১৯২৯ সাল। কানাডা থেকে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরছেন। পথে জাপানে নামেন। এই দেশের এক বিখ্যাত কাগজ ব্যবসায়ী, কুনিহিকো ওকাকুরার সঙ্গে আলাপের পর কবি তাঁকে একটি অনুরোধ করেন। কী ছিল কবির অনুরোধ? আসলে কুনিহিকো জাপানে প্রাচ্য সংস্কৃতির একজন কর্তাব্যক্তি ছিলেন। প্রাচ্যের ঋষিকবির প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ছিলেন এই কারণে। রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁকে শান্তিনিকেতনে একজন অভিজ্ঞ জুজুৎসু শিক্ষক পাঠানোর অনুরোধ করলেন। রবীন্দ্রনাথ জাপানের এই অস্ত্রহীন লড়াইয়ের কৌশল দেখে খুব প্রভাবিত এবং উৎসাহিত হন। এর আগে ১৯০৫ সালে ওকাকুরার পরামর্শে সানো জিন্নাসুকে-কে শান্তিনিকেতনে নিয়েও এসেছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথকে এদেশে জুজুৎসু চর্চার পথিকৃৎ বললে একেবারেই অত্যুক্তি করা হয় না।

এযাত্রা ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ রক্ষা করার জন্য একজন জুজুৎসু শিক্ষক ঠিক করলেন। সেই শিক্ষকটি কেমন? তাঁর নিজের কথায়, ‘তিনি শিনজো তাকাগাকি। তিনি মদ্যপান করেন না। তাঁর স্বভাব শান্ত ও ব্যক্তিত্ব চমৎকার।’ এরপর প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘জুজুৎসুর মাধ্যমে জাপানি আধ্যাত্মিকতা ও জাপানি আদর্শ ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেবার ভূমিকায় তিনি যোগ্যতম।’

এহেন জাপানের সরকারি জুজুৎসু সংস্থা ‘কোদোকান’-এর অভিজ্ঞ সেই শিক্ষক তাকাগাকি শান্তিনিকেতন এসে পৌঁছান ১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে। বিশ্বভারতীর প্রবল আর্থিক সংকটের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ তাকাগাকিকে প্রচুর অর্থব্যয় করে নিয়ে আসেন।

Jujutsu in Santiniketan
তাকাগাকির তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু প্রশিক্ষণ

শান্তিনিকেতনে এসেই রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে শুরু হয়ে গেল জুজুৎসু শেখানো। কবি নিজে এই নিরস্ত্র যুদ্ধের কৌশলকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে নিয়মিত তাকাগাকির শেখানোর সময় হাজির হতেন। সেই সময়কার জনৈক ছাত্রী, শৈলনন্দিনী সেন ‘গীতবিতান’ পত্রিকার রবীন্দ্রশতবার্ষিকী জয়ন্তী সংখ্যায় ‘গুরুদেবের আশ্রম ও ছাত্রীজীবন’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

‘জাপানি জুজুৎসু শিক্ষক তাকাগাকি এলেন সস্ত্রীক। গুরুদেব একদিন শ্রীভবন থেকে আমাদের ডেকে এনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ও তিনি যে বিদ্যা জানেন সে সম্বন্ধে কিছু বললেন। জাপানের অধিকাংশ মেয়ে জুজুৎসু জানে এবং তাদের স্বাস্থ্য ও আত্মরক্ষার উপায় তাদের মনে কেমন সবলতা এনে দিয়েছে সে নিয়েও একটু বললেন।’

আরও পড়ুন: পীতম সেনগুপ্তর কলমে: রবীন্দ্রনাথ ও অ্যান্ড্রুজ় – অন্তরঙ্গতার আখ্যান

ভেবে আশ্চর্য লাগে যে ছাত্রদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ছাত্রীদের স্বাস্থ্য শুধু নয়, আত্মরক্ষার উপায় হিসেবেও আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে জুজুৎসুকে কতটা প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আরও একটু অতীতে ফিরে যদি যাওয়া যায়, তবে দেখা যাবে বালক রবি যখন স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে নারাজ হয়েছিলেন, তখন স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণেই তাঁকে কুস্তি শিখতে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাকাগাকিকে এতটাই সমাদর করেছিলেন যে তাকাগকির পুত্রসন্তান হলে তাঁর নাম দেন ‘উজ্জ্বল সূর্য’। এছাড়া এদেশে জুজুৎসুর প্রচার আরো হওয়া উচিত ভেবে নিজের উদ্যোগে ১৯৩১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার নিউ এম্পায়ার মঞ্চে কবি জুজুৎসু প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এবং এখানেই প্রথম গীত হয় ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’ গানটি। এই গানটির প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ গ্রন্থে…

‘১৩৩৭ সালে গুরুদেব জাপানি যুযুৎসু-পালোয়ান টাকাগাকীকে শান্তিনিকেতনে আনিয়ে যুযুৎসুশিক্ষার প্রবর্তন করেন। এই বিষয়ে দেশবাসীকে উৎসাহিত করবার জন্যে নানা স্থানে প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। এই সব প্রদর্শনীরই উদ্বোধন সংগীতরূপে রচিত হয় “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”; গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৩৩৮ সালে কলকাতার ‘নিউ এম্পায়ার’ রঙ্গমঞ্চে।’

Tagore with Japanese friends
জাপানি বন্ধুদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ

একই স্মৃতিচারণ করেছেন রমা চক্রবর্তী তাঁর ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধা’য়। এদিকে প্রচণ্ড ব্যয়ভারের কারণে শান্তিনিকেতনে তাকাগাকিকে রাখা গেল না দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষের প্রাক্কালে কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্রকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কী লিখেছিলেন সেই চিঠিতে?

চিঠিতে লিখলেন‘তুমি জানো বহু অর্থব্যয় করে জাপানের একজন সুবিখ্যাত জুজুৎসুবিদকে আনিয়েছিলুম।দেশে বারে বারে যে দুঃসহ উপদ্রব চলছিল তাই স্মরণ করে আমি এই দুঃসাহসে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম।’ প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার, যে অস্ত্র আইনে তখন ভারতবর্ষের উপর ব্রিটিশ সরকারের নানাবিধ উৎপীড়ন চলছিল। কবি তাই জুজুৎসুকে অস্ত্রহীন এক লড়াইয়ের কৌশল বলে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। সেই চিঠিতে আরও লিখলেন‘মনে আশা ছিল দেশের লোক সকৃতজ্ঞচিত্তে আমার দায়িত্ব লাঘব করে এই দুর্লভ সুযোগ গ্রহণ করবে। দুই বছরের মেয়াদ আগামী অক্টোবরে পূর্ণ হবে।’

Rathindranath and Santosh Majumdar with Jinnotsu
শান্তিনিকেতনের প্রথম জুজুৎসু শিক্ষক জিন্নোসুর সঙ্গে দুই ছাত্র – রথী ঠাকুর ও সন্তোষকুমার মজুমদার

কবি আপশোস করে বলেছেন যে অন্য প্রদেশ থেকে জুজৎসু শেখার ছাত্ররা এলেও বাংলা থেকে কেউ স্বেচ্ছায় আসেনি শিখতে। তাই ‘যে ব্যয়ের বোঝা আমার পক্ষে অত্যন্ত গুরুভার তাও সম্পন্ন হয়ে এল অথচ আমার উদ্দেশ্য অসমাপ্ত হয়েই রইল। জাপান থেকে এ রকম গুণীকে পাওয়া সহজ হবে না।’ এরপরই তিনি প্রস্তাব দিলেন সুভাষচন্দ্রকে। ‘এখন এই লোকটিকে তোমাদের পৌরশিক্ষা বিভাগে নিযুক্ত করবার কোনো সম্ভাবনা হতে পারে কিনা আমাকে জানিয়ো। যদি সম্ভব না হয় তাহলে এঁকে জাপানে ফিরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবো।’

সুভাষচন্দ্র কবির এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করতে পারেননি, তাই তাকাগাকিকে কবির দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল অনেক অভিমান নিয়ে।

     গ্রন্থঋণ:
১) রবীন্দ্রজীবনী: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ৩-য় খন্ড
২) রবিতীর্থে বিদেশী: প্রবীরকুমার দেবনাথ
৩) রবীন্দ্রসঙ্গীত: শান্তিদেব ঘোষ
৪) ভরা থাক স্মৃতিসুধায়: রমা চক্রবর্তী
৫) রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র: নেপাল মজুমদার

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

One Response

  1. যুযুৎসু শিক্ষা এবং শিক্ষক টাকাগাকি কে গুরুদেব কিভাবে আপামর জনসাধারণের কাছে এই শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তা লেখকের লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। আরও লেখা চাই 🙏🍂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *