১৯৩২ সাল। হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে।’ সে গান শুনে মুগ্ধ কৃষ্ণচন্দ্রের বাসনা জাগল রীতিমত তাণ্ডবের ছন্দে শিবের নৃত্যসঙ্গীত রচনার। সে ইচ্ছার হাত ধরেই জলধর চট্টোপাধ্যায়ের কলমে জন্ম নিল ‘নেচেছ প্রলয় নাচে হে নটরাজ।’ ধ্রুপদের চলনে, সুরফাঁকতালে সুর বাঁধলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর জলদগম্ভীর, উদাত্ত উচ্চারণ এ গানকে কোন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, তা রসিক শ্রোতার অজানা নয়। পরবর্তী সময়ের গান, ধামারে নিবদ্ধ ‘সঘন বনগিরি বিরহে নিমগন, আষাঢ়মেঘ এল নামি রে’-তেও তিন মিনিটের অতি-অল্প পরিসরে ধ্রুপদরীতির গানে দক্ষতার অপূর্ব পরিচয় রেখে যান কৃষ্ণচন্দ্র দে। ধ্রুপদে রীতিমত তালিম নিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। অসম্মানকে আশীর্বাদ হিসাবে গ্রহণ করে ধ্রুপদশিক্ষা আরম্ভ হয় তাঁর।
শশীভূষণ দে, সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেরামতুল্লা খাঁ, দর্শন সিং, জমিরুদ্দিন খাঁ-এর কাছে শিক্ষালাভের পর ততদিনে খলিফা বাদল খাঁ-র কাছে মার্গসঙ্গীতের উচ্চতর তালিম, পুরুষোত্তম ওস্তাদের কাছে তবলা শিক্ষাও সম্পূর্ণ করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসরে শিল্পী হিসাবেও তাঁর বিশেষ কদর। এমনই সময় সেকালের কোনও প্রখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী মন্তব্য করে বসেন, ‘কেষ্টবাবু হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের কী জানেন? সামান্য খেয়াল ছাড়া কিছুই না। মার্গসঙ্গীতের মূল রস রয়েছে ধ্রুপদ, ধামারে। সে গান কি তিনি গাইতে পারেন?’ এই কটাক্ষই কৃষ্ণচন্দ্রের শিক্ষার্থীসুলভ অন্তরে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।

সেনিয়ার বিখ্যাত বীণকর ঘরানার ওস্তাদ দবীর খাঁ-র কাছে বছর চারেক ধ্রুপদ শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। ধ্রুপদী-পাখোয়াজী সতীশচন্দ্র দত্ত (দানীবাবু নামে খ্যাত) ও অমরনাথ ভট্টাচার্যের থেকেও ধ্রুপদ সম্বন্ধে নানা জ্ঞান আহরণ করেন নিষ্ঠাভরে৷ মার্গসঙ্গীতের আসরে বাংলার যে অল্প ক’জন শিল্পী সে যুগে সমানতালে ধ্রুপদ ও খেয়াল পরিবেশনে সক্ষম হয়েছিলেন, কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁদের অন্যতম। রাগসঙ্গীতে তাঁর অনায়াস দক্ষতার প্রমাণ আজও বহন করে নানা সময়ে প্রকাশিত রেকর্ডে, মল্লার রাগে ‘ঘন ডম্বরু বাজে তালে তালে, এলো বরষা’, নটমল্লারে ‘মেঘ হেরি নীল গগনে চঞ্চল মন শ্যাম দরশনে’ (১৯৩৬), দেশ রাগে ‘মেঘমেদুর ঘনছায়ে আসিলে কি তুমি’, মিয়াঁমল্লারে ‘চমকে বিজুরি নবঘন বরষন রাগে, নীপ জাগে’ (১৯৪০), মেঘমল্লারে ‘ঘন অম্বরে মেঘসমুদ্র দোলে রহি রহি’ (১৯৪৩), প্রভৃতি অসংখ্য গান।
গম্ভীর গর্জনরত মেঘ যেমন অঝোর বর্ষণের সম্ভাবনা, কৃষ্ণচন্দ্রের মেঘমন্দ্র উচ্চারণ তেমনই অনন্ত ভাবরসের ভাণ্ডার। তাঁর এই বিখ্যাত রাগাধারিত গানগুলিতেও সেই বর্ষণেরই ছবি। তাই কি এই গানগুলির সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের গায়ন এমনভাবে একাকার হয়ে যায়?
কৃষ্ণচন্দ্র দে’র পরবর্তী প্রজন্মের প্রখ্যাত শিল্পী, একনিষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্র-অনুরাগী সত্য চৌধুরী, তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছিলেন, অল্পবয়সে, গ্রামোফোন রেকর্ডে শোনা কৃষ্ণচন্দ্রের ‘বঁধু চরণ ধরে বারণ করি টেনো না আর চোখের টানে’ কীভাবে তাঁকে সঙ্গীতসাগরে ডুব দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। গোবর গুহের বাড়িতে এক সময় হোলির আসরে এমনই ঠুংরী গেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। অবশ্য সেগুলি দর্শন সিংজির কাছে শেখা, হিন্দি-অবধী ভাষায়। পথের ধারে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করে শুনেছিলেন তাঁর সেই অপূর্ব পরিবেশন।

গ্রামোফোন রেকর্ডে বহু ঠুংরী, দাদরা, ভজন, গজল, নাৎ, কাসিদা, কাওয়ালি, প্রভৃতি ধরা রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কণ্ঠে। ‘জৌক বরবাদি হ্যায় মুঝজো গ্যার কিঁউ’, ‘জিস দাম নাকাবে আরিজে জানা সরক গয়ি’ (১৯৩৩), ‘জপোরে রামনাম সুখদাঈ’, ‘শ্রীরাম ভজো সুখ দুখ মে’ (১৯৩৪), ‘তেরা আশিক খুদা হ্যায় খুদা কী কসম’, ‘লীজিয়ে আকর খবর’, ‘গুঁথি ম্যায় মালা অধুরী’, ‘মানে আপো আঁখ মুরারী প্রভু একজ আশা মারি’ (১৯৪২), ‘মথুরা সে চলি ঝুমকে যব তেরি সওয়ারি’, ‘উও আধি রাত সখী জিস রাত জমানা বদলা থা’ (১৯৫২), প্রভৃতি গানে কৃষ্ণচন্দ্রের স্বকীয়তার প্রমাণ আজও দিয়ে যায় গ্রামোফোন রেকর্ড। নানা ভাষা, নানা মত, সঙ্গীতের নানা ধারাকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। বিবিধের মাঝে এই অপূর্ব মহামিলনই তাঁর সঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বাংলার নিজস্ব সম্পদ পদাবলিকীর্তন। রবীন্দ্রনাথের কথায়:
“চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলাদেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল।”
বিদগ্ধজনের বৈঠক কৃষ্ণচন্দ্র যেমন মহিমান্বিত করেছিলেন রাগসঙ্গীতে তাঁর অনন্য দক্ষতায়, তেমন বাংলার অসংখ্য মানুষের অন্তর স্পর্শ করেছিলেন তাঁর ভাবপূর্ণ কীর্তনগানে। ত্রিশের দশকে এমন সঙ্গীতাসর কমই হয়েছে যেখানে তাঁর কণ্ঠে ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা বঁধু ওইখানে থাকো, মুকুর লইয়া চাঁদমুখখানি দেখো’ শোনা যায়নি। এ পদকীর্তন কৃষ্ণচন্দ্র গেয়েছিলেন নিউ থিয়েটার্সের বিখ্যাত ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩২) ছায়াছবিতে। রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে দশকাধিককাল যুক্ত থাকার পর, এই ছবি থেকেই চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূচনা।n
তখন বাংলা সবাক ছবির সবেমাত্র যাত্রারম্ভ হয়েছে, আর মঞ্চনাটকের মতো, সে মাধ্যমেও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে প্রধান অঙ্গ। দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘চণ্ডীদাস’-এ দৃষ্টিহীন কৃষ্ণপূজারী শ্রীদাম চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর কণ্ঠে ভক্তকবি চণ্ডীদাসের ‘শতেক বরষ পরে বঁধুয়া মিলল ঘরে, রাধিকার অন্তরে উল্লাস’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘ফিরে চল আপন ঘরে – চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিছে, আনন্দ আজ আনন্দ রে’, প্রভৃতি গানে সঙ্গীতময় হয়ে উঠেছিল ছায়াচিত্রটি। ‘চণ্ডীদাস’-এর মধ্য দিয়েই কীর্তনসঙ্গীতে কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মপ্রকাশ।
