‘নে তোরই জিত।’ বাচ্চা ছেলেটির হাতে ক্যাডবেরির প্যাকেটটা ধরিয়ে এভাবেই চলে যান ‘কাঞ্চনজঙঘা’র মিস্টার ব্যানার্জি। সেই ছেলেটি, এখন তিয়াত্তর বছরের প্রবীণ, ‘গুঁইয়ে’ শেরিং শেরপা আবার জিতলেন, ৬০ বছর পরেও। পেলেন এ যুগের কিছু বিশিষ্ট অভিনেতার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম। এক অদ্ভুত সমাপতন তাঁকে মিলিয়ে দিল রায় পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের সঙ্গেও।
ঘটনাটা এই রকম। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দার্জিলিংয়ের ম্যালে শুটিং চলছিল ‘মাস্টার অংশুমান’ ছবির। সত্যজিৎ রায়ের গল্প অবলম্বনে এই ছবির পরিচালক সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়। শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন দেবেশ রায়চৌধুরী, রজতাভ দত্ত, সুপ্রিয় দত্ত প্রমুখ। সেই ছবির আলোকচিত্রী সত্যজিৎ রায়ের নাতি সৌরদীপ। শুটিংয়ের ফাঁকেই একদিন দোরজে শেরপা নামে এক স্থানীয় মানুষ সুপ্রিয়কে জানান তিনি ‘কাঞ্চনজঙঘা’র সেই শিশু অভিনেতার ছেলে। ফিল্ম ইউনিটের সবাই তখন বলেন, ‘কাল বাবাকে নিয়ে আমাদের হোটেলে চলে আসুন।’
পরদিন দুপুরে হোটেলে এসেই ‘গুঁইয়ে’ ধরলেন সেই অসাধারণ নেপালি গান যা দিয়ে ‘কাঞ্চনজঙঘা’র শুরু ও শেষ।
‘তিমরো সুয়েদো সুয়েদো মা
সিন্দুরা লে ঢাকিয়ে চা
মানা খোলি হাসা, লাউ লাউ’
(বাংলা তরজমা:
‘তোমার সিঁথি ঢেকে গিয়েছে সিঁদুরে
এ বার তো এক বার মন খুলে হাসো।
বেশ, বেশ, ঠিক ঠিক।’)

গান শুনে ফিল্ম ইউনিটের সবাই অভিভূত। এর পর তাঁকে প্রণাম করার পালা। স্মারক হিসাবে গুঁইয়েও সবার গলায় পরিয়ে দিলেন সাদা স্কার্ফ। ভাগ করে নিলেন ‘কাঞ্চনজঙঘা’র কিছু টুকরো স্মৃতি। সুপ্রিয় দত্ত জানাচ্ছেন: ‘ওঁকে দেখে রীতিমতো শিহরণ হচ্ছিল। উনি অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, অনুভা গুপ্তার মতো দিকপালদের সঙ্গে। এঁরা সবাই তো বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের অংশ। তার উপর সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজের সুযোগ পাওয়া!’
‘কাঞ্চনজঙঘা’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নন্দনে যে অনুষ্ঠান হয়, তখন গুঁইয়ে রয়ে যান প্রচারের আ়ড়ালেই। তাঁকে খুঁজে পাওয়া এবং প্রচারে ফিরিয়ে আনার বিরল কৃতিত্ব অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্কার অরুণেন্দ্রের আর এক পরিচয় তিনি নির্ভেজাল সত্যজিৎ প্রেমিক।

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যুক্ত ছিলেন, এমন ৩০ জন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ‘রায়সাহেবের সঙ্গে’ নামে একটি বইয়ের পরিকল্পনা করেন তিনি। সেই উপলক্ষে ২০১৮-র মে মাসে তিনি সপরিবার আসেন দার্জিলিংয়ে। উদ্দেশ্য ‘কাঞ্চনজঙঘা’র সেই শিশু অভিনেতার সাক্ষাৎকার নেওয়া। কন্যার খুঁজে পাওয়া একটি ঠোঙায় সেই অভিনেতার প্রবীণ বয়সের ছবি ছিল। সেই ছবি সম্বল করে অরুণেন্দ্র চষে ফেলেন ম্যালের সমস্ত দোকানপাট। কিন্তু গুঁইয়ে শেরিং শেরপার হদিস কেউই দিতে পারে না। বহু চেষ্টার পর একজনের সাহায্যে পৌঁছন তাঁর বাড়ি। দার্জিলিং রেল স্টেশনের কাছে সেই বাড়ি গিয়ে অরুণেন্দ্র টানা দু’দিন তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। বেরিয়ে আসা নানা অজানা তথ্য।

অরুণেন্দ্রের কথায়, ‘সত্যজিৎ রায়ের কথা উঠতেই উনি মাথায় হাত ঠেকালেন। সেই ছবির শুটিং শেষ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় টানা ছ’মাস তাঁকে ৬০০ টাকা করে মাসোহারা পাঠান, স্থানীয় স্কুলে ভর্তিও করে দেন। তবে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে গুঁইয়ের পরিবারের লোকজন রাজি হননি।’
অরুণেন্দ্রের সহায়তায় নম্বর মিলল গুঁইয়ের ছোটো ছেলে তেম্বা শেরপার। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার আগে শুধু বললেন, ‘এখনও বোধ হয় বাবা প্রার্থনায় বসেননি। আর আপনি হিন্দি বলতে পারেন তো?’
খানিক পরেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল সেই গলা। ‘নমস্তে জি। ভগবান কি কৃপা সে ম্যাঁয় বহুত খুশ হুঁ।’ সত্যিই তো। গিন্নি, দুই ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে আজ তাঁর ভরা সংসার। জীবনের ব্যস্ত সময় পর্যটন শিল্পে কাটিয়ে এখন তাঁর অখণ্ড অবসর। যে প্রশ্নটা অবধারিত, সেটাই আগে করলাম। ‘কীভাবে সুযোগ পেলেন এই ছবিতে?’

‘তখন আমার বয়স বারো-তেরো হবে। চকবাজারে খেলছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে নেপালি-হিন্দি মিশিয়ে গানও গাইছিলাম। হঠাৎ একটা লম্বা মতো লোক এসে বলল, ‘কাল সকাল এগারোটায় ম্যালে এসে দেখা কোরো।’
পরদিন গুঁইয়ে সেখানে পৌঁছে দেখেন প্রচুর ভিড়। জানা গেল শুটিং চলছে। ঢোকার চেষ্টা করতেই আটকানো হল তাঁকে। সাহস সঞ্চয় করে গুঁইয়ে বললেন, ‘লম্বু সাব বোলা আনে কে লিয়ে।’ ভিতরে আসার অনুমতি পাওয়ার পর শিশু অভিনেতাকে সত্যজিৎ জানিয়ে দিলেন কবে কোথায় আসতে হবে।’
গুঁইয়ের বেশির ভাগ শুটিং ছিল জলাপাহাড় রোডে। যে পথ দিয়ে হেঁটে যান ব্যানার্জি ও মনীষা। গুঁইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল তাঁর ঢিলেঢালা সোয়েটার আর অত্যন্ত প্রিয় লাট্টু আর লেত্তি। গোল বাধল মেক আপের সময়। অমন ফর্সা মুখে কী সব কালিঝুলি মাখিয়ে দিলেন মেক আপ ম্যান অনন্ত দাস। হাসতে হাসতে গুঁইয়ে বললেন, ‘আমি তখন নেপালিতে বলে উঠলাম, ‘করছেন কী?’ তখন হিন্দিটাও ভালো করে জানতাম না। পনেরো-ষোলো দিনের কাজ ছিল আমার। তবে আমার কোনও শটেই বেশি রিটেক হয়নি। আর আমার গান স্যারের খুব পছন্দ হয়েছিল। কাজ ভালো হলে বলতেন, ভেরি গুড।’
ছবি মুক্তির প্রায় ৬০ বছর পরেও, গুঁইয়ের কথায় ঝরে পড়ে পরিচালকের প্রতি শ্রদ্ধা। ‘তখন আমরা খুবই গরিব ছিলাম। ‘কাঞ্চনজঙঘা’য় আমার ব্যবহার করা পোশাক স্যার নিয়ে গেলেও, আমার জন্য তৈরি করিয়ে দেন স্যুট। ভর্তি করে দেন স্কুলেও। তবে সেখানে আমি ক্লাস টু’য়ের বেশি পড়তে পারিনি। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে বসে স্যারের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করার স্মৃতিই বা ভুলব কেমন করে?’

সেই সময় দার্জিলিংয়ের সিনেমা হলেও বাংলা ছবি দেখা যেত। সেই ভাবেই ১৯৬২ সালে সেখানকার ক্যাপিটাল হলে নিজের কাজ দেখার সুযোগ পান গুঁইয়ে। শুধু কী তাই? ‘কাঞ্চনজঙঘা’র যে সব পোস্টার সত্যজিৎ রায় ডিজাইন করেছিলেন, তার একটিতে মধ্যমণি ছিলেন গুঁইয়েই। তবে তিনি স্বীকার করলেন, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করলেও দার্জিলিংয়ে তাঁকে নিয়ে কোনও হইহই হয়নি। বরং কিছুটা খেদের সঙ্গে বললেন, ‘এখন তো আর ওখানে কোনও সিনেমাই দেখায় না।’
খেদ আছে আরও এক জায়গায়। কখনও তাঁর কলকাতা যাওয়া হয়নি, তাই দেখা হয়নি রায়সাহেবের বাড়িটিও। খুবই ইচ্ছে একবার কলকাতা এসে সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ের সঙ্গে আলাপ করারও।
কৃতজ্ঞতা:
১। অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
২। অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘রায়সাহেবের সঙ্গে’
৩। গুঁইয়ের নাতনি, শালু লামিছানে।
৪। ছবি সৌজন্য: সুপ্রিয় দত্ত
দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।
অনবদ্য প্রাপ্তি। বহুদিন ধরে গানটির অর্থ জানার অপেক্ষায় ছিলাম। গুঁইয়ে কে প্রণাম আর প্রতিবেদককে আন্তরিক ধন্যবাদ।