পত্রের লিখন ধূলিতে মিশে যায় না আজকাল, আখরগুলি হারিয়ে যায় না ইন্টারনেটে। কিন্তু মানুষ কাজের জায়গা ছাড়া আর কোথাও, কোনও চিঠি লেখে কি? সেই প্রয়োজনও অনেকখানি মিটে যায় ইমেল মারফত। হাল্কা হয়েছে ডাকবিভাগের কাজের বোঝা। ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকের ঝোলা পিঠে রাতের আঁধারে গ্রামের পথে রানার ছুটে বেড়ায় না। ইমেল ছাড়াও যোগাযোগ ঘটে হোয়াটস্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি ইনবক্সের আলাপে। কাগজে কলমে আঙুলের স্পর্শে চিঠিতে মনের কথা কে লেখে এখন? অথচ চিঠিকে আশ্রয় করে একসময় উচ্চমানের সাহিত্য রচিত হয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিঠিটাই হয়ে উঠেছে সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ব্যক্তিগত চিঠি অথবা ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রবন্ধধর্মী লেখা শুধুই সাহিত্যমূল্যে অনন্য এমন নয়, তা ঐতিহাসিক দলিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’তে প্রতিটি সর্গ এক একটি চিঠি তথা কবিতা। বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে পত্রের অবতারণা করেছেন কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ চিঠির প্রয়োজন শুধু দুটি মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেই ফুরিয়ে যায়নি, বরঞ্চ অন্য মাত্রার ব্যাপ্তিতে ঠাঁই পেয়েছে। এমনকী গোটা উপন্যাস লেখা হয়েছে শুধুমাত্র চিঠি জুড়ে জুড়ে, কোনও সহায়ক ভাষ্য কিম্বা বর্ণনা ছাড়াই। ‘পত্রোপন্যাস’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে বাংলা শব্দভাণ্ডারে।
পাশ্চাত্য সাহিত্যে পত্রোপন্যাস বহুকাল আগে অবতীর্ণ হয়েছে। স্প্যানিশ ভাষায় দিয়েগো দে সান পেদ্রো ১৪৯২ সালে লিখে ফেলেছেন ‘প্রিজন অফ লাভ’ (Cárcel de amor)। ইংরেজিতে আফ্রা বেন রচিত ‘লাভ লেটারস বিটুইন আ নোবলম্যান অ্যান্ড হিজ় সিস্টার’ সপ্তদশ শতকে লেখা হলেও কেবলমাত্র পত্রনির্মিত নয়, সহায়ক ভাষ্য উপস্থিত। অষ্টাদশ শতকে স্যামুয়েল রিচার্ডসন রচিত ‘পামেলা’ বিশেষ জনপ্রিয় হয়।
বাংলা ভাষায় পত্রোপন্যাস বেশি লেখা হয়নি, কিন্তু যেটুকু লেখা হয়েছে, বেশিরভাগই জনপ্রিয় হয়েছে। কারণ, সাধারণত বন্ধ লেফাফার কৌতূহল মানুষকে টানে। চিঠি যদি হয় প্রেমপত্র, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। অন্যের চিঠি কিম্বা প্রেমপত্র, খাম খুলে পড়বার ইচ্ছে হয়নি, এমন মানুষ বিরল। ভদ্রতাবোধে হয়তো মানুষ সেটা করে না। মানুষের এই সহজাত কৌতূহলই হল পত্রোপন্যাসগুলির সার্থকতার কারণ। পত্রের মাধ্যমে যখন উত্তম পুরুষে ব্যক্ত হয় কাহিনির নায়ক কিম্বা নায়িকার একান্ত সংলাপ, সেই ‘আমি’র অনুভবের একাত্মতায় ঘনিয়ে ওঠে পত্রোপন্যাসের রসায়ন। পাঠক স্বয়ং হয়ে ওঠেন উপন্যাসের যাত্রাপথিক।

১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় বাংলায় প্রথম পত্রোপন্যাস ‘বসন্তকুমারের পত্র’। লেখক নটেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাষা যুগোপযোগী হলেও ভাব অত্যন্ত আধুনিক এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি। যদিও প্রেমাস্পদরা এখানে পরস্পরকে চিঠি আদানপ্রদান করছেন না। কাহিনির নায়ক বসন্তকুমার চিঠি লিখে ঘটনাপরম্পরা জানাচ্ছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হরকুমারকে। হরকুমারের উত্তর দেওয়া চিঠিগুলিতে কিছু সুহৃদসুলভ উপদেশ এবং ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যেগুলো কাহিনির মূল স্রোতে বিশেষ অবদান রাখে না। মূল কাহিনিসূত্র বিবৃত হয় বসন্তকুমারের চিঠিতেই। উপন্যাসের শেষদিকে বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তির আগে ব্যর্থ প্রেমিকা নীলাব্জিকার চিঠি দেখতে পাই। সম্পূর্ণ কাহিনিতে সে বসন্তকুমারকে আর কোনও চিঠি লেখেনি। উপন্যাসের ভাষা, বাক্যের গঠনবিন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব বেশ প্রকট। তবুও বাংলা ভাষার প্রথম পত্রোপন্যাস হিসেবে ‘বসন্তকুমারের চিঠি’ অগ্রাহ্য করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ ছোটগল্পে আমরা দেখি মূল চরিত্র মৃণাল তার স্বামীকে কেবলমাত্র একখানি দীর্ঘ চিঠি লিখেছে। আরও অনেক চরিত্র থাকলেও তাদের সঙ্গে চিঠির আদানপ্রদান এখানে নেই। গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাহিনির বিস্তার উপন্যাসের নয়, ছোটগল্পের। ভাষার বলিষ্ঠ প্রয়োগ এবং আধুনিক চলনের জন্য ‘স্ত্রীর পত্র’ বর্তমান সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক। সংসারে নারীর প্রতি হয়ে চলা অবিচারের প্রতিবাদ হিসেবে এই লেখা পাঠকের মনে স্থায়ী আসন নির্মাণ করে নিয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের পত্রোপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। নজরুল-বিশেষজ্ঞ অনেকের মতে এই উপন্যাস আত্মজৈবনিক। উপন্যাসের নায়ক নুরুল হুদার গানপাগল কবিস্বভাবের সঙ্গে ব্যক্তি নজরুলের আশ্চর্য মিল। এমনকী সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনা, সবকিছুই ব্যক্তি নজরুল এবং উপন্যাসের নায়ক নুরুল হুদা দু’জনের সঙ্গেই ঘটেছিল। এই উপন্যাসে নুরুল হুদা বেশি চিঠি লিখলেও, অন্যান্য সব চরিত্রই কমবেশি লিখছে। চিঠির মধ্য দিয়ে উঠে আসে অতীতের ঘটনার সূত্র। জানা যায়, যে প্রেম থাকা সত্ত্বেও মাহবুবার সঙ্গে বিয়ের আগেই নুরুল বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় এবং মাহবুবার জীবনে অভিশাপ নেমে আসে।
প্রেমের অভিশাপই কি উপন্যাসের অন্তর্লীন সুর? নাকি চিঠিতে চিঠিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ভৌগোলিক দুরত্ব মুছে গেলেও দুটি মানুষের মনের দুরত্ব মুছে না যাওয়ার বিষাদের উপলব্ধি ধরা পড়েছে? ভুললে চলবে না যে ‘বাঁধনহারা’ নজরুলের প্রথম উপন্যাস। পত্রোপন্যাসের কাঠামো যথাযথ থাকলেও ঘটনাপ্রবাহের গতি কোথাও কোথাও মন্থর বলে বোধ হয়। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির সময়ের প্রতিফলন এবং সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী বক্তব্য, এইসব বিভিন্ন কারণে এই উপন্যাস মানুষের মনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।
প্রায় সত্তর বছর আগের লেখা পত্রোপন্যাস ‘ক্রৌঞ্চমিথুন’ দুই সখি- ইন্দ্রাণী আর পারুলের চিঠি জুড়ে জুড়ে নির্মিত। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই উপন্যাসে দুই সখি চিঠিতে লিখে পরস্পরকে জানায় নিজেদের বিবাহ-পরবর্তী জীবনের কথা। এই উপন্যাসের বক্তব্য বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা হারালেও, সেইসময়ে সাধারণ পাঠককূলে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
বনফুল রচিত ‘কষ্টিপাথর’ পত্রোপন্যাসও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য এবং ঘটনার ঘনঘটা সবকিছুই মুন্সিয়ানার সঙ্গে উপস্থাপিত। প্রধান চরিত্র অসিত চিঠি লেখে স্ত্রী হাসিকে। অসিত ছাড়াও বিভিন্ন চরিত্র বিভিন্ন স্থান থেকে চিঠি লেখে। চিঠির ভাষার বৈচিত্র এবং ভিন্ন প্রকাশভঙ্গিমার মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণ করেন। এমনকি কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, বিস্মৃত অতীত জানাবার জন্য পুরনো চিঠির হঠাৎ আবিষ্কার এবং পাঠকের সামনে তুলে ধরার মতো নাটকীয় ঘটনা ঘটে।
প্রচুর জটিলতার শেষে অসিত এবং হাসির দাম্পত্যজীবনে ঘনিয়ে আসা বিচ্ছেদের মেঘ কেটে গিয়ে এক মিলনান্তক উপসংহার পাঠককে স্বস্তি দেয়। এই উপন্যাসে অনেকেই বনফুলের নিজের জীবনের ছায়া দেখতে পান। কারণ বনফুল চিকিৎসক, এবং কাহিনির নায়ক অসিতও ডাক্তারির ছাত্র। বনফুল নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে স্ত্রী লীলাবতীকে লেখা বিবাহ-পরবর্তী সময়ের প্রেমপত্রগুলি, যেগুলি তাঁর স্ত্রী খুব যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলি দেখেই ‘কষ্টিপাথর’ উপন্যাস লিখবার ভাবনা আসে তাঁর মাথায়।
বাংলা ভাষায় কেবলমাত্র নারীপুরুষের প্রেমকে উপজীব্য করে অথবা প্রেমপত্র সাজিয়ে পত্রোপন্যাস লেখা হয়, এরকম ভুল ধারণা ভেঙে যায় বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘পোনুর চিঠি’ পড়লে। পুরীর মন্দিরের জগন্নাথদেব, অর্থাৎ ভগবানের উদ্দেশ্যে একের পর এক চিঠি লিখে যায় সরল বালক প্রণব ওরফে পোনু। হাস্যরসসমৃদ্ধ এই উপন্যাস পাঠকের অত্যন্ত প্রিয়।

তরুণকুমার ভাদুড়ি রচিত ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল এবং সুচিত্রা সেন নায়িকা ছিলেন বলে বড় অংশের মানুষ মনে রেখেছেন, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এটি পত্রোপন্যাস। স্মৃতি রোমন্থনের ভঙ্গিতে এক সাংবাদিককে চিঠি লেখে উপন্যাসের অনাম্নী নায়িকা। সাংবাদিকও উত্তর দেয়। শুধু চিঠি নয়, সহায়ক ভাষ্য হিসেবে সাংবাদিকের ডায়রির পাতার বর্ণনাও উঠে আসে। ফলে উপন্যাসের গতি এতটুকুও ব্যাহত হয় না, বরং আলাদা মোচড় নিয়ে আসে। নায়িকার জীবনে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে ঘটনাপ্রবাহ। নায়িকা ও সাংবাদিকের মাঝে কোনও প্রেমের সম্পর্ক নেই, আছে এক ভরসাযোগ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
এই উপন্যাসে অনেকেই সাংবাদিক চরিত্রটিতে লেখকের জীবনের ছায়া দেখতে পান, কারণ তরুণকুমার ভাদুড়ি নিজেও ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক। কাহিনির বাস্তবতা নিয়ে সেই সময়ে অনেক প্রশ্ন উঠলেও বৈচিত্র এবং গঠনশৈলীর জন্য ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ পত্রোপন্যাস হিসেবে উল্লেখনীয়।
নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসটিও উৎসুক পাঠকেরা তাঁর সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল বলেই গণ্য করে। লেখক আরও একটি প্রেমের উপন্যাস ‘প্রিয়বরেষু’ লেখেন পত্রোপন্যাসের ধাঁচে। তবে ‘মেমসাহেব’ অধিক জনপ্রিয়। উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের কারণেই হয়তো বড় অংশের পাঠকমনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। নায়কের জীবনের কথা তার লেখা চিঠির মাধ্যমে উঠে আসে। পারস্পরিক চিঠির আদানপ্রদান নেই সেভাবে। ষাটের দশকের শেষদিকে ভারতবর্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তিস্তার বন্যা- ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এলেও পাঠককূল ‘মেমসাহেব’কে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস হিসেবেই মনে রাখবেন।

সন্তোষকুমার ঘোষের ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ পাঠকের বিশেষ সমাদর পেয়েছে। এখানে একটিই পত্র লিখছে উপন্যাসের নায়ক। পারস্পরিক চিঠির আদানপ্রদান অনুপস্থিত। জীবনের অনেকক্ষেত্রে কিছু নির্মম সত্য মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করতে পারে না, অথচ চিঠিতে লিখে জানালে মনের ভার হাল্কা হয়, এই চরম অনুভবের মুখোমুখি হতে পারবেন পাঠক এই উপন্যাসে। মায়ের প্রতি অন্যান্যদের এমনকী নিজের করা অবিচার, সেসবের স্বীকারোক্তিও লিখে রেখে যাচ্ছে সন্তান। কারণ সে অনুভব করছে যে হয়তো মায়ের সঙ্গে তার আর দেখা হবে না। ভুমিকায় লেখক বলছেন যে আত্মজৈবনিক চেহারা হলেও, এবং তাঁর জীবনের বেদনা ও নানা অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে গেলেও এই লেখা তাঁর জীবন নয়।
আধুনিক সময়ে পত্রোপন্যাসের আঙ্গিকে যে লেখককে আমরা বারবার লিখতে দেখি, তিনি বুদ্ধদেব গুহ। ‘মহুয়ার চিঠি’, ‘মহুল সুখার চিঠি’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ‘চানঘরে গান’- একাধিক উপন্যাস পেয়েছি আমরা তাঁর কাছ থেকে। সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় ‘সবিনয় নিবেদন’। রাজর্ষি এবং ঋতি, দু’জনের পত্রেই বিচিত্র বিষয় নিয়ে উপভোগ্য বৌদ্ধিক সংলাপ, ভারত এবং আফ্রিকার অরণ্যের রহস্যময় অন্ধকার, প্রেমের বিচিত্র গতি, সর্বোপরি মিলনান্তক উপসংহার পাঠকের মনে দোলা দিয়েছে।

‘চানঘরে গান’ অবশ্য এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, কারণ সেখানে লেখককে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি স্থান পেয়েছে। ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। যদিও লেখক নিজে ‘চানঘরে গান’কে উপন্যাসের তকমা দিতে নারাজ। ভূমিকাতেই তিনি বলেছেন এটি ‘পত্রাশ্রয়ী লেখা’ এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে ভবিষ্যতে এই ধরনের লেখার ধারা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে।
বাংলা সাহিত্যে পত্রোপন্যাসের সংখ্যা কম হলেও, মানুষে মানুষে চিঠি লিখবার প্রবণতা কমে গেলেও বর্তমান সময় এই ধারার লেখা থেকে বঞ্চিত হয়নি। তিলোত্তমা মজুমদার রচিত ‘জল ও চুমুর উপাখ্যান’ পত্রোপন্যাসে আমরা দেখি অস্থির ও অসুখী সমাজের প্রতিফলন। মেধাবী অন্নপূর্ণার জীবনের ঘাত প্রতিঘাত পাঠককে টেনে রাখবে, কাঁদাবে এবং হয়তো এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে যে বর্তমান সময় এবং সমাজ কি তাহলে নারীর প্রতি ক্রমশ নির্দয় হয়ে উঠছে? অন্নপূর্ণা কি সত্যিই পাবে প্রকৃত নিঃশর্ত প্রেমের স্বাদ? এই উপন্যাসে পাঠক একাত্ম হয়ে যেতে পারেন পুন্নি, পুলটন, ভুলাইয়ের ছোটবেলার রঙিন স্বপ্নগুলোর সঙ্গে।

সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত ‘ইতি মা’ পত্রোপন্যাসের আঙ্গিকে লেখা, খেয়ালী দস্তিদার রচিত। সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে তাকে বড় করে তোলার প্রতিদিনের কথা এক মা সন্তানকে লিখছেন চিঠির আকারে তাঁর ডায়রিতে; কখনও আনন্দ, কখনও দুঃখ, আবার কখনও আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসা অসম্পূর্ণ বাক্যে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যেই মা আশা করেন যে সন্তান একদিন এই চিঠিগুলি সন্তান পড়বে এবং জীবনে ঘটে যাওয়া ভুল বোঝাবুঝিগুলো মিটে যাবে। ‘ইতি মা’ পাঠকদের ভাল লাগবে।
বাংলা ভাষায় পত্রোপন্যাস লেখা হচ্ছে এবং জনপ্রিয় হচ্ছে, এই সত্য আসলে একাধিক অদ্ভুত প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রিয়মানুষের লেখা চিঠিতে রঙিন লেফাফায় গোলাপগন্ধী আতরের সৌরভ মেখে আসা আখরগুলি কি এখনও মানুষের মনে আবেগ সৃষ্টি করে? নাকি চটজলদি আঙুল ছুঁইয়ে লেখা এসএমএস, হোয়াটস্যাপের ঘূর্ণিঝড়ে দুর্বল হয়ে গেছে ধীরে ঘনিয়ে আসা আবেগের ঋতুকাল! ‘শ্রীচরণকমলেষু’, ‘সমীপেষু’, ‘প্রিয়তমাসু’, ‘ইতি’– এইসব শব্দগুলো কি লুপ্ত হয়ে যাবে অনাদরে? নাকি মানুষের কোনও কোষের ক্রোমোজোমের ডিএনএ-তে সযত্নে সুরক্ষিত থাকবে চিঠির লিখন দেখে উল্লসিত হওয়ার রাসায়নিক!
হয়তো সেই ক্রোমোজোমের তাগিদেই একদিন বাংলা ভাষায় ইমেল এবং ইনবক্সের চ্যাট জুড়ে জুড়ে লেখা হবে একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। নায়ক-নায়িকা ছাড়া তৃতীয় পক্ষের সহায়ক ভাষ্য হিসেবে হয়তো ফেসবুক অথবা ইনস্টাগ্রাম পোস্ট, কিম্বা ঘটনাপ্রবাহের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রোলিংয়ের স্ক্রিনশট ব্যবহার করা হবে। মিসড্ কলের রেকর্ড দেখাবে ব্যর্থ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস। পত্রলিখন ধূলি হয়ে যাবে না, বিবর্তিত হয়ে থেকে যাবে অন্য মাত্রায়, অন্য চেহারায়।
জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।