*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]

১৯৬৭ তে আমার বড়দা কল্যাণ হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে মেডিক্যালে ভর্তি হল। তার দু’বছর পর ছোড়দা উৎপল। দু’জনেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নামক জাঁতাকল উদ্ভাবনের আগে জীবন যে কী সুখের ছিল! ক্লাস ইলেভেনের পর হায়ার সেকেন্ডারি। তার ফলের ভিত্তিতে অ্যাডমিশন। বড়দা ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল, তিনটে লেটার নিয়ে। বাবা মা কোনও কারণে ভেবেছিলেন সে প্রথম দশের মধ্যে আসবে। তা হল না। বড়দার মাথায় ঠাসা বুদ্ধি, অসম্ভব চঞ্চল ও দুষ্টু, চোখের নিমেষে পড়া সেরে উঠে পড়ে। কিন্তু প্রথম সন্তান বলে হারলেও দাদা জিতে যায়। কাজেই আমি চিরকালই শুনলাম, তুমি হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হতে পার, কিন্তু কল্যাণের বুদ্ধি তোমার চেয়ে বেশি। এর পরে আর কথা চলে না। 

যাইহোক, দাদা কলকাতা মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ায় বাবা-মা খুশি। প্রথম সন্তান ডাক্তার হবে,  ডাক্তারের ফি, ওষুধের খরচ বাঁচবে, আদি ভূমিচ্যুত মধ্যবিত্ত পরিবার বহুদিন ধরে রঙিন স্বপ্ন দেখছিল। প্রিমেডিক্যাল পড়ানো হত প্রেসিডেন্সি কলেজে। দাদা সেখানে পড়াশুনোর সঙ্গে ভাঙা টব পুলিশের উপর নিক্ষেপের মতো বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল। একটাই স্বস্তি, এসব রিপোর্ট করার জন্য কোনও স্কুলের দারোয়ান ছিল না। আমরা ছোট দুই ভাইবোন ছিলাম দাদার যাবতীয় রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির মনোযোগী শ্রোতা।

ছোড়দা তার অগ্রজকে অনুসরণ করে চলেছে দু’বছর পিছনে থেকে। আলাদা স্কুলে পড়েছে এটাই রক্ষে। পুরনো বই পড়তে হয়নি। স্কুল ইউনিফর্ম আলাদা। কিন্তু যা কিছু পুনর্ব্যবহারের যোগ্য, সবই তার কাছে কালের নিয়মে চলে আসে… মেজ ছেলের এই অভিমান ছোড়দাকে ছাড়ত না। পুরনো কিন্তু ছোট হয়ে যাওয়া জামাকাপড়, সোয়েটার, প্রাণে ধরে ফেলা যায় না মধ্যবিত্ত বাড়িতে। সে সব কে পরবে, ছোড়দা ছাড়া? এ সব তবু সওয়া গিয়েছিল, কিন্তু মা জেদ ধরলেন, এত দামি দামি সব ডাক্তারি বই, কঙ্কালের হাড়, ফেলে দেব নাকি? উৎপল তুইও ডাক্তার হ’। ছোড়দা মোটেই ডাক্তার হতে চায় না। তার ওপর দুই ভাই এক কলেজে পড়ার ভয়াবহ সম্ভাবনা। বায়োলজি ছিল ফোর্থ পেপার। ৬০ নম্বর কেটে তার বাকিটা জোড়া হত টোটালে। বায়োলজি না থাকলে ডাক্তারি পড়া যাবে না, কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে অসুবিধে নেই। কাজেই বায়োলজি পরীক্ষার দিন সকালে ছোড়দার শরীর অসুস্থ। যাকে বলে ‘নো কনফিডেন্স মোশন।’ কিন্তু কম্বল নাছোড়। 

সালফাগোয়ানিডিনের বড়ি (আমাদের শৈশবের উদরাময় নিরোধক মহৌষধ) খাইয়ে ছোড়দাকে পাঠানো হল পরীক্ষা দিতে। বাবা সঙ্গে গেলেন। তাঁকে বলা হল হলের বাইরে বসে থাকতে। ছেলে মাঝপথে উঠে এলে হলে ফেরৎ পাঠাবেন। যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ গল্পের ‘ছানা যথাস্থানে পৌঁছাইতে লাগিল’-এর মতো শোনাচ্ছে? প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে ছোড়দা বেশ ভাল এবং জনদরদী ডাক্তার হয়েছিল। এবং যখনই তার কেরিয়ার বা পোস্টিংয়ে উত্তম কোনও ঘটনা ঘটেছে, মা বলে উঠেছেন, দ্যাখ তুই তো বায়োলজি পরীক্ষা দিচ্ছিলি না। আমি জোর করলাম, তাই তো ডাক্তার হলি! 

Classroom of Calcutta Medical College
দাদার মুখে অধ্যাপকদের নানা বাচনশৈলী শুনে হেসে গড়িয়ে পডতাম

তবে দাদার মতন ছোড়দার প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রিমেডিক্যাল পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। ও ভর্তি হল মৌলানা আজাদ কলেজে। যদিও এর অন্যথা হলে ফল অন্যরকম হত কিনা জানি না, প্রিমেড পরীক্ষা বার ছয়েক বাতিল হয়েছিল। ‘বুর্জোয়া পরীক্ষা ব্যবস্থা নিপাত যাক’ বলে যারা প্রতিবার এসে খাতা ছিঁড়ে দিত, তারা বিপ্লবী ছিল, না সমাজবিরোধী, তার কোনও কিনারা হয়নি। তবে বিলম্বিত পাঠক্রমের সেই উদ্বেগের দিনগুলিতে মা নিশ্চয় মনে মনে আক্ষেপ করেছিলেন, দুই ছেলেকে একইরকম লম্বা এক পড়াশুনোর মধ্যে জড়ানোর সিদ্ধান্তের। আট বছর লেগেছিল ছোড়দার ডাক্তার হতে। বাবার রিটায়ারমেন্ট নামক আশঙ্কার মেঘ নিরন্তর জড়িয়ে থাকত আমাদের সংসারের মাথায়। সেই দিক দিয়ে আট বছর বেশ দীর্ঘ সময়।

তবে দাদার কলেজে ভর্তি, মেডিক্যাল কলেজে গরম গরম ভাত-মাছের ঝোল খেয়ে যাওয়া, এবং উন্মুক্ত গবাক্ষপথে জীবনের নানা গল্প, আমার ক্লাস সেভেন আর এইটের স্কুলবন্দি জীবনে আনন্দের বসন্তবাতাস এনে দিল। দাদা খুব ভাল নকল করত। তার মুখে অধ্যাপকদের নানা বাচনশৈলী শুনে হেসে গড়িয়ে পডতাম। অন্তর্বর্তী টেস্টের রেজাল্ট কেমন হয়েছে জানতে চাওয়া হলে এক অধ্যাপক বলেছিলেন, কেউ কেউ খুব ভাল করেছে। আবার কেউ কেউ খুব খারাপ করেছে। অনুনাসিকতা বোঝাতে সব শব্দের মাথায় চন্দ্রবিন্দু একটা করে।

দাদা কলেজ থেকে সন্ধে বেলা না ফেরা পর্যন্ত, তার পড়ার বইগুলি আমার দখলে চলে আসত। বিপুলকায় গ্রেজ় অ্যানাটমি, যার দাম তখন ছিল ২৪০ টাকা (ছোড়দাকে ডাক্তারি পড়ানোর এটা একটা কারণ), ফরেনসিক মেডিসিন, এ দুটো নিয়ে অনেকক্ষণ পড়ে থাকতাম। প্রিভেনটিভ আর সোশ্যাল মিডিসিন যার ডাক নাম পিএসএম, তার বইকে মনে হত জলভাত। ফার্মাকোলজির বইতে দাঁত ফোটাতে পারিনি। নিজের বাড়িতে যে হাতুড়েপনা চালিয়ে গেছি, এ যাবৎ তার মূলে ওই সব বইয়ের নির্জন পাঠ।

একদিন ছোড়দা গিয়ে নরকঙ্কালের একরাশ হাড় নিয়ে এল। একেবারেই অবৈধ ব্যাপারটা, পরে বুঝেছি। বেওয়ারিশ লাশের হাড়গোড়। নিশ্চয়ই মাটির তলা থেকে বার করা। বাসে আসতে আসতে এক বয়স্ক যাত্রী জানতে চেয়েছেন, ওতে কী? মানুষের হাড় শুনে বলেছেন, তোমরা কি যাদু কর? খাটের তলায় দিব্য থাকত সুটকেসভর্তি হাড়। বাড়িতে ভূতুড়ে কিছু ঘটেনি। তবে করোটিটা আমাদের সঙ্গে ছিল অনেকদিন। সেটা সম্পূর্ণ ছিল না। মাথার উপরি ভাগ গোল করে কাটা। দাদার অনুমান, মাথায় গুলি লেগে এই ব্যক্তির মাথার উপরদিক চুরমার হয়ে যায়। ডাক্তারি পড়া শেষ হলে হাড়গুলি কোথাও বিসর্জন দেওয়া হয়। কিন্তু করোটিটা রয়ে গেল।

বাড়িতে তালা দিয়ে কোথাও বেরোনোর সময় তাকে দৃশ্যমানভাবে টেবিলের উপর রেখে যাওয়া হত। কেন জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। মা বোধহয় ভাবতেন দরজা ভেঙে চোর বা ডাকাত ঢুকলে কাটা মুণ্ডু দেখে ভিরমি খাবে। নয়তো কোনও পরাবাস্তব শক্তিবলে নিষ্ক্রিয় হবে তারা। যাই হোক। এসব কিছু ঘটেনি। জনবহুল বাজারের বাড়িতে ছুঁচ গলতে পারত না, তায় চোর ডাকাত।

Presidency College Campus View
দাদাদের প্রিমেডিক্যাল হত প্রেসিডেন্সি কলেজে

প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের সাদামাটা কোর্সে একটা বড় আকর্ষণ ছিল ফিল্ড ট্রিপ। নদিয়ার এক গ্রামে কয়েক সপ্তাহ হইহই করে কাটিয়ে এল দাদা, বন্ধুদের সঙ্গে। প্রতিপক্ষকে চোখে হারান মা, দাদা নেই বলে রাতদিন চোখের জল। আমাদের দিকে ফিরেও তাকান না। বিষয়টির কৌলিন্য নেই, তাই পিএসএম অধ্যাপকেরও প্রতিপত্তি কম। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল, আজও সেই পরিস্থিতি বদলায়নি। প্রিভেনটিভ হেল্থকেয়ার যে রোগের প্রাদুর্ভাব বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারে, এ কথা জানা সত্ত্বেও অধিকাংশ ডাক্তার এর উপর জোর দেন না। তাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী, ট্রেনড ধাত্রী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা যেন স্বাস্থ্য পরিষেবার সীমার মধ্যে ঢুকে না পড়েন, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে পেশাদার চিকিৎসকদের।

দাদার দুষ্টুমির মধ্যে নানারকম মজা ছিল, তবে তা সবার জন্য সমান উপাদেয় ছিল না। একটা গল্প বলি আমার বিড়ম্বনার। জানলা দিয়ে এসে পড়া শীতের রোদে শুয়ে আছি বিছানায়, অন্য রোদের ফালিটিতে মা ধনে, সরষে ইত্যাদি চালনিতে ধুয়ে শুকোতে দিয়েছে। হঠাৎ মনে হল কানের মধ্যে কী যেন চলে গেল। ঘুম ভাঙা চোখে দেখি, দাদা কানের মধ্যে কয়েকটা ধনে ফেলে দিয়ে হাসতে হাসতে পালিয়ে যাচ্ছে। পরেরদিন অস্বস্তি বদলে গেল ব্যথায়।

স্নানের সময় কানে জল ঢুকে ধনেগুলি ফুলে উঠেছে। তাদের ঠেলাঠেলিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। মায়ের আদেশে পরেরদিন দাদা আমাকে হাতের নড়া ধরে নিয়ে চলল মেডিক্যাল কলেজ। এক ভীষণ রাগি ইএনটি স্পেশালিস্ট। তাঁর ধমক ধামকে রোগীরা সন্ত্রস্ত। কানে জল ঢুকিয়ে সিরিঞ্জ দিয়ে একরাশ ধনে বার হল। ডাক্তার কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কানের মধ্যে এসব ভরেছ কেন? এত বড় মেয়ে! দাদা তাড়াতাড়ি বলল, ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি স্যার, আর এরকম করবে না। 

এই হল দাদা। দুর্দান্ত ডাক্তার। কোনও প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা ছাড়া রোগ নির্ণয় করতে ওস্তাদ। মেডিকেল কলেজের রিইউনিয়নে উৎপল দত্তের ‘মানুষের অধিকারে’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়িসেইজন্য ওর অনেক উৎপাত মাফ করা যায়। আর হ্যাঁ, ও আমাকে অক্ষর চিনিয়েছিল। বাংলা অক্ষর। 

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Quora

কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।

One Response

  1. Amaro ekta Dada chilo, gato bachor ajker dine Baba chole gelo, sei shok soite na pere 1 mas pore Dada chole gelo. Amar dekha ekmatro Genius, sobaike valobasto, ki sundor lomba nak, chupchap chole gelo, ses dekhao dekhte pelam na. Amake hat dhore porashona sikhiyechilo. Aj je bhat khete pai or daya.
    Apnar lekha elei pori, khub valo lage r kanna pay, kauke dhore rakhte parlam na. Amar wife Apnar motoi Beltala Girls e porto, amay bolto Ami Bengali medium, tai kichu hobena, apnar katha bollam oke. Ekhan oh ekta restaurant suru koreche. Ei lekha apni dekhben kina janina, dekhle ek line uttor deben ki? khub valo thakben r majhe majhe ektu kadiye halka kore diye jaben amader mon.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *