শুন দেব, অপূর্ব কাহিনী।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য, যাহারে নাশিলা
চক্রপাণি নরসিংহ-রূপে, তাঁর কুলে
জন্মিল নিকুম্ভ নামে সুরপুররিপু,
কিন্তু, বজ্রি, তব বজ্র-ভয়ে সদা ভীত
যথা গুরুত্মান শৈল। তার পুত্র দোঁহে
সুন্দ উপসুন্দ-এবে ভুবন-বিজয়ী। 

(চতুর্থ সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য) 

যুদ্ধের মধ্য দিয়েই সভ্যতার সমস্ত সত্য প্রকাশিত। সুরাসুরের সব রিপু প্রকাশিত। পুরাণে বারবার অসুররা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। বুঝিয়েছে স্বর্গের দখল তাঁদের করায়ত্ত কেন থাকবে, কেন তাঁরাই আসলে সেই সুখের অধিকারীআর দেবগণ আধুনিক রাষ্ট্রের মতো সুচারু বুদ্ধিতে অবদমন করেছে অসুরদের। শক্তিতে নয়, যোগ্যতায় নয়, কেবলমাত্র বিশেষ সুবিধায়, কৌশলে। দেব-দানবের যুদ্ধে দেবতাদের যখনই পরাভব হয়েছে, তখনই নারীর মোহিনী-মায়া, পুরুষ-কামনা উদ্রেককারী শক্তিকে ব্যবহার করেছে দেবগণ। নারীর যৌনতা, পুরুষের কৌশল। নারীকে যৌন-সামগ্রি হিসাবে ব্যবহার করাই পুরুষের শেষ সুচারু ও কূটতম যুদ্ধকৌশল। 

পুরাণ, ইতিহাস ও মহাকাব্যের গল্পগুলো বারবার নানাভাবে কথিত হয়। সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে এইভাবে অতীত ও ঐতিহ্যের নির্মাণ চলতে থাকে। পুরাণের “সুন্দ-উপসুন্দ উপাখ্যান”, একই সঙ্গে নীতি ও কৃতির রাজনীতি। মহাভারতে নারদমুনি পাণ্ডবদের শুনিয়েছিলেন এই উপাখ্যান। দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে পাণ্ডবদের মধ্যে যাতে বিবাদ না হয়, সেই উদ্দেশেই নারদ মুনির এই শিক্ষাদান। সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনিতে আরও একটি কাহিনি একইভাবে ক্ষমতাপূর্ণ হয়ে বারবার কথিত হয় ভারতীয় সাংস্কৃতিক সৃষ্টিতে। তা হল: তিলোত্তমার কথা

মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। তিনি যোগ্য মহাকাব্যের নায়ক, সংস্কৃত মহাকাব্যের নায়ক। তামিল সঙ্গম সাহিত্যের মহাকাব্য শিলাপাদ্দিকরম -এ কাহিনি আবর্তিত হয় সামান্যা নারীকে ঘিরে। কিন্তু সংস্কৃত মহাকাব্যের নায়ক সবসময় ধর্মের রক্ষক, ধর্ম-স্বরূপ। এই ধর্মস্বরূপ যুধিষ্ঠিরের দ্বারা অসুরোচিত লোলুপতার ঘটনা কখনওই ঘটবে না। এই রাজকূল, এই দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট নরগণ মন্দবুদ্ধি হতে পারেন না। গল্পের পর গল্প বয়নের মধ্য দিয়ে আসলে একটি নীতির প্রবাহ ধরে রাখা হয়। নীতি যে কী মূল্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সত্য মূল কাহিনির গভীরে অন্তঃশীল থাকে। সুন্দ-উপসুন্দাসুর নীতিকথার অধ্যায় হয়ে থাকেন, নীচ প্রবৃত্তির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন

 

আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলমে খলিল জিব্রানের ‘দ্য প্রফেট’-এর অনুবাদ

  

আপাতভাবে স্বর্গের অপ্সরারা নীরব। তাঁরা সরব কেবল তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ তাঁরা সুরের নির্দেশ পালন করেন। তাঁরা বাধ্য, ও সৎ-এর নির্দেশ পালনে বদ্ধপরিকর। সুন্দ-উপসুন্দ ব্রহ্মার বরে প্রায় অমরত্ব লাভ করেন। কিন্তু সেই অমরত্বের একটি শর্ত ছিল। তা হল, যতক্ষণ না সুন্দ-উপসুন্দ দুই ভাই নিজেদের হত্যা করছে, ততক্ষণ তাঁদের কেউ হত্যা করতে পারবে না। সুন্দ-উপসুন্দ, এই দুই ভাইয়ের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস প্রশ্নাতীত। তাঁরা জানতেন, তাঁরা যা করবেন, একই সঙ্গে করবেন। তাঁরা কখনও কল্পনাও করেননি একে অপরকে হত্যা করবেন। “একপ্রাণ দুই ভাই- বাগর্থ যেমতি” (চতুর্থ সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)। তাই তাঁরা ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। অবধ্য হয়ে ওঠেন। তাঁদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ওঠে নরলোক ও দেবলোক। 

সুন্দ উপসুন্দাসুর, সুরে পরাভবি,
লণ্ড ভণ্ড করিল অখিল ভূমণ্ডল;

(প্রথম সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)।

ব্রহ্মার কাছে বিচার চাইলে তিনি দেবতাদের বলে দেন, তাঁর বরের মধ্যে দুই অসুরের মৃত্যুপথ কোথায় আছে। দেবাসুরে লড়াই তো অমরত্বের অধিকার নিয়েও। অমরত্ব মানে তো সম্পদের উপর অন্তহীন অধিকার। সেই অমরত্বের চাবিকাঠি বারবার নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে, সাধনা দিয়ে অর্জন করেই ফেলে অসুরকুল। বারবার তারা তাদের সাধনা দিয়ে জয় করে আনে দেবতাদের কাছ থেকে অপার্থিব সব বর। অসুররা যা করেছে, তা করেছে তাদের কৃতি দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে। তারপর প্রবল স্পর্ধায় বারবার লড়াইয়ের আহ্বান ছুড়ে দিয়েছে দেবতাদের দিকে। দেবতারা কূট-কৌশল ছাড়া নিতান্তই দুর্বল মানব। 

পালাইলা দেবগণ রণভূমি ত্যাজি;
জয় জয় নাদে দৈত্য ভুবন পূরিল।
দৈববলে বলী পাপী, মহা অহঙ্কারে প্রবেশিল স্বর্গপুরী-কনকনগরী,-
দেবরাজাসনে, মরি, দেবারি বসিল!
(প্রথম সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)। 

দেবত্ব ও রাজত্ব দুইই চলে যাওয়ার ভয়ে অসুর নিধনের একটি করে কূট কৌশল রেখে দিতে হয় দেবতাদের। এবারেও তার অন্যথা হল না। বিশ্বকর্মা সৃষ্টি করলেন তিলোত্তমাকে, যাঁকে তিল তিল সুন্দর সঞ্চয় করে তৈরি করেছেন। শ্রেষ্ঠা সুন্দরী। রাজা রবি বর্মা এঁকেছিলেন তিলোত্তমার ছবি। বক্ষযুগল উন্মুক্ত, কটিদেশ থেকে খসে পড়ছে বসন। তিলোত্তমার ছবিতে এই যে উন্মুক্ত শরীর, সেটাই সত্য। পৃথিবীর সুন্দরতম নারী ঠিক কেমন দেখতে, আমরা জানি না। শুধু জানি যে তাঁর জন্মের উদ্দেশ্যই হল, কামনার চাতুর্যে অসুরকে বুদ্ধিহীন কামনাস্পৃষ্ট করে তোলা। রবি বর্মার তিলোত্তমার শরীর জুড়ে দেবতাদের যুদ্ধনীতি। নারী তো পুরুষের সৃষ্টিমাত্র। নারীকে নীরব করার রাজনীতি নারীকে পুরুষের দ্বারা সৃষ্টি করার কৌশল। এই নারীর প্রতি কামনাতুর সুন্দ-উপসুন্দ। কে দখল করবে তিলোত্তমাকে! এই নিয়েই সুন্দ-উপসুন্দর লড়াই। এর জেরেই একে অপরকে হত্যা করেন তাঁরা। এই ছিল নিয়তি। কেউ বেঁচে থাকবে না, মৃত্যু হবে একই সঙ্গে। তিলোত্তমার উপস্থিতি এই হত্যা ঘটাবে।

সুন্দ-উপসুন্দের আপাত অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা কী সহজে, কেবল নারী-অস্ত্রে ধ্বংস করে গেছে অসুরদের! যে অসুররা এক সময় তাদের সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে জয় করেছে দেবতাদের মন, কী আশ্চর্য যে কত সহজেই অপ্সরাদের রূপ ও কামনার হাতছানিতে তারা হয়ে উঠছে কামনাসর্বস্ব। অর্জনে যে অসুর আসলে সুর, কীর্তিমান সেই অসুরই তার কৃতি ধরে রাখতে কেবল কামনাদুষ্ট পুরুষমাত্র। দেবতাদের ক্ষমতা ও রাজ্যপাট হারানোর ভীতিই তো অসুরকে দুষ্ট বানিয়েছে। অন্যথায় অসুররা তো তেমন নয়। উপসুন্দকে সুন্দ বলেন,

“রাজ-সুখে সুখী প্রজা; তুমি আমি, রথি,
সসাগরা বসুধারে দেবালয় সহ
ভুজবলে জিনি, রাজা; আমাদের সুখে
কেন না সুখিনী হবে বনরাজী আজি?”
(চতুর্থ সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)। 

Brahma_give_boon_to_Sundopasunda
ব্রহ্মার বরে প্রায় অমরত্ব লাভ করেছিলেন সুন্দ ও উপসুন্দ

পুরাণ-ইতিহাসের কাহিনি জুড়েই বারবার দেখা যায়, অসুর বা রাক্ষসরা কেবলমাত্র পরাস্ত তাদের প্রেম ও কামনার কারণে। শূর্পনখা, শুম্ভ-নিশুম্ভ বা সুন্দ-উপসুন্দ, এইরকম বহু চরিত্র শেষ পর্যন্ত প্রেম ও কামনার কারণেই আহত বা নিহত হয়েছেন। দেবতাদের কূট যুদ্ধ পরিকল্পনা-

কে সম্বরিবে সে অব্যর্থ শরে?
লয়ে তিলোত্তমায়-অতুলা ধনীরূপে-
ঋতুপতি সহ রতিপতি সর্ব-জয়ী
গেছে চলি যথায় নিবাসে দেব-অরি
দানব! থাকহ সবে সুসজ্জ হইয়া।
সুন্দ উপসুন্দ যবে পড়িবে সমরে,
অমনি পশিব মোরা সবে দৈত্যদেশে
বায়ুগতি, পশে যথা মদকল করী
নলবনে, নলদলে দলি পদতলে। 

(চতুর্থ সর্গ, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)

যে অসুররা এক সময় তাদের সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে জয় করেছে দেবতাদের মন, কী আশ্চর্য যে কত সহজেই অপ্সরাদের রূপ ও কামনার হাতছানিতে তারা হয়ে উঠছে কামনাসর্বস্ব। অর্জনে যে অসুর আসলে সুর, কীর্তিমান সেই অসুরই তার কৃতি ধরে রাখতে কেবল কামনাদুষ্ট পুরুষমাত্র। 

কৃত্রিম কামনার কূট কৌশল ছাড়া অসুর নিধন অসম্ভব, একথা জানতেন বাসব। অসুরকে অসুন্দর হিসাবে দেখা হয়েছে মূলত তাদের পুরুষকারের জন্য। সেই সমাজে যেন নারী নেই, নারী থাকলেও সেই নারী অসুন্দর। অসুন্দর অসুরের সঙ্গে সুন্দর দেবলোকের নারীর প্রেম হতে পারে না। এই অসাম্য অসুরকে নীচু গোত্রের করে রেখেছে, অসুররা চিরকাল এই হতাশা নিয়েই থাকবে, এই লোলুপতা নিয়েই থাকবে। কামনা যেন অভিশাপ। তারা ধ্বংস হবে সুরলোকের প্রতি কামনায়। সুরলোকের নারীরা নীরব। তাঁরাও যেন কেবলমাত্র যৌনতার প্রতিমূর্তী ও এই যৌনতা তাঁদের অস্ত্র, ধর্ম রক্ষার জন্য, সত্যের জন্য। তাই এই অপ্সরারা কেবল দেবলোকের ত্রাতা, তাঁদের আর কোনও বাক্য নেই, বয়ান নেই, তাঁদের আর কোনও মূল্যও বৃহৎ সমাজের কাছে নেইতাঁরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিছুই করতে পারেন না।

সুরলোকের পুরুষই কেবলমাত্র ধর্ম ও সত্য। সুরলোকের নারী কামনার প্রতিমূর্তি, আর অসুরলোকের পুরুষ মোটা দাগের কদাকার যৌন-লালসাদুষ্ট। অসুরলোকের নারী প্রেম-কামনার অযোগ্য। দেবতার এই নারীকে সামগ্রি করে যুদ্ধজয়ের পূর্বে, সুন্দ-উপসুন্দ তিলোত্তমাকে দেখে- 

চল, যাই ত্বরা, পূজি পদযুগ!
দেবীর চরণ-পদ্ম-সদ্মে যে সৌরভ
বিরাজে, তাহাতে পূর্ণ আজি বনরাজী।

আর সেই মুহুর্তেই দেবতারা, “হান তব ফুলশর, ফুলধনু ধরি”। ইন্দ্র হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুনরায়। 

সুন্দ-উপসুন্দাসুর, হে শূরেন্দ্র রথি,
অরি মম, যমালয়ে গেছে দোঁহে চলি
অকালে কপালদোষে। আর কারে ডরি?
(চতুর্থ সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)। 

বুদ্ধদেব বসুর “প্রথম পার্থ”, কাব্যনাটকে কৃষ্ণ বলেছিলেন কর্ণকে, পৃথিবীর সব যুদ্ধই ভ্রাতৃযুদ্ধ, সব হত্যাই ভ্রাতৃহত্যা। আর এই হত্যালীলার মধ্যেই লুকিয়ে সমস্ত নীতি ও ধর্মের কাহিনি। সুন্দ-উপসুন্দ চিরকেলে সেই যুদ্ধ-বাস্তবতার চিহ্ন।

পুরাণ এইজন্যই গুরুত্বপূর্ণ, যে তা আসলে পুরনো নয়, পুরনো হয় না। পাঠক, কবি ও চিত্রনির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের একটি ছবি, “উত্তরা” (২০০০) মনে করুন। স্বল্পভাষী, প্রায় নীরব সেই মেয়েটি, নতুন বৌ, নীরবে লক্ষ করল দুই পুরুষ, যারা কিনা হরিহর আত্মা ছিল, তাদের লড়াই, একে-অপরকে হত্যা করতে উদ্যত হওয়া কুস্তির আসরে! মেয়েটি পালিয়ে যাবে, পালাতে চাইবে একটু শান্তির খোঁজে গ্যালিভারের ভ্রমণে পাওয়া লিলিপুটদের দেশে। বড় মানুষদের সঙ্গে থাকার ক্লান্তি থেকে বাঁচতে সে যেতে চাইবে ছোট মানুষদের দেশে। 

এই সিনেমার দেড় দশক আগে আমরা দেখেছি মৃণাল সেনের “জেনেসিস” (১৯৮৬), এই একই বিষয় নিয়ে। মূল গল্প সমরেশ বসু রচিত। পুরুষের কামবুদ্ধিতায় কীভাবে পুরুষ নিজেকে ও নারীকে একই সঙ্গে ধ্বংস করে বিভিন্ন সময়, তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি আমাদের বিবিধ সাংস্কৃতিক আখ্যানের মধ্যে। মৃণাল সেন দেখিয়েছেন নারীকে কেন্দ্র করে পুরুষের উদগ্র কামনা ও নারীদেহমন দখল করার প্রবণতা কীভাবে পুরুষকে অন্য পুরুষের দাসত্বে বদ্ধ করে।     

fronton-the-sunda-and-asura-upasunda-disputing-the-apsara-tilattama
কাম্বোডিয়ার মন্দিরগাত্রে খোদিত সুন্দ উপসুন্দের লড়াই। মাঝখানে তিলোত্তমার মূর্তি

এরিস্তোফেনিস রচিত গ্রিক যুদ্ধ-বিরোধী নাটক “লিসিস্ত্রাতা” অবলম্বনে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একশো বছর স্মরণে তৈরি নাটক “গজব তেরি অদা” ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার নিজস্ব প্রযোজনা সেখানে যুদ্ধ থামানোর জন্য মেয়েরা একটি অদ্ভূত পরিকল্পনা করে। সমস্ত সেনার স্ত্রীরা একজোট হয়ে ঠিক করে, যে যতক্ষণ না স্বামীরা তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে তারা আর যুদ্ধ করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বামীসঙ্গমে লিপ্ত হবে না। একদিন সমস্ত সেনা গ্রামে ফিরে আসে, একটি যুদ্ধ জয়ের পর। স্ত্রীরা রাতে ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রশ্ন করে, স্বামীরা তাদের জন্য কী করতে পারেন, ঠিক কতটা ভালবাসেন তাদের, ইত্যাদি। প্রত্যাশিত উত্তর পান রোম্যান্টিক স্বামীদের কাছে থেকে, সবাই তাঁদের জীবন দিতে পারেন স্ত্রীদের জন্য। কিন্তু স্ত্রীদের শর্ত শুনে তাঁরা সবাই ভাবেন এ নিছক রসিকতা।

তারপর ক্রমে ক্রমে সেনারা বিরক্ত, ক্রুদ্ধ ও নৃশংস হয়ে ওঠেন স্ত্রীদের আচরণে। রোম্যান্টিক প্রেমিক পুরুষ হারিয়ে যান কোথায়, এতদিনের এত চেনা স্বামীরা অচেনা হয়ে ওঠেন! নারীরা বুঝতে পারেন, প্রেমিকের জীবনের থেকেও দামি প্রেমিকের একটু প্রেম। এই প্রেমটুকু পেলে আর প্রেমিকের প্রয়োজন নেই প্রেমিকার জন্য প্রাণ দেওয়ার। আমরা বুঝি, পৃথিবীর সব যুদ্ধ আসলে নারী আর পুরুষের মধ্যে। যুদ্ধ দুই রাজায় নয়, দুই দেশে নয়, যুদ্ধ আসলে স্ত্রী-পুরুষে। পুরুষ-পুরুষকে হত্যা করে আর সারা জীবন শোকের শাস্তি পায় নারী, অসম্মানিত হয় নারী, অত্যাচারিত হয় নারী। যে নারী কোনওদিন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাঁদের সেনা-স্বামীদেরও যুক্তি ছিল, যুদ্ধ শেষ হলে খাবে কী, চাকরি থাকবে না।

তিলোত্তমা কি তাহলে কেবল দেবতার কৃতি? নীরব সুন্দরী? কামনা উদ্রেককারী নারী কেবল? পুরুষকে কামনার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শেষ করে দেওয়ার মোহিনী যাদু মাত্র? ধর্ম ও সত্য তো নারীর এই ভূমিকাই নির্দিষ্ট করেছে। তিলোত্তমা কি তাহলে কেবল অসুরকে প্রতারিত করেছে? আমাদের সামনে তুলে ধরেনি কীভাবে সুরলোক তাঁকে নারী নয়, কামনার ভাণ্ড হিসাবেই দেখেছে? পুরুষ সুরলোকের নীরব তিলোত্তমা বুদ্ধিবৃত্তির পুরুষকার কূটনীতির আখ্যান। সুন্দ-উপসুন্দরা সেই আখ্যান চিনতে সাহায্য করেছে নরলোককে। 

 

আরও পড়ুন: দেবাশীষ দেবের কলাম: চলিবলি রংতুলি

 

সুর-অসুর তো রূপকমাত্র। আসল লড়াই তো শব্দ ও শব্দহীনতার, সরব সুরাসুরের সঙ্গে নীরব নারীর। সেই নারী হতে পারেন তিলোত্তমা বা শূর্পনখা, সীতা বা দ্রৌপদী। পৃথিবীর সব যুদ্ধই শেষ অবধি লিঙ্গযুদ্ধ। পুরুষের অধিকার কায়েম আর নারীর দাসত্বের, পুরুষের সরব বয়ান আর নারীর নীরব গভীরতার মধ্যে যুদ্ধ। সুন্দ-উপসুন্দের মৃত্যুতে পতিপরায়ণা শোকাকুলা মহিষীদ্বয় অনুমৃতা হন। আপাতভাবে দেব-দানবের যুদ্ধের বাইরেই তো ছিলেন দুই মহিষী, কিন্তু তাঁদেরও নিয়তি মৃত্যু। এই তো নারী-পুরুষের যুদ্ধে নারীর মৃত্যু! আর কী পেলেন তিলোত্তমা? মধু কবি কী চমৎকারভাবে নারীকে অলংকৃত করার পরিহাসকে ধরেছেন – 

তবে তিলোত্তমা পানে চাহি সুরপতি
জিষ্ণু, কহিলেন দেব মৃদুমন্দস্বরে;-
তারিলে দেবতাকুলে অকূল পাথারে
তুমি; দলি দানবেন্দ্রে তোমার কল্যাণে,
হে কল্যাণি, স্বর্গলাভ আবার করিনু।
এ সুখ্যাতি তব, সতি, ঘুষিবে জগতে
চিরদিন। যাও এবে (বিধির এ বিধি)
সূর্যলোকে; সুখে পশি আলোকসাগরে,
কর বাস, যথা দেবী কেশব-বাসনা,
ইন্দুবদনা ইন্দিরা– জলধির তলে” 
চলি গেলা তিলোত্তমা– তারকারা ধনী-
সূর্যোলোকে। সুরসৈন্য সহ সুরপতি
অমরাপুরীতে হর্ষে পুনঃ প্রবেশিলা।”

(চতুর্থ সর্গ। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)

 

*ছবি সৌজন্য: Alamy Stock Photo, Wikipedia

মৃন্ময় প্রামাণিক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় অনুবাদ তত্ত্ব, দলিত সাহিত্য, মাইগ্রেশন, বিশ্বসাহিত্য, ভারতীয় আখ্যান ও সাহিত্যতত্ত্ব। বিখ্যাত মরাঠী দলিত সাহিত্যিক শরণকুমার লিম্বালের বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদক। তাঁর দলিত সাহিত্যাচে সৌন্দর্য শাস্ত্র, তিনি বাংলায় দলিত নন্দনতত্ত্ব শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। দেশ-বিদেশে বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় যুক্ত মৃন্ময় একাধিক দেশি-বিদেশি ফেলোশিপ পেয়েছেন। একাধিক বই ও পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যুক্ত।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *