নির্বাচন সবে শেষ হয়েছে। এখনও রঙিন হয়ে রয়েছে দেওয়ালগুলি। ‘রঙিন‘ নাকি ‘নোংরা‘ দেওয়াল? কেন স্লোগানগুলি আধুনিক ম্যুরাল বা স্ট্রিট আর্টের ধাঁচে লেখা হল না সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে? এখনও কেন সেই সেকেলে শব্দপ্রয়োগের আকচা-আকচি? অথচ, শহরের দেওয়ালে তো ক্রমে বেড়েই চলেছে গ্রাফিতি, ইন্সটলেশান, মিক্স-মিডিয়া, স্ট্রিট আর্ট জাতীয় চিত্রকলার নতুন নতুন ভাষা। অথচ, এ বঙ্গের রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ালে ছুড়ে মারায় তার প্রকাশ নেই কেন, কে জানে!
অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের পাড়ার ম্যুরালগুলোই হোক বা প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে বিখ্যাত সংবাদপত্র দফতরের অফিসের সামনের শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর বরুণ সেনগুপ্তের ম্যুরালই হোক, বেহালায় সনাতন দিন্দার ইন্সটলেশান বা মিন্টো পার্কে-র নারীপাচারের গ্রাফিতি; একটা নতুন কলকাতা ডালপালা মেলছে এভাবে, ছোট ছোট পরিসরে। দক্ষিণ কলকাতার অলিগলিজুড়ে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা এঁকে রাখছে যা কিছু প্রতিবাদ ও ভালোবাসা। তা ছড়িয়েও পড়ছে বইয়ের হরফ থেকে সিনেমার পর্দায়। রাস্তাতেই নেমে আসছে মঞ্চ ছেড়ে রাগীমুখো চরিত্ররা।
এমনিতে, এ শহরের মৌলালি মোড় তো অনেক আগেই দেখেছে বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার। তারও আগে, এ শহরের জন্মের প্রাকলগ্নেই তো আঁকা হয়েছে কালীঘাটের পটচিত্র। সময়ের হাত ধরে সে বার্তাই বদলাতে বদলাতে আপনি দেখছেন আপনার পাড়ার দেওয়াল রঙিন হয়ে উঠছে হঠাৎ। রঙিন হচ্ছে বিদ্যুৎবাক্সগুলি গ্রাফিতিতে। এবং বহুদিন পর দেখতে সুন্দর লাগছে আপনার নিজের পাড়ার দেওয়ালগুলোকে, যা সচেতনতার বার্তাও দিচ্ছে বারবার…

কী এই ম্যুরাল? আসলে ইন্সটলেশনের নানা ভাগের একটি ভাগ। যেখানে, গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এসে ছবি আঁকা হয় রাজপথে। আঁকা হয় মুখ্যত মানুষের মুখই। আমজনতার জন্য। আপনি হাঁটাচলার পথে সার্দান এভিনিউতে দেখছেন পরপর দেবকী বসু বা সত্যজিৎ রায়কে, বিদ্যুৎবাক্সে। আপনার মনে পড়ছে, এখানেই কাছাকাছি কোথাও তাঁরা থাকতেন। মিন্টোপার্কের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। আর লা‘ মার্টিনিয়ার স্কুলের দেওয়ালে ভেসে উঠছে, নারী নিরাপত্তার বিশাল বিশাল রঙিন ছবি। তাতে নানা পেশায় মেয়েদের ভূমিকা আঁকা। পাশে লেখা, নিরাপত্তা বিষয়ক নানা কথাও।
আপনি চমকিত হচ্ছেন। মন বলে উঠছে অজান্তেই, বাহ! লেক বা বিবেকানন্দ রোডের রাস্তায় অবশ্য কিছুটা আলাদা ম্যুরাল। সেখানে কোথাও ফুল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। তো, কোথাও বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দের ছবিও ভেসে উঠছে আচমকা । কেয়াতলা লেন বা ডোভার রোডে কারা আবার এসে এঁকে দিয়ে গেছে, উড়ন্ত শিশুদের। এভাবেই কোথাও বিন্দুমাত্র পরামর্শ বা মরালিটির ভারিক্কি বাণী না দিয়েই, সময়টাকে কামড়ে ধরছেন শিল্পীরা। বাঘ যেভাবে শিকার ধরে… লিখে গিয়েছেন একদা, এ শহরের কবীর।
পাশ্চাত্যে এই ফর্ম পুরোনো। ব্যাংক্সির নাম এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলার। এই শিল্পীর প্রকৃত পরিচয় আজও জানা না গেলেও, ব্রিস্টল-সহ নানা দেশের রাস্তায় আজ ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর রাজনৈতিক ছবিগুলি। লুকিয়ে থেকে খেলা দেখিয়ে চলেছেন ব্যাংক্সি এভাবেই। কেউ জানছে না রাস্তায় দেখা ছবিগুলি কে এঁকেছে! কিন্তু ধাক্কা খাচ্ছে। বারবার শাসক তা মুছেও দিচ্ছে। আবার আঁকা হচ্ছে সেগুলি। ম্যুরালের সঙ্গে এভাবেই জড়িয়ে যাচ্ছে লড়াই। ‘স্যানিটাইজেশান‘ হয়ে উঠছে অনিবার্য একটা প্রসেস এইসব ছবির। কারণ ছবিতে রয়েছে রক্তের ছিটে। বা, আগুনের ডালপালা ও হাহাকার…

কলকাতার দেওয়ালের এসব চিত্রকলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শানু লাহিড়ির নাম। চলে আসে চিত্তপ্রসাদের নামও। দু’জনেই বামপন্থী ঘরানায় চেয়েছিলেন রাস্তায় ছবি আঁকতে। মানুষের মধ্যে চলে যেতে বারবার। মনে পড়ে যেতে পারে রামকিঙ্করের শান্তিনিকেতনের মুক্ত ভাস্কর্যর কথাও। খোলা আকাশের নীচে সেসব কাজকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ম্যুরাল প্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী হিরণ মিত্রের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন:
‘এমনিতে ছবিগুলি দেখতে ভাল লাগছে। ক্যানভাসের এস্থেটিক আর সাইট স্পেসিফিক দেওয়ালের নন্দনতত্ত্ব আলাদা। দুটোয় বিরোধ আছে। তবু এই সব কাজে চেষ্টা ও শ্রমের ছাপ স্পষ্ট। তবে স্থানীয় মানুষেরা ছবিগুলিকে কীভাবে দেখছে সেটাও জানার। যারা ফুটপাতে ঘুমোচ্ছেন, তাঁদের মাথার উপর আঁকা ছবিগুলি, তাঁরা কীভাবে দেখছেন ছবিগুলি সেটাও জানার।’
চিত্তপ্রসাদ ও শানু লাহিড়ির স্ট্রিট আর্ট প্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পচিন্তক ও লেখক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছিলেন:
‘চল্লিশ দশকের দৈনন্দিনতাকে যেভাবে সবল রেখায় চিত্তপ্রসাদ ধরেছিলেন, আজ পেলব শান্তিনিকেতন যখন ভেঙে পড়েছে তখন আমরা আবিষ্কার করছি চিত্তপ্রসাদ আমাদের মুক্তির আলোরেখা। এ প্রসঙ্গে শানু লাহিড়ি আর বিজন চৌধুরীর নামও আমাদের বলতে হবে। বিজনবাবুর মৌলালি যুব কেন্দ্রের কাজগুলির কথাও বলতে হবে, যে অনবদ্য কাজগুলি পরে ভেঙে দেওয়া হয়। মূলত, ৬৮-র ফ্রান্সেই এই ম্যুরাল বা গ্রাফিতি জ্বলে ওঠে। সরবোঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাসাইলামের দরজাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানান ছবিতে। কলকাতায় সত্তরের দেওয়াল লেখায় মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখে একদল দক্ষিণপন্থীরা তাকে সাংস্কৃতিক পাঠ্যক্রমের বাইরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা বলতে শুরু করেছিলেন, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।

আসলে, শহরের সৌন্দর্য বেঁচে থাকে অন্তরের কান্নায়। সত্তর দশকে এ ছবিগুলো বন্ধ করা হয়েছিল শহরকে হাসপাতাল বানানোর জন্য। আজ আবার হিরণদা বা সনাতনরা রাস্তায় এ কাজ করছেন, এ তো পাগলামির কারুশিল্প এক রকম। মিশনারি বা ধর্মীয় আখড়ার বা হাসপাতালের বা কর্পোরেটের-স্তব্ধতার বদলে আমরা চাই আবার পশম পরিহিতা ভেনাসকে। চাই, মায়াকভস্কি আবার তাঁর কবিতায় ট্রামগুলো রাঙিয়ে দিক শহরের। শানু লাহিড়ির আত্মীয় সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদারের কথাও মনে পড়ছে। আমাদের জীবনের অসুন্দরের রাজত্বকে সরিয়ে কমলবাবু চেয়েছিলেন, দোয়েল কোকিল থাকুক আমাদের জীবনের পথ চলায়। তাই ছোট ছোট রেখা বা মন্দিরের গায়ের কারুকার্যগুলি তিনি সনাক্ত করছিলেন ছোট রেখাচিত্রে। আজ সেসব দিয়েই এই পল্লিসভ্যতাকে বিদ্রূপ করতে পারি।‘
তবে, এ প্রজন্মের চিত্রকর অসীম পাল অভিযোগের সুরেই জানালেন, সরকারি তরফে এ ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও নতুন ধারার এসব ছবি শহরকে যে নতুন ভাষা দিচ্ছে, তা এক কথায় মেনে নিলেন সকলেই।
কথা হচ্ছিল ভাস্কর্য শিল্পী ও চিত্র-গবেষক ধ্রুপদী ঘোষের সাথে। বিশ্বভারতী ও জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন এই নতুন ধারার মাধ্যমগুলি নিয়ে তাঁর পাঠ। বলছিলেন, ‘ম্যুরাল বা গ্রাফিতির সঙ্গে মিউজিয়াম আর্টের স্পষ্ট ফারাক আছে। ১৯৬৮-র ফ্রান্স বা হালের সিরিয়ার দেওয়াল চিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায়, এগুলির বার্তা তীব্রভাবে রাজনৈতিক। তাই এগুলিকে প্রশাসকরা মুছে দেবেন সেটাই স্বাভাবিক। মোছার পরেও আবার রাস্তার দেওয়ালে আঁকা হচ্ছে সেই চিত্র। শাসকের সঙ্গে শিল্পীর এই লড়াই এভাবে চলতেই থাকবে নিত্য। কখনওই গ্যালারি বা মিউজিয়ামের ‘কমফোর্ট জোন‘ প্রত্যাশিত না এসব ছবির জন্য।’
কলকাতার রাস্তাতেও বারবার এমন চিত্র এঁকেছেন ধ্রুপদী ও তাঁর কমরেডরা। কেমন ছিল সেসব চিত্রের স্লোগান? জানালেন, পুরনো স্লোগান ফিরিয়ে এনেই কখনও লেখা হয়েছে, ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ প্রতিবাদ করি‘… কোথাও বা তাঁরা লিখেছেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না/ তা হবে না তা হবে না‘। বা, ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন‘ কলকাতার রাস্তায় লেখার পর মুছে দেওয়া হয়েছিল তাও জানালেন ধ্রুপদী। তবে এই মাধ্যমের শক্তি প্রবল বলেই এই মাধ্যমকে সম্প্রতি ব্যবহারও করার চেষ্টা করছে মূলধারার বাজার। এবং সেখানেও আর একটা নিত্য লড়াই জারি থাকছে।

সার্দান এভিনিউ সংলগ্ন হোয়াটসাপ কাফের জন্য দেওয়াল চিত্র আঁকছিলেন শুভ কামিল্যা। আর্ট কলেজের ছাত্র শুভর এই কাজটি তাঁর শিক্ষক পূণ্য মুখোপাধ্যায়র সঙ্গে করছেন। কেমন লাগছে কাজ করতে? জানালেন, কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই অঞ্চলটি। নানা শ্রেণীর মানুষের বাস। তাঁরা আসা যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে বারেবারেই খোঁজ নিচ্ছেন, ‘কী ছবি আঁকছেন?’ জানালেন আরও, যেহেতু এটা ‘অ্যাসাইন্ড প্রোজেক্ট‘ তাই প্রখ্যাত নানা শিল্পীর জনপ্রিয় কাজকেই নতুনভাবে আঁকছেন তাঁরা। যাতে মানুষের স্মৃতিতে আরেকবার ফিরে আসে সে ইতিহাস।
এখানে যেমন ভ্যান গখ, অ্যান্ডি ওয়্যারহল, ফ্রিডা কাহলো আছেন, তেমনি আছেন দালি ও পিকাসো। ‘ম্যুরাল সম্পর্কে কি সচেতনতা বাড়ছে মানুষের?’ শুভর মতে, ‘বাড়ছে তো বটেই। আগামী বছরগুলোয় আরও বাড়বে বলেই মনে হয়।‘

সব মিলিয়ে যে এ এক নতুন কলকাতার চালচিত্র, তা মেনে নিলেন সকলেই। বারবারই নতুন শিল্প মাধ্যমকে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছেন কলকাতার মানুষ। পকেটের পয়সা খরচ করে দেখেছেন নতুন সিনেমা বা চিত্রকলা, শুনেছেন গান। নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই এসেছে নতুন নতুন মাধ্যম। নব্বইয়ের বিশ্বায়নের পর থেকে ডিজিটাল প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, তারা বেড়েছে।

এই নতুন প্রজন্ম সিনেমা দেখে নেটফ্লিক্সে, গাড়ি ডাকে উবর বা ওলাতে, আড্ডা দেয় ফেসবুকে আর খাবার চায় সুইগিতে। এদের প্রকাশের ভাষা তো আলাদা হবেই। এমনই মনে করছেন সমাজতাত্ত্বিকেরাও। তবে মজা এটাই, তিনশো বছরের এই শহরে, প্রকাশ আলাদা হলেও কেউই ছিন্নমূল না। শেকড় ধরেই বেড়ে উঠছে এ প্রজন্ম আকাশের দিকে। যে শেকড় বুনে দিয়েছিলেন শানু লাহিড়ী, চিত্তপ্রসাদ, বাদল সরকারেরা। তাঁদের উত্তরাধিকার সানন্দে কাঁধে তুলে নিয়েছে মিলেনিয়াল প্রজন্মের শিল্পী-সাহিত্যিকরা।
আজ যখন দাউদাউ করে জ্বলছে দেশ, তখন নতুন নতুন ফর্মে প্রতিবাদের ছবি আঁকছেন, গাইছেন তাঁরা। জোট বাঁধছেন। নতুন ভারত জেগে উঠছে নতুন ভাষায়, নতুনভাবে, এভাবেই… শহরজোড়া আবহমান দৃশ্যদূষণ কি তবে বদলাবে কিছুটা? আশায় রয়েছে উত্তরকাল।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।
দেবর্ষি দা, বড্ড দেরি করলাম লেখাটা পড়তে। খুব ভাল লাগ্ল লেখাটা । তবে ওয়ি সময়তেও প্যারালাল রাজনৈতিক কিছু গ্রাফিতির কিছু কাজ হয়েছে কলকাতার রাস্তায় । ভেবেছিলাম আপনি সেগুলোর কথাও লিখবেন। এই ভোট এর আগে কলকাতার রাস্তায় নো ভোট টু বিজেপি বলে এক্তা কেম্পেইন হয়েছিলো তারাও চমৎকার কিছু গ্রাফিতি এঁকেছিল সিএএ এনারসি নিয়ে , সেগুলোও রাজনৈতিক ভিত্তিতে খুব চমৎকার। আমি হাতিবাগান বাগবাজার গড়িয়াহাট অঞ্চলে সেগুলো দেখেছি। আপনার পড়ে সেগুলো চোখে পরলে সেগুলো নিয়েও লিখতে পারেন।