সে সময় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দীর্ঘ গান প্রকাশের জন্য গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে সাধারণ আটাত্তর পাক রেকর্ডের তুলনায় দীর্ঘায়তন রেকর্ড প্রস্তুত হত। এমনই রেকর্ডে এক সময় প্রকাশিত হয়েছিল আব্দুল করিম খাঁ-র ‘যমুনাকে তীর’, ‘ফাগুয়া ব্রিজ দেখন কো চলোরি’, ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের ‘পগ ঘুঁঘরু বাঁধকর’ কিংবা ‘বন্দেমাতরম্’-এর মত গান। ‘চণ্ডীদাস’ ছায়াছবি থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র বিখ্যাত কীর্তনদুটির জন্যও গ্রামোফোন কোম্পানি প্রস্তুত করেছিলেন দীর্ঘায়তন বিশেষ রেকর্ড। ফলে সাড়ে তিন মিনিটব্যাপী গানের যুগেও, প্রায় সাড়ে চার মিনিটের এই গানদুটির রেকর্ড আকারে প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল।
বহুধারার শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে দক্ষ, থিয়েটার, চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে খ্যাতিমান কৃষ্ণচন্দ্রের মনে প্রথাগতভাবে কীর্তনশিক্ষা করতে না পারার অভাববোধটি জাগ্রত ছিল ‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে তাঁর কীর্তনের অশেষ জনপ্রিয়তালাভের পরেও। ফলে সে ছায়াছবি প্রকাশের কিছু বছর পর, তিনি পরম আগ্রহে কীর্তনে শিক্ষা নিতে পৌঁছেছিলেন রাধারমণ দাসের কাছে। বাংলার প্রখ্যাত কীর্তনিয়া অদ্বৈত দাস (পণ্ডিত বাবাজি নামে পরিচিত) ও গোয়াবাগানের অখিল দাসের শিষ্য রাধারমণ ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জীউর কীর্তনগায়ক। কৃষ্ণচন্দ্র বলেছিলেন:
“আমাদের ঘরের নিজস্ব সম্পদ হল কীর্তন। কীর্তনের মতন অমন মধুর গান আর হয়না। হয়তো এর ভেতর রাগ-রাগিণী তেমন কিছু না থাকতে পারে তবুও বলবো কীর্তনের মত জিনিস নেই।”
কীর্তনের বৈশিষ্ট্যই তার কাব্যগত ভাবৈশ্বর্যে। হেমেন্দ্রকুমার রায় লক্ষ করেছিলেন, “কৃষ্ণচন্দ্রের মধ্যে আছে প্রভূত কাব্যরস, মানে না বুঝে সুরে কেবল কথা আওড়ানো নিয়েই তিনি তুষ্ট হয়ে থাকতে পারলেন না, কথার অর্থ অনুসারে সুরের ভিতরে দিতে লাগলেন চমৎকার ভাবব্যঞ্জনা।” সুরের কায়ায় ভাবের প্রাণের সন্ধান কৃষ্ণচন্দ্র দে পেয়েছিলেন কীর্তনে। হয়ত তাই, পদাবলিকীর্তনেই হোক বা আধুনিক কবি রচিত কীর্তনে, কৃষ্ণচন্দ্র উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন তাঁর সমস্ত সত্তা।

লীলাকীর্তন ‘গোষ্ঠলীলা’ (১৯৪৩), ‘মাথুর’ (১৯৪৭), ‘দানলীলা’ (১৯৫৬), প্রভৃতি কিংবা শৈলেন রায় রচিত বহুজনপ্রিয় ‘সখী লোকে বলে কালো, কালো নয় সে যে আমারই চোখের আলো’, ‘আমি চন্দন হইয়ে শীতল অঙ্গের পরশ লব’ (১৯৩৫), ‘স্বপন দেখিছে রাধারাণী, ভিখারির বেশে এসেছে বঁধুয়া আঁখিতে মিনতি-বাণী’, ‘ওগো হিয়ায় রাখিতে এ পরশমণি হিয়া না ভরসা পায়’ (১৯৩৯), ‘নবদ্বীপের শোভনচন্দ্র আজিকে অস্তমিত’, ‘আহা ওদিকে নিমাই চলে, মুখে হরি হরি বলে’, ‘কুঞ্জ সাজায়ে দে লো ওই বুঝি বঁধু এলো’, ‘ওগো যামিনী তুমি দীঘল হয়ো মিনতি রাখো মম’ (১৯৪১), ‘বলি শুন হে মথুরারাজ’, ‘আহা কুরুপা কুব্জা রাণী হল আজ’ (১৯৫১), প্রভৃতি কীর্তনে কৃষ্ণচন্দ্র দে’র স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের মধ্য দিয়ে আজও ধরা দিয়ে যায় তাঁর সেই উজাড় করে দেওয়া সত্তাটি।
কৃষ্ণচন্দ্রের অন্তরের গভীরতম অনুভব কখনও ধরা দিয়েছে মধুঝরা কীর্তনের মধ্যে, কখনও বা দেশাত্মবোধক গানের দৃপ্ত উচ্চারণে। ভারতের স্বাধীনতালাভের পর, ‘সূর্যালোকের দেশ গাহে আজ সূর্যোদয়ের গান’ গানে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের কাছে ঐক্যের বার্তা বহন করে এনেছিল যে কণ্ঠ, সে কণ্ঠই শ্রদ্ধার অর্ঘ্য পৌঁছে দিয়েছিল শত শত স্বর্গগত বিপ্লবী-বন্ধুর চরণে, মোহিনী চৌধুরী রচিত ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান’-এর মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণচন্দ্রের সেই শ্রদ্ধার্ঘ্যে যে সমগ্র বাংলার মানুষের শ্রদ্ধাকুসুম স্থান করে নিয়েছিল, তারই প্রমাণ সে যুগে এবং বর্তমানে এ গানের লোকপ্রিয়তা।
১৯৩২ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের যে যোগাযোগ আরম্ভ হয়েছিল, তা অব্যাহত ছিল পরবর্তী আড়াই দশক। গায়ক, অভিনেতা ও সঙ্গীত পরিচালক, তিন ভূমিকাতেই বাংলা ও হিন্দি বিভিন্ন ছায়াচিত্রের বিভিন্ন সময় তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেসব ছবির অধিকাংশই বর্তমানে অপ্রাপ্য। লভ্যগুলির মধ্যে, ‘চণ্ডীদাস’-এর শ্রীদাম, ‘ধূপছাঁও’-এর সুরদাস, ‘দেবদাস’-এর বৈরাগী, ‘বিদ্যাপতি’-র মধুসূদনদাদা, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’-এর চণ্ডাল, প্রভৃতি চরিত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের অভিনয় উল্লেখযোগ্য।

স্বর্ণাক্ষরে খচিত, ছায়াচিত্রের গানের ইতিহাসে, তাঁর ‘ওরে পথিক তাকা পিছন পানে’ (ভাগ্যচক্র, ১৯৩৫), ‘বাবা মন কি আঁখে খোল’ (ধূপছাঁও, ১৯৩৫), ‘মৎ ভুল মুসাফির তুঝে জানাহি পড়েগা’ (দেবদাস, ১৯৩৫), ‘আজি আঁধার হইল আলা, অঙ্গের লাবণী যেন সে নবনী সহে না তপনজ্বালা’ (মায়া, ১৯৩৬), ‘অব মথুরাপুর মাধব গেল গোকুল-মাণিক কে হরি নিল’, কানন দেবীসহ ‘ও তোর অভিসারের লগ্ন এল, এল রে সময়’ (বিদ্যাপতি, ১৯৩৮), ‘ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী, গর্জে সিন্ধু চলিছে তরণী’, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’ (চাণক্য, ১৯৩৯), রবীন্দ্রনাথের ‘তোমরা যা বল তাই বল আমার লাগেনা মনে’, ‘হে মহাজীবন, হে মহামরণ, লইনু শরণ’ (দৃষ্টিদান, ১৯৪৮), প্রভৃতি গান।
সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সাক্ষর বহন করে ‘সোনার সংসার’ (১৯৩৬), ‘রাঙা বৌ’ (১৯৩৭), ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘চাণক্য’ (১৯৩৯), ‘আলোছায়া’ (১৯৫০), ‘তমন্না’ (১৯৪২), ‘বদলতি দুনিয়া’ (১৯৪৩), ‘দেবদাসী’ (১৯৪৫), ‘পূরবী’ (১৯৪৮), ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ (১৯৫০), প্রভৃতি ছবি। সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায় তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব, চলচ্চিত্রসঙ্গীতের জগতে রাধারাণী দেবী ও ভ্রাতুষ্পুত্র মান্না দে-কে নিয়ে আসা, যথাক্রমে ‘রাঙাবৌ’ (১৯৩৭) ও ‘তমন্না’ (১৯৪২) ছবির মধ্য দিয়ে। কীর্তনে প্রসিদ্ধা রাধারাণীর শেষ নেপথ্যসঙ্গীতটির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। সে গানে অংশ নিয়েছিলেন পরবর্তীযুগের প্রখ্যাত কীর্তনশিল্পী গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন যুগের এই তিন কীর্তনগুণীর ত্রিবেণীসঙ্গমটি ঘটিয়েছিলেন অনুপম ঘটক, ১৯৫৬ সালের ‘একতারা’ ছবিতে। গোপালচন্দ্র মিত্র সঙ্কলিত পুরাতনী পদ ও হীরেন বসুর অলঙ্কাররচনায় সমৃদ্ধ রাধাকৃষ্ণের দানলীলাকীর্তন গীত ও দৃশ্যায়িত হয়েছিল সে ছবিতে। সেই দীর্ঘ লীলাকীর্তনে পদকর্তার ভূমিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, পদকর্ত্রীর ভূমিকায় রাধারাণী দেবী ও কৃষ্ণের ভূমিকায় ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রামোফোন রেকর্ড, ছায়াছবির জগৎ, রঙ্গমঞ্চ, আর অসংখ্য সঙ্গীতাসর চারটি দশক ধরে উজ্জ্বল ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। তাঁর কম্বুকণ্ঠের গান দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বেতারের মাধ্যমে। কলকাতা বেতারের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্কের সূচনা কলকাতা বেতারকেন্দ্রের জন্মলগ্নে। টেম্পল চেম্বার্স রোডে কলকাতা বেতারকেন্দ্র (তখন ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি) যাত্রারম্ভ করে ১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট। সম্প্রচারের সেই শুরুর দিনই বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কৃষ্ণচন্দ্র দে।
তখন মার্গসঙ্গীতের নানা ধারা, নানা ধারার লোকসঙ্গীত, কীর্তন, প্রভৃতির পাশাপাশি ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে ‘আধুনিক’ বাংলা গানের ধারা। হীরেন বসুর পরিচালনায় অর্কেস্ট্রা সম্বলিত গান ‘শেফালী তোমার আঁচলখানি বিছাও শারদপ্রাতে’ ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে গ্রামোফোন কোম্পানি প্রকাশিত হতেই মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল এ গানের গায়িকা মিস লাইটের নাম। গায়িকার প্রকৃত নাম অবশ্য তারকবালা। স্টার থিয়েটারের ‘উর্বশী’ (১৯১৯) নাটকে মদন চরিত্রে ছয়-সাত বছরের তারক যখন একটি বিশেষ দৃশ্যে ফুলে ফুলে সেজে মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন, তখন টুনি বাল্বের আলোয় তাঁর সারা গা ঝলমল করে উঠত। এই কারণেই শিশু অভিনেত্রীর মঞ্চনাম হয় যায় লাইট।

তারপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। মিস লাইট তখন বেতারের শিল্পী। বেতারভবনেই তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় কৃষ্ণচন্দ্রের। যোগাযোগ বাড়ে রঙ্গমঞ্চের জগৎকে কেন্দ্র করে। মিস লাইটের বয়ানে:
“রেডিও বাড়িতে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে আমার আলাপ হলো। মানুষটার দুটি চোখই ছিল না। মানসচক্ষে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। রেডিও থেকে আমার গান শুনে তিনি আমাকে বড় আপন করে চিনতে পেরেছিলেন… আমাকে সবাই ‘লাইট’ বলে ডাকত, কৃষ্ণচন্দ্র সে নাম জানতেন কিন্তু একদিনের জন্যও দেখলেন না সেই ‘লাইট’ আসলে কতটা উজ্জ্বল! কত রূপসী! কৃষ্ণচন্দ্র আমাকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, কৃষ্ণচন্দ্র আমাকে নারীর মর্যাদা দিয়েছিলেন, আমাকে পূর্ণ করেছিলেন।”
প্রথাসিদ্ধভাবে বিবাহ হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্র ও লাইটের। এক সন্তানের জনক-জননীও হয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৭৩ সালে, এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষকে তিনি বলেছিলেন:
“উনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন থিয়েটার বায়োস্কোপের মানুষরা আমাকে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, কেউ কেউ শ্রদ্ধাও করতেন। আজ সব ফুরিয়ে গেছে… আমাদের একমাত্র খোকা চোদ্দ বছর বয়সে পা দিয়ে হঠাৎ একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। খোকা মারা যাবার পর উনি বড় বিব্রত হলেন আমাকে নিয়ে। সব সময় বলতেন আমি যেদিন থাকব না তুমি কেমন করে একলা থাকবে? খোকা মারা যাবার কিছুদিন পর উনিও মারা গেলেন… মৃত্যুর আগে একটা দলিল আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন – ‘এই বাড়িটাই শুধু তোমার রইল। যদি আমার অবর্তমানে তোমার কোন অসম্মান হয় তুমি এখানেই থেকো’ – স্বামীর সেই তীর্থে আজও আমি একলা পড়ে আছি… আমার আপনজনদের কাছে থাকা হয়নি।”
১৯৬২ সালের ২৮শে নভেম্বর প্রয়াত হন কৃষ্ণচন্দ্র দে।

‘সুরের আকাশে কৃষ্ণচন্দ্র’ শীর্ষক রচনায়, খুল্লতাতের স্মৃতিচারণে মান্না দে লিখেছিলেন:
“কৃষ্ণচন্দ্র বোম্বাইয়ে যখনই এসেছেন, যতবার এসেছেন, প্রত্যেকবারই একটু অবসর পেলেই ছুটে ছুটে আসতেন এই সমুদ্রের ধারে। একেবারে জলের উপর এসে দাঁড়াতেন। সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে তিনি যেন অন্য মানুষ। আমাদের প্রতিদিনের অতি-পরিচিত বাবুকাকা আর নন। দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে, উৎকর্ণ হয়ে তিনি শুনছেন, মুহূর্তে মুহূর্তে তাঁর মুখের ভাব বদল হচ্ছে… আমরা ওঁকে নিয়ে বালির ওপর দিয়ে এগোতাম। স্পষ্ট শুনতে পেতাম, উনি গুণগুণ করে গাইছেন ওঁরই বহু পুরানো একটি গান, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের গান, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’। তারপর হঠাৎ একসময় গুণগুণ থামিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন করতেন, ‘সমুদ্র দেখলে?’ দাদা উত্তর দিত, ‘হ্যাঁ, দেখেছি।’ উনি আবার জিজ্ঞেস করতেন, ‘কেমন দেখলে?’ এবার আমি বলতাম, ‘ভারী সুন্দর, আর খুব গম্ভীর।’ উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতেন। খানিক পরে বলতেন, গলার স্বরটা কেমন অন্য আর যেন বেদনায় ভরা, ‘আমি তো তোমাদের মতো করে দেখতে পাইনা, কিন্তু আমি যেমনটি দেখেছি তোমরা বোধহয় তেমন করে দেখতে পাওনি।”
কেমন করে সমুদ্রকে দেখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে?
কেন কারাগারে আছিস বন্ধ,
ওরে, ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ!
ওরে, সেই সে পরমানন্দ,
যে আমারে ভালবাসে।
কেন ঘরের ছেলে, পরের কাছে,
পড়ে আছিস পরবাসে।।
ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
কী সঙ্গীত ভেসে আসে।
মহাসাগরের গানেই কি বদ্ধপ্রাণের কারা-ভাঙার সুর খুঁজে পেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র?
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Facebook, Wikipedia, Youtube, aponpath.com
* মুখ্য তথ্যসূত্র
সঙ্গীতচিন্তা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিঠিপত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্র রচনাবলী সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড)
বাঙ্গালার কীর্তন ও কীর্তনিয়া – সাহিত্যরত্ন ডঃ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
সঙ্গীতের আসরে – দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়
বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস (১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭) – কালীশ মুখোপাধ্যায়
ওস্তাদ কাহিনী – অজিতকৃষ্ণ বসু
সোনার দাগ (প্রথম পর্ব) – গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
প্রসঙ্গ: বাংলা গান – রাজ্যেশ্বর মিত্র
কৃষ্ণচন্দ্র – সংকলন ও সম্পাদনা – দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনের জলসাঘরে – মান্না দে
সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র – মান্না দে
বিমানে বিমানে আলোকের গানে – সিতাংশুশেখর ঘোষ
সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত রেকর্ডপুস্তিকা ও ছায়াছবির পুস্তিকা
জীবনে সবেমাত্র পেরিয়েছেন ছাব্বিশটি বসন্ত! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সঙ্গীতসাধনায় রত। নেশা গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পত্রপত্রিকায় সঙ্গীতবিষয়ক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরাজিতে৷