আজ পিৎজ়ার গল্প।

হাত বাড়ালেই যেটা কিনতে পাওয়া যায়, আর তৈরিও করা যায়। যা নিয়ে বিশেষ করে বাচ্চাদের উৎসাহের শেষ নেই..

একটু সবজি খাওয়ানো আর ঘরের ক্ষুদেটিকে একটু একটু অঙ্ক শেখানো। পিৎজ়ার এক অন্য ইতিহাস তো আমাদের বাড়িতেও আছে, সেও প্রায় এক যুগ হতে চলল। তখন ইস্ট আর মোজ্জারেলা চিজ়ও সহজে পেতাম না। আটা, অল্প দই একটু নুন আর মিষ্টি দিয়ে মেখে ভিজে কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হত, ঘণ্টার পর ঘণ্টাকখনও কয়েকদিন। সাওয়ারডো হিসেবে একটু পাঁউরুটি মিশিয়ে দিতাম, দিব্বি ফার্মেন্ট হয়ে যেত। 

মোজ্জারেলাও প্রায় ঘরে বানানোকাঁচা দুধ, ভিনিগার আর হ্যাঁ, থার্মোমিটার দিয়ে! একটা পিৎজ়া, তার ওপরে অনেক সবজি। সঙ্গে যা খুশি টপিং। তারপর শুরু হত গল্প.. ১২ ইঞ্চি পিৎজ়া আর ৮ ইঞ্চি পিৎজ়া, কোনটার দাম কত, আর কোনটার এরিয়া কত। তাহলে কম দামে কোনটায় বেশি পিৎজ়া হচ্ছে? আহা অঙ্ক কষার কি উৎসাহ !

মেপে টেপে নেবার পর কাটতে কাটতে এলো পাই (π) এর গল্প। ব্যাবিলন ইজিপ্ট ঘুরে আরকিমিদিসের কাছে… পাই এর ভ্যালু বের করতে গিয়ে আরকিমিদিস এক মনে সার্কেল আঁকছিলেন, আর রোমান সৈন্য এল তাঁকে মারতে। মগ্ন বিজ্ঞানী বলে উঠলেন, “Nōlī turbāre circulōs meōs!” ডোন্ট ডিস্টার্ব মাই সার্কল! খুন হলেন তিনি! বিজ্ঞান সাধনা আর শিক্ষার আলো তখনও ছিল রাষ্ট্রের কাছে ভয়ের! আর এই ছিল আমার বাড়ির পিৎজ়া ইতিহাস…।

পিৎজ়া, আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে কিন্তু ভীষণ আকর্ষণীয় খাবারবিশেষত বাচ্চাদের কাছে। দোকানে পাওয়া তো যায় হাত বাড়ালেই, কিন্তু বাড়ির স্বাস্থ্যকর পিৎজ়ার কোনও তুলনাই হয়না! স্বাদ? জোর দিয়ে বলতে পারি, ঠিকঠাক বেক করলে আর একটু মোজ্জারেলা বেশি করে দিলে বাইরে খেতে ইচ্ছেও করবে না…

Homemade Prawn Pizza
ঘরে বানানো চিংড়ির পিৎজ়া

যে পিৎজ়ার উৎস গরিব মানুষের খাবার হিসেবে, সেই পিৎজ়া আজ বহুজাতিক কোম্পানির হাত থেকে প্রচুর দামে কিনব কেন! হ্যাঁ। পিৎজ়ার উৎস বহু বহু আগে, খ্রিস্টপূর্বে। চ্যাপ্টা রুটির ওপরে টপিং, ওই ধর বাড়িতে মায়েরা তাড়াতাড়িতে কখনও যেরকম রুটির ওপর মাখন-চিনি, জেলি বা রাবড়ি বা এটা সেটা ইন্টারেস্টিং কিছু মাখিয়ে খেতে দিয়ে দিত, সৈন্যরাও সেরকম ফ্ল্যাট রুটির ওপর খেজুর আর চিজ দিয়ে খেত। 

তবে এখনকার পিৎজ়ার উৎস বলা হয় নেপলস-এ। বহুদিন ধরে পিৎজ়া ছিল এক্কেবারে গরিব মানুষের খাবার। নাক উঁচু বড়লোকদের রান্নাঘরে তার স্থান ছিল নাআমেরিকানরা টমেটো নিয়ে এল ইউরোপে, আর গরিবের রুটির সঙ্গে মিশে গেল টমেটো, চিজ, অরিগ্যানো, বেসিল, রসুন। ওহ আর সেই দামি দামি পিৎজ়াগুলো, ক্যাভিয়ার, স্টিল্টন চিজ, ব্ল্যাক স্কুইড ইনক, এডিবল গোল্ড আর কি কি না দামি জিনিস সব দিয়ে! আর সেই ৭৭ লাখ টাকায় ‘লুই ত্রয়োদশ’ পিৎজ়া! ভাবা যায়!!

সব চেয়ে মজার কথা, পিৎজ়ার মিষ্টি ভার্সনটাই কিন্তু আগে জনপ্রিয় ছিল, আর নোনতা ভার্সন ছিল পিৎজ়ার চেয়েও বেশি, স্কিয়াচাটাহ রুটির মতন। Savoury পিৎজ়া এল তার পরে। আর দামি পিৎজ়া তো আরও পরে। তারপর এই তো ২০০০ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ পিৎজ়া দিবসও হয়ে গেল!

Prawn and Chicken Tikka Pizza
হাতে বানানো চিংড়ি আর চিকেন টিক্কা পিৎজ়া

তাহলে, ২০১৩ সালে মহাকাশে যদি পিৎজ়া বানানো যায়, কয়েকটা মধ্যবিত্তের মিষ্টি আর নোনতা পিৎজ়া ঘরে বানাতে পারি না? চটপট ঘরে বানানো ডো থেকে শুরু করা যাক। তারপর সেখান থেকে অন্য কোনওদিন চলে যাব পিৎজ়ার সমগোত্রীয় লেবানিজ মানৌশ আর টার্কিশ লাহমাজুন-এ। রুটির দ্বিতীয় গল্পে…। 

এই রুটির ওপর নানান টপিং, ভূমধ্যসাগরের চারপাশ জুড়ে প্রায় একইরকম খাবার৷ তবে কার কখন ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে! শুধু নেপলস থেকে আমেরিকা উড়ে বিশ্ব জুড়ে বসলো পিৎজ়া!

ডো বানাতে

*ইস্ট থাকলে এক বড়ো চামচ ইস্ট, ঈষদুষ্ণ জলে অল্প চিনি দিয়ে গুলে অ্যাক্টিভেট করতে দিতে হবে। 
* সেটা দিয়ে ময়দা ( স্বাস্থ্যকর অপশনে আটা) এক কাপ মেখে নিতে হবেদিয়ে ভিজে কাপড় জড়িয়ে ঢেকে রেখে ফুলতে দিতে হবে।
* প্রায় দ্বিগুণ হলে, আবার একবার মেখে নিতে হবে।

ব্যাস, পিৎজ়া বেস রেডি!

Prawn Pizza before baking
আভেনে ঢোকানোর আগে চিংড়ি পিৎজ়া

ইস্ট না থাকলে, দই দিয়ে এক কাপ ময়দা মাখা হবে, সঙ্গে অল্প বেকিং পাউডার আর চিনি আর অল্প নুন। অথবা পাঁউরুটির টুকরো থাকলে সেটা দিয়েও মেখে ভিজে কাপড় জড়িয়ে ফারমেন্ট করতে দেওয়া যেতে পারে। যাই হোক, ডো বানিয়ে গোল করে ৮ বা ১২ ইঞ্চি ডায়ামিটার মাপে বেলে নিতে হবে ১/৪ ইঞ্চি মোটা করে।

পিৎজ়া সস: ( নোনতা পিৎজ়ার জন্যে)

চারটে টমেটো একটু ফুটন্ত জলে ব্লানচ করে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে পেস্ট করে নিতে হবে। তারপর কড়াইতে সাদা তেল/ অলিভ অয়েল দিয়ে ৪-৫ টা রসুন কুচি আর পাপ্রিকা কুচি ফোড়ন দিয়ে টমেটো পেস্ট মিশিয়ে দাও, প্রয়োজন মত নুন মিষ্টি আর গাঢ় হয়ে আসার আগে অল্প টমেটো সস মিশিয়ে নামিয়ে ঠান্ডা হোক…

সস রেডি!

পিৎজ়া বেসে প্রথমে পিৎজ়া সস, তারপর ইচ্ছে মত টপিং দিয়ে, (চিংড়ি, সসেজ, চিকেন, বা সবজি ) ওপরে মোজ্জারেল্লা চিজ় গ্রেট করে, মিক্সড হার্ব আর টাটকা বেসিল ছড়িয়ে ২০০ –২২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ১৫-২০ মিনিট বেক করে গরম গরম খাও…

আর মিষ্টি পিৎজ়ার জন্যে

ওই পিৎজ়া বেসটা একটু পাতলা করে বেলে ৭-১০ মিনিট বেক করে পিৎজ়া কাটার দিয়ে টুকরো করে নাও। তারপর ওপরে পিনাট বাটার দিয়ে কুচোনো ফল আর বাদাম দিয়ে সাজিয়ে দিলেই হল…

Sweet Pizza with chocolate and Peanut Butter
দু’রকমের মিষ্টি পিৎজ়া। বাঁয়ে ফল আর পিনাট বাটার টপিং দিয়ে, ডাইনে চকোলেট টপিং দিয়ে

মিষ্টি পিৎজ়া নানান রকম হতে পারে, পিনাট বাটারের ওপর হরেকরকম চকোলেট আর হরেকরকম বাদাম দিয়ে। আমি দু’রকম বানিয়ে ছবি দিলাম…

বাকি নোনতা হোক আর মিষ্টি, একটু ব্যাকরণ টা ঠিক রেখে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যে যেরকম করবে রচনা!

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *