বেলঘরিয়ার কলোনিতে তখন রাত। হঠাৎ ঝুমঝুম শব্দ, তারপরই হ্যাজাকের আলোয় দেখা দিলেন জ্যান্ত কালী। পয়সা নেওয়ার পালা মিটলে, শব্দ ও আলো দুইই মিলিয়ে গেল। সম্প্রতি ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’-তে (কেসিসি) ‘দ্য লেগাসি অফ লস: পারস্পেক্টিভস অন দ্য পার্টিশন অফ বেঙ্গল’ প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই ভাবেই শৈশবের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন বিশ্বভারতী কলাভবনের অধ্যাপক দিলীপ মিত্র।

১৭ থেকে ২৯ অগস্টের এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে আরও চার শিল্পীর কাজ। এঁরা হলেন বিনায়ক ভট্টাচার্য, পলা সেনগুপ্ত, অমৃতা সেন এবং দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। প্রদর্শনীর সহ-উদ্যোক্তা ইমামি ফাউন্ডেশন, কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম এবং টাটা স্টিল। উদ্বোধনের দিন বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কলকাতায় ইতালির কনসাল জেনারেল গিয়ানলুকা রুবাগোত্তি, ইতিহাসবিদ সুগত বসু, চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন এবং কেসিসি-র পক্ষ থেকে রিচা আগরওয়াল ও রিনা দেওয়ান।

প্রদর্শনীর মূল ভাবনা যাঁর, সেই ইতিহাসবিদ রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল, দেশভাগের যন্ত্রণা যে সব শিল্পী ভোগ করেছেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের এই বিষয়টি নিয়ে উপলব্ধি এ বার তুলে ধরা দরকার। শিল্পী নির্বাচনের পর দেখা গেল অমৃতা ছাড়া, বাকি চারজনেরই শিকড় ওপার বাংলায়। এ প্রসঙ্গে কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম ট্রাস্টের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ঋতুপর্ণা রায় বললেন,

‘আমাদের মূল লক্ষ্য বাংলার দু’ভাগ হওয়া নিয়ে কাজ করা হলেও, আমরা মনে করি এই নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে লাভ নেই। শুধু কাঁটাতারের আবর্তে ঘুরপাক খেলে আর নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করলে, আমাদের বৃহত্তর লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে। আমরা চাই দু’বাংলার সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে। ভাষার মাধ্যমে, খাওয়াদাওয়ার মাধ্যমে, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে। এই প্রদর্শনী তারই একটি ধাপ। কী করে ভুলি, ’৪৭-এর আগে দুই বাংলার ইতিহাস অভিন্ন ছিল?’

vinayak bhattacharya art
বিনায়ক ভট্টাচার্যের তুলিকলমে দেশভাগের যন্ত্রণা

দেশভাগ নিয়ে এই প্রদর্শনীতে প্রত্যেক শিল্পীর কাজে একটি নির্দিষ্ট থিম বা ভাবনা দেখা যায়। দুই বাংলার সীমান্ত থেকে সামান্য দূরে, অশোকনগরে থাকেন শিল্পী ও অধ্যাপক বিনায়ক ভট্টাচার্য। তাঁর জলরং, আলোকচিত্র এবং রিলিফ প্রিন্টে মিলেমিশে তাই বার বার ফিরে আসে কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হিংসা ও মৃত্যুর আখ্যান। সেখানে একদিকে রয়েছে সাদা বক, অন্য দিকে কালো বাদুড়। একটি ছবিতে রুপোলি শস্য ইলিশও কাঁটাতারে বন্দি।

প্রচলিত অর্থে ওপার বাংলার সঙ্গে অমৃতা সেনের যোগ না থাকলেও, প্রায় এক দশক আগে বিশিষ্ট লেখক ঊর্বশী বুটালিয়ার সঙ্গে এক কর্মশালায় যোগ দেওয়ার পর তিনি এই বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন। এ ক্ষেত্রে কলাভবনের এই প্রাক্তনীর অনুপ্রেরণা, ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ ট্রিলজি: ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা।’ তাঁর সব ক্যানভাস এক অর্থে যেন ঋত্বিকের ছবিগুলিরই কোলাজ। ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে সেটা আরও স্পষ্ট। 

amritah sen Partition Art
অমৃতা সেনের কাজ

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলির’ দৃশ্যকল্পের পাশাপাশি রয়েছে বাবা-রূপী বিজন ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘আই অ্যাকিউজ়।’ ছ’পাতার অ্যাকর্ডিয়ন বুকে ‘কোমল গান্ধার’-এর ভৃগু আর অনসূয়াকে দেখে ‘দোহাই আলি’র অনুরণন না এসে পারে? আর একটি ছবিতে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে সল্টলেক স্টেডিয়ামে অল্প কিছুদিন আগে দুই-প্রধানের ফুটবল খেলার সময় প্রদর্শিত এনআরসি-বিরোধী টিফো, ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়।’

কিছুদিন আগে, অন্য একটি ওয়েবিনারে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পলা সেনগুপ্ত নিজের পরিচয় দেন ‘দেশভাগের সন্তান’ হিসাবেই। মা যশোরের, বাবা কুমিল্লার। মেয়েবেলায় পলার আক্ষেপ ছিল, কেন তাঁরা তাঁকে এক বারও পূর্ব পাকিস্তানে (পরে বাংলাদেশ) নিয়ে যাননি? সেই সুযোগ আসে ২০০৮ সালে, দু’বার। দ্বিতীয়বার অল্প দিনের জন্য সফরসঙ্গী হন তাঁর মা-ও। সেই সফরের পরতে পরতে লুকিয়ে ছিল নানা অমূল্য রতন। তারই কিছু আভাস পাওয়া গেল এই প্রদর্শনীতে। 

Paula Sengupta art work
পলা সেনগুপ্তের কাল্পনিক রেস্তোরাঁ

পলার থিম ছিল এমন এক ছবি-রেস্তোরাঁ যেখানে দুই বাংলার মাছ পাওয়া যায়। সেখানে ভেটকি আর ইলিশ পাতুরির পাশাপাশি রয়েছে পমফ্রেট আর রূপচাঁদার শুঁটকি। সব শেষে চিংড়ির মালাইকারি। এ ছাড়াও চোখ টানল পলার রেসিপি ক্যাবিনেট এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধের বিশিষ্ট নায়ক, তাঁর বাবার ইউনিফর্মে কন্যার এমব্রয়ডারির কাজ।

এই প্রদর্শনীতে সব থেকে নজরকাড়া কাজ দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের ৪০ ফুট লম্বা, এক-মিটার চওড়া ইনস্টলেশন, ‘রিভার সং,’ যেটি শিল্পীর মায়ের পোর্ট্রেট। বিহারের ছাপরায় বেড়ে ওঠা, বর্তমানে দিল্লিবাসী দেবাশিস প্রথাগত ফোটোগ্রাফিক পোর্ট্রেটে একেবারেই বিশ্বাসী নন। বরং এই শিল্পকর্ম দেখে ঋতুপর্ণার মনে হয়েছে, ‘মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসাও বহতা নদীর মতো।’ মাঝের লাল রং সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, ‘লাল তো শুধু ভালবাসার রঙই নয়। তার সঙ্গে মিশে আছে অনেক ব্যথা, রক্ত, ঘাম।’ 

debasish mukherjee art installation
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের ইনস্টলেশন

অভিনব লাগল ছাপরায় ২২টি বসন্ত পার করা নিয়ে দেবাশিসের বাইশটি বিমূর্ত চাঁদের নির্মাণও। সেখানে প্রতিটি চাঁদের আয়তন এক একটি এমব্রয়ডারি হুপের সমান। 

দিলীপ মিত্রের কাজগুলি যেন এক একটি উদ্বাস্তু কলোনির মানচিত্র। সেখানে জ্যান্ত কালী প্রতিমার পাশাপাশি রয়েছে পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, এমনকী পুকুরও। কিছুটা তাঁর জীবন থেকে নেওয়া, কিছুটা বাপ-ঠাকুরদার কাছে শোনা।

dilip mitra
দিলীপ মিত্রের কাজ

সেই ওয়েবিনারেই তাঁর কাছে জানা গেল, কলকাতায় কলোনি গড়ে উঠত পূর্ব পাকিস্তানের জেলার উপর ভিত্তি করে। বহিরাগতদের প্রবেশ রুখতে বাবা-কাকারা লণ্ঠন হাতে দিতেন রাত-পাহারা। কলোনিগুলিতে সব থেকে বেশি চলত বেড়ার দোকান। আর জলাজমিকে উঁচু করতে পুকুর থেকে নিয়মিত তোলা হত মাটি।

আর কে না জানে, ‘ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।’

 

*ছবি সৌজন্য: কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)

দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *