ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আকাশপথে আমাদের পুষ্পক বিমান এগিয়ে চলেছে। ভারত মহাসাগর পার করে রাবণের দেশের মানচিত্রে প্রবেশ। পুরাণের লঙ্কা, ইতিহাসের সিংহল, জীবনানন্দের দারুচিনি দ্বীপ… যে নামেই ডাকি না কেন, পাখির চোখে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধতা। কেউ যেন এক গামলা জলে নীল কালির দোয়াত উপুড় করে দিয়েছে আর তাতে ভেসে আছে একখণ্ড শ্যাওলা, শ্রীলঙ্কা। 

‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়’- ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার যোগাযোগ বহু প্রাচীন। একসময় দাক্ষিণাত্যের অংশবিশেষ এই দ্বীপটিতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বাংলার বিজয়সিংহের পদার্পণ ও বিজয় বাঙালির কাছে রীতিমতো গর্বের বিষয়। সিংহ থেকে সিংহল নামকরণ, এমনই মনে করা হয়। আবার খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র আর কন্যা সঙ্ঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এসব ছাড়াও মহাকাব্যে লঙ্কার উপস্থিতি তো ভারতীয় মননে গেঁথেই আছে। এদেশের মানুষজন, খাওয়াদাওয়া, সংগীতনৃত্য, এমনকি বাড়িঘরের সঙ্গেও দক্ষিণভারতের প্রচুর মিল।

শ্রীলঙ্কার অমুক-শহর, তমুক-গ্রাম দেখতে দেখতে সুদূর দক্ষিণপ্রান্তে মাতারা জেলার বন্দরশহর মিরিশ্যায় পৌঁছেছি। মূলত নীল তিমি দর্শনের জন্যই রাত্রিবাস। অভিজাত হোটেলের চড়া দামের হাড়িকাঠে গলা দেওয়ার ইচ্ছে নেই। দু’দিন ধরে তাই গুগল ঘেঁটে শেষ পর্যন্ত ‘বাজেটে ফিট’ একটা ছোট বাড়ি পাওয়া গেছে।

মিরিশ্যা যখন পৌঁছলাম, সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। স্বাগত জানাতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মাধুশঙ্খা। হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো, গালদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। মাথায় বটের ঝুরির মতো রুক্ষ চুলে দীর্ঘদিন তেল পড়েনি, নাকি ফ্যাশন- ঠিক বুঝলাম না। পরনে নোংরা বারমুডা আর তিলি ধরা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। দেশি কায়দায় করজোড়ে আলাপ পরিচয় মিটল। কাঁধে, পিঠে, গলায় চারটে লাগেজ ঝুলিয়ে ঘুপচি গলিটা দিয়ে সে হনহন করে হেঁটে চলল। বাকি ব্যাগপত্তর নিয়ে আমরা তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

turtle bay beach Srilanka
নীল জলরাশির শান্ত ঢেউ বোল্ডারগুলোর গায়ে আছড়ে পড়ছে

গলিপথ এসে মিলে গেল শেষে এক ফালি উঠোনে। কয়েক পা দূরত্বে নীল জলরাশির শান্ত ঢেউ বোল্ডারগুলোর গায়ে আছড়ে পড়ছে। নারকেল গাছগুলো নিজেদের শরীরটা বেঁকিয়ে যেন সাগরের চুম্বকটানে ঝুঁকে পড়েছে। এমন পরিবেশে সস্তার নিশিযাপনে আমরা সবাই যারপরনাই আহ্লাদিত।

বাড়িটা সাদামাটা। গাল ভরা নাম, ‘বিচ হাইড আউট’। খুব বেশিদিনের নয়, এখনও নতুনত্বের গন্ধ কাটেনি। থাকার মধ্যে সাত ফুট বাই সাত ফুট একটা খাট, আলনা, জলের বোতলে ঠাসা ছোটো একটা ফ্রিজ আর ঘরের কোণে একটা ছোট টেবিলে ইলেকট্রিক কেটলি, চা-কফি বানানোর কিছু উপকরণ। দোতলায় আর একটা ঘর, একইরকম ব্যবস্থা। রান্নাঘর একটা আছে বটে, কিন্তু তাতে সাজসরঞ্জাম কিছু নেই। রাতের খাবারের ব্যবস্থা বাইরেই কোথাও করতে হবে। একতলার ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দা। সাগরমুখী বড়সড় জানালাটার ফ্রেমে বন্দি হয়েছে নীল জলের শোভা। 

mirissa Srilanka
মায়াবি মিরিশ্যা

মাধুশঙ্খার ইংরেজিটা তেমন বোধগম্য হচ্ছে না। সিংহলীজ় আর ইংলিশ মিলিয়ে একটা সংকর প্রজাতির ভাষায় কথা বলে চলেছে, যার সবচেয়ে ভালো নামকরণ হতে পারে সিংলিশ। হাতড়ে হাতড়ে যেটুকু বুঝলাম, সে নিজের কোটায় ডিসকাউন্টে তিমি দর্শনের টিকিটের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভারতীয় টাকায় যার দাম ৪০০০ টাকা, কমসম করে সেটা ৩০০০-এর কিছু কমেই পাওয়া যাবে।

মাধুশঙ্খা এই বাড়ির মালিক হলেও, মিরিশ্যা হাবে এক বিলাসবহুল ক্রুজ়ের কর্মী। টিকিটের দাম বুঝে নিয়ে সে বলেছিল, “যে কোনও ক্রুজেই আমাদের কোটা থাকে। আমি যে ক্রুজে কাজ করি, সেখানে ডিসকাউন্ট দিয়েও টিকিটের দাম অনেক বেশি। তবে এই ক্রুজটাও বেশ ভালো।”

দিনের আলো তখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। মাধুশঙ্খার বাড়ি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। যাওয়ার আগে ব্যবস্থাপনা সব সেরে নিচ্ছে। রাতে আর তাকে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যাবেলা খাওয়ার জন্য ফিশফ্রাই, অর্থাৎ মশলা মাখানো পমফ্রেট ভাজা এনে দিল। রাতের খাবার কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইলে সে বলল, “মেন রোড ধরে ডানদিকে ২০০মিটার গেলেই একটা রেস্তোরাঁ আছে, ভালো সি-ফুড পাওয়া যায়।”

পরদিন সকালে তার ক্রুজের ডিউটি আছে। বেলা এগারোটার আগে আর দেখা হবে না। প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব বুঝিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিতে প্রস্তুত। যাওয়ার আগে সতর্কবার্তা দিয়ে গেল যে, রাতে ঘুমানোর সময় যেন জানালা খুলে রাখা না হয়। ভোররাত থেকেই জেলেদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। জানালায় গ্রিল নেই, তাই… একটু সাবধানে থাকা, এই আর কি। আকাশ খুঁজতে চলে এলাম সাগর কিনারে। বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে জনা কয়েক ট্যুরিস্ট কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে জলে। ঢেউয়ের দোলায় কচ্ছপের ভেসে বেড়ানো দেখতে ছোট্ট জটলা। অলিভ রিডলে। চাঁদনি রাতে এরা পাড়ে উঠে আসে, ডিম পাড়ে। তাই হয়তো এই সৈকতের নাম ‘টার্টল বে’।

turtle bay beach (1)
অলিভ রিডলে চাঁদনি রাতে পাড়ে উঠে আসে। তাই তটের নাম টার্টল বে

ডানদিকে সামান্য এগোলেই বোল্ডারের রাজত্ব শেষ। তারপরই জলে নিকোনো বেলাভূমি। সমস্ত চঞ্চলতা শান্তি পায় এই নীল নির্জনতায়। গোধূলিলগ্নে পাঁচমিশালি রং মেশে সাগরের জলে। আর তা গায়ে মাখবে বলেই সাগর বিলাসে মেতেছে ক’জন। তবে, ঊর্মিমালাকে না ছুঁয়ে দূর থেকেই আমার পিপাসা মিটেছে। অস্তরাগের শেষ আলোটুকু নিবিয়ে ঘরে ফিরলাম। অন্ধকারে আলো জ্বালাতেই সব রোম্যান্টিকতা নিমেষে উধাও। খাটের তলা থেকে ‘মিঁয়াও মিঁয়াও’ আওয়াজ করতে করতে বিড়াল বেরিয়ে এল। এরপরই জানালা দিয়ে গলে লাফিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল নেড়িকুত্তা। কপাল ভালো, পমফ্রেট ভাজাটা সাবাড় করতে পারেনি। 

এতো মহা জ্বালা হল। মাধুশঙ্খার সাবধানবাণীর আসল কারণটা এবার বোঝা গেল। তাদের ঘর থেকে বের করে ভর সন্ধ্যাবেলাতেই জানালা বন্ধ করে দিতে হল। প্রচণ্ড গরম। ঘর ঠান্ডা করার যন্তরটির তার কাটা। অর্থাৎ, এই বাজেটে মাথার ওপর ‘সাক্ষীগোপাল’ ফ্যান ছাড়া বেশি কিছু জুটবে না। ঘরে টেঁকা দায়। একটু বাতাসের খোঁজে সবাই মিলে বারান্দায় এসে বসলাম। 

মাথার ওপর একথালা জ্যোৎস্না, সাগরের বুকে তারই আলপনা। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ঢেউয়ের গায়ে সে আলো রুপোর কুচির মতো চিক্‌চিক্‌ করছে। নিস্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দিচ্ছে ঢেউ ভাঙার গান। হালকা হাওয়ায় নারকেল গাছের পাতাগুলো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নীরবে কথা বলে চলেছে। প্রকৃতি যেন আজ সব আবদারের আশ্রয়দাত্রী।

মন হারাবার নেশায় ভেসেছিলাম। যখন খেয়াল হল, ঘড়ির কাঁটা ন’টা পার করেছে। খেয়াল হল, এদেশে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র রাত আটটা নাগাদ দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। জমাটি আড্ডায় ফুলস্টপ দিয়ে তড়িঘড়ি ছুটলাম। মেনরোড ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি। বেশিরভাগ দোকানের শাটার বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি খাবারের দোকানগুলোও। বিকেলের সেই লোক গমগমে রাস্তাটা এখন ফাঁকা। মাধুশঙ্খার ‘দুশো মিটার দূরের’ সেই রেস্তোরাঁ কম-সে-কম এক কিলোমিটার তো হবেই। সেও এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করে ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত। এদিকে এত হাঁটাহাঁটির পর পরিপাকতন্ত্রের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সঙ্গে কিছু ম্যাগির প্যাকেট ছিল। টেবিলের ওপর রাখা চা বানানোর কেটলিতে ম্যাগি তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল। ভরপেট আহার না জুটলেও অভুক্ত থাকতে হল না। খাওয়ার পর কেটলিটা মেজে ধুয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে এমনভাবে রাখা হল যে, মাধুশঙ্খার টের পাওয়ার কোন উপায় নেই। 

মার্চের মাঝামাঝি। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। কুকুর বিড়ালের উৎপাতে দরজা-জানালা এঁটে প্রায় দমবন্ধ পরিস্থিতি। রাত বাড়ছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। এদিকে ভোর ছটার মধ্যে তৈরি থাকতে হবে। শেষমেশ নানাবিধ সমস্যাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্লান্ত শরীরে তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে। 

mirissa hub, srilanka
মিরিশ্যার জাহাজঘাটা

ভোরবেলায় চোখ কচলানো, আড়মোড়া ভাঙা সমুদ্রটাকে এক ঝলক দেখে এসেছি। তারপরই তৈরি হওয়ার ব্যস্ততা। ছটা নাগাদ দরজায় নক্‌। এক বয়স্ক ভদ্রলোক হাসিমুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, “টুক্‌টুক্‌ ইজ রেডি।” এটুকু বলেই চলে যাচ্ছিলেন। কী মনে হল, ঘাড় ঘুড়িয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্ডিয়ান?” মাথা নেড়ে হেসে সম্মতি জানালাম। এবার উনি ঝরঝরে হিন্দিতে বললেন, “ঠিক হ্যায়, আপলোগ আ যাইয়ে।” কৌতূহল হল। জানতে চাইলাম, উনিও ভারতীয় কিনা। উত্তরে তিনি জানালেন, সিংহলী হলেও কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলতে পারেন। বিদেশের মাটিতে বিদেশির মুখে স্বদেশের ভাষা শুনে মনটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল।

আমাদের দেশের অটো ওদেশে নাম বদলে হয়েছে টুকটুক। এ দেশের নানান জায়গায় লাল, নীল, হলুদ, সবুজ টুকটুক দেখেছি। তাতে চেপে মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার চলার পর পৌঁছলাম মিরিশ্যা হাবে। নীল তিমি দর্শনের টিকিটে টুকটুক আর ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাছ ধরার রঙিন ট্রলার আর কয়েকটা ক্রুজ। সাত-সকালের ব্যস্ত ছবি। জাম্বো সাইজের মাছগুলো ট্রলার থেকে নামিয়ে চালান করার জন্য বড় বড় ট্রাকে তোলা হচ্ছে। কোনওটার দৈর্ঘ্য ৭/৮ ফুট। ওজন কম করে ৩০/৩৫ কেজি তো বটেই। ৬/৭ জন লোক মিলে এক একটা মাছ নামানো-ওঠানো করতে একেবারে হিমশিম খাচ্ছে।

আমাদের ক্রুজটা টুকটুক স্ট্যান্ডের কাছেই। দোতলায় খুঁজে পেতে ভালো সিট দেখে বসে পড়লাম। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা এক ছাদের তলায় জড়ো হয়েছেন। ক্রুজবয় মুখের সামনে চা-কফির ট্রে ধরে ঝকঝকে সাদা দাঁতে মুক্তোর ঝলকানি তুলে বলল, “হাই, আই অ্যাম চামিণ্ডা।” এদেশের চা এককথায় ‘স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়’, তা সে ফুটপাতের গুমটিরই হোক বা অভিজাত রেস্তোরাঁর। তাকে ‘হাই’ জানিয়ে এক কাপ চা তুলে নিলাম।   

ঠিক সাতটায় ক্রুজ় ছাড়ল। ভারত মহাসাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছি। জাহাজ দুলছে, গা গোলাচ্ছে। অল্পবিস্তর মাথাও ঘুরছে। তবে সেটা খুব দীর্ঘস্থায়ী নয়। ধীরে ধীরে সয়ে গেল। মিরিশ্যা শহরটা ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। যেন বলছে, ‘গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও’। আবছা হতে হতে একটা সময় স্থলভাগটা অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিকে নীল সাম্রাজ্য। ফুরফুরে রোদ। দিক্‌চক্রবালের রেখাটা না থাকলে, আকাশ আর সমুদ্রকে বোধহয় আলাদা করা যেত না। আধঘণ্টা পর চামিণ্ডা ব্রেকফাস্টের প্যাকেট দিয়ে গেল। আলাপ-পরিচয় পর্ব চলছে। কোরিয়া, জাপান থেকে শুরু করে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা– নানান দেশের পর্যটক সম্মেলন। এখানে সবাই একটাই ভাষা বোঝে, ভ্রমণের ভাষা।  

blue whale
প্রথম দর্শনে নীল তিমি

সাগর এখন ময়ূরকন্ঠী। হঠাৎ ক্রুজ় থেমে গেল। আরও খান চারেক ক্রুজ়ও একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথমবার নীল তিমি দর্শন দিল। ফোয়ারার মতো জল ছড়িয়ে ধনুকের মতো শরীরটা বেঁকিয়ে ভেসে উঠল কয়েক পলকের জন্য। পরমুহুর্তেই সে লেজটাকে সোজা করে উপর দিকে তুলে ঝপাং করে ডুব দিল সাগরের অতলে। 

পরপর তিনবার এমন দৃশ্য দেখার পর ক্রুজ়ে সবাই হৈ হৈ করছে। সবার চোখেমুখে প্রাপ্তির উজ্জ্বলতা। আমার পাশে বসেছেন এক বৃটিশ দিদিমা। একটা জাপানি পাখা নিয়ে হাওয়া খাচ্ছেন। আমাকে দরদর করে ঘামতে দেখে মুখমণ্ডলে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে এক গাল হেসে হাতপাখাখানা দিয়ে আমাকে হাওয়া করতে শুরু করলেন। 

dolphin Srilanka Mirissa
ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন খেলা করছে

আবার শোরগোল, সেকেন্ড সাইটিং। ক্যামেরাবন্দি করব বলে সিট ছেড়ে উঠে রেলিংয়ের ধারে এগোতে গেছি, দুলুনির চোটে ছিটকে গিয়ে পড়লাম রাশিয়ান জেঠুর ঘাড়ে। কী বিড়ম্বনা! ততক্ষণে তিনি আমার সাধের ক্যামেরাটি দু’হাত দিয়ে আগলেছেন। আমার একটা হাত টেনে ধরেছেন অস্ট্রেলিয়ান মাসিমা। দাঁড়িয়ে পড়া সব যাত্রীদেরই টলমল অবস্থা। নাঃ! আর ছবি তোলার নয়। মনের ফ্রেমেই ‘নীল তিমি’ স্মৃতি হয়ে থাক।

চামিণ্ডা সবাইকে তিমি দর্শন করানোর ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। বিশেষ করে বয়স্ক ট্যুরিস্টদের হাত ধরে রেলিং-ধারে নিয়ে যাচ্ছেন আরও স্পষ্টভাবে দেখানোর জন্য। বারোবার নীল তিমির ঘাই, তার শারীরিক কসরত দেখার পর ক্রুজ় এগিয়ে চলল ডলফিনের রাজ্যে। ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন একই ছন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করছে। তৃষ্ণা মিটল। তৃপ্ত শেষ চুমুকের পর ফেরার পালা। চামিণ্ডা তরমুজ আর আনারসের টুকরো ট্রেতে সাজিয়ে সবাইকে পরিবেশন করছেন। ক্রুজ় এখন তার অভিমুখ বদলেছে। সূর্যও আগের অবস্থান থেকে খানিকটা সরে এসেছে। তারই প্রভাবে সাগরের নীলরঙে এখন অন্য মাত্রা। অনেকটা দূরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে মিরিশ্যা।

সব ছবি লেখকের তোলা

Shreyoshi Lahiri

দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্‌-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *