নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল কলেজ দুটোই ছিল আবাসিক। ক্লাস এইটে যখন স্কুলে ভর্তি হই, আমাদের স্কুলের আর হস্টেলের মাসের খরচ সবমিলিয়ে ছিল ৭৫ টাকা। আর একটা ক্যাডবেরি চকোলেটের দাম ছিল ৭৫ পয়সা।

তাই ওই ৭৫ টাকার দাম তখন নেহাত কম ছিল না! তার মধ্যেই ধরা থাকত স্কুলের মাইনে, হস্টেলের ফিজ়, মানে পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া সব। তা ছাড়াও এটা-সেটা দরকারি খরচার জন্য মাসে মাসে হাতখরচ জুটত কুড়ি কি পঁচিশ টাকা। তবে ৭৫ পয়সার দামও তখন কম না। তাই হাতখরচের টাকায় আমার প্রিয় ক্যাডবেরি চকোলেট কেনার ইচ্ছে অধরাই থেকে যেত।

তখন রোববার রোববার মা দেখা করতে যেতেন, আর বাবার শুক্রবার ছুটি থাকত বলে, সে দিন যেতেন। মায়ের সঙ্গে কোনও কোনও দিন বোনেরাও যেত। সপ্তাহে একটা দিন মাত্র দেখা, তাই রোববারটা ছিল স্পেশাল। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে তৈরি হয়ে স্কুলের সামনে আমবাগানে গিয়ে বসে থাকতাম, কখন মা আসবে। আমবাগানই ছিল ছাত্রদের সঙ্গে বাড়ির লোকেদের দেখা করার জায়গা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষার আরও একটা কারণ ছিল। মা একটা ক্যাডবেরি নিয়ে আসতেন। বেগুনি চকচকে কাগজে মোড়া সাড়েচার বাই আড়াই ইঞ্চির ওই চকোলেটটা দেখলেই আমার চোখ চকচক করে উঠত। অল্প অল্প করে খেতাম, তাও পরদিনই ফুরিয়ে যেত। আবার অপেক্ষা পরের রবিবারের জন্য।

ছোটবেলা থেকে একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে এগিয়ে যাই কুড়ি কুড়ি বছরের পার। কলকাতা থেকে কয়েক বছরের জন্য প্রথম প্রবাস কোলনে গিয়ে হাজার হাজার লোভনীয় জিনিসের মধ্যেও যে জিনিসটা দেখে ঠিক ছোটবেলার মতো চোখদুটো চকচক করে উঠেছিল, সেটা চকোলেট। আমাদের বাঙাল ভাষায় যাকে বলে ‘হাভাইত্যার মতো’… চকোলেটের ওপর হামলে পড়েছিলাম।

Belgian Chocolates
বেলজিয়ান চকোলেটের সম্ভার

জার্মানিতে অবশ্য ক্যাডবেরি ছিল না। কিন্তু জার্মান, সুইস, বেলজিয়ান বড় বড় মিল্ক চকোলেটের বার ছিল! ছোটবেলায় ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পের মতো ভাবতাম, বড় হলে যখন অনেক টাকা হবে, যত খুশি চকোলেট খাব। সেই ইচ্ছাই পূর্ণ হল! আমার দিন শুরু হত চকোলেট দিয়ে। ব্রেকফাস্টে চকোলেট, তারপর চকোলেট দিয়ে লাঞ্চ, আবার চকোলেটেই ডিনার!! সহকর্মীদের হাসাহাসি ‘ডোন্ট কেয়ার’ করে দিব্যি চলছিল। কিন্তু মুশকিল হল, কয়েকদিনের মধ্যেই চকোলেট দেখলেই গা গুলোতে শুরু করল। বেশ কিছুদিন চকোলেট খাওয়া একদম বন্ধ রাখায় আবার তার প্রতি ভালবাসা ফিরে এল। বলে না, বিরহ প্রেমকে ঘন করে!

বিদেশে আশ মিটিয়ে চকোলেট খেয়ে যখন আবার দেশে ফিরলাম, তখন আমাদের আদি অকৃত্রিম ক্যাডবেরি তো ছিলই, তার সঙ্গে বাজারে জুটেছে নেসলে আর একেবারে দেশি কোম্পানি, আমূল। খেতে ভাল, দামে কম, আমূল বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখলাম, আমূল চকোলেটকে লোকে বলত ‘আমূলের ক্যাডবেরি’। আসলে ভারতে প্রথম সত্যিকারের চকোলেট বাজারে ছেড়েছিল ক্যাডবেরি কোম্পানি। তার আগে অনেক লোক টফিকেই চকোলেট বলে জানত। ফলে ক্যাডবেরি আসার পর থেকে ওটা এমনই একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করতে পেরেছিল যে, চকোলেট আর ক্যাডবেরি সমার্থক হয়ে দাঁড়াল। খুব মজা লাগত।

তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকায়, রিপোর্টিং দফতরে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনকে ‘ইউনেস্কো’ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দিল। আর পরের বছরেই তার বর্ষপূর্তি উদযাপন করতে বিলেত থেকে হইহই করে চলে এলেন টয়ট্রেনের ‘বন্ধুরা’। ইংরেজদের কাছে দার্জিলিং ছিল পাহাড়ের রানি। সেই দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন তাঁদের নয়নের মণি তো হবেই। ফলে তাঁরা টয় ট্রেনের এমন সম্মানে উত্তেজিত এবং উৎসাহিত হয়ে বিলেতে বসেই তৈরি করে ফেললেন ‘ফ্রেন্ডস অফ দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে’। টয় ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চাঁদা তুলে তাঁরা কিছু টাকাও দেবেন ঠিক করলেন। প্রথমে তাঁরা এলেন কলকাতায়, এখান থেকে যাবেন দার্জিলিং।

হচ্ছে চকোলেটের কথা, তার মধ্যে হঠাৎ আস্ত একটা টয় ট্রেন ঢুকে পড়ল কী করে? কারণ ‘এফডিএইচআর’-এর টিম লিডারের নাম ছিল অ্যাড্রিয়ান ক্যাডবেরি। শুধু ইংল্যান্ডের নয়, আন্তর্জাতিক ক্যাডবেরি কোম্পানির সর্বময় কর্তা। কর্মচারীদের জন্য তিনি এমন সব ভাল ভাল কাজ করেছেন যে, কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গিয়েছে। রানি তাঁকে নাইটহুড দিয়েছেন। এহেন স্যার জর্জ অ্যাড্রিয়ান হেহার্স্ট ক্যাডবেরি সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনওদিন সামনাসামনি দেখা আর আলাপ হবে ভাবতেও পারিনি। সেটা সম্ভব হল আমাদের বন্ধু পূর্ব রেলের জনসংযোগ কর্মকর্তা সমীর গোস্বামীর দৌলতে।

Sir Adrian Cadbury
স্যার অ্যাড্রিয়ান ক্যাডবেরি

আনন্দবাজার থেকে আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ‘ফ্রেন্ডস অফ দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে’-র সফর নিয়ে খবর করার। সমীর গোস্বামী আমাকে একেবারে ওই দলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিলেন। পার্ক স্টিটের ফ্লুরিজ়ে ব্রেকফাস্ট দিয়ে শুরু। তারপর গঙ্গাবক্ষে লঞ্চে ভ্রমণ ও লাঞ্চ। পুরো সময়টাই ওঁদের সঙ্গে। ফ্লুরিজ়ে হবি তো হ, খোদ স্যার অ্যাড্রিয়ানের টেবিলেই আমার জায়গা হল। দেখলাম অসম্ভব মিষ্টি হাসিমুখের একজন বয়স্ক মানুষ। তখন ওঁর বয়স সত্তর, নির্মেদ চেহারা। শুনেছিলাম, ছাত্র জীবনে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির রোয়িং চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এটা সেটা কুশল বিনিময়ের পর ব্রেকফাস্ট শেষে আমরা উঠলাম গিয়ে গঙ্গার ঘাটে অপেক্ষমান লঞ্চে।

কলকাতা থেকে কয়েক বছরের জন্য প্রথম প্রবাস কোলনে গিয়ে হাজার হাজার লোভনীয় জিনিসের মধ্যেও যে জিনিসটা দেখে ঠিক ছোটবেলার মতো চোখদুটো চকচক করে উঠেছিল, সেটা চকোলেট। আমাদের বাঙাল ভাষায় যাকে বলে ‘হাভাইত্যার মতো’… চকোলেটের ওপর হামলে পড়েছিলাম।

অনেকক্ষণ ধরে যাত্রা। আলাপ তো হয়েই গিয়েছে। স্যার অ্যাড্রিয়ানকে বললাম আমার চকোলেট প্রীতির কথা, স্কুলে মায়ের কাছ থেকে ক্যাডবেরি পাওয়ার আনন্দ, পরে জার্মানিতে চকোলেট দিয়ে খিদে মেটানো, আর দেশে ফিরে ‘আমূলের ক্যাডবেরি’র সঙ্গে পরিচয়। শুনে ওঁর চোখ গোল গোল। হো হো করে হেসে উঠে বললেন–
“এটা দুর্দান্ত! আমি দেশে গিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করব, ভারতের নিজস্ব চকলেটের নামের সঙ্গেও ক্যাডবেরি লাগিয়ে দেওয়ার কথা।”
আমি বললাম,
“আচ্ছা, আপনার এই মিষ্টি হাসি, এটা কি খুব ক্যাডবেরি খান বলে?” উনি আবার হাসলেন।
উনি বললেন,
“থ্যাঙ্ক ইউ! এটা তো আমাকে গল্প করতেই হবে দেশে ফিরে। বিজ্ঞাপনে এই লাইনটা ব্যবহার করলেও মন্দ হয় না- “ক্যাডবেরি চকলেট খেলে হাসি মিষ্টি হবে”…।

আমি বললাম,
“জানেন তো! আমাদের দেশে কিন্তু সদ্যোজাত বাচ্চাকে দিদিমা ঠাকুমারা মুখে মধু দেয় কথাবার্তা মিষ্টি হবে বলে। তা হলে মধুর বদলে চকোলেটই বা নয় কেন?” 
স্যার অ্যাড্রিয়ান শুনে বেশ মজা পেলেন। বললেন,
“ঠিকই তো! এখনও ক্যাডবেরির ডেয়ারি মিল্ক চকোলেটই সবচেয়ে জনপ্রিয় আর সবচেয়ে বেশি বিক্রি। আমার পূর্বপুরুষ দুধের মধ্যে চিনি, কোকো আর চকোলেট মিশিয়েই প্রথম চকোলেট তৈরি করেছিলেন! নিজের নামে তার নাম দিয়েছিলেন ক্যাডবেরি। সেই শুরু।”
আমি বললাম, “তার পরে তো অনেক কিছু হয়েছে!”
উনি বললেন,
“হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদা ক্যাডবেরি কারখানার কর্মচারীদের ভালভাবে থাকার জন্য একটা আস্ত গ্রাম তৈরি করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন বোর্নভিল! খেলার মাঠ থেকে শুরু করে স্কুল, ক্লাব, সব কিছু আছে সেখানে। পরে তারই নামে ক্যাডবেরি ডার্ক চকলেটের নাম দেওয়া হয় ‘বোর্নভিল।”

The Bournville
বোর্নভিল গ্রামে ক্যাডবেরি কর্মীদের বাড়িঘর

নানা রকম গল্প করতে করতে যাত্রা শেষ হয়ে এসেছে। বললাম,
“স্যার অ্যাড্রিয়ান, আমার ছেলেমেয়ের জন্য একটু শুভেচ্ছা লিখে দেবেন?” সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে কলম আর নিজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে জিজ্ঞেস করলেন, “ওদের নাম কী?”
বললাম, “ছেলের নাম টিনটিন, মেয়ের নাম তিন্নি।”
“টিনটিন! সেই ইয়ং বেলজিয়ান রিপোর্টার?”
 “হ্যাঁ। তবে এখানে বাবা রিপোর্টার, ছেলে পরে কী হবে জানি না।”

Cadbury Visitning Card
ক্যাডবেরি সাহেবের ভিজিটিং কার্ডে শুভেচ্ছাবার্তা

হাসিমুখে কার্ডের পেছনে কয়েক লাইন লিখে দিলেন-

টু টিনটিন অ্যান্ড তিন্নি
উইথ বেস্ট উইশেস
অ্যাড্রিয়ান ক্যাডবেরি
ক্যালকাটা,
১৫ নভেম্বর, ২০০০

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক

Dipankar Chakraborty

দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।

7 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *