আজ মেট্রোতে তেমন ভিড় নেই। জ্যোতিশঙ্কর নতুন কেনা দামি ফোনটাকে ব্যাগের একেবারে ভেতর দিকে ঠেসে দিয়ে ছেড়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলেন! এইরকম একেবারে দমদম পর্যন্ত বসে চলে যাওয়ার ভাগ্য খুব কম দিনই ঘটে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে কামরার ভেতরে চোখ বোলাতে গিয়ে পাশে বসা মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলেন। হাতে তাঁরই প্রিয় লেখকের বই। কোনওদিকে না তাকিয়ে মেয়েটি পড়ে যাচ্ছে মগ্ন হয়ে। এটা একদম সদ্য প্রকাশিত। মেয়েটি যেভাবে পড়ছে, নিশ্চয়ই দারুণ হয়েছে। জ্যোতিশঙ্কর মেয়েটির আর একটু কাছ ঘেঁষে বসলেন। 

আগে কী ঘটনা ঘটেছে, জানা নেই। কিন্তু এই পাতাটায় গাড়ির ব্রেক ফেল করে পাহাড়ি রাস্তায় সাঙ্ঘাতিক এক দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এই সময়ে মেয়েটি পাতাটা উল্টে দিল। নাহ, কালই অফিস ফেরত বইপাড়া হয়ে আসবেন। মেয়েটির হাতের ফাঁক দিয়ে জ্যোতিশঙ্কর দেখলেন, গাড়িটা মারাত্মকভাবে পাহাড়ের খাঁজে আটকে আছে। সন্ধে হয়ে আসছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো বরফ পড়াও শুরু হয়েছে। গল্পের নায়ক ওই গাড়ির মধ্যেই আটকে। তিনি বোধহয় একটু বেশিই ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়েছিলেন। মেয়েটি বই থেকে চোখ না তুলেই একটু সরে বসল। জ্যোতিশঙ্কর লোভীর মতো তাকিয়ে শেষ যে লাইনটা দেখলেন, তাতে গল্পের নায়ক সিটের খাঁজে আটকে যাওয়া হাতটা ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। 

 

আরও পড়ুন: পিনাকী ভট্টাচার্যের গল্প: দুর্জয়বাবুর দুঃসময়

 

পরের স্টেশন দমদম, এটা দু’বার শোনার পর মেয়েটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বইটা বন্ধ করে জ্যোতিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে মুখটা হাসি হাসি করল। দু’জনেরই প্রিয় লেখক যে এক, এটা বুঝতে পারার হাসি। জ্যোতিশঙ্করও হাসলেন।  তারপর বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও তুমি না বলে বললেন,
– প্রায় তো শেষ করে ফেলেছেন।
মেয়েটি বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে আছে যখের ধনের মতো। স্টেশন এসে যাওয়ায় আর কথা হলও না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মেয়েটি বলল,
– আমি থাকি বেহালায়। এখানে পিসির বাড়ি। আজ দাদার জন্মদিন। নয়তো রাতেই শেষ হয়ে যেত।
কেমন লাগছে এই নতুন বইটা?
আমার তো ওঁর সব লেখাই দারুণ লাগে। আমার দিদি আর আমি দু’জনেই ওঁর লেখার অন্ধ ভক্ত। মায়ের ভাল লাগে না। বলেন, বড্ড গাঁজাখুরি। আপনারও কি তাই মনে হয়?
জ্যোতিশঙ্করের ঘাড় নেড়ে না বলা আর মোবাইল বাজা একই সময়ে হল। মোবাইল কানে দিয়ে বরাবরের অভ্যেসমতো বললেন,
জ্যোতিশঙ্কর বলছি।
তারপর কথাটা লম্বা হবে বলে বললেন,
– এখন বাইরে আছি। পরে কথা হবে।

Reading Books
মেয়েটি পড়ে যাচ্ছে মগ্ন হয়ে

ফোনটা বন্ধ করে জ্যোতিশঙ্কর দেখলেন, মেয়েটি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর তাঁকে ভীষণ চমকে দিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল,
– ইস আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। যখন আপনি জিজ্ঞেস করলেন নতুন বইটা কেমন লাগছে? প্লিজ আমার নতুন বইটাতে সই করে দিন।
জ্যোতিশঙ্কর যতক্ষণে বুঝতে পারল মেয়েটি কী বলছে, ততক্ষণে সে ব্যাগ হাতড়ে কলম বের করে বইটা একেবারে জ্যোতিশঙ্করের মুখের কাছে ধরে আছে। আশা আর আনন্দে জ্বলজ্বলে কিশোরী মুখটার দিকে তাকিয়ে জ্যোতিশঙ্কর একটু ইতস্তত করছেন দেখে সে বলল,
– আজ যখন আমি সবাইকে গিয়ে বলব, কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না। আমি শুনেছিলাম আপনি নর্থের দিকে থাকেন। সেটা যে দমদম তা জানতাম না। ভাগ্যিস আজ এলাম।
জ্যোতিশঙ্কর কলমটা ধরে আছেন দেখে মেয়েটি আবার তাড়া লাগাল…
– আমার নাম মধুরা সেটা লিখবেন মনে করে। নয়তো সবাই ভাববে অন্য কারও বই।
এত আদর, সম্মানের যে এমন একটা মাদকতা থাকে, জ্যোতিশঙ্কর তা জানতেন না। তিনি একটা ঘোরের মধ্যে লিখতে লাগলেন… স্নেহের মধুরাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে- যতিশঙ্কর ভট্টাচার্য।

মধুরা বিদায় নিতেই ঘোর কেটে গেল জ্যোতিশঙ্করের। এটা তিনি কী করলেন? সারাটা রাস্তা তাঁর পিঠের শিরদাঁড়াটা শিরশির করল একটা চাপা ভয়ে। কেবল মনে হতে লাগল পেছন থেকে এসে কেউ যেন পিঠে টোকা দিয়ে বলবে- এটা কী হল? মধুরাকে ফোন নম্বর দেওয়াটাও ঠিক হয়নি। বাড়ি আসার পরও ভয়টা কাটল না। অসময়ে দরজায় ঘণ্টা বাজলেই চমকে ওঠেন। এইভাবে দু’চারদিন কাটার পর হঠাৎ একদিন মধুরার ফোন এল।
– আমি সবাইকে বলেছি আপনার কথা। আমার বন্ধুদের বইতেও আপনাকে সই দিতে হবে। বইগুলো নিয়ে ওরাও আসবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।  

মধুরার বইতে সই করার সময় যে উত্তেজনা তিনি বোধ করেছিলেন, সেটা আবার ফিরে এল। বানানটা সামান্য এদিক ওদিক! তাতেই তিনি যেন আমূল বদলানো এক মানুষ হয়ে উঠতে লাগলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন ভাল করে। যতিশঙ্কর আর তিনি প্রায় একই বয়সী। হাইটও মোটামুটি একই। বহুদিন আগে তাঁদের অফিসে এসেছিলেন যতিশঙ্কর। তাঁর পাশের টেবিলেই বসেছিলেন বন্ধু দেবমাল্যর সঙ্গে। যতিশঙ্কর তখন সবে লিখতে শুরু করেছেন। অফিসে জ্যোতিশঙ্করই শুধু বই পড়ার অভ্যেসটি বাঁচিয়ে রেখেছেন। তার ওপরে আবার ছোটদের বই। সেইজন্য তিনি যতিশঙ্করের নাম জানতেন। দেবমাল্যরই বন্ধু যতিশঙ্কর। কিন্তু সে একটাও লেখা পড়েনি। কথায় কথায় বলেন, সব পরীক্ষা শেষ। মুখের সামনে আয়নার মতো বই ধরা পর্বও শেষ। তাছাড়া টিভি থাকতে বই পড়ে কোন আহাম্মক

Working sheets
বেশিরভাগ লোকই তাঁদের লেখা দিয়ে চেনে

ওঁরা কি একটা কাজের কথা আলোচনা করছিলেন। জ্যোতিশঙ্কর অত মন দিয়ে শুনছিলেনও না। একসময়ে দেবমাল্যর হেঁড়ে গলা কানে গেল।
– এবার কলম পেষা থামিয়ে একটু কোটরটা ছেড়ে বেরো। সব কাজ কি অন্য লোক করে দেবে? যতিশঙ্কর কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিলেন,
– জানিসই তো ওই একটা কাজই তবু এক আধটু পারি। একে অলস তার ওপর মুখচোরা। আমার দ্বারা হবে না।

কী হবে না, তা আর জ্যোতিশঙ্কর জানতে চাননি। মনে হয়েছিল, স্কুল কলেজের ব্যাপার। চাঁদা টাদার কথা হচ্ছে হয়তো। এখনও যতিশঙ্কর সেইরকমই অলস মুখচোরা আছেন নিশ্চয়ই। খুব কম লোকই চেনে। নয়তো এত বড় ভক্ত এই ভুলটা করত না। তবে লেখকরা তো আর সিনেমা আর্টিস্ট বা খেলোয়াড় নয় যে কাগজে নিত্যিদিন তাঁদের ছবি বেরুবে। বেশিরভাগ লোকই তাঁদের লেখা দিয়ে চেনে। শুধু খুব বিখ্যাতদেরই গোঁফ দিয়ে যায় চেনা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ জ্যোতিশঙ্করের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে লাগল। বাঁদিকের সিঁথিটা বদলে চুলটা উলটে দিলেন, বহুদিন আগে দেখা অথচ মনের মধ্যে ছাপ রেখে যাওয়া চেহারাটা মনে করে। একটা পাওয়ার ছাড়া চশমা যোগাড় করা জলের মতো সহজ। শুধু নিজের শখের সরু গোঁফটা কামিয়ে ফেলতে হবে।

 

আরও পড়ুন: ঋতা বসুর কলমে: দুটি নারীঘটিত গল্প

 

সামনের কয়েকটা দিন পরিচিত লোকেরা একটু কৌতূহল দেখাল। প্রতিবেশী সুশান্তবাবু বললেন,
– একেবারে ভোল ফিরিয়ে ফেলেছেন দেখছি।
কেমন লাগছে চেঞ্জটা?
দিব্য। বেশ লেখক লেখক। 

অজান্তেই সুশান্তবাবু তাঁর মনের সবথেকে নরম জায়গাটা ছুঁয়ে দিলেন। জ্যোতিশঙ্করের আজকাল নিজেকে যতিশঙ্কর বলে ভাবতে একটুও অসুবিধে হয় না। মিল খুঁজে পাবার লোক দেবমাল্য বহুদিনই চাকরি বদলে অন্য অফিস, অন্য শহরে চলে গিয়েছেন। চেহারায় বদলটার থেকেও জ্যোতিশঙ্করের মনের বদল হল বেশি। যতিশঙ্করের গল্পগুলো পড়ে এখন তাঁর মনে হয়, এমনটা তো তিনিও  ভেবেছিলেন! কতবার তো গল্পের শেষটা আগেই কল্পনা করে নিয়েছেন! তারপর দেখা গেছে গল্পটা হুবহু ওইভাবেই শেষ হয়েছে! লেখেনি বলে তিনি লেখক নন, এটা ঠিক নয়। ভাবনাটাই আসল। সেটা যখন তিনি পারেন, তখন লিখতে কতক্ষণ? যত ভাবলেন তত উত্তেজিত হলেন তিনি। বাড়ি গিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল।

সেদিন অফিসের পর বেশ খানিকটা কাটাকুটি হলেও কয়েকপাতা লিখেও ফেললেন। আর যত লিখতে লাগলেন, ততই অন্য লোকের হয়ে সই করার অপরাধবোধটা একেবারেই চলে গেল। তাঁর মনে হল, লেখা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। এতদিন যে তিনি কেন লেখেননি সেটাই আশ্চর্য। এখন গল্প আড্ডা সিনেমা কিছুই আর ভাল লাগে না। মনে মনে সারাক্ষণই তিনি গল্প ভেবে চলেছেন আর সুযোগ পেলেই সেগুলো লিখে ফেলছেন। আচমকা মধুরা বলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা না হলে জীবনের এদিকটা অজানাই থেকে যেত। মধুরার বন্ধুরা এলে তিনি তার নতুন গল্প পড়ে শোনাবেন। সই দেবেন সবার বইতে। 

নামের নতুন বানানটা পরখ করার জন্য সুশান্তবাবুকে তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে একখানা কার্ড দিলেন। সুশান্তবাবু অবাক হলেও বেশ খুশি হয়ে বললেন,
– জন্মে কোনওদিন এ জিনিস পাইনি। রেখে দেব যত্ন করে। আপনার ভেতরে যে বেশ ভাব আছে তা আপনার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। তবে আমি জানতাম না অন্তস্থ য দিয়েও যতি হয়। আমাদের বিখ্যাত মন্ত্রীর নামটা কাগজের পাতায় দেখে দেখে ওটাই অভ্যেস কিনা।
আমি বরাবরই এই বানান লিখি। দুটো বানানের দুরকম মানে।
বানানের ব্যাপারটা পাকাপোক্ত হওয়ায় তাঁর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। এরমধ্যে অফিসের কাছে একটা ছোট বইয়ের দোকানে ঢুকে বই নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– যতিশঙ্করের আগের দুটো বই দেখছি না?
ওগুলোর থেকে নতুন বইটা এখন চলছে বেশি। আপনার লাগলে এনে দেব।
একটু লাজুক হেসে তিনি বললেন,
– আমারই বই। লোকে পড়ে টড়ে কিনা তাই জানতে চাইলাম।
কাউন্টারের ছেলেটি বলল,
-খুব ভাল হল। আপনি নিজে আমাদের দোকানে এসেছেন। আমরা ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব। আমরা একটা পত্রিকা বার করছি। আপনি যদি লেখা দেন তো খুব ভাল হয়। 

Bookshop
একটা ছোট বইয়ের দোকানে ঢুকে বই নাড়াচাড়া করতে লাগলেন

জ্যোতিশঙ্কর সেদিন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরলেন। হোক নতুন কাগজ, তবু ছাপার অক্ষরে লেখার সুযোগ এই প্রথম। যদি দশটি লোকও পড়ে, তাই বা কম কী? সুন্দর হাতের লেখায় পরিষ্কার করে এতদিন ধরে যা লিখেছেন, তার থেকে একটা গল্প কপি করে পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। অফিসের ঠিকানাই দিলেন। সবাইকে যদিও মুখে মুখে অনেকবার বলেছে- বাড়ি গিয়ে লেখা নিয়ে বসতে হবে, তবুও পত্রিকা অফিস থেকে চিঠিচাপাটি এলে ব্যাপারটা আরও ভাল হয়। তাঁর কেবল মনে হতে লাগল, এই  শুরু হয়ে গেল তাঁর লেখক জীবন। এবার বড় বড় কাগজ থেকে তাঁর ডাক আসবে লেখা দেবার জন্য। যত ভাবলেন ততই রোমাঞ্চিত হলেন! একবার আবছা করে মনে হল, আসল যতিশঙ্করের সঙ্গে যদি কখনও দেখা হয়… তাড়াতাড়ি ভাবনাটাকে চাপা দিলেন তিনি। যখন হবে তখন দেখা যাবে এই বলে। তাছাড়া অন্তস্থ য তো যতিশঙ্করের একলার সম্পত্তি নয়। যে কেউ তা ব্যবহার করতেই পারে।

বেশ কিছুদিন বাদে একটা মোটা খাম এল তাঁর নামে। সই করবার সময়ে তাঁর বুক কাঁপছিল। জীবনে প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখতে পারার উত্তেজনার কাছে আর সবই যে ফিকে, এই নিয়ে তাঁর আর কোন সন্দেহ রইল না। কিন্তু খামটা খুলে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, কোনও পত্রিকা নয়। তাঁর নিজের হাতে লেখা গল্পটাই শুধু আছে। সঙ্গে একটা মুখবন্ধ খাম। খামের মুখটা ছিঁড়তেই একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি বেরিয়ে এল। 

মাননীয়েষু, এই লেখাটায় আমাদের পরিচিত যতিশঙ্কর ভট্টাচার্যকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়েছি। আপনি হয়তো ছোট কাগজ বলে অতটা মন দেননি। প্রথম সংখ্যায় আপনার লেখা দিতে পারলে আমাদের সুবিধেই হত। কিন্তু তাতে আপনার প্রতি অবিচার হত। আমরা কিন্তু অপেক্ষা করে রইলাম আপনার পরের লেখার জন্য। প্রণাম নেবেন।

ইতি

গুণমুগ্ধ সুমন্ত্র বিশ্বাস।

 

আরও পড়ুন: ঈশানী রায়চৌধুরীর গল্প: নীল পাখি

 

চিঠিটা পড়ে জ্যোতিশঙ্করের মনে রাগ দুঃখ হতাশা লজ্জা সব মিশে একটা অদ্ভুত অবস্থা হল। এখন টেবিলে বসে শান্ত স্বাভাবিকভাবে কাজ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। বাড়ি এসে তিনদিন তিনি শুয়ে বসে রইলেন। লেখার মতো প্রিয় কাজটাও করতে ইচ্ছে হল না। একটা নতুন কাগজ, যেটার একটা সংখ্যাও এখনও আলোর মুখ দেখেনি, তাঁরা পর্যন্ত যতিশঙ্কর নামটাকে পাত্তা দিল না? আর তিনি কিনা নাম বদলে, চেহারা বদলে চোর সেজে রইলেন

তিনদিন বাদে তিনি আবার দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। ভাল করে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারলেন না। পাওয়ার ছাড়া চশমা খুলে ফেললেন। চিরুনি দিয়ে সিঁথি কাটলেন মাথার বাঁ দিকে। তিনদিন দাড়ি না কামানোর জন্য আবার গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। সেটুকু রেখে বাকিটা কামিয়ে ফেললেন পরিষ্কার করে। এখন অনেক ভাল লাগছে। নিজের নামটাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করল তাঁর। বর্গীয় জ টাকেই অনেক আপন বলে মনে হল।

শান্ত হয়ে মনস্থির করে তিনি বসলেন লেখার টেবিলে। কালি কলমের সঙ্গ তাঁকে যে আনন্দ দিয়েছে, তার সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা চলে না। যাই ঘটুক না কেন, লেখা তিনি ছাড়বেন না। তিনি নিজে যা, সেইভাবেই লিখবেন। তাঁর লেখা লোকে জ্যোতিশঙ্করের বলেই পড়বে। যতিশঙ্করকে খুঁজবে না।  কারও নাম চেহারা ধার নেবার আর তাঁর প্রয়োজন নেই।

*ছবি সৌজন্য: Subpng.com, Dreamstime, Saatchiart

বাংলা সাহিত্য নিয়ে শান্তিনিকেতন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা। পরে শিক্ষাঙ্গনকেই বেছে নিয়েছেন কর্মজগত্‍ হিসেবে। তবে লেখালিখিই প্রথম ভালবাসা। ছোটদের ও বড়দের –-- দু'রকম লেখাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। ছোটদের ও বড়দের গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল জীবন নিয়ে তাঁর লেখা 'শ্রীসদনের শ্রীমতীরা' পাঠকসমাজে সমাদৃত। প্রিয় বিষয় সিনেমা, নাটক, রহস্য ও ইতিহাস।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *