শতবর্ষে পা দিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ। বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর লেখায় কোনওদিনই কোনও গ্ল্যামারের ঝলকানি বা রাজনৈতিক উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকত না। থাকত এক শান্ত সৌন্দর্য, ধৈর্যবান পর্যবেক্ষণ আর ভারসাম্যময় বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দী ব্যাপী কর্মজীবন নিয়ে তিনি যেন সাংবাদিকতার এক খোলা পাঠ্যপুস্তক। তাঁকে বাংলা সাংবাদিকতার শিক্ষক বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৫ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় যোগদান। তারপর নানাভাবে তা প্রবাহিত থেকেছে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে। নতুন পথ দেখিয়েছেন ‘ওভারল্যান্ড’ সম্পাদনা করতে এসে। স্পষ্ট, অকম্পিত বাচন বরাবর তাঁর পছন্দ। নিজের কলমেও এর প্রকাশ অবিচল থেকেছে। এর জন্য বহু উঁচু পদ ও নানা সুযোগসুবিধা হেলায় প্রত্য়াখ্যান করেছেন। কিন্তু বদলাননি শংকর ঘোষ। তাঁর বিপুল রচনারাজি পড়লে আজ তাঁকে এক একক ‘ক্রুসেডার’ মনে হয়। যেন সময়-পথের একলা অভিযাত্রী। এক নির্ভীক মেধাবী বাঙালি, এক সত্যদ্রষ্টা বিশ্বজনীন ভারতীয়ের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। তাঁকে নিয়ে একান্ত স্মৃতিচারণায় স্ত্রী তথা লেখিকা আলপনা ঘোষ।
প্রুফরিডার থেকে সম্পাদক- সাংবাদিকতার জগতে দীর্ঘ পথ পেরিয়েছেন শংকর ঘোষ। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে দাপটে শুধু নয়, সৎ ও নির্ভীকভাবে সাংবাদিকতার সর্বস্তরে বিচরণ করে গেছেন। ১২ জুলাই, ২০২১-এ এই মানুষটির জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি। আমার স্বল্প সাংবাদিক জীবনের প্রথম পাঠটি নিয়েছিলাম ওঁর পাঠশালাতেই। সম্পর্কও এক জায়গায় থেমে থাকেনি। প্রথম সাক্ষাতের পরে নিজের অজান্তে কবে গুরু মেনেছিলাম ওঁকে, সে কথা আজ আর মনে পড়ে না। ছাত্রী থেকে গৃহিণী। প্রায় চল্লিশ বছরের যৌথ জীবনে, তাঁকে কখনও পেয়েছি গুরু হিসেবে আবার কখনও বা প্রাণসখারূপে।
গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার পাঠ নেবার ফাঁকে আমি তখন দৈনিক বসুমতী কাগজে শিক্ষানবিশ। প্রায়ই যেতে হত রাইটার্স বিল্ডিং। আবার কখনও বা কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে বা কোনও জনসভায়। এরকমই এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথম দেখেছিলাম শংকর ঘোষকে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের প্রেস কনফারেন্স ছিল কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের দোতলার একটি হলঘরে। মাটিতে মস্ত ফরাস পাতা। সেখানে সাংবাদিকরা বসেছিলেন। ডঃ ঘোষ বসেছিলেন একটি উঁচু গদিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি।
আমি গিয়ে যাঁর পাশে বসলাম, তিনি বয়সে তরুণ এক রিপোর্টার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের কলকাতা প্রতিনিধি। নাম অসীম চৌধুরী। একেবারে সামনের সারিতে বসেছিলেন বেশ কয়েকজন সিনিয়র রিপোর্টার। ওঁদের মধ্যে এক ভদ্রলোককে নজরে পড়ল। সরকারি খাদ্যনীতি নিয়ে ভারি চোখা চোখা প্রশ্ন করছিলেন তিনি। এক এক সময় তো প্রশ্নবাণে মন্ত্রীমশাইকে বেশ পর্যুদস্ত বলে মনে হচ্ছিল। ওই ব্যক্তি সম্বন্ধে আমার একটু কৌতুহল হচ্ছিল। অসীম জানালেন উনি শংকর ঘোষ। টাইমস অফ ইন্ডিয়া কাগজের কলকাতা প্রতিনিধি। শহরের প্রথম সারির সাংবাদিক। এরপর রাইটার্স বিল্ডিং-এর প্রেস কর্নার, বা বিধানসভার অধিবেশন, যখন যেখানে গেছি দেখা হয়েছে শংকর ঘোষের সঙ্গে। কলকাতার অনেক সাংবাদিক এসে বসতেন প্রেস কর্নারে। সবাইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হয়েছে।

প্রেস কর্নারে সাংবাদিকদের দেখেছি জোর আড্ডা দিতে। শংকর ঘোষ ছিলেন অত্যন্ত মিতভাষী আর এই আড্ডাতে তিনি বেশিরভাগ সময়েই একজন নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করতেন। ওঁর একটি বিশেষ বন্ধুবৃত্ত ছিল। সে বৃত্তে ছিলেন পিটিআই-এর সুধীর চক্রবর্তী, স্টেটসম্যানের ফণী চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকার বরুণ সেনগুপ্ত আর অমৃতবাজারের অনিল সেন। খবরের সন্ধানে ওঁরা কখন কার সঙ্গে জোট বেঁধে কোথায় চলে যেতেন, তা কারুর জানা সম্ভব ছিল না। বরুণ সেনগুপ্ত বয়সে অনুজ হলেও এক অসম বন্ধুত্ব লক্ষ করেছি ওঁদের মধ্যে। রাজনৈতিক মতামত বা কর্মপদ্ধতিতে যথেষ্ট অমিল থাকলেও পারস্পরিক আস্থার অভাব ছিল না। প্রায় রোজই দিনের খবর নিয়ে দু’জনের আলোচনা হত। প্রয়োজনে দু’জনে একই সংবাদসূত্রের কাছেও যেতেন।
সন্ধ্যের মুখে রাইটার্সবিল্ডিং থেকে ঝাঁক বেঁধে রিপোর্টাররা বেরুতেন। আমিও ওই দলে থাকতাম। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার অফিস ছিল গভর্নর হাউসের উলটো দিকে। বেশিরভাগ দিনই শংকর ওঁর অফিসে ঢুকে যেতেন। আমাদের বাকি সবাইকে এসপ্লানেড পর্যন্ত হেঁটে এসে বাস বা ট্রাম ধরতে হত। তার আগে প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল একটি চা-পানের বিরতি। কোনও কোনওদিন শংকর অনুরোধ এড়াতে না পেরে আমাদের সঙ্গে চা খেতে ঢুকতেন। কেসি দাসের পাশে একটা মস্ত দোকান ছিল, যেখানে চা আর তার সঙ্গে সিঙ্গাড়া খেতে ঢুকতাম আমরা। এই সব আড্ডাতে খুব বেশি কথা বলতেন না শংকর এটা যেমন ঠিক, তেমনি যেটুকু বলতেন, তার মধ্যেই ওঁর সূক্ষ কৌতুক ও রসবোধ প্রকাশ পেত।
অনুজ সব সাংবাদিক তাঁকে ‘শংকরদা’ বলে ডাকলেও শংকর সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। আমার ক্ষেত্রেও প্রথমদিকে তার অন্যথা হয়নি। সমবয়সী সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার। নাম ধরে ডাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওঁকে কোনদিন ‘আপনি’ সম্বোধন থেকে ‘তুমি’তে নামতে দেখিনি। ইতিমধ্যে আমার দু’বছরের সাংবাদিকতার পাঠক্রম শেষ হয়েছে এবং শারীরিক কারণে প্রায় একইসঙ্গে চুকে গেল আমার প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতার পাট। প্রায় তিন বছর বাদে পড়াতে শুরু করলাম সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। আমার নতুন পেশার পাশাপাশি লেখালিখিও চলল। শংকর ঘোষের সঙ্গে যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা করতে গিয়ে, নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে সে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হল। ১৯৭০ সালে আমরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলাম।

সে সময়টা ছিল এ শহর, এ দেশের পক্ষে এক ভারি উত্তাল সময়। একদিকে নকশাল আন্দোলনের জোয়ার, অন্য দিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজ্য। কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বাম রাজনৈতিক দলগুলির সংঘাতে বিপর্যস্ত শহরবাসী। শংকরের পাইকপাড়ার বাসা থেকে সাতসকালে বেরিয়ে পড়তে হত আমাকে। দোতলা বাসে চেপে গড়িয়াহাট। গন্তব্য আমার কর্মস্থল- সাউথ পয়েন্ট। সারাদিন স্কুল করে বাড়ি ফেরা। কোনও কোনওদিন মাঝপথে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে গোলমাল। পুলিশের লাঠিচার্জ, বাসে আগুন লাগানো ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনও হয়েছে গোলমালের জেরে বাস বন্ধ। কোনওরকমে ঘুর-পথে বাড়ি ফিরেছি যখন, তখন সন্ধ্যে-রাত।
শংকরের চিরদিনের অভ্যাস রাত জেগে পড়াশুনো করার, সে যত রাত করেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরুন না কেন! আর আমার ঠিক উলটো অভ্যেস- ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ!’ শংকরের দেরি করে ফেরার কারণে চোখ টেনে আমি জেগে বসে থাকতাম, যদিও ওঁর বরাবরের নির্দেশ ছিল, আমি যেন ওঁর জন্য না খেয়ে ওভাবে অপেক্ষা না করি। শীত-গ্রীষ্ম চিরটাকাল টেবিলে ঢেকে রাখা ঠান্ডা খাবার খেয়ে তিনি অভ্যস্ত। কেউ ওঁর জন্য জেগে বসে থাকলে ওঁর নাকি অস্বস্তি হয়। বকুনিও দিতেন। অগত্যা খেয়ে নিতাম, কিন্তু জেগে বসে থাকা থেকে আমাকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। বিয়েতে একটি হটপ্লেট উপহার পেয়েছিলাম। সেটা খুব কাজে লেগেছিল। যত রাতই হোক, তাতে খাবার গরম করে দিতাম শংকরকে। আমার যে ওটুকু করতে কষ্ট হয় না, বরং ভাল লাগে, সে কথা শংকরকে বোঝাবে কে!
সপ্তাহে সাতদিনই অফিস করতে দেখতাম শংকরকে। বারোটা নাগাদ বেরিয়ে যেতেন আর রাতে টাইমস অফ ইন্ডিয়া অফিস থেকে শেষ ট্রামে চড়ে বেলগাছিয়া ট্রামডিপো। সেখান থেকে মাঠ পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তা ধরে আমাদের বাড়ি। কোনওদিন কোনও সমস্যা হয়নি। অনেকদিনের বাসিন্দা ওপাড়ার। একডাকে চিনত সবাই। কিন্তু সত্তরের দশকে তখন কোনও কিছুই নিরাপদ, নিরুদ্বেগ ছিল না। একদিন রাস্তায় একদল ছেলের হাতে পড়লেন। পরিচয়পত্র দেখে তারা ওঁকে চিনতে পারল। এত রাত করে ফিরবেন না দাদা- এরকম কিছু একটা সতর্কবাণী দিয়ে ছেড়ে দিল। আবার কোনও কোনওদিন সন্ধ্যে থেকে গোলমাল। পাইপগান, লাঠি নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে লোকজন ছুটে যেত। ঘরের আলো নিভিয়ে, কাঠের জানলার ঘুলঘুলি ফাঁক করে দেখেছি সেসব দৃশ্য। শংকরকে ফোনে জানিয়ে দিতাম সে কথা। আর যতক্ষণ বাড়ি না ফিরছেন, বুকের ধুকপুকুনি থামত না। তথাপি ওঁর সেই এক আশ্বাসবাণী ‘এ পাড়ায় কিছু হবে না আমার।’

রোববার দিনটাতে তেমন কিছু না ঘটলে বিকেলের দিকে অফিস যেতেন। ওই একটি দিন দুপুরে দু’জনে টেবিলে বসে একসঙ্গে খেতাম। বাড়িতে গ্যাস ছিল না। শংকরের পুরাতন ভৃত্য ওড়িয়া উপেন ছিল ওই সংসারের সর্বেসর্বা। আমার রান্নাঘরে ঢোকাটা সে মোটেই পছন্দ করত না। কী বাজার হবে, কী রান্না হবে, সবই চলত তার মর্জিমতো। রোজই চারাপোনার ঝোল। শনিবার থেকে উপেনের পিছনে পড়ে থাকতাম। অনেক খোসামোদ করে পাঁঠার মাংস নিয়ে আসার জন্য রাজি করাতাম। সত্যি রান্না করতে একেবারেই জানতাম না তখন। টেলিফোনে মায়ের কাছ থেকে রান্নার পদ্ধতি জেনে নিতাম আর হাতেকলমে সে রান্না শেখাত উপেন। কিন্তু একটি গুণ ছিল তার- মার দেওয়া রেসিপি অনুসরণ করেই সে সাহায্য করত আমাকে। কয়লার উনুনে রাঁধতাম তখন আর রোববারের মাংসের ঝোলভাত খাওয়ার শেষে শংকর যখন বলতেন, রান্না বেশ হয়েছে, কী যে আনন্দ হত আমার!
ইতিমধ্যে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনায়, লেক রোড অঞ্চলে আমাদের জন্য একটি বাড়ি ঠিক হল। চমৎকার বাড়ি। ও বাড়িতে ছ’বছর কেটেছিল আমাদের। তারপর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সপ্তপর্ণী, যেখানে গত ৪৫ বছর ধরে আমার বাস। তার মধ্যে গত দশ বছর একাই।
শংকর সারাজীবন সাংবাদিকতা করে গেছেন। খুঁটিয়ে বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষার ছয় থেকে সাতটি খবরের কাগজ পড়তেন। দুই ভাষাতেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ, সাবলীল। ওঁর একটি পোর্টেবল জার্মান টাইপরাইটার ছিল। পড়ার টেবিলের ওপরে টাইপরাইটার রেখে তাতেই ওঁর সব ইংরেজি লেখা লিখতেন। দেশে বিদেশে যখন যেখানে গেছেন, ওই টাইপরাইটার ছিল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ঝকঝকে রুপোলি অক্ষরে ‘কোলিব্রি’ লেখা।

বাংলা লেখার সময়ে শংকরের পছন্দের জায়গা ছিল আমাদের বসবার ঘরের নিচু সেন্টার টেবিল। মাটিতে বসে টেবিলের ওপরে লাইন টানা ফুলস্কেপ কাগজ রেখে তাতে লিখতেন। লেখার জন্য ব্যবহার করতেন পেলিক্যান পেন আর পছন্দের সুলেখা কোম্পানির রয়াল ব্লু কালি। কপি রাখার জন্য দেখেছি দু’টি কাগজের মাঝখানে কার্বন পেপার রেখে লিখতে। ওঁর ছিল টানা হাতের লেখা, কাটাকুটি প্রায় থাকত না বললেই হয়।
সাগরময় ঘোষ যতদিন দেশ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, রাজনৈতিক প্রবন্ধের জন্য ওঁর পছন্দের লেখক ছিলেন শংকর ঘোষ। এমনকী যখন তিনি অন্য সংস্থায় চাকরিরত, তখনও সাগরবাবু ওঁকে দিয়ে লিখিয়েছেন। একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আমি। শংকর তখন অমৃতবাজার পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। কাজের দায়িত্ব অনেক। তার মধ্যে অসুস্থ স্ত্রী, কিশোর পুত্র নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। এর মধ্যে সাগরময় ঘোষের ফোন। দেশ পত্রিকার জন্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতে হবে। সবিনয়ে শংকর বাড়ির হাল এবং তাঁর অপারগতার কথা জানালেন। অনুরোধ করলেন আর কাউকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিতে। সব শুনে সাগরবাবুর সোজাসাপটা জবাব– কোনও ব্যাপার নয়, শংকরবাবু। আপনার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠুন, ওদিকটা সামলে নিন আপনি। তার পরে লিখবেন। আমি অপেক্ষা করব। সত্যি, অপেক্ষা করেছিলেন। এখনও মনে আছে আমি সুস্থ হয়ে ওঠার পরেই সেই বিশেষ সংখ্যাটি বেরিয়েছিল এবং কথামতো প্রধান প্রবন্ধটি শংকরই লিখেছিলেন।

যতদূর মনে পড়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে তখন একটি ডাইনিং কার ছিল। অনেকটা মিনি রেস্তোরাঁর মতো। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার ওখানে বসে সারতে হত। মনে পড়ে যাচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির সেই দৃশ্যগুলির কথা যেখানে সাংবাদিক অদিতির চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর আর নায়ক অরিন্দমের ভূমিকায় উত্তমকুমার কফি খাচ্ছেন। আমার খুশি, আনন্দ, ভাল লাগা, আমার সদাব্যস্ত গম্ভীর স্বামীটিকেও বোধ হয় সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সারা পথ তিনি আমার কত খেয়াল রাখলেন, পঞ্চাশের দশকে ওঁর দিল্লিবাসের কত মজার গল্প শোনালেন। কোথা দিয়ে গোটা দিনটা কেটে গেল টেরও পেলাম না।
নয়াদিল্লি স্টেশনে আনন্দবাজারের গাড়ি আমাদের জন্য হাজির ছিল। সেই গাড়ি করে রাজেন্দ্রনগরে পত্রিকার গেস্টহাউসে পৌঁছে গেলাম। বাগানওলা দোতলা বাংলো। হরেক রকমের গাছগাছালি, রংবেরঙের মরসুমি ফুল আর সবুজ, নরম ঘাস বিছানো লন। দোতলাতে গেস্ট হাউস। মস্ত সব ঘর আর তার সঙ্গে ঢাকা বারান্দা। এক তলায় আনন্দবাজার-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের উচ্চপদস্থ কর্মী নৃপেন ভট্টাচার্যের সপরিবার বাস। ওঁদের সকলের কথা শংকরের মুখে আগে থেকেই শোনা ছিল তাই প্রথম দর্শনে ওঁদের কাউকেই অপরিচিত বলে মনে হল না আমার।
পঞ্চাশের দশকে শংকর যখন দিল্লির হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে কর্মরত, সেই সময় থেকে এই পরিবারের সঙ্গে ওঁর সখ্য। সে সময়ে ওঁদের কাগজের প্রেস ছিল পুরনো দিল্লির কুতুব রোডে। প্রেসের ওপরতলায় কয়েকটি ফ্ল্যাট ছিল। পত্রিকার সাংবাদিক ও পদস্থ কর্মীরা সপরিবার থাকতেন ওখানে। ওরকম একটি ফ্ল্যাটে শংকর নিজে থাকতেন আর তার লাগোয়া ফ্ল্যাটে থাকতেন সস্ত্রীক নৃপেনবাবু। ওঁদের চার ছেলেই তখন বেশ ছোট। শংকরকে ওরা ডাকত কাকাবাবু বলে। অবসর সময়ে ওদের সঙ্গে ক্রিকেট, কখনও ব্যাডমিন্টন খেলতেন শংকর। অনেকবছর পরে ওই ভাইদের মুখে শুনেছি কীভাবে শংকরকে ঘিরে বসে ওরা গল্প শুনত। ওদের সকলের ছোট বাবুন ছিল ওঁর সব চাইতে প্রিয়।

প্রথমবার যখন দিল্লি গেলাম, তখন ভট্টাচার্য পরিবারের বড়ছেলে কল্যাণের বিয়ে হয়েছে সবে। সে ডাক্তার। নৃপেনবাবুর স্ত্রী বীণাদি চমৎকার মানুষ। কল্যাণের স্ত্রী মায়া আর বাবুন দুজনেই তখন কলেজে পড়ে। নৃপেনবাবুর কড়া নির্দেশমতো সকালের চা আর আর তার সঙ্গে বীণাদির হাতে বানানো নানাবিধ মুখোরোচক খাবার খেতে দু’জনকে নীচে নামতে হত। খাওয়া আর তার সঙ্গে প্রচুর গল্প। কুতুব রোডের বাড়িতে ছেলেরা যখন বেশ ছোট, বীণাদির হঠাৎ পড়াশোনা করার ইচ্ছে হয়েছিল। এ ব্যাপারে ওঁকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন শংকর এবং পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্যও করেছিলেন। চারটি ছেলে ছোট। একা হাতে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম বীণাদিকেই করতে হত সেকালে। নৃপেনবাবু মানুষটি সাদাসিধে প্রকৃতির হলেও তাঁর মেজাজটি ছিল চড়া। এসব কিছু সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিল না বীণাদির পক্ষে। সেই কঠিন সময়ে ওঁর অনেক চোখের জলের সাক্ষী ছিলেন শংকর। বীণাদি আমার কাছে গল্প করেছিলেন, কীভাবে শংকরের কাছে পড়ে সসম্মানে ঊত্তীর্ণ হয়েছিলেন পরীক্ষায়।

প্রথমবার শংকরের সঙ্গে এই দিল্লি ভ্রমণের স্মৃতি আজও সজীব, আনন্দময়। নৃপেনবাবু অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে। বলতেন, ‘শংকরবাবু, এমন লক্ষ্মী প্রতিমাকে কোথায় পেলেন?’ ওঁর কথায় আমি অপ্রস্তুত হতাম আর শংকরবাবু মুখ টিপে হাসতেন। দিল্লি শংকরের অতি চেনা শহর। তাই হয়তো অত উৎসাহ করে নতুন দিল্লি, পুরনো দিল্লি সব ঘুরে দেখিয়েছিলেন আমাকে। লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, হুমায়ুনের সমাধি থেকে শুরু করে চাঁদনি চক– প্রভৃতি কোনও জায়গা বাদ যায়নি। কুতুব মিনারের পাশে ফুচকার দোকানের কথা মায়া, বাবুন আগে থেকে বলে দিয়েছিল আমাকে। কুতুব দর্শন শেষ হতে আমি সার দেওয়া ফুচকার দোকান দেখে আবদার করলাম ফুচকা খাওয়ার। ফুচকা যে স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর সে সম্বন্ধে আমার কর্তামশাই আমাকে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেও, শেষ পর্যন্ত আমার করুণ আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। আমি মনের সুখে ফুচকা খেলাম আর শংকর খেলেন মাটির গেলাসে করে মশলা চা।
সেবার কলকাতায় ফেরার একমাসের মধ্যে নবজাতক রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে শংকর ঢাকা গেলেন। ৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গঠিত হয়েছিল নতুন সরকার। দেশের প্রধানরূপে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নায়ক মুজিবুর রহমান নতুন সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন। ঢাকা সফরের সময়ে শেখ মুজিবুর থেকে শুরু করে সে দেশের বেশ কিছু মন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে শংকরের কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।
মনে পড়ে, মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে কত গল্প করেছিলেন তিনি আমার কাছে। ওঁর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারের সময় ওঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল শংকরের। ফিরে এসে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ও আনন্দবাজারে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। সেবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অতিথি সাংবাদিক শংকর ঘোষকে নানাবিধ উপহারও দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল টাঙ্গাইলে তৈরি একটি তাঁতে বোনা উত্তরীয়। সরকার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু সেই উত্তরীয় নিজের হাতে শংকর ঘোষের গলায় জড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ঢাকা থেকে ফিরে সেদিন সন্ধ্যেতেই স্যুটকেস খুলে সেই সব উপহার বের করে আমাকে দেখিয়ে শংকর ডালাটি বন্ধ করে দিলেন। চা খেতে খেতে ঢাকার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক গল্প করলেন। আমি অবশ্য মনে মনে একটু হতাশ। এর আগে যখন যেখানে গেছেন, প্রতিবারই আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে এসেছেন। একটি ঢাকাই শাড়ির বড্ড শখ ছিল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু অভিমানও হয়েছিল। কী করে জানব, এর পরে আমার জন্য একটি দারুণ চমক অপেক্ষা করে আছে। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে এসে দেখি, খাটের ওপরে বিছানো রয়েছে লাল হলুদ ফুল তোলা একটি কালচে সবুজ রঙের ভারি সুন্দর ঢাকাই শাড়ি!
*ছবি সৌজন্য: লেখক
*কাভার ছবি ও মুখবন্ধ সৌজন্য: সম্রাট মুখোপাধ্যায়
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
Khoob bhalo laglo porrey. 🌷🙏🌷
Porte porte kothay hariye jacchilam..eto sabolil aar sachhando aapnar Lekha..aapni eto sahaje personal life aar public life er connection koren..je bojha jaina..er por ki holo..porer lekhar apekkkai roilam..
অসাধারণ একটি লেখা আন্টি । অনেক পুরানো কথা মনে পড়ছে । আরও এরকম লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।
Cherished memories.
খুব সুন্দর আর সুললিত ভাষা। আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।
তুমি এত সুন্দর করে তোমাদের দুজনের কথা লিখেছ যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আগেও বলেছি যে, শঙ্করদার সঙ্গে সময়মত দেখা হলে 75এ আমার জার্ণালিজম পড়া বোধহয় বন্ধ হত না। এ দুঃখ আমার চিরকালের। হস্তান্তর প্রবন্ধের নিয়মিত পাঠক ছিলাম।🙏
Khub sunder
Wonderfully written memoir, Alpana, very enjoyable reading. Such fluency!
Waiting for more writings like this.
Very nice write-up. Khub bhalo laglo.
Akta brief history of time In Kolkata & India
Ki aantorik lekha. Mon chue gelo.
Very candid feelings have been penned. Indeed loved reading it.
ঝরঝরে সুন্দর লেখা,একটানে পড়ে ফেললাম। বিখ্যাত সাংবাদিক শংকর বাবুর জীবনের কথা জানার কৌতুহল তো ছিলই। আলপণাদির আরও লেখার অপেক্ষায় র্রইলাম। : তুষার