আশির দশকের ফেলে আসা ছোটবেলা… পঞ্চমীর দিন হাফছুটি… লাস্ট পিরিয়ডের পড়াশোনা কিছু আর মাথায় ঢোকে না…! আগের দিন, মানে চতুর্থীর দিন ভোরবেলা হইহই করে প্রতিমা আনা হয়ে গেছে পাড়ার প্যান্ডেলে। বাড়ির সামনের ঘাসে হিরের কুচির মতো শিশির জমতে শুরু করেছে। বাগানের উঠোনে বিছিয়ে আছে শিউলিফুল। “চণ্ডীতলায় ঢাকের আওয়াজ মিষ্টিমধুর, জাগিনা তাক তাধিনা তাক তাধিনা, তাক কুড়কুড় কুরুড় কুরুড় তাক!”

বয়েস অনেক হল টের পাচ্ছি। আজকাল স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা…। বড়ো জেঠু, মেজোপিসি, মাসীর দেওয়া পুজোর জামা কবে কোনটা পড়া হবে, আর ঠাকুমার দেওয়া হাত খরচের টাকায় কতবার নাগরদোলা চাপব, আর কী কী খাব… সারাদিন এসব প্ল্যান চলতে চলতে আর আনন্দ করতে করতে কখন যে সেই শেষ দিন এসে উপস্থিত! সারাবছর যে দিনগুলোর জন্যে অপেক্ষা, নিমেষে বুকের ভিতর নিংড়ানো কষ্ট দিয়ে চলে এল দশমী…

সিঁদুর খেলা, ঘট বিসর্জন, ব্যাস! শেষ! আরে শেষ বললে হয়? এর পর তো আরও প্ল্যান শুরু। বিধিমতো কালীপুজো পর্যন্ত বিজয়া চলতে পারে।  কোন বিধি, কার বিধি জানি না, তবে এটাই রীতি! মানে, প্রণাম আশীর্বাদ আর কোলাকুলি এসব তো আছেই, আর এসব তো শুকনো মুখে মোটেই আসে না! তো নবমীর রাতে, প্যান্ডেলের মাঠে বসে খসড়া তৈরি হয়– দশমীর দিন ব্যানার্জিকাকিমার বাড়ি, পরদিন রায়কাকিমা, তারপর দপ্তরীকাকু… এই করে পুরো কালীপুজো পর্যন্ত সর্টেড! ইয়ে মানে একদিনে একটা বাড়িই যথেষ্ট। যা যা সব খাবার বানায়, উফফ ভেবেই জিভে জল…। আরে বাপু তখন কি আর ডাইজিন জেলুসিলের ভরসায় ছিলাম? ওই, আমার দাদুর ডায়ালগ আর কি, “আমরা লোহা চিবিয়ে হজম করতাম, বুঝলি?”

বিজয়া শুরু হতো ঠিক ট্রাকে প্রতিমা ওঠার পর। কিছুর দূর সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পাড়ার শেষ টার্নে ঢুকে যেতাম ব্যানার্জিকাকিমার বাড়ি। নাড়ু, নিমকি, এসবের সঙ্গে সাঁতরা কাকিমার স্পেশাল ঘুঘনি, পেঁয়াজ লঙ্কা লেবু আর একটু তেঁতুলে চাটনি ওপরে দেওয়া! আহা অমৃত! কারও কারও বাড়িতে স্পেশাল ছিল কিমা অথবা আইসক্রিমও, ঘরে তৈরি সবই… জোমাটো, সুইগি কি স্বপ্নেও ভেবেছি তখন!

Nimki and Nadu
বিজয়া দশমী মানেই প্লেটে সাজানো এইসব ভালমন্দ

যাইহোক, এত এত বছর কেটেছে, বিজয়া আজও আসে। পুজোটা আজকাল নির্জনে কাটাতে বেশি ভালোলাগে। সারা বছরের ক্লান্তি কাটাতে, এই কটা দিন হয়তো কোনও পাহাড়ে…। পুজোরও ধরন পাল্টেছে, থিম পুজোর চল আজকাল। তবু আঁকড়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে মা কাকিমার হাতের লাল আর সাদা নারকেল নাড়ু, সিরির নাড়ু, কুচো নিমকির স্বাদ। সিরির নাড়ু, আজকাল পাওয়া যায় না খুব একটা। যা-ও বা পাই, অতীব শক্ত। অগত্যা মায়ের হাথ জগন্নাথ ছাড়া গতি কী?

বিজয়ার মিষ্টিমুখে, আজ বলি, মায়ের হাতের সিরির নাড়ুর গল্প। সঙ্গে মায়ের দেওয়া নারকেল নাড়ু আর নিমকি (নোনতা ও মিষ্টি) বানানোর কিছু গোপন টিপস, আর দুটো অন্য স্বাদের মিষ্টির কথা…

সিরির নাড়ু করতে…

*******************

বেসন, গুড়, তেল। ব্যাস এইটুকুই!

প্রায় পাঁচশো গ্রাম বেসন, অল্প অল্প করে জল দিয়ে একটু টাইট করে গুলে নিতে হবে। ব্যাটারটা ওই বেগুনি গোলার মতো নয় মোটেও, আরো খানিক শক্ত। বেশ খানিকটা তেল ভালো গরম করে, তারপর মিডিয়াম আঁচে, তেলের ওপর বড়ো একটা ছানতা ধরে, তার ওপর বেসন গোলা ফেলে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে তেলে ফেলতে হবে। তবেই মুচমুচে  ঝুরিভাজা তৈরি হবে। বেশ মুচমুচে হবে কিন্তু খুব লাল নয়, এরকম সময় তুলে নিতে হবে। ভেজে রেখে ঠান্ডা করতে হবে। তৈরি সিরি।  

তারপর কড়াইতে গুড় জাল দিয়ে, গুড় মানে ভালো ভেলি গুড়, ভালো করে গুড় গলিয়ে নিতে হবে আঁচে। বেশ ফ্যানা হলে, আঁচ থেকে নামিয়ে নিয়ে ঝুরিগুলো গুড়ে দিয়ে নাড়তে হবে। ভালো করে সবার গায়ে গুড় লেগে গেলে, থালায় নামিয়ে নিতে হবে। এরপর সব চেয়ে শক্ত কাজ। ওই উষ্ণ গরম অবস্থায় হাতে তেল মাখিয়ে নাড়ু পাকিয়ে ফেলা, ঠান্ডা করলে হবে না মোটেই!

নারকেল নাড়ুর সিক্রেট টিপস

নারকেল নাড়ুর রেসিপি নতুন করে কী বলি আর, বাংলার ঘরে ঘরে সব্বাই পারে।  বরং মায়ের সিক্রেট টিপস বলি,
*নারকেল কোরার সময় খেয়াল করবে যাতে শেষের ব্রাউন অংশটা পর্যন্ত না আসে, (ওটা পরে তরকারিতে দেবে), তাহলে সাদা ধবধবে নাড়ু হবে।
* নারকেল কোরা মিক্সারে বেটে নিয়ে নাড়ু বানালে মুখে মসৃণ আর মোলায়েম লাগে।
* নারকেলের সঙ্গে একটু খোয়াক্ষীর মিশিয়ে নিতে হবে উনুনে পাক দেবার সময়, নাহলে গুঁড়ো দুধও চলবে। ওই ধরো, এক কাপ নারকেলে আধ কাপ চিনি, আর দু তিন চামচ খোয়া গ্রেট করা।
*চিনি টা গুঁড়ো করে দিলে আরো ভালো।

কড়াইতে দিয়ে মিডিয়াম আঁচে নাড়তে নাড়তে বেশ চিটচিটে হলে নামিয়ে হাতে তেল দিয়ে নাড়ু পাকাও… এলাচ গুঁড়ো দিতে ভুলো না।

White Coconut Nadu
সাদা ধবধবে চাঁদপানা নারকেল নাড়ু

কুচো নিমকির টিপস (নোনতা)

ময়দা, নুন, সাদা তেল (ময়ান আর ভাজার জন্যে), জোয়ান, কালোজিরে, লেবুর রস

* ময়দায় অল্প জোয়ান আর কালোজিরে দিতে হবে। আর একটু লেবুর রসও।
*ময়ান এমন হবে যাতে শুকনো মুঠোয় চেপে ধরলে দলা পাকানো যায়।
*নুনের সঙ্গে খুব অল্প চিনি মেশালে টেস্ট বাড়ে।
* রুটির মতো বেলার সময় খুব পাতলা হবে না, খুব মোটাও নয়। তারপর সুন্দর করে বরফি আকারে কেটে নিতে হবে।
* নিমকি ভাজতে তেল গরম করে আঁচ কমিয়ে ভাজতে হবে ধৈর্য নিয়ে। আর ফার্স্ট লটটা অল্প দিয়ে ভাজো, যাতে বোঝা যায় তেল ঠিক গরম হল কিনা… পুড়লে অল্পের ওপর দিয়ে যাবে আর কি!

The Bijaya Feast
নাড়ু নিমকি দেদার মজা

মিষ্টি নিমকির জন্যে

*ময়দায় নুন মেশানো যাবে না। বাকি সব একই…
* গাঢ় চটচটে চিনির রস গরম গরম রাখতে হবে। এলাচ দারচিনি ফ্লেভারের জন্য, তাতে মিষ্টি দিয়ে নাড়িয়ে, তেল মাখানো থালায় ঢেলে ঠান্ডা করতে হবে… ব্যাস এই আর কি!

আর সঙ্গে অন্যরকম দুটো মিষ্টি, অতীব সহজেই করে ফেলা যায় যেগুলো…

পটল মিষ্টি

পটল
খোয়াক্ষীর
চিনি (রসের জন্যে)
চিনিগুঁড়ো
এলাচগুঁড়ো
গোলাপজল
কাজু কুচি
পেস্তা কুচি
মিছরি
সিলভার তবক (হলে ভালো, না হলেও চলে)

পটলের খোসা ভালো করে পিলার দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে, ছুরি দিয়ে আলতো করে চিরে বীজগুলো বের করে নিতে হবে সাবধানে, পটল যাতে দু’ভাগ না হয় বা ফেটেও না যায়। তারপর ফুটন্ত জলে ১০-১৫ মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে। ওদিকে চিনির একটু গাঢ় রস তৈরি করে তাতে সেদ্ধ পটলটা দিয়ে ফের ১০-১৫ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে। দিয়ে একপাশে ঠান্ডা করে রাখো।

Potol Mishti
পটল দিয়ে মিষ্টিমুখ

ওদিকে কড়ায় অল্প ঘিয়ে খোয়াক্ষীর, অল্প চিনিগুঁড়ো দিয়ে নেড়েচেড়ে নিতে হবে, সঙ্গে গোলাপ জল একটু। ব্যাস। পটলের ভিতরের পুর রেডি। পটলের মিষ্টি বীজ এফেক্ট দিতে পুরটায় একটু মিছরি মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর শর্টকাট করতে চাইলে সন্দেশ কিনেও দেওয়া যেতে পারে। তারপর সাবধানে পুর ভরে ওপরে কাজু পেস্তা আর সিলভার তবক দিয়ে সাজিয়ে খোয়া বা শুকনো নারকোল ছড়িয়ে পরিবেশন করা। ওহ, এই মিষ্টিতে এসেন্স টা খুব জরুরি। প্রতি কামড়ে যেন সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। তাই চিনির রসে এলাচগুঁড়ো, আর খোয়া পুরে গোলাপজল মাস্ট!

গুঁড়ো দুধের লাড্ডু

বয়েস যাই হোক না কেন,  গুঁড়ো দুধ চুরি করে খাও না এখনও, কে আছে বলো দেখি? হলফ করে বলতে পারি, এই লাড্ডু খেয়ে খুশি হবে না, এমন কেউ পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, গুঁড়ো দুধের লাড্ডু।

গুঁড়ো দুধ এককাপ
ঘি আধকাপ
চিনি ১/৪ কাপ গুঁড়ো করা
ওপরে দেওয়ার জন্যে পেস্তা কাজু কুচি

Milk Powder Laddu
গুঁড়ো দুধের লাড্ডু ছেলেবুড়ো সক্কলের মন ভোলাবে

কড়ায় ঘি দিয়ে অল্প গরম করে চিনিগুঁড়ো মিশিয়ে দাও সাবধানে, যাতে পুড়ে না যায়। লাল করতে হবে না, জাস্ট মিশিয়েই নামিয়ে নাও। আর বড়ো বাটিতে নেওয়া গুঁড়ো দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দাও ভালো করে অনেকক্ষন ধরে। তারপর ছোট ছোট অংশ নিয়ে চেপে চেপে গোল লাড্ডু পাকাও। এতে কী এসেন্স দেবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। ভ্যানিলা, বা গোলাপজল বা এলাচগুঁড়ো, যা খুশি। ওপরে ড্রাই ফ্রুট কুচি দিয়ে পরিবেশন করো। বারবার বানানোর আবদার আসবে প্রতি পার্বণেই!

বানিয়ে কেমন হয় দেখো তবে… মায়ের আঁচল আর ছেলেমেয়েদের পছন্দ মিলে মিশে এক হোক স্বাদে! পুরনো আর নতুন মিলেমিশে মিষ্টিমুখে সেজে উঠুক শুভ বিজয়া!

 

*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
*মূল ছবি: The Statesman

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *