১৪ অগস্ট ২০১৯। রাত ৩:২০। এসপো-হেলসিংকি, ফিনল্যান্ড।

ব্যাটাচ্ছেলে গল্প করতে করতে ঢুলছিল বলে ঠেলেঠুলে শুতে পাঠিয়েছি সবে। ভাইকিংদের দেশে অদ্যই শেষ রজনী। আজ রাতটা আর ঘুমোব না, কারণ এখনও অবধি দেখা বা চেনা সভ্যতাগুলোর থেকে একেবারে আলাদা একটা আবহাওয়ায় রাত জাগার শেষ সুযোগটা হাতছাড়া করবার প্রশ্নই ওঠে না। আজ একটা সুন্দর দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম। তবে সে কথা এখন থাক, তার চেয়ে বরং দু’দিন আগের ভাইকিং নৌবহরের গল্পটাই আগে সেরে রাখি।

যাব কি যাব না ভেবে ভেবে…

মনে মনে ব্যাপারটা দানা বাঁধছিল অনেকদিন ধরেই। 

জানুয়ারির শেষে ড্রেসডেন ছেড়ে নিস-এ চলে আসার পর বিশেষ ঘোরাঘুরি হয়নি। এপ্রিলে দিন দুয়েকের জন্য একবারই বার্সেলোনা গিয়েছিলাম। সেই শেষ বেড়াতে যাওয়া। তাছাড়া ড্রেসডেনে প্রচুর বন্ধুবান্ধব থাকায় বেশিরভাগ সন্ধ্যেগুলোই হয় এর বাড়িতে নয় তার বাড়িতে হইচই-খাওয়াদাওয়ায় কেটে যেত। একটা অবাঙালি বাচ্চাদের দলও ছিল, মানে ওই সব ২৫-২৬ বছরের ছোঁড়া-ছুঁড়ি আর কী। এক আধটা দিন একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগলে হিমাংশু, অনুরাগ, চরণ আর বাকিরা মিলে সারারাতব্যাপি এমন গোল বাধাত যে কখনও একা থাকার অভাববোধটা টেরই পাইনি। কিন্তু নিস-এর ব্যাপার একেবারেই আলাদা। শহর কিম্বা তার আশেপাশের সৌন্দর্য নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই ঠিকই, তবে এক্কেবারে বাঙালি-বিহীন মরুভূমি। নেহাত ১৫ বছরের একাত্ম অনুষঙ্গ তাই, নাহলে কলকাতার আড্ডাবাজ যুগল কাঁহাতক একে অপরের মুখ চেয়ে দিন কাটাতে পারে?

 

আরও পড়ুন: জয়া মিত্রর কলমে নদীর বৃত্তান্ত। 

 

তাই গৌরব যেদিনই ওদের ওখানে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা মুখ ফসকে বলে ফেলল, আমরা সেটা মাটিতে পড়ার আগেই জন্টির মতো লুফে নিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। গৌরব আমার কলেজের বন্ধু। একসঙ্গে পড়াশোনা, আড্ডা, গানে সবাই মিলে একের পর এক রাত কাটিয়েছি। অনার্স পরীক্ষার আগের মাসগুলোয় মুকেশদার দোকানের উলটোদিকের রাস্তায় ফ্লেকের কাউন্টারেই আমরা স্ট্রেসবাস্টার খুঁজে নিতাম। তাছাড়া কথায় কথায় শেষ রাতের ট্রেনে বন্ধুরা মিলে এখানে সেখানে হারিয়ে যাওয়া তো রয়েছেই। এরপর সায়েন্স কলেজে আরও তিন বছরের সুমধুর স্মৃতি। এরপর ও স্কলারশিপ নিয়ে ফিনল্যান্ড চলে এল আর আমিও তার বছর দেড়েক পর ইস্তানবুল পাড়ি দিলাম। মাঝের এই ন’বছর পুরোটাই না-দেখা। তাই এতবছর পর আবার সামনাসামনি দুই বন্ধুতে আড্ডা হবে- বেড়াতে যাওয়ার পাশাপাশি সেও এক বিরাট পাওনা। তারওপর আমার মামাতো বোনকে বিয়ে করে ব্যাটাচ্ছেলে বন্ধুত্বটাকে সরাসরি আত্মীয়তায় পরিণত করেছে।

ফিনল্যান্ডে যাব, সে তো হল! কিন্তু তারপর? গৌরব বলল, “সে চিন্তা তো তোর নয়। তুই আর শারদীয়া শুধু হেলসিংকি এয়ারপোর্ট থেকে একটা বাস নিয়ে আমার বাড়িতে বডিটা ফেলবি। তারপরের ব্যাপারটা আমি বুঝছি। তোর পছন্দ অপছন্দ তো আমার জানা। তোরা যে ৪/৫ দিন ধরে শুধু হেলসিংকি শহরে সাইটসিয়িং করে কাটাবি না, সে আমি জানি। টিকিটটা কাট। দিনক্ষণ জানা তারপর প্ল্যান বলব। এখন রাখছি।”

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলে, এমন পাজি!

আর কী করা। সেদিনই টিকিট দেখতে বসলুম। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ঘাঁটার পর ঠিক হল ৯ অগস্ট আমরা মিউনিখ হয়ে হেলসিংকি নামছি। আর ফেরার দিন ১৫ আগস্ট- রুট একই। কুড়িয়ে কাঁচিয়ে আমাদের ফ্লাইট টাইম মোট চার-সাড়ে চার ঘণ্টা। একটু দূর তো বটেই। নিস ইউরোপের একেবারে দক্ষিণে আর ফিনল্যান্ড রাশিয়ার কাছে। টিকিটের কপি গৌরবকে ওয়াটস্যাপ করতে রাতেই ফোন। 

“শোন, কয়েকটা দিন হাতে রেখেছিস সেটা ভাল ব্যাপার। আরও দিন দুয়েক হলে বেড়ে হত। যাই হোক। প্রথম দিন আমরা বাড়িতে বসেই আড্ডা দিই। পরের দিনটা হেলসিংকিটা দেখে ফ্যাল। একটু রেস্ট হলে সুবিধা।”
আমি: কেন? রেস্ট কেন?
গৌরব: কারণ তার পরেরদিন একটা ডে ট্রিপ করব। তালিন!
আমি: তালিন?! মানে এস্তোনিয়া?
গৌরব: ইয়েস স্যার! শোন আমি অফিস সামলাই। পরের প্ল্যান এলে বলব। 

যাহ! আবার কেটে দিল!

***

তালিন শোনার পর থেকেই মনটা আনচান করছিল। বিশেষ কিছুই তো জানা নেই! শুক্রবারের অফিস কোনওক্রমে সেরেই আমি আর অর্ধাঙ্গিনী বইপত্র নিয়ে বসে পড়লাম। এই উইকেন্ডে, নো ফান, ওনলি স্টাডি। একটু পড়াশোনা না করে অফবিট জায়গায় গেলে গোটা ঘোরাটাই মাটি হয়ে যাবে!

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি থেকে দক্ষিণ দিকে নাক বরাবর গ্রিস পর্যন্ত যদি একটা সরলরেখা টানা যায়, তবে “গালফ অফ ফিনল্যান্ড” পার করে যে বিন্দুতে সেই লাইন প্রথম স্থলভাগ ছোঁবে, মোটামুটিভাবে সেটাই তালিনের অবস্থান। তালিন শহর এস্তোনিয়ার রাজধানী। এস্তোনিয়ার আরও দক্ষিণে গেলে পড়বে লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার মত অন্য দুই বলটিক প্রদেশ। বলটিক সাগরের এই অংশটার তিনদিকে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও রাশিয়া; অর্থাৎ সমতল দিয়ে আসতে হলে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ হয়ে ঘুরে আসা যেতেই পারে, তবে গোটা দুয়েক ভিসা পালটে!

ইতিহাস তুমি কেঁদো না!

১০৫০ সালের আগে তালিন অঞ্চলে মানব সভ্যতার বিশেষ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১১০০ শতাব্দী শুরু হওয়ার ঠিক আগে ইরু অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক দুর্গকে ঘিরে বর্তমান তালিনের বিবর্তনের সুত্রপাত হয়। ওই শতাব্দীরই শেষের দিকে কোনও অজানা কারণে সেই দুর্গকে ইরু প্রদেশের মানুষ পরিত্যাগ করে চলে যান। ১২১৯ সালে ড্যানিশরা (ডেনমার্ক অঞ্চলের নিবাসী উত্তর জার্মানির আদিবাসী, এরাই ভাইকিং জমানায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ভবিষ্যতে আধুনিক ডেনমার্কের জন্ম দেন) ওই অঞ্চল দখল করে আর একটি নতুন দুর্গ স্থাপন করেন। যে উঁচু অঞ্চলে এই দুর্গ তৈরি হয় সেটাই এখনকার বিখ্যাত টুম্পিয়া পাহাড়। 

The medieval Hanseatic ports
হানসিয়াটিক বন্দরের মধ্যযুগীয় চিত্র

এরপর মূলত ১২৮৫ সালে হানসিয়াটিক লিগে যোগদান করার পর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে তালিনের উত্থান ঘটে।এরপর ১৩৪৬ সালে টিউটোনিক নাইটদের কাছে হস্তান্তর এবং এরও পরে ১৫৬১ সালে সুইডেনের অধীনস্থ হওয়া। সবশেষে ১৭১০ সালে রাজা প্রথম পিটারের হাত ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ অবধি (১৯১৮) তালিন শহর রাশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসাবেই ইতিহাসে ঠাঁই পায়। এরপর ১৯১৮ সালে মুক্ত এস্তোনিয়ার অংশ হয় তালিন। 

হানসিয়াটিক লিগ বা হানসা আসলে কিছু উত্তর জার্মান শহর ও জার্মান সদাগরদের হাতে ১৩০০ শতাব্দিতে তাদেরই আত্মরক্ষার তাগিদে তৈরি হওয়া একটা সংগঠন। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ইয়োরোপীয় তথা বলটিক বাণিজ্যের এক বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করত এই সংগঠন। পর্তুগাল, ইতালি, রাশিয়া, ইংলন্ড সর্বত্র ছিল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এর সদস্যরা শুধুমাত্র যে নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার পেত, তা-ই নয়, পেত জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার অধিকার এবং কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা, যাকে সহজ ভাষায় বলে ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি। হানসা-দের নিজস্ব আইন ছিল, এমনকী ছিল সেনাবাহিনীও। 

কিন্তু সে সুখ কপালে বেশিদিন সইল কই? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আবার লড়াই, আবার একের পর এক হস্তান্তর। খাতায় কলমে ১৯৪০ থেকেই সোভিয়েত সোশালিস্টদের অন্তর্ভুক্ত হলেও, ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত জার্মান তৃতীয় রাইখের দখলে ছিল আজকের তালিন। এই গোটা সময় জুড়েই তাই একের পর এক বীভৎস কার্পেট বম্বিংয়ের আওতায় এসেছে এ শহর, যার মধ্যে প্রধানতম হল ১৯৪১ সালের জার্মান লুফতওয়াফের ‘অপারেশান বার্বারোসা’, ১৯৪২ সালের সোভিয়েত বোমারু আক্রমন এবং সব শেষে ১৯৪৪ সালে আরও একবার সোভিয়েত বিমানের অত্যাচার। 

কাজেই  যুদ্ধ শেষের পরের প্রায় পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ সময় সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তই থাকতে হয় তালিনকে। শুধু তাই নয়, ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যেকার সময়টুকুতে বহু এস্তোনিয়ান, সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে, কারারুদ্ধ ও অত্যাচারিত হন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন গণতান্ত্রিক এস্তোনিয়ার হাত ধরে মুক্তির আলোয় ফেরা। বর্তমানে, তালিন-নিবাসীদের মধ্যে ৫০% আদিম এস্তোনিয়ার উত্তরাধিকারী এবং বাকি ৫০%এর ৪০ শতাংশই রাশিয়া থেকে আগত। 

এই গেল তালিনের ঐতিহাসিক বিবর্তনের কথা। মোটের উপর ভাইকিং, রাশিয়ান, থার্ড রাইখ মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার। এছাড়াও একটা মজার ব্যাপারেও জায়গাটা আমায় বেশ টেনেছে, সে কথায় পরে আসছি।

চালাও পানসি এস্তোনিয়া…

৯ আগস্ট ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া গেল। নিস থেকে সকাল ছ’টায় উড়ে আমরা মিউনিখ নামছি সকাল সওয়া সাতটা। এরপর ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষা। সাড়ে আটটা নাগাদ মিউনিখ থেকে টেকঅফ করা ফিনল্যান্ড-মুখী ফ্লাইটটা আমাদের হেলসিংকি নামাচ্ছে ওখানকার সময় দুপুর বারোটায়। এরপর হেলসিংকি এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমে ট্রেন নিয়ে প্রধান স্টেশান আর তারপর একটা বাস নিয়ে এসপো যেতে আমাদের লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক।

ট্রেনের সময়টা এক বাংলাদেশী যুগলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাস জার্নিটা বেশ সময়সাপেক্ষ। প্রায় ৪০ মিনিট ঝিমিয়েঝিমিয়েই লক্ষ্য করেছি শহর থেকে শহরতলি পেরিয়ে জঙ্গল আর সবুজ পাহাড়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসপো, মানে যেখানে গৌরবদের বাড়ি, সেদিকটা আসলে হেলসিংকি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তবে ইউরোপের অন্যান্য বড় শহরের মতো, জীবনযাপন খরচসাপেক্ষ হওয়ায় আমাদের মতো চাকুরীজীবীরা এইদিকটাতেই থাকে আর রোজ যাতায়াত করে অফিসে হাজিরা দেয়। 

Operation Barbarosa
তালিনের উপর ১৯৪০ সালের অপারেশন বারবারোসার বোমারু আক্রমণ

বাস থেকে যেখানটায় নামলাম সে জায়গাটার নাম হানুসজারভি। প্রায় পাহাড়ের সমান টিলার উপর উঁচু উঁচু নর্ডিক গাছ, আর তার ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে আসে। সেই আরামেই মিনিট দুয়েক হাটতেই ওদের ছোট্ট মিষ্টি দোতলা বাড়িটার সামনের রাস্তায় দেখা মিলল তন্বী আর ওদের ছানা গুলগুলির! বাড়িতে ঢুকে স্নান সেরে গরম গরম লাঞ্চ সহযোগে আড্ডা দিতে দিতেই দেখি গৌরব হাজির। নাহ! আর সময় নষ্ট করা যাবে না। সেই কবে থেকে প্ল্যান শোনাবে বলে ঝুলিয়ে রেখেছে!

প্রথমেই হেলসিংকি শহর আর তার আশেপাশের দু’ একটা জায়গা আমরা পরপর দুদিন ধরে চষে ফেলব। চষব বলতে ওদের চার চাকার বাহনে, যার সারথি গৌরব স্বয়ং। সে তো মজারই ব্যাপার, কিন্তু আমার মনটা পরে আছে তালিনে। ওটার প্ল্যানটা কী? আর একটুক্ষণ ধানাই পানাই করে বন্ধুবর যা শোনাল, সে কথায় না গিয়ে বরং একেবারে অভিজ্ঞতা সমেতই লিখে রাখা যাক।

ভাইকিংদের জলে…

১২ অগস্ট সকাল সকাল বেশ কিছু খাবার, জল, টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের গাড়ি যখন হেলসিংকি বন্দরে পৌঁছল তখন সকাল দশটা। গতরাত্রে ওদের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিল। উপলক্ষ: গুলগুলির মামাভাত। অবশ্যই মামা মানে আমি! কাজেই খাওয়াদাওয়া আর আড্ডাও হয়েছে ভরপুর।  

আমরা যে কারণে হেলসিংকি বন্দরে এসেছি সে কথাটা আগে বলা প্রয়োজন। যেমন বলছিলাম, হেলসিংকি থেকে একটা সরলরেখা বরাবর তালিন যেতে হলে মাঝে গালফ অফ ফিনল্যান্ড পড়ে। এ এক বিরাট পর্যটনযজ্ঞ, আর তার জন্য বলটিক সাগর পারাপারের মতো প্রয়োজনীয় কাজ নিপুণভাবে সামলানোর দায়িত্ব দেশগুলো বেশকিছু প্রাইভেট জাহাজ কোম্পানিকে দিয়ে রেখেছে। হেলসিংকি থেকে তালিন যাতায়াত করে এমনই এক বিরাট বিলাসবহুল জাহাজ, নাম ‘ভাইকিং লাইন্স।’ কাজেই এ যাত্রায় আমরা এক ভাইকিং নৌবহরে চড়ছি আর আমাদের চার চাকার বাহন সন্ধ্যে পর্যন্ত এই বন্দরের পার্কিংয়েই অপেক্ষমান থাকবে।

Viking Lines Ship
ভাইকিং লাইন্সের জাহাজ

মোট আড়াই ঘণ্টার জলবিহার। বিরাট জাহাজ। নয় নয় করে সব মিলিয়ে চারতলা সমান উঁচু। এক্কেবারে উপরে ক্যাপটেন আর ক্রুদের অফিস। এক্কেবারে তলায় বিরাট বিরাট লরি আর গাড়ি বোঝাই করে জাহাজ এপার ওপার করে। ডেক বরাবর ঢুকে গেলে বাকি দু’তলার এক দিকে বার-কাম-রেস্তোরাঁ, আর অন্য দিকটায় আরও কিছু ক্যাফে ও আড্ডা মারার জায়গা। এছাড়া একটা বিরাট স্টেজও রয়েছে। তার উপরে ঝিকিমিকি আলোর ক্রিস্টাল। সকাল সাড়ে দশটা বাজে বলে এসব আয়োজন এখন নিজেদের মতোই জিরচ্ছে। ফেরার সময় আমাদের যা প্ল্যান তাতে ভাইকিং নর্তকীর দেখা পেলেও পেতে পারি। দেখা যাক বরাত কী বলে!

জাহাজ ছাড়ার পর প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ডেকের পিছনদিকের খোলা জায়গাটায় রেলিংয়েএর ধারে দাঁড়িয়ে জাহাজ আর জলের খেলা দেখব বলে ঠিক করেছি। আমি এমন শান্ত সমুদ্র কখনও দেখিনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশান্ত মহাসাগর, ইস্তানবুলের মারমারা, আমাস্রার কৃষ্ণ সাগর, বা নিসের ভূমধ্য সাগর– সবই শান্ত। তবু কখনও সখনও তারা উশৃঙ্খল চপলা হয়ে দেখা দেন বৈকি। তবে বলটিক যেন একেবারেই এক স্নিগ্ধ শান্ত বিদগ্ধ বৃদ্ধ। উপরের ছোট ছোট ঢেউয়ের নীচে কত অভিমান বুঝি জমাট বেঁধে হিম হয়ে আছে। 

Helsinki from Baltic Sea
বলটিকের উপর থেকে দেখা হেলসিংকি ও ছোট স্থলভাগ

সেই স্থিরতার তীরে অবস্থিত হেলসিংকি শহর ধীরে ধীরে আমাদের নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, এ যেন তার রোজকার বিরহমেদুরতা। কেবল মাঝে মাঝে এক আধটা দ্বীপের মতো ভেসে থাকা ছোট ছোট স্থলভূমি তার অস্তিত্বের কথা থেকে থেকে মনে করিয়ে দেয়। 

কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। খেয়াল হতে দেখি এখন আর স্থলভাগের দেখা মেলে না, শুধুই জল। এবার একটু গলা ভেজানো দরকার। গৌরব বারের ভিতরেই একটা কোণায় জায়গা দেখেছে। দুপাত্তর হলে মন্দ হয় না। (চলবে)

*ছবি সৌজন্য: Opensource, Estonica.org ও লেখক

Rupak bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

One Response

  1. রূপক বর্ধন রায়, আপনার হৃদয়ের সঙ্গে হাত চমৎকার সঙ্গত করে। পাঠক মুগ্ধ হয়, পরের কিস্তি কবে পাবো তার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *