স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিগুলি পড়লে তাঁর মনের খবর মেলে। তাঁর মন তাঁর কর্মচিন্তার থেকে বিযুক্ত ছিল না।  

এই সন্ন্যাসী যুবার বক্তৃতার লিখিত রূপ, বাংলা ভাষায় লেখা ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ এসব পড়লে বুঝতে পারা যায় কীভাবে পরাধীন দেশের সাধারণ মানুষকে উদ্দীপিত করতে চাইছিলেন তিনি। আলস্য ত্যাগ করে কর্মপথে এগিয়ে যান তাঁরা, এই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের বার্তা। কাজ বলতে বিবেকানন্দ অবশ্য কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা-কিছু করি আমরা, তা বোঝাচ্ছিলেন না। তবে কেবল নিজের জন্য যে কাজ, তা একেবারে কিছু না-করার থেকে ভালো। পরশ্রমভোগী, অলসদের চাইতে নিজের জন্য কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা তুলনায় উত্তম। তার থেকেও তাঁরা ভালো, যাঁরা পরার্থে কাজ করেন।

গীতায় দু’রকম কাজের কথা আছে– সকাম ও নিষ্কাম। এই হল কর্মের দুই শ্রেণি। কোনও কাজ, যা নিজের বাসনা পরিপূরণের জন্য তা সকাম কর্ম। আর যে কাজ নিজের বাসনা পরিপূরণের জন্য নয়, বস্তুতপক্ষে যা ফলের আশা না করেই করা হয়, তা নিষ্কাম কর্ম। ফলের আশা করলেই কাজে বাসনা এসে জোটে, মন ভাবে কাজের সুফল পাওয়া যাবে। বিবেকানন্দ খেয়াল করছিলেন ভারতবর্ষের জনসাধারণ এতই অলস হয়ে পড়েছেন, যে তাঁরা সকাম-কাজেও আগ্রহী নন। তাঁদের নিজেদের ঘর-বাড়ি ভীষণ অপরিচ্ছন্ন। কলকাতার ব্ল্যাক-টাউনে খোলা নর্দমা, জঞ্জাল, পচা খাবার, মৃতদেহ, মাছি, শকুন– এর মধ্যে অলস জীবনযাপন। 

সকাম-কর্মে মন দিলে অন্তত অবস্থা এমন হত না। তাই তিনি প্রথমেই অন্যের জন্য কাজ করতে বলেন না, কাজে নিষ্কাম হতে বলেন না। প্রথমে তামসিক আলস্য কেটে যাওয়া চাই, তার জন্য উদ্যম, উৎসাহ দরকার। উদ্যমী, উৎসাহী মানুষ সকাম কর্ম করেন– নিজের জন্য কাজ করেন, নিজের পরিবারবর্গের জন্য করেন, আত্মীয় পরিজনের জন্য করেন। এভাবে সকাম কর্মের সীমা একটু একটু করে সম্প্রসারিত হয়। তারপর একসময় সকাম কর্মের খোলস ভেঙে নিষ্কাম কর্মের পথে মানুষ অগ্রসর হয়। তখন ফলাফল কামনাশূন্য ভাবে কাজ করা সম্ভব হয়। 

স্বামী বিবেকানন্দের এই কর্ম-সম্প্রসারণের প্রসঙ্গটি তাঁর প্রিয় গদ্যকার বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাতেও নানাভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে। বঙ্কিম তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছিলেন। সেখানে প্রীতিবৃত্তির সম্প্রসারণের কথা ছিল। মানুষ সবার আগে নিজেকে ভালবাসে, তাকে বলে আত্মপ্রীতি। তারপর সে নিজের কোঠা ছাড়িয়ে ভালোবাসতে শুরু করে স্বজনবর্গকে– তাকে বলে স্বজনপ্রীতি। তারপর ভালোবাসা আরও সম্প্রসারিত হয়– তখন ক্রমে স্বদেশপ্রীতি ও জাগতিকপ্রীতি সম্ভব হয়। প্রীতিবৃত্তির সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কর্মও ক্রমে সকাম থেকে নিষ্কামের দিকে এগোয়। 

 

আরও পড়ুন: শামিম আহমেদের কলমে: মহাভারত রচয়িতা রাজশেখর

 

আত্মপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতিতে সকাম কর্মের প্রকাশ, স্বদেশপ্রীতি ও জাগতিক প্রীতির ফল নিষ্কাম কর্ম। স্বজনপ্রীতিও ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হল নিষ্কামকর্মের প্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্র গীতার শ্লোক উধৃত করে তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে সন্ন্যাসের সঙ্গে নিষ্কাম কর্মের যোগ দেখিয়েছিলেন। সকাম কর্মের ত্যাগ সন্ন্যাস, কিন্তু সন্ন্যাসে নিষ্কাম কর্ম থাকতে পারে। সন্ন্যাসী নিজের জন্য কাজ করবেন না, অপরের জন্য করবেন– ফলের আশা করবেন না। বিবেকানন্দের লেখাপত্র পড়লে বোঝা যায়, সন্ন্যাসীর পক্ষে নিষ্কাম কর্মের গুরুত্ব যে কত গভীর, তা তিনি স্বীকার করতেন। তাঁর পত্রাবলীতে গুরুভাইদের তিনি কতরকমভাবে যে নিষ্কাম কর্মে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর চিঠিপত্রে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে কাজের কথা। তিনি নিষ্কাম কর্মকে নানা-সময়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সখার প্রতি’ কবিতার শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু, সর্ব্বভূতে সেই প্রেমময়,/মন প্রাণ শরীর অর্পণ, কর সখে, এ সবার পায়।/ বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/ জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ তাঁর ইংরেজিতে লেখা কবিতার তুলনায় বাংলা কবিতার ভাষা দুর্বল, মিলও কোথাও কোথাও ততটা কাব্যগুণসম্পন্ন নয়। তবে কবিতার ভাবটি খাঁটি, বুঝতে অসুবিধে হয় না এ তাঁর আত্মোপলব্ধি। ফলের আশা না করে যেমন নিরাসক্ত মনে কাজ করে যাওয়া, এও তেমন। কিছু না চেয়ে নিজের হৃদয় দিয়ে জীবকে ভালোবাসতে হবে। যে ভালোবাসা প্রতিদান চায় না, সে ভালোবাসা নিষ্কাম। সে ভালোবাসা নিষ্কাম কর্মে মানুষকে প্রাণিত করে। 

এই গভীর উপলব্ধি ১৮৯৭ সালে আলমোড়া থেকে অখণ্ডানন্দকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতেও রয়েছে। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর গুরুভাইদের মধ্যে সেবাকার্যে সবচেয়ে দক্ষ। অনাথাশ্রম করে তিনি যে কতজনকে অন্নসেবা করতেন! দুর্ভিক্ষের সময় পীড়িতদের কথা ভেবে অনেক সময় মুখে অন্ন তুলতে পারতেন না। ফলে সেবাকার্যের কঠোর শ্রম ও অন্ন গ্রহণ করতে না পারা, এই দুইয়ের অনিবার্য ফল শরীরের উপর পড়ত। সেবাকার্য তাঁকে পীড়িতদের প্রতি সমানুভূতিসম্পন্ন করে তুলেছিল।

বৈষ্ণব শাস্ত্রে আদর্শ প্রণয়ের অধিকারী সমর্থা রতিময়ী রাধা। তাঁর প্রণয় নিষ্কাম। যাঁকে তিনি ভালোবাসছেন, তাঁর কাছ থেকে কোনও প্রতিদান তিনি আশা করেন না। প্রণয়ের ধর্ম মেনে যে মানের প্রকাশ তাঁর প্রণয়ে দেখা যায়, তা কৃষ্ণের লীলাসুখের জন্য। সেবাধর্ম নিষ্কাম হলে, সমর্থার প্রণয়ের অনুরূপ হলে, তার আনন্দ প্রেমানুভূতিতুল্য। অখণ্ডানন্দকে চিঠিতে লিখছেন বিবেকানন্দ, 

‘তোমার সবিশেষ সংবাদ পাইতেছি ও উত্তরোত্তর আনন্দিত হইতেছি। …ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতলেও যায়, অহোভাগ্যমহাভাগ্যম্‌। …ভ্যালা মোর ভাইরে, অ্যাইসাই চলো। …পুঁথিপাতড়া, বিদ্যেসিদ্যে, যোগ ধ্যান জ্ঞান– প্রেমের কাছে সব ধূলসমান (যৎ)– প্রেমেই অণিমাদি সিদ্ধি, প্রেমেই ভক্তি, প্রেমই জ্ঞান, প্রেমেই মুক্তি।’ 

সন্ন্যাসী জাগতিক প্রীতির টানে নিষ্কাম কর্মে আত্মদান করছেন– একেই বিবেকানন্দ বলবেন জীবেপ্রেম। সেবাকর্ম প্রেমানুভূতিতে পৌঁছে দেবে। 

বিবেকানন্দের এই কথাগুলি আরও ব্যক্তিগত স্তরে ফিরে এসেছিল নিবেদিতার কাছে। ১৮৯৭ সালের অক্টোবর মাস। নিবেদিতাকে কাশ্মীর থেকে চিঠি লিখছেন তিনি। সম্বোধন করছেন কল্যাণীয় মার্গো বলে। নিবেদিতাকে নানা চিঠিতে নানা ভাবে সম্বোধন করতেন তিনি, কখনও কখনও মিস নোবল্‌ লিখেছেন। এখানে মার্গারেট থেকে মার্গো, আদরের ডাক। এই চিঠিতে স্বামীজি কথায় কথায় একজায়গায় লিখলেন,

আমি দেখতে পাই– অনেকে তাদের প্রায় সবটুকু ভালবাসাই আমাকে অর্পণ করে; কিন্তু প্রতিদানে কোন ব্যক্তিকে আমার তো সবটুকু দেওয়া চলে না; কারণ একদিনেই তাহলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। নিজের গণ্ডির বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত নয়– এমন লোকও আছে যারা ঐরূপ প্রতিদান চায়। 

Sister-Nivedita and Swami Vivekananda
স্বামীজি ও তাঁর স্নেহের মার্গারেট

সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর প্রীতিবৃত্তিকে সম্প্রসারিত করেছেন, ব্রতী হয়েছেন নিষ্কাম কর্মে। এখন যদি কোনও একক-ব্যক্তির প্রতি তাঁর সমস্ত ভালোবাসা অর্পণ করেন, তাহলে তো সম্প্রসারিত প্রীতিবৃত্তি সংকুচিত হয়ে পড়বে। যাঁর প্রতি সব অর্পণ করলেন, তাঁকে ঘিরে ফিরে যেতে হবে আত্মপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির আঙিনায়, এমনকী এই ভালোবাসা ফলাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠতে পারে। এই পিছন দিকে ফেরা তো তাঁর ‘ধর্ম’ নয়। যদি ফেরেন, তাহলে যে কেবল নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হবেন তাই নয়, নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হয়ে যে কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন, তাও যে পণ্ড হবে। বিবেকানন্দ যে এই কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে– তিনি প্রীতির জাগতিকতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন বলেই তো তাঁকে ঘিরে রয়েছেন অনুরাগীরা। তাঁরা সহায়তা করছেন এই নিষ্কাম কর্মে। যদি কোনও একজনের প্রতি চিত্তবৃত্তি ধাবিত হয়, তাহলে তো অন্যরা আর তাঁকে নেতা বলে মানবেন না। কলহ-হিংসা দেখা দেবে অনিবার্যরূপে।

না, কে বিবেকানন্দকে সম্পূর্ণ রূপে চাইছেন এখানে সে-কথা একেবারেই খুলে বলা হয়নি, দরকারও নেই। তবে লিখছেন তিনি স্নেহের মার্গোকে, ‘আমার বিশ্বাস তুমি এ-কথা বুঝতে পারছ।’ চিঠিটি কিন্তু এখানেই শেষ হয় না। সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে দিতে না-পারার প্রত্যাখ্যানে নয়, এ চিঠি শেষ হয়েছিল ভালোবাসারই কথায়। লিখেছিলেন মার্গোকে,  

আমার ভালোবাসা একান্তই আমার আপনার জিনিস, আবার প্রয়োজন হলে– বুদ্ধদেব যেমন বলতেন ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়’– তেমনি আমি নিজহস্তেই আমার হৃদয় উৎপাটিত করতে পারি। এ প্রেমে উন্মত্ততা আছে, কিন্তু কোন বন্ধন নেই।

লক্ষ করার বিষয় এই, যখন কেউ সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে চাইছেন স্বামীজিকে, তখন সে ভালোবাসার পরিবর্তে কেন সেই ব্যক্তিতে আপন চিত্তকে সম্পূর্ণ সমর্পণ সম্ভব নয়, তা জানাচ্ছেন তিনি। নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। তাই বলে কিন্তু অশ্রদ্ধা করছেন না সেই অর্পণকে। জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত ভালোবাসার পরিসরটিকে হত্যা করেননি তিনি, তা একান্তই ব্যক্তিগত। সেই তো সবকিছুর উৎস। ওই ঐকান্তিক ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতা যাঁর নেই, তিনি কীভাবে উন্নীত হবেন জাগতিক প্রীতিতে? ঐকান্তিক ভালোবাসাই তো জাগতিক প্রীতিতে ক্রম-প্রসারিত হয়েছে। এই জাগতিক প্রীতির সূত্রে প্রয়োজনে তিনি ব্যক্তি-হৃদয় উৎপাটিত করতে পারেন। তাঁর যা ব্রত, তাঁর যে অবস্থান সেখানে ব্যক্তিগত ভালোবাসার ঐকান্তিক প্রকাশকে তিনি অস্বীকার করেন না। কিন্তু সেখানেই তিনি আটকে থাকেন না। সেজন্যই ‘এ প্রেমে উন্মত্ততা আছে, কোন বন্ধন নেই।’ 

sister-nivedita
আচার্য বিবেকানন্দের স্নেহ, সখ্য, সাহচর্য লাভ করেছিলেন মার্গো

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাস সম্পর্কে একটি স্তরে সংশয় পোষণ করতেন। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস– এই ক্রমের বাইরে ‘সন্ন্যাস’ স্বতন্ত্র একটি পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পরেই কেউ সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারেন কিম্বা গার্হস্থ্যাশ্রম সম্পূর্ণ না করেও কেউ নিতে পারেন সন্ন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন, তিনিই জাগতিক প্রীতিতে নিজেকে উন্নীত করতে পারেন যিনি চারটি বৃত্তির যথাযথ অনুশীলন করেছেন। 

কী সেই চারটি বৃত্তি? যথাক্রমে বৃত্তি চারটি হল, শারীরিকী বৃত্তি, জ্ঞানার্জনী বৃত্তি, কার্যকারিণী বৃত্তি ও চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি। তাঁর অভিমত, সন্ন্যাসীর  পক্ষে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির যথাযথ অনুশীলন সম্ভব নয়। তা করতে গেলে সন্ন্যাসীর গৃহত্যাগধর্ম লঙ্ঘিত হতে পারে। ভালোবাসা, যা চিত্তরঞ্জিনীবৃত্তির অন্যতম শর্ত, তা পালন করতে গিয়ে সন্ন্যাসী বিপন্ন হতে পারেন। তাই তিনি চিত্তরঞ্জিনীবৃত্তির অনুশীলন করেন না। এখানেই তাঁর চারটি স্বাভাবিক বৃত্তির অনুশীলন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে তাঁর পক্ষে জাগতিক প্রীতিতে উপনীত হওয়া কি সম্ভব? বঙ্কিমের মতে, তাই প্রাচীন ভারতে এই চারটি বৃত্তির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে আদর্শ নায়ক হিসেবে যদি কেউ জাগতিক প্রীতিতে উপনীত হতে পারেন, তাহলে তিনি কৃষ্ণ। এবং কৃষ্ণ সন্ন্যাসী নন। বঙ্কিম বুদ্ধদেবকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু কৃষ্ণের মতো আদর্শ মানুষ বলে স্বীকার করেন না।

বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে লেখা এই চিঠিতে বুদ্ধদেবের প্রসঙ্গ এনেছেন। বিবেকানন্দ যেমন কৃষ্ণকে শ্রদ্ধা করেন, তেমন বুদ্ধদেবকেও। কৃষ্ণ, বুদ্ধের  কথা থাক। কথা বিবেকানন্দকে নিয়ে। বিবেকানন্দের ব্যক্তিগত জীবনে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুশীলন বন্ধ হয়নি। কবিতা লিখতেন, গান গাইতেন, সর্বোপরি ভালোবাসার ঐকান্তিক স্তরকেও অস্বীকার করতেন না। তবে সেই ঐকান্তিক ভালোবাসা জাগতিক প্রীতির ও নিষ্কাম কর্মের বিরোধী যেন না হয়, সে বিষয়ে তাঁর প্রখর সচেতনতা ছিল।  

খুবই কঠিন কাজ, খুবই কঠিন এ ব্রত, সন্দেহ  নেই। আচার্য বিবেকানন্দের স্নেহ, সখ্য, সাহচর্য লাভ করেছিলেন মার্গো। সেই স্নেহ-সাহচর্যে পেয়েছিলেন আশীর্বাদী স্পর্শ। প্রয়াণের আগে প্রিয় নিবেদিতাকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিলেন। হাত ধুয়ে দিয়েছিলেন। সেই সব ঘটনার অকপট মালিন্যহীন বিবরণ আমরা পেয়েছি। এ সম্ভব হয়েছিল বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা দু’জনে দু’জনকে শ্রদ্ধা করতেন বলেই। তাঁরা জানতেন তাঁদের মধ্যে ‘কোন বন্ধন নেই।’ 

১৯০২ সালে বিবেকানন্দের  প্রয়াণ হল। তাঁর প্রয়াণে গভীর বেদনা পেলেন নিবেদিতা। কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে ফুলে গেল দুই চোখ। কিন্তু সেখানেই আটকে গেলেন না তিনি। তাঁর সামনে তখন অনেক কাজ। যে কাজ স্বামীজি শুরু করেছিলেন, তা যতটা সম্ভব এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আত্মপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির সীমায় আটকে থাকার সময় এ নয়, জাগতিক প্রীতির জন্য নিষ্কাম কর্মে আত্মনিবেদন করলেন তিনি। স্বামীজির সঙ্গে ইংল্যন্ডে তাঁর যখন দেখা হয়েছিল তখন ভেঙে গেছে তাঁর দ্বিতীয় প্রণয়। সেই ভাঙা-ভালোবাসার অকূলে আর এক অন্যরকম ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। সে ভালোবাসাতে উন্মত্ততা আছে কিন্তু বন্ধন নেই– সেই বন্ধনহীন উন্মত্ততা নিজেকে সম্প্রসারিত করার শক্তি প্রদান করে, সেই শক্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছিল অন্য এক দেশ। তার নাম ভারতবর্ষ।  

বিশ্বজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭৮-এ, কলকাতায়। রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়ায় স্কুলজীবন কাটিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশুনো। উভয় পর্যায়েই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। বর্তমানে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ: স্বদেশে সমকালে’, ‘সচলতার গান’, ‘সব প্রবন্ধ রাজনৈতিক’। এর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তগদ্যের বই ‘ঘটিপুরুষ’, ‘অন্দরবেলা’ ও ‘ইস্কুলগাথা’ এবং পদ্যের বই ‘বিচ্ছেদ প্রস্তাব’ ও ‘গেরস্থালির পদ্য’। ‘ঘটিপুরুষ’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন নীলাঞ্জনা সেন স্মৃতি পুরস্কার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *