান ভারতের হাতে বোনা কাপড়ের ঐতিহ্য ফেরাতে।

এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে স্থাপিত হয় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি। এই ঘটনা ভারতীয় ফ্যাশনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর আগে এ দেশে ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনা করার উপযুক্ত কোনও সংস্থাই ছিল না। বলা ভাল, ফ্যাশন যে পড়াশোনার বিষয় হতে পারে, তা ছিল আমাদের ধারণার অতীত। এর মাত্র পাঁচ বছর পরই আসে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত– ভারতের অর্থনীতির দরজা খুলে যায় পৃথিবীর বাজারে। একের পর এক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে থাকে ভারতের বাজারে। ফরাসি ডিজাইনার পিয়ের কার্দাঁ প্রথম আন্তর্জাতিক ডিজাইনার যিনি ভারতে ফ্যাশন শো করেন।

Manisharora creation
মণীশ অরোরার ডিজ়াইনারওয়্যার

নয়ের দশকে ক্রমে ফ্যাশন শোয়ের মাধ্যমে ডিজাইনারেরা তাঁদের কালেকশন পরিবেশন করতে শুরু করেন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে খুব ধীরে হলেও, ফ্যাশন সম্পর্কে একইসঙ্গে কৌতূহল এবং জ্ঞান বাড়তে থাকে। এছাড়া সর্বস্তরের হিন্দি ছবির দর্শকদের মধ্যেও বলিউড ফ্যাশনের প্রভাব পড়তে থাকে। তবে, ভারতে এই সময়ের ফ্যাশন মূলত বাঁধা পড়ে ছিল বিয়ের সাজের গণ্ডিতে। বিয়েতে বরকনে এবং তাঁদের পরিবার– এঁরাই ছিলেন ডিজাইনারদের সিংহভাগ ক্রেতা। তার বাইরে অফিসের পোশাক, অবসরযাপনের পোশাক কিংবা পার্টিওয়্যারের জন্য এঁরা বিদেশি ব্র্যান্ডের দ্বারস্থ হতেন।

নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকেই অবশ্য ছবিটা দ্রুত বদলাতে শুরু করে। একইসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা পরপর ঘটে যায় দেশে এবং বিদেশে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিরাট স্ফীতি দেখা যায়, যার ফলে প্রচুর ভারতীয় কর্মচারী বিদেশে পাড়ি দিতে থাকেন সাময়িক এবং পাকাপাকিভাবে। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি এবং রিয়েল এসটেট বুম-এর হাত ধরে এক শ্রেণীর ক্রেতার হাতে ডিসপোজ়েবল ইনকাম বাড়তে থাকে। আর সেইসঙ্গে বেড়ে চলে মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর আয়তন। রিটেল ক্ষেত্র বড় রকমের সাফল্য পায় এবং ফ্যাশন ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজি লগ্নি করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে অনাবাসী ভারতীয় ক্রেতা এবং পৃষ্ঠপোষকদের উৎসাহে একাধিক ভারতীয় ডিজাইনার এবং ব্র্যান্ড তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে শুরু করেন বিদেশে।

julia-roberts
হাতে বোনা সনাতনী টেক্সটাইল ও বুননশৈলীর পুনরুজ্জীবন চাইছে ফ্যাশন দুনিয়া। ‘ইট প্রে লাভ’ ছবিতে জুলিয়া রবার্টস পরেছেন ভারতের সনাতনী কাঞ্জিভরম শাড়ি

গত এক দশকে অনেকটাই সাবলীল হয়ে উঠেছে ভারতীয় ফ্যাশন। সক্ষম হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের পরিচিতি তৈরি করতে। ভারতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় দশ কোটি মানুষ এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। নানান সূত্রের হিসেব অনুযায়ী এই ক্ষেত্রের বাজারমূল্য বর্তমানে পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সহজেই অনুমান করা যায়, এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

শুরুর কথায় ফিরে আসি। মার্কিন ফার্স্ট লেডি, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সদস্য, রুপোলি পর্দার তারকার হাত ধরতে পারলে আঞ্চলিক ফ্যাশনের পালে খানিক হাওয়া লাগে, কারণ তা মিডিয়ার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যতবার এমন ঘটনা ঘটে, এক ঝাঁক নতুন ক্রেতা ভারতের ফ্যাশন নিয়ে আগ্রহী হন। এই আগ্রহকে ভারতের হাজার  বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঁধনি, আজরখ, শিবোরি, মসলিনের মতো বিভিন্ন জাতের টেক্সটাইল এবং তাদের কারিগরী পদ্ধতির দিকে বইয়ে দিতে পারাই এর পরের পদক্ষেপ, যাতে ভারতীয় ফ্যাশন তার প্রাক ব্রিটিশ গৌরবময় অধ্যায় আবার ফিরে পেতে পারে।

 

ছবি সৌজন্য: Pinterest, Pure Elegance, Instyle, abcnews, Facebook

পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *