হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’বলছে প্রাকৃত শব্দ ‘কিসর’ বা ‘কৃসরা’ থেকে ক্রমান্বয়ে খিচরি (রী/ড়ি/ড়ী) হয়ে আজকের অপভ্রংশ এই খিচুড়ি শব্দের বিবর্তন। গ্রিক সম্রাট সেলুকাস ৩০৫ থেকে ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত আক্রমণের সময় “খিসরি” নামে একটা খাবারের উল্লেখ করেন যেটি চাল ও ডাল সহযোগে তৈরি। মরক্কো পরিব্রাজক ইবন বতুতা ১৩৫০ খ্রিঃ ভারতের থাকাকালীনও খিচুড়ি জাতীয় খাবার দেখেছিলেন বলে শোনা যায়।
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ‘নিরামিষ আহার’-বইতে রাজবল্লভের এই শ্লোকটি পেলাম খিচুড়ি নিয়ে।
তন্ডুলা দালিসংমিশ্রা লবণারদ্রকোহিংগুভিঃ।
সংযুক্তা সলিলে সিদ্ধা কৃসরা কথিতা বুধৈঃ
কৃসরা শুক্রলা বল্যা গুরুঃ পিত্তকফপ্রদা
দুরজ্জরা বুদ্ধিবিষ্টম্ভমলমূত্রকরী স্মৃতা।
চরকের মতে খিচুড়ির গুণ পোলাও এর অনুরূপ। “তদ্বন্মাষতিলক্ষীরমুগদসংযোগসাধিতাঃ”।
সুকুমার রায় এই খিচুড়ির মাহাত্ম্য সেই কবেই বুঝেছিলেন। নয়তো ব্যাকরণ বহির্ভূত হাঁসজারু কিম্বা বকচ্ছপের জন্ম হয়? অর্থাৎ যেমন তেমন করে চালে আর ডালে বসিয়ে দিতে পারলেই তালেগোলে খিচুড়ি কিন্তু দাঁড়িয়ে যাবেই। এই যেমন আজ বাংলা এক খিচুড়িভাষায় পরিণত হচ্ছে কালে কালে। বাঙালিদের সবেতেই কথায় কথায় একটা খিচুড়ি পাকানোর অভ্যেস যেন গেলই না, এমনটিও শুনে আসছি বড় হওয়া ইস্তক। আভিধানিক অর্থ বলছে, ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য।’ এমন হচপচ আইডিয়াই ছিল বুঝি খিচুড়ির জন্মলগ্নে। তা সে জগন্নাথদেবের দুর্লভ খিচুড়ি বা দ্বিপ্রাহরিক ভোগের খেচরান্ন হোক। তার থেকেই বুঝি জগাখিচুড়ি শব্দটিরও জন্ম।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাকপ্রণালী’তে প্রায় সতেরো রকমের আর প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ নামক বিখ্যাত বইখানিতেও দেখি কুড়ি রকমের নিরামিষ খিচুড়ির কথা। সহজ পদ্যে তিনি লিখেছেন:
“ডাল আর চালে খিচুড়ি বানায়।
খিচুড়ির স্বাদ পোলায়ে না পায়।
খিচুড়ি বৈষ্ণব ও পোলাও শাক্ত।
নিরামিষ হিন্দু খিচুড়ির ভক্ত।”
প্রজ্ঞাসুন্দরীর কথায়:
“সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেইরূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমাধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। খিচুড়ির এই আনুষাঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনও প্রধান হলো ইলিশ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়েই বাঙালীর অন্যতম প্রিয়…।”
আলবেরুনি তাঁর ‘ভারততত্ত্ব’-তে যেমন খিচুড়ি প্রসঙ্গ এড়াননি তেমনই ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে আছে পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ করছেন শিব। ডাবের জল শিবপার্বতীর ধাম কৈলাসে না পাওয়া গেলেও মনসামঙ্গলের রচয়িতা বিজয়গুপ্ত যেখানে জন্মেছিলেন, অর্থাৎ বরিশাল, সেখানে যে থিকথিক করছে নারকোল গাছ! তাই ডাবের জলে খিচুড়ি রান্না সেদিক থেকে কিছু অমূলক নয়। ‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’ এই পংক্তিও মঙ্গলকাব্যেই পাই। ইলিশের সঙ্গতে বাঙালির খিচুড়ি নাহয় বর্ষাকালীন আবেগ। কিন্তু ইলিশের বিরহে বাকী ঋতুগুলিতে? পোরের ভাজা, লাবড়া, ছ্যাঁচড়া সহযোগেও খিচুড়ি দৌড়তে থাকে বাঙালি হেঁশেলে।

ওদিকে মুঘল বাদশাদের খাদ্যপ্রীতি নিয়ে আমাদের জানতে বাকি নেই। তাঁদের তুমুল মাংসপ্রীতির কারণে আমাদের রসনা সংস্কৃতির অভ্যন্তরেও আজ প্রবেশ করেছে কাবাব, বিরিয়ানি, পোলাওয়ের মতো জনপ্রিয় সব ডিশ। আবার তাঁদের বাখরখানি বা শিরমল-প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার কারণে আমরাও চিরকালের মতো নানান ধরনের রুটি পরোটা বানাতে শিখে গেছি দিব্য। এবার যে কথাটি না বললেই নয় তা হল, মুঘল দরবারে খিচুড়ির জনপ্রিয়তা। মাছ, মাংস, ডিম সব একপাশে সরিয়ে রেখে জাহাঙ্গীর নাকি গুজরাতি খিচুড়ির প্রেমে পড়ে গেছিলেন। কিন্তু মহার্ঘ্য সব রাজকীয় খানাপিনার সঙ্গে খিচুড়ির তো পংক্তিভোজনে বসার অধিকার নেই। সেই খিচুড়ি শুধু জাহাঙ্গীরই কেন, তাঁর পিতা আকবরেরও ফেভারিট ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ মুঘল সম্রাটদের তো বিত্ত বৈভবের অভাব ছিল না! তাহলে? কী ছিল তবে সেই হাঁড়ির মধ্যে চালে ডালে বসিয়ে দেওয়া খিচুড়ির রহস্য?
আকবরের খিচুড়ি-প্রীতির কথা তো সবাই জানে। বীরবলের বাঁশের উপরে হাঁড়ি বেঁধে নীচে আগুন জ্বালিয়ে খিচুড়ি রান্নার সেই গল্প কে না শুনেছে? এমনকী আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও আকবরের প্রিয় বিভিন্ন রকমের খিচুড়ির কথা রয়েছে। হুমায়ুনকে তার বেগম হামিদা খিচুড়ি তৈরি করে খাইয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরের প্রিয় ছিল পেস্তা, কিসমিস দিয়ে তৈরি বিশেষ এক রকমের খিচুড়ি, আদর করে যার নাম রাখা হয়েছিল “লাজিজান”। আবার আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি হত নানা রকমের মাছ আর ডিম দিয়ে তাঁর প্রিয় “আলমগিরি খিচড়ি”। বাহাদুর শাহ জাফর মুগডালের খিচুড়ি এতই ভালবাসতেন যে সেই সময় মুগডাল ‘বাদশাহ-পসন্দ’ নামে বিখ্যাত হয়ে গেছিল। হায়দ্রাবাদের নিজামের খিচুড়ির মধ্যে থাকত সুস্বাদু মাংসের কিমা।
সে যাইহোক, খিচুড়ি গুজরাতিই হোক কিম্বা বাঙালি, মুঘল দরবারে যে সুপারহিট রেসিপি তা আশা করি এতক্ষণে বোঝা গেছে। বৈদিক সাহিত্যে “ক্রসরন্ন” নামে যে শব্দটি পাওয়া যায় কিম্বা সংস্কৃতে ‘কৃশরান্ন ‘ বা ‘খিচ্চা’ নামের যে সুখাদ্যের কথা আছে তা মূলত তিল, মুগডাল আর চালে ঘৃতপক্ব অন্ন। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, চাল আর ডাল যেমন আলাদা খাওয়ার চল ছিল, তেমনই চাল আর ডাল সমানুপাতে মিশিয়েও খাওয়া হত। চাণক্যের বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে এক খিচুড়ির বিবরণ আছে। সেখানে চাণক্য সুষম আহার প্রসঙ্গে এক প্রস্ত চাল, সিকি প্রস্ত ডাল, ১/৬২ প্রস্ত লবণ আর ১/১৬ প্রস্ত ঘি দিয়ে তৈরি খাবারের কথা বলেছেন। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও মৌর্য রাজাদের হেঁশেলে এই চালে ডালে মেশানো খাদ্যের কথা রয়েছে।

পঞ্চদশ শতকে রাশিয়ার ব্যবসায়ী ও বিখ্যাত ভ্রামণিক আফানাসি নিকিতিনের রচনায় দক্ষিণ ভারতে এই চাল ডাল মিশিয়ে খাওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভারনিয়েও লিখেছেন ভারতীয় হেঁশেলের সর্বত্র এই খিচুড়ির কথা। উনিশ শতকে ইংরেজরা সসম্মানে ইংল্যান্ডের প্রাতরাশে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই খিচুড়ি বা “কেজড়ি”কে। রানি ভিক্টোরিয়া ভারতে থাকাকালীন তাঁর উর্দু শিক্ষক আবদুল করিম ওঁর স্ত্রীর হাতের রান্না নানা পদ এনে রানিকে খাওয়াতেন, যার মধ্যে রানির সবচেয়ে পছন্দের ছিল মুসুর ডালের খিচুড়ি। এই ডাল তখন, মলিকা মুসুর নামে প্রচলিত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি মিশরীয়দের মধ্যে “কুশারি” নামে একটি পদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি তৈরি হত চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটোর রস, পেঁয়াজ, আদা, রসুন প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে। রন্ধনপ্রণালী হিসেবে এই কুশারীকে খিচুড়িরই একটা ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে।
অতএব মোদ্দা কথা হল সংস্কৃত কৃশরান্ন বা খিচ্চা, ইবন বতুতার কিশরি, মিশরীয় সৈন্যশিবিরের চটজলদি রান্না কুশারি, আর ভারতীয়দের কমফর্ট ফুড খিচুড়ি বা খিচরি যাই বলি না কেন, সবেতেই মধ্যমণি দুজন: চাল এবং ডাল। তারপর এশিয়ার নানান রসুইঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতোই হয়েছে খিচুড়ির ইম্প্রোভাইজেশন। চাল ডালের মধ্যে মাংস পড়েছে। সবজি পড়েছে। ডিম, মাছ, আরও নানাকিছু যুক্ত হয়ে খিচুড়িকে মহার্ঘ্য করে তুলেছে।
“বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ
বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।”
বাঙালির সংসারে সারাবছর যোগাড় থাকে খিচুড়ির। তবে ভোগের খিচুড়ির স্বাদ যেন সবচেয়ে সুখকর। সম পরিমাণ গোবিন্দভোগ চাল আর শুকনোখোলায় ভেজে রাখা সোনামুখ ডাল মেপে ধুয়ে ভিজিয়ে নিলেই হল। তবে ডাল একটু বেশি দিলে আরও তার হয়। ডুমো ডুমো ফুলকপি, কুচোনো গাজর, বিনস আর মটরশুঁটি পড়লে কথাই নেই।

এবার মশলা রেডি করার পালা। একটা বাটিতে গ্রেট করা আদা, ট্যোম্যাটো কুচি, জিরে আর ধনের পাউডার। সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো। এবার চাল ডাল ধুয়ে আধা সেদ্ধ করে নিয়ে অন্য ডেকচিতে সামান্য সরষের তেলে তেজপাতা, জিরে আর গোটা গরমমশলার ফোড়ন। চড়বড়িয়ে উঠলেই আদা-মশলার পেস্ট। সবশেষে চালডাল সেদ্ধ দিয়ে নাড়াচাড়া, ওলটপালট। এবার সবজি দিয়ে মেপে জল ও নুন হলুদ ছেটানো। নারকেলকুচি দিলে অতি উত্তম। চাল ডাল সেদ্ধ হলেই স্বাদ অনুসারে চিনি। তবে নাড়তে হবে প্রতি মিনিটে। তলা লেগে গেলেই এক্কেবারে মাটি।
বর্ষার দিনে চালে ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়ার মতো ঝাড়াঝাপটা মেন্যু আর কিছুই নেই। শুধু সঙ্গে যদি থাকে জবরদস্ত একটা ছ্যাঁচড়া বা লাবড়া আর কিছু না কিছু মুচমুচে ভাজা।
*ছবিঋণ: Jaagonews, Facebook, Youtube, Cookpad
*মূল ছবি: লেখকের সৌজন্যে
*তথ্যঋণ:
পাকপ্রণালী – বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
নিরামিষ ও আমিষ আহার -প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী
বিভিন্ন সংবাদপত্র
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
দারুন একেবারে খিচুড়িতে জমে গেছিলাম।