সৈয়দ মুজতবা আলী সরষে প্রীতির পরিচয় দিয়ে ‘বাঙালী মেনু’ নিবন্ধে বলেছেন ‘মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসংগীতে কথার সঙ্গে সুরের মিলন।’ সব মশলাপাতি দূরে সরিয়ে রেখে হলফ করে বলতে পারি মাছের সঙ্গে সর্ষের সম্পর্কটি যেন এক স্বর্গীয় ম্যাচ, অর্থাৎ যাকে কিনা বলে “a match made in heaven” । সর্ষেবাটার ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে ছুটির দিনে সুখ-উদগার তুলে বাঙালিবাবু তাই বুঝি বলেন, “হেভেনলি”।
এই কম্বিনেশনটি ঠিক আমাদের উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-লতা, দই-মিষ্টি অথবা তেলেভাজা-মুড়ির মতো। বাঙালির রসনাপুরাণের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দ্বন্দ্বসমাস হল সর্ষে-মাছ। মাছ আর সর্ষেবাটার এই বন্ধন যেন জন্মজন্মান্তরের, তেমনি বিশ্বাস আমাদের।
মাছের সঙ্গে সর্ষের রসায়ন এতটাই গাঢ় যে আমাদের ছেলেপুলেরা বিদেশযাত্রায় মনে করে বাজারচলতি সর্ষে পেস্টের সম্বচ্ছরি কেনাকাটা আগেভাগে করে রাখে। সেখানে শিল নোড়া নেই। কাজের মাসি নেই। আর বাকিসব মশলা মিক্সার গ্রাইন্ডারে জব্দ হলেও সর্ষে জব্দ শিলে, মাছ সর্ষের তেলে। মিক্সিতে সর্ষে তেতো হয়, তাই চোখে আঙুল দিয়ে কাজের মাসিকে কলের গানের মতো বলে যেতেই হয় মা’কে… ওরে এক পিষুনিতেই থাম তুই। অথবা একটু নুন দিয়েছিস তো? শিলনোড়ায় কেউ সর্ষে দিয়ে কাঁচালংকা বাটতে বসলে আর খুব খারাপ বাটা হলে সেই সর্ষেবাটাকে ছেঁকে নিতে দেখেছি মায়েদের। আমার রন্ধনপটীয়সী দিদিমা মাছের ঝাল রাঁধতেন না, সর্ষে বাটা “চন্দনের” মতো না হলে।
এই সর্ষেবাটা দিয়ে মাছের ঝালের নানারকমের বৈচিত্র্য দেখেছি তার ফোড়নে, সবজির ব্যবহারে অথবা ভাপা কিম্বা দমে রান্নার অভিনবত্বে। সর্ষেবাটার সঙ্গে মাছের অনবদ্য রসায়নের মতো কাঁচা সর্ষের তেল আবার তাকে আরও রসোত্তীর্ণ করে দেয়। বহু গুণী মানুষদের সঙ্গে মিশে দেখেছি, সর্ষেবাটা দিয়ে মাছের ঝালের জন্য তাদের আকুতির কথা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সবার প্রিয় ছিল এই সর্ষেবাটার মাছের ঝাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মায়ের হাতের সবচেয়ে প্রিয় রান্না ছিল নারকোল কোরা, সর্ষে, কাঁচালঙ্কা, হলুদ, নুন আর সামান্য মিষ্টি দিয়ে, সর্ষের তেল দিয়ে মেখে চিংড়িমাছ কিম্বা ইলিশভাপা। চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলেছিলেন তাঁদের ঢাকা-বিক্রমপুরের অথেন্টিক এক পাতুরির অভিনব রেসিপি। সর্ষে, পোস্ত, নারকোল কাঁচালঙ্কা বেটে নিয়ে, নুন, হলুদ, সর্ষের তেল দিয়ে ম্যারিনেট করা রুই বা কাতলা মাছের কাঁচা পেটি কলাপাতায় তিনটি স্তরে সাজাতেন তাঁর মা। এবার চাটুতে তেল মাখিয়ে সেই মাছের এক দিক হয়ে গেলে পুরোটা উল্টে দেওয়া হত।
সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর প্রিয় ছিল ভাত ফোটার সময় ভাতের হাঁড়ির মুখে কলাপাতায় মুড়ে সর্ষে নারকোল কোরা দিয়ে চিংড়ি ভাপা কিম্বা তেল কই। আমার দিদিমাকেও দেখেছি ভাতের হাঁড়ির মুখে কচুপাতার মধ্যে ইলিশমাছ সর্ষেবাটা, তেল, কাঁচালঙ্কা দিয়ে ম্যারিনেট করে ভাপা বানাতে। বাঙালির এই সর্ষে-মৎস্য প্রীতি থেকেই বুঝি একদিন জন্ম নিয়েছিল পাতায় মোড়া ভাপা মাছ বা পাতুরি।
পার্সি সম্প্রদায়ের পাটরানি মচ্ছি বা পত্রানি মচ্ছি অনেকটাই আমাদের এই পাতুরির অনুরূপ। তাই পাতুরি দুই বাংলার একচেটে সম্পত্তি কিনা, এ বিষয়ে আমি মুখ খুলতে নারাজ। আগে মুরগি না আগে ডিম, সেই তর্কের মতো অসমাপ্ত থাকুক এই বিষয়টা।
পাতুরি কলাপাতায় মোড়া বিশেষ পদ। তা সে ছানার হোক, বা বীচেকলার বা বেগুনের। কিম্বা মোচার ভেতরের অংশের অথবা শুধুই মাছের বা ডিমের, তা বাঙালির অন্যতম রসনা সংস্কৃতি। বাংলার এই পদটি পার্সি সম্প্রদায়ের পত্রানি মচ্ছির সহোদর বলা যেতে পারে। এই পাতুরি প্রসঙ্গে বরিশাল জেলার ফুল্লশ্রী গ্রামের বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে বরিশালের বাঙালি রান্নাশৈলীতে ‘কলাপাতায় রোহিত মৎস্য’ বা রুইমাছের উল্লেখ আমাদের ভাবায়
“রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত
মৎস্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলাপাতার আগ।”

ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে এক রেসিপি পেলাম পার্সি পাতুরির। পার্সিরা কাঁটাছাড়া মাছের ফিলে নুন আর লেবুর রসে ম্যারিনেট করে নারকেল কোরা, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, ধনে-জিরে গুঁড়ো, লেবুর রস অথবা কাঁচা আম কোরা, একটু চিনি এবং নুন দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতার মধ্যে রেখে সুতো দিয়ে বেঁধে আভেনে বেক করে বা ওয়াটার বাথে স্টিম করে।
তবে পার্সি সম্প্রদায়ের পত্রানি মচ্ছি আর বাংলার মাছের পাত-পাতুরির বাহ্যিক রূপ এক হলেও এ দুই হল ভিন্ন অবতার। অন্ততঃ বাঙালির স্বাদকোরক তাই বলে। দুই ঘরানার পাতুরি রান্নায় মাছ আর কলাপাতায় মোড়া বাদে মশলাপাতিতে বেশ ফারাক। বাংলার পাতুরিতে সর্ষে, কাঁচালংকা বাটা, সরষের তেল আর হলুদ থাকবেই। পার্সি পাতুরিতে মশলা হল নারকোল কোরা, পুদিনা আর ধনেপাতা বাটার সঙ্গে আদা-রসুন-পিঁয়াজবাটা দিয়ে মাছ ম্যারিনেশন। আর একটি প্রধান ফারাক হল মাছ নির্বাচনে। ওদের সামুদ্রিক মাছ বা পমফ্রেট আর আমাদের নদীর মাছ। ইলিশ, ভেটকি কিম্বা রুই অথবা চিংড়ি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই কলাপাতায় মোড়া পাতুরি হয় হ্যালিবাট কিম্বা কড মাছ দিয়ে। সেখানে অলিভ অয়েল ব্যাবহৃত হয়। বাঙালির পাতুরির মতো পার্সিদের পত্রানি মচ্ছিও ম্যারিনেট করা হয় নুন আর লেবুর রসে। তবে সম্ভবত স্বাস্থ্যজনিত কারণে তেলের ব্যাবহারের কথা পাই না পার্সি পাতুরিতে।
এখন তো ছানার সন্দেশও কলাপাতায় মুড়ে স্টিম করা হচ্ছে। আবার কাম্বোডিয়ায় দেখেছিলাম চিনি আর নারকোল মুড়ে কলাপাতায় সেঁকা হয়ে আমাদের সাদা নাড়ু বা রসকরার অপভ্রংশরূপে পাতে দেওয়া হচ্ছে। বেসিক প্রিন্সিপল এক। অর্থাৎ কলাপাতায় মোড়া। এবার কালে কালে তার ইম্প্রোভাইজেশন হয়েছে বিস্তর। কলাপাতার বদলে এডিবল পাতায় মোড়া হয়েছে মাছ কিম্বা ছানাকে। আমার রান্নাঘরে ভেটকি বা ইলিশ পাতুরি একইভাবে বানাই এডিবল পাতা দিয়ে। কলাপাতা ফেলে দিতে হয় আর অনেকটা গ্রেভি সেখানে ফেলা যায়। তাই লাউ, কুমড়ো কিম্বা পুঁইপাতার মধ্যে যদি ম্যারিনেটেড মাছ নিয়ে পাতুরি করা যায়, তবে পাতাশুদ্ধ ভাতে মেখে দিব্য খাওয়া যায়। কারণ পাতুরির ঝাঁঝ, গন্ধ সবটুকু সেই পাতায় থাকে।

মাছের ফিলে ধুয়ে নিয়ে প্রথমে লেবুর রস, নুন-হলুদ ও পরে সব বাটামশলা আর দু’চামচ তেল দিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পরে প্রতিটি মাছকে আলাদা ভাবে পাতার ওপরে রেখে পান মোড়ার মতো তিনভাঁজ করে একটি কাঠের টুথপিক গেঁথে পাতার মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। ননস্টিক প্যানে সরষের তেল মাখিয়ে প্যানে মাছ চারটি পাতিয়ে রেখে ঢাকা দিতে হবে। ঢিমে আঁচে এমন থাকবে মিনিট পনেরো। এবার উলটে দিয়ে আরও পনেরো মিনিট গ্যাস সিম করেই। তারপর ফুরফুরে সাদা জুঁইফুলের ভাতের বাগানে সবুজ পাতা সমেত রেখে দিলেই কেল্লাফতে। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ, লংকা চলতেই পারে। আর কোনও রকেট সায়েন্স নেই এই পাতুরির প্রযুক্তিতে।
শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার ঠাকুমা দিদিমার রান্না’ বইতে কুমড়োপাতার মাছ নামে যে রেসিপিটি রয়েছে, তা এই পাতুরির অনুরূপ। কচি কুমড়োপাতায় ভেটকি বা ইলিশের ফিলে সরষের তেল, পোস্ত, কাঁচালংকায় মুড়ে স্টিম করার কথা লিখেছেন তিনি। আমার দিদিমাকেও দেখেছি ইলিশভাপা লাউপাতায় মুড়ে এভাবে অনেকটা ভাতের মধ্যে রাখতে। এটাই বর্তমানে চাটু বা ননস্টিটিক তাওয়ায় তেল ছড়িয়ে সেঁকে নেওয়ার আধুনিক পন্থা। কচি কচুপাতাতেও করা যায়।

শতরূপাদেবীর আর একটি বইতে উত্তরভারতের ‘পাতুরির ইয়াখনি’ নামে একটি রান্না পেলাম। সেখানে মাছ, আলু, মশলা দিয়ে চটকে কলাপাতায় মুড়ে ভাজার কথা রয়েছে। অসমের ‘পাত্তদিয়া মাস’ এমনি আরেক পাতুরি। পশ্চিমবাংলা ও অসম দুটি পড়শি রাজ্য যাদের মাছ-ভাত হল প্রধান খাদ্য। কিন্তু সেখানে এই পাত্তদিয়া মাস বা মাছের পাতুরি ভাজা হয় মাছের ফিলে মশলা দিয়ে ব্লেন্ডারে পিষে নিয়ে কলাপাতায় মুড়ে।
বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক প্রণালী’-তে আবার কইমাছের পাতুরির কথা পেলাম। সেখানে ঘিয়ের সঙ্গে সরিষাবাটা, গোলমরিচ, কাবাবচিনি, লংকা ইত্যাদির গুঁড়োর সঙ্গে আমসি বেটে আর ডিম ফেটিয়ে মাছ ম্যারিনেশনের কথা রয়েছে। এমনকি কইমাছের পেটের মধ্যেও মশলা পুরে দিতে হবে। তারপর তিনি যেমন বলেছেন হুবহু তুলে দিলাম।
“অনন্তর মাছ কলাপাতায় জড়াইবে। এখন উন্মানে তাওয়া বা কড়া চাপাইবে এবং তাহার উপর পাতা-জড়ান মাছ রাখিবে। আগুনের আঁচে পাতা পুড়িয়া আসিবে। দু-পিঠ উলটাইয়া দিবে। পরে তুলিয়া লইবে, এবং পাতা খুলিয়া মাছ বাহির করিবে। এখন আহার করিয়া দেখ।”
*ছবি সৌজন্য: Cookpad, spicypunch, Khonjkhabar
*ভিডিও সৌজন্য: Bong Eats, Youtube
*তথ্য সৌজন্য:
পাক প্রণালী (আনন্দ) / বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী (আনন্দ) / শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার ঠাকুমা দিদিমার রান্না (আনন্দ) / শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।