ওয়াশিংটনে রবিশঙ্কর

তখন সদ্য ওয়াশিংটনে গিয়েছি ভয়েস অফ আমেরিকার ব্রডকাস্টার-রিপোর্টার হয়ে। মাসকয়েক পরেই গ্রীষ্মকালে শুরু হল ভারত উৎসব। পুরো একবছর ধরে সে এক হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার! 

ইন্দিরা গান্ধীর শোচনীয় মৃত্যুর পর তখন সবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন রাজীব গান্ধী। তিনি এলেন ভারত উৎসব উদ্বোধন করতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেতার বাজাবেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। আমি ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগ থেকে দায়িত্ব পেলাম সেই উৎসবের খবর করার।

দায়িত্ব তো পেলাম, কিন্তু রাজীব গান্ধী তখন ভারতের নবীনতম প্রধানমন্ত্রী মাসকয়েক আগে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছে শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে। ফলে আমেরিকার সরকার কোনওরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। তার ওপর সিক্রেট সার্ভিসের কাছে গোপন খবর ছিল, ক্যানাডা থেকে কিছু খালিস্তানি নাকি ওয়াশিংটনে ঢুকেছে। ফলে আষ্টেপৃষ্ঠে নিরাপত্তার মোড়কে রাজীব গান্ধীকে ঘিরে রাখা হয়েছে। কলকাতায় কোথাও রিপোর্টিং করতে গেলে আনন্দবাজারথেকে আসছি, বললে আলাদা খাতির। আর খোদ আমেরিকাতেই কেউ ভয়েস অফ আমেরিকা কী, জানে না। আমি পরিচয় দিতেই বলে কিনা, ‘হোয়াট? বয়েজ অফ আমেরিকা?‘ 

কিন্তু আমাকে তো খবর করতেই হবে! হাজির হলাম ওয়াশিংটনের যে হোটেলে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের রাখা হয়েছিল, সেখানে। আমার সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি যাঁর কাছে, সেই অমিতাভ চৌধুরী (তখন আনন্দবাজার ছেড়ে যুগান্তরে), আনন্দবাজারের দিল্লি অফিস থেকে গিয়েছেন ব্যুরো চিফ সুনীত ঘোষ, টেলিগ্রাফ থেকে এম জে আকবর, লন্ডন অফিস থেকে অমিত রায়। এ ছাড়া আরও অনেকেই ছিলেন ভারতের নানা জায়গা থেকে। 

অমিতাভ চৌধুরী, আমাদের অমিতদা তো আমাকে দেখে মহাখুশি। ওঁদের সব প্রেস ব্রিফিংয়ের দায়িত্ব তখন রাজীবের কাছের লোক মণিশঙ্কর আইয়ারের ওপর। আমার সেখানে প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা নয়। আমি ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’র স্থানীয় রিপোর্টার, আর ওঁরা এসেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে। কিন্তু অমিতদা আমাকে একেবারে তাঁর পক্ষপুটে টেনে নিলেন। বললেন, “তোমার ভিওএ-র কার্ডটা পকেটে রেখে দাও। এখন তুমি আমাদের সঙ্গে আছ।” সহজেই মিশে গেলাম ওঁদের মধ্যে। মণিশঙ্কর আইয়ার যা যা কিছু বলছেন, আমি সব নোট করে নিচ্ছি। 

national-gallery-of-art-east-building-main-exterior
ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্ট

এরই মধ্যে জানা গেল, দুপুরে রাজীব গান্ধী যাবেন ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্টসে ভারতীয় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে চলে গেলাম এবং আমাকে দেখে যথারীতি পুলিশ আটকে দিল। হোটেলে ভারতীয় সাংবাদিকদের অনেকের মধ্যে আমাকে আলাদা করা যায়নি। কিন্তু অনুষ্ঠানে ঢোকার জন্য নামে নামে যে সরকারি কার্ড দেওয়া হয়েছে, তা তো পাইনি। মহা মুশকিল! খবর না করলেই না, অথচ ঢুকতে পারছি না। অমিতদারা ভেতরে কোথাও রয়েছেন। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই।

কী করব ভাবছি! শুকনো মুখে গ্যালারির সামনে ঘুরঘুর করছি। হঠাৎ দেখি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন অতি পরিচিত চেহারার একজন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর! ওঁকে দেখে আমার হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। তাড়াতাড়ি গিয়ে কোনওমতে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম,
রাজীব গান্ধী ভেতরে রয়েছেন, কিন্তু আমাকে তো যেতে দিচ্ছে না! ওখানে কী হল আপনি যদি একটু বলেন!
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
আমি তো বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। আমাকে এখনই একটু হোটেলে যেতে হবে। তো তুমি আমার সঙ্গে চল হোটেলে, আমি তোমাকে বলব।
আমি বললাম,
আমাকে এক্ষুনি আমার অফিস ভয়েস অফ আমেরিকায় গিয়ে খবরটা করে দিতে হবে। যদি কিছুক্ষণ পরে আপনার কাছে গিয়ে দেখা করি! আপাতত শুধু ভেতরে কী হল সেটুকু আমাকে বলে দিন। 

 

আরও পড়ুন: অন্বেষা দত্তের ছোটগল্প: জোড়াতালি

 

ওঁর জন্য লম্বা কালো লিমুজিনের দরজা খুলে ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার অপেক্ষা করছেন। রবিশঙ্করজি ওরই মধ্যে আমাকে সংক্ষেপে কী হয়েছে ভেতরে, বলে দিলেন। তখন আমার খেতে পেলে শুতে চায় অবস্থা। এর পরের আবদার,
আপনার একটা ইন্টারভিউ..! 
উনি বললেন,
আমি হোটেলে যাচ্ছি। তুমি কাজ সেরে বিকেলে চলে এস। তখন কথা বলব। হোটেলে পৌঁছে রিসেপশন থেকে আমাকে একটা ফোন কোরো। 
– কোন হোটেল
– ওয়াটারগেট। 

সেই ওয়াটারগেট! ইতিহাসের পাতায় যার নাম উঠে গিয়েছে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জন্য। আড়িপাতা কাণ্ড ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি! যা ফাঁস করেছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের দুজন রিপোর্টার, যার জেরে নিক্সনকে বিদায় নিতে হল, যা নিয়ে অস্কার পাওয়া ছবি অল দা প্রেসিডেন্টস মেনহল। দুই রিপোর্টারের ভূমিকায় ছিলেন রবার্ট রেডফোর্ড আর ডাস্টিন হফম্যান। মুহূর্তের মধ্যে কত কথা মাথায় এসে গেল! 

watergate-complex
পোটোম্যাক নদীর ধারে বিখ্যাত ওয়াটারগেট হোটেল

রবিশঙ্করের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার পাব! আনন্দে উড়তে উড়তে অফিসে গেলাম। গ্যালারি অফ আর্টস থেকে অফিস হাঁটাপথে মিনিট পাঁচ-সাত। খবরটা কোনওমতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলাম ওয়াটারগেট। অফিস থেকে আমার বাড়িও হাঁটাপথে। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরনোর সময় ছিল না। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। 

হোটেলটা কোথায় জানতাম, কিন্তু ঠিক কোন জায়গা দিয়ে ঢুকব জানা ছিল না। পোটোম্যাক নদীর ধার দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ দেখি বড় একটা বাড়ি। মনে হলো এটাই হবে। আমার আগে আগে একজন পুলিশ সার্জেন্ট মোটরসাইকেলে করে যেতে যেতে একটা বাঁকের মাথায় শোঁ করে বাইক ঘুরিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আমিও তাঁর পিছু পিছু ঢুকে গেলাম।

 

আরও পড়ুন: শ্যামলী আচার্যের ছোটগল্প: লাল ঘুড়ি

 

উনি আমাকে দেখে অবাক
আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন?
ঠিক পিছু নিইনি। আমি ওয়াটারগেট হোটেলে যাব। কিন্তু হোটেলের এন্ট্রান্সটা চিনি না। ভাবলাম যে, আপনি বুঝি হোটেলের পার্কিংয়ে ঢুকলেন, তাই আমিও ঢুকলাম।

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক মোটামুটি বিশ্বাস করলেন, ভাগ্য ভাল! দেখিয়ে দিলেন, ওখান থেকে আর একটু এগোলেই ওয়াটারগেট। সতর্ক করে দিয়ে বললেন,
পুলিশের পেছনে আর ফলো করবেন না। ঝামেলা হতে পারে। 
তা আর বলতে! থ্যাঙ্ক ইউ!

বিলাসবহুল হোটেল, বিশাল ব্যাপার। রিসেপশনে রবিশঙ্করজির নাম বলতেই শশব্যস্তে রিসেপশনিস্ট ফোনে ধরিয়ে দিলেন। লিফটে করে উঠে ওঁর ঘরের সামনে যেতেই দেখি, দরজা খুলে উনি অপেক্ষা করছেন। কী সুন্দর দেখতে লাগছিল! আমাকে দেখে উনি খুব বিচলিত।
– তোমাকে এ রকম শুকনো লাগছে কেন? বললাম,
আমার আসলে অসম্ভব কাহিল অবস্থা। আপনার সঙ্গে দেখা করে অফিসে গিয়ে কোনওমতে রিপোর্ট লিখে সেটা রেকর্ড করে এখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। গলা শুকিয়ে গেছে।উনি বললেন,
ফ্রিজে কিছু আছে কিনা দেখ তো?
ঘরের মধ্যে ছোট একটা ফ্রিজতার থেকে একটা সেভেন আপ-এর ক্যান খুলে চমুক দিলাম। একটু যেন ঠান্ডা হল শরীরটা। বিশাল স্যুইট, দুটো বিছানার একটায় উনি শোন, অন্যটার ওপরে যত্ন করে শুইয়ে রেখেছেন ওঁর সেতার। জানালার ধারে সোফায় বসে কথাবার্তা শুরু হল। পণ্ডিতজি স্নেহভরে আমাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছেন। কলকাতার কথা, ওয়াশিংটনে এসে কেমন লাগছে, সে কথা! মিনিট কুড়ি আমাকে সময় দিয়েছিলেন। দেখলাম, দশ মিনিট তো এতেই পার হয়ে গেল। বললাম,
আমরা ইন্টারভিউ শুরু করি? উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
হ্যাঁ হ্যাঁ! আরে, তোমাকে পেয়ে একটু দেশের কথা মনে হচ্ছিল। নাও, শুরু কর।

আমি: বিদেশের সঙ্গে, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ তো বহুকাল হয়ে গেল! 
রবিশঙ্কর: হ্যাঁ। দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে যতবার এসেছি তা নিয়ে ধর বছর পঞ্চান্ন তো হল! আর আমি নিজে এখানে যাতায়াত করছি বছর তিরিশেক ধরে।
আমি: এই যে পাশ্চাত্য দেশে ভারতীয় সঙ্গীতকে এই পর্যায়ে তুলে ধরেছেন, সেটা কীভাবে সম্ভব হল?
রবিশঙ্কর: দেখো, এ দেশের বা ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে কিছু লোক ভারতের গান বাজনা শুনতে ভালবাসতেন আগে থেকেই। কিন্তু এই মাপের আগ্রহ আগে কখনও ধরা পড়েনি। আমি চেষ্টা করেছি অনেকদিন ধরে। ভারতীয় সঙ্গীতকে বিদেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নানা জায়গায় বাজিয়েছি, লেকচার দিয়েছি, টেলিভিশন যখন এল, তখন তাতে সাক্ষাৎকার দিয়েছি। খুব খেটেছি তখন। সেই সময় আমি ইহুদি মেনুহিনের সঙ্গে ডুয়েট বাজিয়েছি, ডেভিড অয়েস্ট্রাখের সঙ্গে বাজিয়েছি। পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের সঙ্গীতের মিলন যাতে হয় তার চেষ্টা করেছি। সেটা ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের একটা সম্মানজনক অধ্যায়। 

 

আরও পড়ুন: বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: পশমিনা

 

আমি: আপনার ইস্ট মিটস্ ওয়েস্টঅ্যালবামটা আমার কাছে আছে। তার পরে কয়েকটা বছর তো আপনাকে নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনার জোয়ার বয়েছে! 
রবিশঙ্কর: হ্যাঁ। ১৯৬৬ সালে জর্জ হ্যারিসন যখন আমার ছাত্র হল, তখন একটা ভীষণ আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। তবে এটা হয়েছিল মুলত ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে। তারা তো আগে আমার বাজনা শুনতে আসত না! যখন আসা শুরু করল, তখন একেবারে বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো। বড় বড় হলগুলোতে কুলোত না। আমাকে বাজাতে হতো স্টেডিয়ামে, এরিনায়, এই সবে। তবে বোঝা গেল, ওটা ছিল একটা ফ্যাড, হুজুগ। ওরা রক কনসার্ট শোনার মেজাজে আসত। ড্রাগ, ম্যারিহুয়ানা, এই সব নিয়ে তুরীয় অবস্থায় সেতার শুনছে। সিটি মারছে, হুল্লোড় করছে!

Rajiv and Sonia Gandhi with Ronald Regon
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, সঙ্গে সনিয়া গান্ধী। হোয়াইট হাউসে তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ও ন্যান্সি রেগান

আমি: অনেকটা উডস্টক রক ফেস্টিভ্যালের মতো! এ সবের মধ্যে আপনি বাজাতেন কী ভাবে?
রবিশঙ্কর: খুবই অসুবিধা হত। অবশ্য ওদের পুরো দোষ নেই। সময়টাই ছিল অন্যরকম। তরুণ প্রজন্ম তখন ফ্রাস্ট্রেটেড। ভিয়েতনাম টিয়েতনাম, হিপি মুভমেন্ট, সবমিলিয়ে। ওরা আমাকে কাল্ট গুরু বানিয়ে ফেলল। কিন্তু ক্লাসিকাল মিউজিক শোনার জন্য যে শ্রদ্ধা দরকার, সেটা ওদের মধ্যে ছিল না। সিরিয়াস শ্রোতারা তখন পেছনে চলে গেছে। আমি ওদের বোঝালাম, ভারতীয় সঙ্গীত শ্রদ্ধা সহকারে শুনতে হয়। হট্টগোল, চেঁচামেচি, এভাবে ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনা যায় না। এইসব বলার পর আস্তে আস্তে দেখলাম ওই ভিড়টা কমে গেল। তখন যারা রইল, তারা কিন্তু একেবারে খাঁটি। 
আমি: কনরাড রুক্সের প্রথম ছবি চাপাকুয়াতে আপনি সুর দিয়েছিলেন। ছবিটা ছিল একজন ড্রাগ অ্যাডিকটের (রুক্স নিজে) নেশা ছাড়ানোর ব্যাপারে। খুব কঠিন, প্রায় অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিল্ম ছিল সেটা। এ ছাড়া আর কোনও.. 
রবিশঙ্কর: ‘চাপাকুয়াহয়েছিল ওই ১৯৬৬-তেই। তা ছাড়াও হলিউডের আর একটা ছবিতে সুর দিয়েছিলাম, ‘চার্লি। পশ্চিমের আরও ছবিতে কাজ করেছি আমি। অ্যাটেনবরোর গান্ধীযেমন। সবাই খুশি হয়েছে হয়তো, কিন্তু আমি হতে পারিনি। ব্যাপারটা কী জানো? আমাদের মতো কনসার্ট-আর্টিস্টদের সব সময় খালি ঘুরে বেড়াতে হয়। আজ এখানে, কাল ওখানে অনুষ্ঠান থাকে। ফলে কোনও ছবিতে সুর দিতে হলে যতটা সময় দিতে হয়, ততটা দেওয়া সম্ভব হয় না। সত্যজিৎবাবু যেমন বলতেন, ‘আপনি তো খালি চাকা আর পাখার উপরে আছেন!‘ (হাসি) তো ও ভাবে কাজ করে ঠিক মন ভরে না। আমি হয়তো আমার সাধ্যমতো সুর দিলাম, কিন্তু তার পরেও তো কাজ থাকে! পরিচালকের সঙ্গে, এডিটরের সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালককে বসতে হয়। হিট অ্যান্ড রান-এ আমি বিশ্বাস করি না। তাই আজকাল অনেক অফার এলেও নিই না।

ইন্টারভিউ শেষ হল। কুড়ি মিনিটকে তুড়ি মেরে ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলেছে আমাদের কথা। বললাম,
রাত হয়ে গেল। আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত করলাম। এ বার তা হলে আসি?
পণ্ডিতজি বললেন,
আমি তো বিশ্রামেই আছি। কালকে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাজাতে হবে, ওই একটু রেয়াজ করে নেব সকালে উঠে। তুমি কিন্তু সাবধানে যেও। খুব ক্লান্ত রয়েছ। 
এমন মমতার সঙ্গে এ কথা বলছেন ওরকম একজন মানুষ আমার মতো সাধারন একজন রিপোর্টারকে! আমার কেমন যেন ভাবতে অদ্ভুত লাগছিল। আর অসম্ভব ভাললাগায় মন আচ্ছন্ন হয়েছিল। একবার খুব মনে হয়েছিল বলি, কলকাতায় আপনার সেতারের অনুষ্ঠান কত শুনেছি! কাল এখানে জন এফ কেনেডি সেন্টারে বাজাবেন, শুনতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। একটা কার্ড পাওয়া যাবে? কিন্তু এতই লজ্জা লাগছিল, শেষ পর্যন্ত বলে আর উঠতে পারলাম না। প্রণাম করলাম। উনি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আমাকে হাত নেড়ে বিদায় দিলেন। 

বাড়ি ফিরলাম হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পোটোম্যাক নদী। তার পাড়ে কেনেডি সেন্টার ঝলমল করছে। আগামীকাল ওখানে ভারত উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার! শোনা হল না। কিন্তু যা হল, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।

Kennedy_Center_seen_from_the_Potomac_River,_June_2010
এই কেনেডি সেন্টারেই হয়েছিল সেদিনের ভারত উৎসব

পরদিন দুপুরবেলা অমিতাভ চৌধুরী আর সুনীত ঘোষ দাদারা আমাদের বাড়িতে খেতে এলেন। আমার স্ত্রী বাঙালি খাবার রান্না করেছে। খেতে খেতে ওই ইন্টারভিউয়ের কথা বলছিলাম। অমিতদা বললেন,
রবিশঙ্করের সঙ্গে তো অনেক কথাই হল। একবারও ওঁকে তোমাদের বাড়িতে খেতে আসতে বলতে পারলে না
আমি হতবাক!
– রবিশঙ্করকে আমাদের বাড়িতে এসে খেতে বলব! বলছেন কী অমিতদা
আরে, উনি তো এ সব খাবার পান না! হোটেলের খাবার খেতে খেতে মুখে অরুচি হয়ে গেছে। আমাকে বলেছেন সে কথা। রাজি হয়ে যেতেন হয়তো! 
তখন আর এক দুঃখে পড়লাম আমি। ইশ্…. এ কথাটা আগে জানলে তো বলেই দেখতাম! বলা যায় না, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে হয়তো ছিঁড়ত। যে রকম স্নেহের সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেনআমাদের বাড়িতে বাঙালি মাছের ঝোল ভাত খেতে ডাকলে হয়তো আসতেন! 

এই দুঃখ আমার আজও যায়নি। 

 

ছবি সৌজন্য: আন্তর্জাল থেকে

Dipankar Chakraborty

দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *