এই তো, আগের বছর সেই শীতের দুপুরে, ছাদে বসে ফুলের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ, আবিষ্ট হয়ে আছি। পিঠে নরম রোদ্দুরের সেঁক দিতে দিতে মনে হল, এমন দুপুর গড়িয়ে বিকেলবেলায় হাতে এক কাপ ফেনাওয়ালা কফি আর গরম গরম কেক হলে মন্দ হত না…! স্পাইস কেক? বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু পরদিন আবার মনে হল, এর সঙ্গে, এই ফুল ভর্তি বাগানের সঙ্গে ম্যাচ করে আর একটা কিছু রঙিন করি? সূর্যমুখী কেক! হলুদ রঙের…

নিশ্চিন্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেলবেলায়, পশ্চিমদিকে হেলে যাওয়া সূর্যের আলোর আলতো ছোঁয়ায়, কফি আর স্পাইস কেক এক টুকরো আর পাশে ঝলমলে সূর্যমুখী কেক তখন হাসছে…!

কিন্তু, মনের এই এক দোষ! যখন তখন তা কোন দূরে চলে যায়…। ভেসে ভেসে চলে গেলাম বহু বছর আগে। মা সেই দুর্গাপুরের বাড়িতে, কাঠ কাটছে, কয়লা ভাঙছে, উনুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে শেষ আঁচে কত কাণ্ড করে বাটিতে কেক বানাচ্ছে। আমার জীবনে প্রথম কেক!

The Sunflower cake
শীতের রোদে সূর্যমুখী কেক

তারপর দৃশ্য বদল। মন গেল কোনও এক ভিন দেশে, আবছা আবছা চোখে ভাসতে থাকল, ইট দিয়ে তৈরি ওভেনে কাঠের আগুন জ্বলছে, বাইরে বরফ পড়ছে, ঘরের ভিতরে হালকা হলুদ আলো, একটা ক্রিসমাস ট্রি এক পাশে সাজানো। আগুনের চারপাশে বাড়ির সবাই বসে হাত সেঁকছে আর ছাই রঙের অ্যাপ্রন পরা, মাথায় স্কার্ফ বাঁধা হাসিমুখ মহিলাটি  টেবিল থেকে কিছু একটা তুলে ঢুকিয়ে দিয়ে এলেন ওভেনে!

সে তিন-চারশো বছর আগের কথা… তৈরি হচ্ছে প্রথম কেক! ঠিক কবে প্রথম বেক করা হয় কেক? কী ছিল তার রেসিপি?

লিনজার টর্ট! হেজ়েলনাট, বা আমন্ডগুঁড়ো, ময়দা, অনেক মশলা দিয়ে তৈরি পৃথিবীর প্রথম কেক। কেউ বলে ১৬৯৬ সালের এই রেসিপি ভিয়েনাতে প্রথম পাওয়া যায়। কেউ বলে তারও আগে, এটা নাকি ভেরোনিজ় রেসিপি, সেই ১৬৫৩ সাল থেকে চলে আসছে। কেউ বলে অস্ট্রিয়ার লিনজ় প্রদেশের রেসিপি বলে এই নাম। আবার কেউ বলে লিনজ়ার নামে এক কনফেকশনারের নাম অনুসারে এর নাম…।

The ancient Oven
প্রাচীনকালের কেক ওভেন

যাই হোক না কেন, প্রায় চারশো বছরের পুরনো পাতার ধুলো ঝেড়ে বের করা বিশ্বের প্রথম কেকের রেসিপি চশমা এঁটে পড়ে ফেলি? আর কোমর কষে বানিয়েই ফেলি ঝট করে?

যা যা লাগবে…

ওই সেই চারশো বছর আগের পুঁথিতে লেখাটা… না না, সে কষ্ট থাক। আমিই বরং বলে দিচ্ছি…

দেড় কাপ ময়দা
দেড় কাপ আমন্ড ফ্লাওয়ার
২/৩ কাপ চিনি
এক চা চামচ দারচিনিগুঁড়ো
১/৪ চা চামচ লবঙ্গগুঁড়ো
আধ চা চামচ বেকিং পাউডার
দুটো ডিমের কুসুম
একটা লেবুর খোসা গ্রেট করা
দেড় কাপ মাখন
রাস্পবেরি জ্যাম এক কাপ
আইসিং সুগার ওপরে ছড়ানোর জন্য
আমন্ড স্লাইস সাজানোর জন্যে

The old recipe book
ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া রেসিপি খাতার পাতা থেকে বেরল প্রণালী

সব শুকনো উপকরণগুলো একসঙ্গে ভালো করে মসৃণভাবে মিশিয়ে নেওয়া যাক। ওই ময়দা, আমন্ড পাউডার, লেমন জ়েস্ট, চিনি, লবঙ্গ দারচিনিগুঁড়ো, বেকিং পাউডার এক চিমটে নুনও…।

তারপর তাতে মাখন ও ডিমের কুসুম মিশিয়ে দিতে হবে, যতক্ষণ না সেটা শক্ত হচ্ছে বেলার মতো। রেডি হলে একটা বড় আর একটা ছোট ভাগ করে একটা পাতলা পলিথিন জড়িয়ে ফ্রিজে রাখো, ঘণ্টাখানেক বা দুয়েক। তারপর স্প্রিংফর্ম প্যান  বের করে মাখন মাখিয়ে রাখো। ওদিকে ওই ডো-টা বের করে, একদম গোল করে ১/৪ ইঞ্চি পুরু করে বেলে প্যানের মাপমতো গোল করে কেটে নাও। তারপর সেটা প্যানের ভিতরে বসিয়ে ধারগুলো চেপে চেপে প্রায় এক ইঞ্চি তুলে দাও।

Linzer Torte in the Springform
স্প্রিংফর্ম প্যানে লিনজ়ার টর্ট

একটা বড় বাটির মত আকার হবে। সেটার ভেতরে রাস্পবেরি জ্যামের একটা পাতলা স্তর তৈরি করে দাও। তারপর ওই ডো-এর ছোট অংশটা গোল আর পাতলা করে বেলে, সরু সরু স্ট্রিপ কেটে নাও। রাস্পবেরি জ্যামের ওপরে স্ট্রিপ দিয়ে নানান ল্যাটিস ডিজাইন করতে হবে। এমন করে করবে যাতে স্ট্রিপ এর ফাঁক দিয়ে জ্যাম দেখা যায়!

ওহ! এর মধ্যে ওভেন ১৮০ডিগ্রি সেলশিয়াসে গরম করা আছে তো? ব্যাস। তাহলে ওই স্ট্রিপগুলোর ওপরে একটু ডিমের কুসুমগোলা ব্রাশ দিয়ে বুলিয়ে ইচ্ছেমতো আমন্ড দিয়ে সাজিয়ে বেক করতে দাও। ওই ধরো ৪৫ মিনিট মতো। তারপর গরমাগরম বের করে আইসিং সুগার দিয়ে ডিজাইন করে ঠান্ডা বা গরম সব্বাইকে খাওয়াও।

Eating Linzer Torte
কেটে কেটে খাওয়া চলছে লিনজ়ার টর্ট

কিন্তু…

ওহ বাবা, আমি ভাবলাম আমি একাই এসব ভাবছিলাম! পৃথিবীর প্রথম কেক… হ্যানো ত্যানো। তারপর দেখি অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি পেরিয়ে আমেরিকাতেও জনপ্রিয় লিনজার টর্ট বা লিনজার কুকিজ়ও! চারশো বছর আগের, সেই কবেকার গল্প.. আজও সুগন্ধিত, সুসজ্জিত!

 

*রেসিপি খাতা এবং ওভেনের ছবি – ইন্টারনেট
* বাকি ছবি ও রান্না সৌজন্য – লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *