১৯০৯ সাল। সেপ্টেম্বর মাসের কথা। এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে ‘গান’–এর দ্বিতীয় সংস্করণ এবং রবীন্দ্র-কবিতার নির্বাচিত সংকলন ‘চয়নিকা’ প্রকাশের আয়োজন নিয়ে তোড়জোড় চলছিল। এই সময় আটচল্লিশ বছরের কবি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এসে হঠাৎই ডেকে পাঠালেন সাতাশ বছরের এক যুবককে। যুবক কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন দুরুদুরু বুকে। শোনা যাক সেই স্মৃতিকথা যুবকের বয়ানে…
‘সসংকোচে গেলুম আমি দেখা করতে। কবি বললেন, “তোমার ‘তারা’ মূর্তি আমি দেখেছি। বেশ হয়েছে। তা, তোমাকে এখন আমার কবিতার বই ইলাস্ট্রেট করতে হবে।”…. কবিকে আমি বললুম– আমি আপনার বই পড়িনি বললেই হয়। পড়লেও মানে কিছু বুঝিনি।’
কবি যুবকের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, “তাতে কী, তুমি পারবে ঠিক। এই আমি পড়ছি, শোন।” বলে তিনি তাঁর চয়নিকার কবিতাগুলো এক এক করে পড়তে শুরু করলেন। যুবক লিখছেন, ‘তাঁর পড়বার ভঙ্গিতেই আমার মনে যেন নানা ছবি বসতে লাগলো। তারপরে ছবি এঁকেছি।’ এরপর সেই যুবকের আঁকা সাতটি ছবি ‘চয়নিকা’য় মুদ্রিত হয়েছিল।

কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ করে কবি এই যুবককে কোথায় আবিষ্কার করলেন এবং কেনই বা ডেকে পাঠিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে? এই যুবক তখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে চিত্রকলা শিখছেন। ইতিমধ্যেই অবনীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে থেকে ‘সতী’, ‘সতীর দেহত্যাগ’, ‘কর্ণের সূর্যপূজা’, ‘কৈকেয়ী’, ‘কর্ণ’ এই সমস্ত ছবি এঁকে নাম করেছেন। থাকেন উত্তর কলকাতায়, হাতিবাগানে। নানা অনুরোধের ছবিও আঁকেন তখন। এমনই এক অনুরোধ এল বাঁকুড়ার এক সাধকের কাছ থেকে। তারা দেবীর মূর্তি আঁকার জন্য। সেই মূর্তি আঁকার পর রবীন্দ্রনাথ জানতে পারেন, চিত্রশিল্পী কে। সেই কথা জেনেই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এই সেই শিল্পী যাঁর আঁকা ‘চয়নিকা’য় ছাপার পর বই দেখে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘চয়নিকা পেয়েছি। ছাপা ভাল, কাগজ ভাল, বাঁধাই ভাল। কবিতা ভাল কিনা তা জন্মান্তরে যখন সমালোচক হয়ে প্রকাশ পাব তখন জানাব। কিন্তু ছবি ভাল হয়নি সে কথা স্বীকার করতেই হবে। এই ছবিগুলোর জন্যই আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছিলুম কারণ এগুলি আমার রচনা নয়।’ এরপর সরাসরি চিত্রকরের নাম উল্লেখ করে জানালেন, ‘নন্দলালের পটে যেরকম দেখেছিলুম বইতে তার অনুরূপ রস পেলুম না। বরঞ্চ একটু খারাপই লাগল।’

হ্যাঁ, সেদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই, ‘চয়নিকা’র চিত্রকর ছিলেন নন্দলাল বসু। প্রথমদিন আলাপের পরেই রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম দেখতে যাবার যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই শুরু। এরপর রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের যুগলবন্দির ইতিহাস গড়ার পালা। সেই প্রথম সাক্ষাতের পরপরই ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের আঁকা একটি জলরঙের ছবি দেখেন। মন্দিরের মধ্যে গুরুর কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত হচ্ছেন এক শিষ্য- এই ছিল ছবির বিষয়। সে ছবিটি দেখে রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা লিখলেন, যা পরে ‘গীতাঞ্জলি’র অন্তর্ভুক্ত হয়।
‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা,
ভক্ত সেথায় খোলো দ্বার আজ লব তাঁর দেখা।’
পরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩১৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় নন্দলাল বসুর ছবিটির সঙ্গে কবিতাটি প্রকাশিত হয় এবং তৎপরে গীতবিতানেও স্থান পায়।
তখন থেকেই কবির সাহচর্য পেতে শুরু করেন তরুণ নন্দলাল। অবশেষে ১৯১৪ সালের ২৪ এপ্রিল কবির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে তাঁর দূত অসিতকুমার হালদারের সঙ্গে নন্দলাল বোলপুরে যান। পরদিন, অর্থাৎ পঁচিশ এপ্রিল সকালবেলায় নন্দলাল বসুর সম্বর্ধনা আয়োজন হল শান্তিনিকেতনে। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, অসিতকুমার হালদার, পিয়ারসন অ্যান্ড্রুজ, ভীমরাও শাস্ত্রী প্রমুখ আরো অনেকে।
রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে শাঁখ বাজানো হল, মালা পরানো হল নন্দলালের গলায়। রবীন্দ্রনাথ কবিতা পাঠ করলেন যা কিনা নন্দলালের উদ্দেশ্যে লেখা,
‘শ্রীমান নন্দলাল বসু পরমকল্যাণীয়েষু
তোমার তুলিকা রঞ্জিত করে
ভারত-ভারতী চিত্ত।
বঙ্গলক্ষী ভাণ্ডারে সে যে
জোগায় নতুন বিত্ত।
ভাগ্যবিধাতা আশিস মন্ত্র
দিয়েছে তোমার কর্ণে–
বিশ্বের পটে স্বদেশের নাম
লেখ অক্ষয় বর্ণে।
তোমার তুলিকা কবির হৃদয়
নন্দিত করে, নন্দ।
তাইত তোমার লেখনী তোমায়
পরায় আপনি ছন্দ।
চিরসুন্দরে কর গো তোমার
রেখাবন্ধনে বন্দী।
শিবজটাসম হোক তব তুলি
চিররস-নিষ্যন্দী!’
সে দিনের এই সম্বর্ধনায় নন্দলাল ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিলাইদহে যাত্রা করেন ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেখানে গিয়ে রবীন্দ্র-সান্নিধ্য এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে নন্দলালের শিল্পীমনের নবজন্ম হল। নিজেই এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের হাতে-কলমে নেচার-স্টাডির সেই হাতে খড়ি। আগে ছবি আঁকতুম শাস্ত্রপুরাণ পড়ে। … এখানে গুরুমশাই হলেন পদ্মার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর তার ব্যাখ্যাতা স্বয়ং বিশ্বকবি।’ কবির সঙ্গে হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব, কবিতা-গানে মেতেছিলেন সেই দিন পনেরো শিলাইদহবাসের কালে।

বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রতিষ্ঠার পরই রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে কলাভবনে এসে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। ১৯১৯ সালে নন্দলাল চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। যদিও মাঝে বেশ টানাপোড়েন হয় তাঁর আসা নিয়ে। ফিরে গিয়েছিলেন কলকাতায়। গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কলকাতায় থাকুন তাঁদের প্রিয়তম শিষ্যটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই টানাহেঁচড়ায় জিত হল রবীন্দ্রনাথের। নন্দলাল পাকাপাকিভাবে কবির কাছে চলে এলেন ১৯২০ সালে। ১৯২৩ থেকে ১৯৫১, দীর্ঘ আঠাশ বছর নাগাড়ে কলাভবনের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এরমধ্যে আঠেরো বছর পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের মতো অভিভাবককে।
এরপর কবি ও শিল্পীর যুগলবন্দিতে বহু কবিতা বন্দিত হয়েছে শিল্পীর তুলির টানে। ‘বিচিত্রিতা’ গ্রন্থে এমন একটি কবিতা ‘স্যাকরা’ ছাপা হয়েছিল। এই কবিতার কথা ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’-তে ১৯২৭ সালের ২৮ জুলাই রচিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘সেদিন যখন শিলঙে ছিলেম, নন্দলাল কার্সিয়ঙ থেকে পোস্টকার্ডে একটি ছবি পাঠিয়েছিলেন। স্যাকরা চারদিকে ছেলেমেয়েদের দিয়ে চোখে চশমা এঁটে গয়না গড়ছে। ছবির মধ্যে এই কথাটি পরিস্ফুট যে, এই স্যাকরার কাজের বাইরের দিকে আছে তার দর, ভিতরের দিকে আছে তার কদর।…’

সেদিন নন্দলালের আঁকা স্যাকরার ছবি দেখে কবি লিখেছেন যে কবিতাটি,
‘কার লাগি এই গয়না গড়াও
যতনভরে।
স্যাকরা বলে, একা আমার
প্রিয়ার তরে।
শুধাই তারে, প্রিয়া তোমার
কোথায় আছে।
স্যাকরা বলে, মনের ভিতর
বুকের কাছে।….’
ওই ‘বিচিত্রিতা’ বইতেই আরও দুটি কবিতা কবি লিখলেন এবং নন্দলাল ছবি আঁকলেন। সে দুটির নাম ‘পসারিনী’ ও ‘কন্যা বিদায়’। এমনই আরও একটি কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে নন্দলালের ছবি দেখে রবীন্দ্রনাথ হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। এক সাঁওতাল প্রেমিকযুগলের ছবি এঁকে কবির ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন নন্দলাল। কবি তখন সে ঘরেই টেবিল চেয়ারে বসে লিখছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পরে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে বলেছিলেন,
‘আমি একদিন আমার লিখবার টেবিলে বসে লিখছি। হঠাৎ নন্দলাল ঘরে ঢুকে আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে সামনের দেওয়াল জুড়ে ছবিখানা এঁটে দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।…. চেয়ে চেয়ে ছবিখানা দেখলুম আর তখনই কবিতাটা তৈরি হয়ে গেল।’

সেদিনের কবিতাটির নাম ছিল ‘প্রত্যাগত।’ আসলে নন্দলাল বসুর কন্যার সেই সময় বিয়ে ছিল, ফলে কন্যাকে গৌরীদান করে বিদায় দেবার দুঃখ তাঁকে ব্যথিত করত। সেই বিচ্ছেদবেদনা রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন এবং লিখেছিলেন এমন,
‘হে বন্ধু, কোরো না লজ্জা, মোর মনে নাই ক্ষোভ লেশ,
নাই অভিমানতাপ। করিব না ভর্ৎসনা তোমায়;
গভীর বিচ্ছেদ আজি ভরিয়াছি অসীম ক্ষমায়।…’
এই যুগলবন্দির যেন বিরাম ছিল না। ১৯২৯ সালে ছোটদের ভাষাশিক্ষার জন্য কবির লেখা ‘সহজ পাঠ’ – এর সঙ্গে নন্দলালের আঁকা ছবি বাংলা সাহিত্যে এক ঐতিহাসিক দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছিল। আজও তার আবেদন অমলিন, অটুট। আর সম্ভবত এভাবেই বাংলা সাহিত্যে চিত্রসহ কবিতার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Twitter, Blindhammer, The Print
*গ্রন্থঋণ:
রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড – প্রশান্তকুমার পাল
দৃষ্টি ও সৃষ্টি – নন্দলাল বসু
ভারত শিল্পী নন্দলাল – ১ম-৪র্থ খণ্ড – পঞ্চানন মণ্ডল
রবীন্দ্রনাথ ও বিভিন্ন ভারতীয় ব্যক্তিত্ব – কোরক, সম্পাদনা তাপস ভৌমিক
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।