বহু বহু দিন গৃহবন্দি, তাই বেশ খানিকটা মনোরোগ আর শারীরিক রোগ চেপে বসেছিল। ইন শর্ট, পাগল পাগল হাল! মনোরোগ কী রকম? ওই একটু মেঘ একটু বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব হলেই পাহাড় পাহাড় ইলিউশন হচ্ছিল। কানে ঝরনার আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁর ডাক… নাকে শ্যাওলা আর ফার্নের গন্ধ।

একটু সুযোগ পেতেই বেরিয়ে পড়তে হল পাহাড়ে! হাত বাড়ালেই কালিম্পং আর দার্জিলিং। কালিম্পং যাওয়া স্রেফ পাহাড়ের জন্যে আর দার্জিলিং? বলাই বাহুল্য! সকালে যাব ক্যাভেন্টার্স, দুপুরে গ্লেনারিজ়, রাতে গাটিস কাফে…। পরদিন সকালে সোনমস কিচেন, দুপুরে কুঙ্গা রেস্তোঁরা…। দাঁড়াও দাঁড়াও! যাচ্ছি তো এক দিনের জন্যে মেরেকেটে। অত সময় কই হে! আচ্ছা লিস্টে এ সব থাক…। তারপর চৌরাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে, ম্যাল রোডের ওই চেয়ারে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে ক্ষিদে অনুযায়ী যেখানে হোক যাওয়া যাবে…। রাস্তার ধারে শা ফলে‘-ও তো খেতে হবে!

sha phaley in Darjeeling
রাস্তার ধারে ‘শা ফলে’-ও তো খেতে হবে!

কালিম্পংয়ে দু’দিন মহড়া চলল ক্ষিদে বাড়ানোর। কয়েক কিলোমিটার আপহিল আর ডাউনহিল হাঁটা যাতে ডাইজেস্টিভ সিস্টেম থাকে চনমনে। তারপর…

নীল আকাশ আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে কালিম্পং থেকে যাত্রা শুরু। যতবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি, ফেলুদার মতোই মনে হয়, বয়সটা কিছুটা কমে গেল, আর টুক করে বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতাখান আউড়ে ফেলি মনে মনে…

অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে!
দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে…‘ 

Kanchenjunga
এ দৃশ্য ভোলার নয়

সোনাদা ঘুমের বাঁকে বাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর লাল গুরাস দেখতে দেখতে জটায়ুর মত, ‘সাবলাইম, অনির্বচনীয়, স্বর্গীয়, অপার্থিব বলতে বলতে পৌঁছলাম দার্জিলিং। কাঞ্চনজঙ্ঘা! এই একটা দৃশ্য যা কখনও পুরনো হয় না, যতই দেখি…। ব্যাগপত্তর রেখেই শুরু হল খাবার অভিযান। প্রবল খিদের মুখে চল গ্লেনারিজ়। তারপর কী কী খাওয়া হল কি হল না সে সব জানে আমার পেট আর এনজাইমের পাতা…।

সাহেবি শহরে সাহেবি খাবার ছাড়াও নেপালি আর তিব্বতী খাবার টার্গেট ছিল। কত বছর কত ইতিহাসের সাক্ষী দার্জিলিং, কত ধরনের মানুষ, খাবারের বৈচিত্র্যও বলাই বাহুল্য! সোনমস কিচেন বন্ধ থাকায় নেপালিটা বাদ গেল। কিন্তু কেভ থেকে নীচে নামার পথে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে একটা ছোট্ট তিব্বতী রেস্তোরাঁ.. প্রাণ ভরে আর মন ভরে খেলাম থুকপা, চিলি পর্ক, বিফ ফিং, থেনথুক, গ্যথুক আর অবশ্যই টিবেটান মোমো, তিব্বতী লঙ্কার চাটনি দিয়ে। ইয়ে মানে একা খাইনি এত কিছু… অনেকে মিলেই!

ওদের তিনটে খাবারের কথা আজ আপাতত বলি… যা দিয়ে একদিন তিব্বতী নৈশভোজ হয়ে যাক তাহলে!

১. চিলি পর্ক
২. বিফ ফিং স্টার ফ্রাই
৩. তিব্বতের স্টিমড বান, টিংমো যেটা ওপরের দুটোর সঙ্গেই খাওয়া যায়। সঙ্গে একটা তিব্বতী লঙ্কার চাটনি আর বড় এক কাপ বাটার চা দিয়ে! ওই কনকনে জমে যাওয়া ঠান্ডায় এও কম অপার্থিব, অনির্বচনীয়নয় কিন্তু!

যাই বল তাই বল, রেস্তোরাঁতে খেয়ে আসার পর, বিশেষ করে ওই সুদূর পাহাড়ে, বাড়িতে এসে কখনও না বানালে চলে? গরম পড়লে পাহাড়ের জন্যে মাঝে মাঝেই মন কেমন করে তো! তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা…!

সবার আগে তিব্বতী চাটনি বা সস:

৩-৪ টে টমেটো
২-৩ টে তিব্বতী গোল্ডেন চিলি/ অ্যালেপিনো/ যে কোনও পছন্দের ঝাল লঙ্কা
২-৩ কোয়া রসুন
৩-৪ গাছা ধনে পাতা/ সেলেরি
নুন স্বাদ মতো
অল্প সাদা তেল, যে কোনও রকম
আর ৪-৫ দানা শেজ়ুয়ান পেপার/ কিম্বা গোলমরিচ

Cafe in Darjeeling
দার্জিলিংয়ের ক্যাফে

ওপরের সমস্ত কিছু মিক্সারে পেস্ট করে নিয়ে, কড়ায় তেল গরম করে, ঢিমে আঁচে ফুটিয়ে গাঢ় করে নিলেই রেডি।

তারপর চিলি পর্ক:

হরিণঘাটা থেকে কিনে আনলাম ৫০০ গ্রাম পর্ক বেলি। পাতলা স্লাইস করে কাটলামমাংসটা একটু ফ্যাট সমেত হলে টেস্ট বেশি হয়, আমার স্বাদমতে..

আদা কুচি, দু চামচ
রসুন কুচি এক চামচ
পেঁয়াজ ডাইস করা আধ কাপ
লাল আর হলুদ বেল পেপার ডাইস করা আধ কাপ করে
টমেটো ডাইস করা একটা
গোল্ডেন পেপার স্লিট করা কয়েকটা
সোয়া সস ৩-৪ চামচ
আর এম্মা মানে শেজ়ুয়ান পেপার কয়েকটা

Chilli Pork in Kunga Restaurant
দার্জিলিংয়ের কুঙ্গা রেস্তোরাঁয় চিলি পর্ক

পাতলা স্লাইস করা পর্ক অল্প নুন, স্টার অ্যানিসগুঁড়ো আর অল্প আদা-রসুনের রস দিয়ে ম্যারিনেট করাই ছিলসেটার ওপরটা বেশ মুচমুচে ফ্রাই করে, সেই তেলে রসুন আদাকুচি নেড়ে, তাতে একে একে পেঁয়াজ, বেলপেপার টমেটো দিয়ে, সোয়া সস নুন লঙ্কা দিয়ে নামিয়ে নেওয়া…

ডিনারের একটা মেনু রেডি।

সেকেন্ড মেনু:

বিফ ফিংগ… “Phing” হলো গ্লাস নুডলস।

একদম ছোট্ট টুকরো বিফ নুন আদা-রসুনের রস দিয়ে ম্যারিনেট করা।
গ্লাস নুডলস, যেটা কাচের মত স্বচ্ছ সেদ্ধ করা দু’কাপ (আজকাল অনলাইনে কী না পাওয়া যায়!)
জুলিয়েন কাট সবজি, পছন্দমতো
পেঁয়াজ জুলিয়েন কাট
রসুন আর আদা কুচি এক চামচ
সোয়া সস
এম্মা পেপার
গোল্ডেন তিব্বতী পেপার
এই দুটো না থাকলে গোলমরিচ আর শুকনোলঙ্কা

Beef Fing in Kunga
কুঙ্গা রেস্তোরাঁয় বিফ ফিং

ওরা এতে ওয়াইল্ড ফুড প্লান্ট কিম্বা ফিডলহেড ফার্ন এর ফ্রন্ড-ও ব্যবহার করে দেখলাম, স্টার ফ্রাই করে।

এবার গ্লাস নুডলস গরম জলে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে নরম হলে ড্রেইন করে রাখতে হবে। ওদিকে কড়ায় তেল দিয়ে তাতে শুকনোলঙ্কা, আদা রসুনকুচি দিয়ে বিফের ছোট্ট টুকরোগুলো ভাল করে স্টার ফ্রাই করে নিতে হবেতাতে এম্মা পেপার, সোয়া সস, জুলিয়েন কাট সবজি, আর শেষে গ্লাস নুডলস দিয়ে নেড়ে নুডলস স্বচ্ছ হলে নুন স্বাদ মতো দিয়ে নামিয়ে নাও। 

Red Guras and Honey Bee
লাল গুরাসের মধু খাচ্ছে ছোট্ট পাখি

এবার টিংমো:

ময়দা এক কাপ
ইস্ট এক চামচ
এক চামচ চিনি
একটু গরম জল
একটু নুন
আর আধ চামচ বেকিং পাউডার

Tingmo and Home Made sweet bun
বাড়িতে তৈরি বান দিয়ে তৈরি টিংমো

ইস্ট অ্যাক্টিভেট করে সেটা আর বাকি জিনিস দিয়ে ময়দা মেখে ফুলে ওঠার জন্যে ঢেকে রাখতে হবে বেশ অনেকক্ষণ। তারপর  অল্প তেলে, মিহি রসুনকুচি আদাকুচির সঙ্গে ধনেপাতা আর পেঁয়াজ শাক কুচি দিয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে।

ময়দা ফুলে উঠলে, আবার একবার মেখে নিয়ে চৌকো করে বেলে, ওই আদারসুন ভাজার প্রলেপ দিয়ে স্প্রিং রোলের মতো রোল করে নিতে হবেতারপর ছুরি দিয়ে গোল গোল চাকতির মতো টুকরো করে কেটে নিয়ে স্টিমারে ১৫-২০ মিনিট স্টিম করলেই রেডি, তিব্বতী স্টিমড ব্রেড!

Tibetan Momo and Red Chutney
তিব্বতী মোমো এবং লাল সস

তিব্বতী ডিনার রেডি তাহলে! সময় আর এনার্জি থাকলে তিব্বতের মোমোও করা যেতে পারে। ব্যাস! সঙ্গে একটু বাটার টি বা “পো চা” কিম্বা “ছাং” নিয়ে বসে পড়া যাক, দেরি কিসের!

শেলাক নেবো নাঙ-রক!‘ 
( কী বললাম, এইরে!!)

 

*সব ছবি লেখকের তোলা

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *