‘মেয়েটাকে আদ্ধেক করে দু’জায়গায় ভরে দিলে হত না?’

ছোটকাকুর জন্য যখন ছোটকাকিমাকে দেখতে যাওয়া হয়, কাকিমার বাবা নাকি এমন মন্তব্য করেছিলেন বলে শোনা যায়। নয়ের দশকের প্রথমদিক। কাকিমার মুখ থেকে পরে শুনেছিলাম, তাঁর বাষট্টি বছরের টেক স্যাভি-হতে-চাওয়া-বাবা ঠিক করেছিলেন, সম্বন্ধ এলে ছবির প্রিন্ট আউট পাঠাবেন না, খামে ভরে পাত্রপক্ষকে ক্যুরিয়র করে দেবেন ফ্লপি। ছবির ফাইলটা ফ্লপিতে ধরাতে না পারার দুঃসংবাদ পেয়ে তিনি পারিবারিক মহলে এই বোমাটা ফাটিয়েছিলেন। মেয়ের হাই রেজ়লিউশান ছবি একটা ফ্লপিতে না ধরানো গেলে এটাই ছিল তাঁর বিকল্প সিদ্ধান্ত।

আমরা যারা এখন টিবির মানে যক্ষ্মার বদলে টেরাবাইট বুঝি, তাদের কাছে মেগাবাইটের সংগ্রামমাখা কৈশোর যৌবন অদেখাই থেকে গেল। জামার বোতামের মতো ছোট্ট এক জায়গায় যে যুগে পুরে দেওয়া যায় শয়ে শয়ে জিবি, সে যুগে ডেটা ট্রান্সফার কথাটার মধ্যে কোনও বিস্ময়ে প্রাণ জাগা থাকে না, সঙ্গত কারণেই। অথচ বছর পঁচিশেক আগে ভাবতাম, কী আশ্চর্য উপায়ে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ডেটা জুগিয়ে যায় এক কার্ড-শরীর। ধাতুর পাতলা ফ্রেমটা হালকা করে টেনে দেখা এক খয়েরি রঙের ফিনফিনে প্লেট। হাত দেওয়া মানা। ওর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্কুলকাব্যের কম্পিউটার ক্লাসের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। 

ফ্লপি কিন্তু তার চেহারা নিয়ে বাস্তবিকই শেষ হয়েও হইল না শেষ। ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্টের মাথার উপরে একেবারে বাঁদিকে আজও জেগে থাকে এক ছোট্ট ফ্লপি চিহ্ন। আজও কোনও ফাইল সেভ করতে গেলে সেই আদিযুগেই ফিরে যেতে হয় আমাদের। ফাইল খুলে কাজ করতে করতে আইকনটারটার উপরে বারবার ক্লিক করতে থাকলে মনের শান্তি যেমন আসে, তেমনভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় ডেটা-সুরক্ষা নিয়েও। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ফ্লপি নিজে মরে গিয়েও সেভ করার প্রতিভূ হয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন। কে এই উপমা দিয়েছিলেন, তাঁকে খুঁজে পেতে খুব ইচ্ছে করে।

Floppy drive
ফ্লপি ড্রাইভে ক্লিক করলেই ক্যাবিনেটের অন্তঃস্থল থেকে ক্রমাগত এক শব্দ আসতে থাকত

পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু নেশায় কবি, আমার এক বন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, কম্পিউটারের পড়ার শব্দ প্রাণ পায় ফ্লপিতে। সিডির পড়া মনে মনে, তবে ফ্লপির পড়া কিংবা লেখার শব্দ যেন এক যন্ত্রশিশুর ভোরের পড়ার আওয়াজ। শুদ্ধ। ফ্লপি ড্রাইভের কথা ক’জনের আর মনে আছে জানি না। ক্যাবিনেটের শরীরে ফ্লপিটা ঠেলে দেওয়ার পরে খট করে এক মৃদু আওয়াজ হত।

‘মাই কম্পিউটার’-এ গিয়ে ফ্লপি ড্রাইভে ক্লিক করলেই ক্যাবিনেটের অন্তঃস্থল থেকে ক্রমাগত এক শব্দ আসতে থাকত। ঘড়ঘড় ঘড়ঘড়। কোনও ফাইল কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক থেকে ফ্লপিতে পাঠানোর সময়েও একইরকম শব্দ পেতাম। কম্পিউটারের পড়া মুখস্থ বলা কিংবা শিখে যাওয়া পড়া উগরে দেওয়ার শব্দ হয়তো এমনই। হাল আমলের চিপ-জগতে এই অধ্যয়নের কোনও শব্দ নেই। বোবা তোতারা মুখস্থ করে যায় শুধু। রা কাড়ে না।

আরও পড়ুন: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্তর কলমে গান্ধী সমীপে দিলীপকুমার রায়ের গল্প!

ফ্লপি ড্রাইভের আবির্ভাব-তিথির কথা জিজ্ঞেস করা হলে যে সালের কথা উঠে আসে, তা হল ১৯৬৭। জীবনচক্র যে তিরিশ বছরের বেশি গড়াবে না, তা হয়তো তখন ভাবতে পারেননি কেউ। ডেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আগামী দিনের কথা আঁচ করতে পারলে হয়তো বলে উঠতআর কত ছোট হব ঈশ্বর! ১৯৬৭ সালে আমেরিকার সান হোসে শহরে আইবিএম সংস্থার তদারকিতে ফ্লপি নিয়ে কাজ শুরু হয়।

পাঁচ বছর পর, ১৯৭২ সালে ফ্লপি ডিস্কের আদিপুরুষ হিসেবে যা বাজারে আসে, তা ছিল ৮ ইঞ্চির। প্রাগৈতিহাসিক জন্তু জানোয়ারের মতো এমন ফ্লপির ছবি আজকের শিশুরা দেখে ইতিকথার বইয়ে। এর চার বছর পর, ১৯৭৬ সালে যে ফ্লপি ডিস্ক বাজারে এল তা সোয়া ৫, মানে পাঁচ পূর্ণ একের চার ইঞ্চির। ছোট হওয়ার দৌড়ও শুরু হল। ছ’বছর রাজত্ব করার পরে, ১৯৮২ সালে এল সাড়ে তিন ইঞ্চির ফ্লপি ডিস্ক। আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গে মিশে ছিল এই সাড়ে তিন ইঞ্চিই। ১.৪৪ মেগাবাইটের সংরক্ষণ ব্যবস্থা আজ বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসা কোনও শব্দের মতো মনে হয়।

Floppy 2
চরমপন্থী না হতে পারার জন্যই কি ক্রমশ ম্লান হয়ে গেল ফ্লপি?

চরমপন্থী না হতে পারার জন্যই কি ক্রমশ ম্লান হয়ে গেল ফ্লপি ড্রাইভ? কম্পিউটারের খুঁটিনাটি নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা টেকনোলজির জাতক-জাতিকাদের সব সময় চরম অবস্থার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ফ্লপির বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগের তালিকা দ্রৌপদীর শাড়ির মতোই লম্বা, অন্তহীন ছিল।

বেচারা এই স্টোরেজ মাধ্যম নাকি বড়ই সুখী প্রকৃতির। বেশি ঠান্ডা কিংবা গরমদুটোর একটাও সহ্য করতে পারে না। ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে তাপমাত্রা চলে গেলে ক্ষেপে যায়, আবার শূন্যের নিচে পারদ নামলেও পাকাপাকিভাবে শীতঘুমে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলোয় বারো আনা। আর্দ্রতা সহ্য হয় না, জলে বাঁচে না, ধুলোয় ভোগে অযথা, অন্য জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা-টাক্কা লাগলেও খাবি খেতে শুরু করে। হাত ফস্কে কয়েকবার পড়ে গেলে তো আর কথাই নেই।

আজকের মেমোরি কার্ড কিংবা পেন ড্রাইভ এমন কথা শুনলে হেসে গড়াগড়ি দিয়ে দিয়ে চোখ গোল গোল করে বলবেফ্লপিভায়া, তুমি বেঁচেছিলে কেন হে? সাড়ে তিন ইঞ্চির এমন বেআক্কেলেপনা দেখে ব্যবহারকারীরা ভুরু কুঁচকে, সারা মুখে বিরক্তি লেপে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ফ্লপির মতো মুডি কিংবা বদমেজাজি স্টোরেজ মিডিয়াম নাকি আর দ্বিতীয়টি নেই। ডিস্ক ড্রাইভের মধ্যে তাজা ফ্লপি রাখলেও ড্রাইভকে ঝং ধ্বনি-সহ বলতে শোনা গিয়েছে, এই ডিস্কের কোনও অস্তিত্ব নেই। রসাতলে কে গেলড্রাইভ না ফ্লপি, তা নিয়ে বহু মানুষের বিনিদ্র রাত কেটেছে। পেন ড্রাইভ কলার তুলেছে যত, ব্যবহারকারীদের কাছে ফ্লপিও হয়ে উঠেছে তত বিশ্বাসঘাতক। 

এক অভিমানী ফ্লপি যদি ৫১২ জিবির পেনড্রাইভের কাছে চোখের জল ফেলতে পারত কোনওদিন, তা হলে বুঝত এই অসম লড়াইয়ের কথা। এখানে লড়াইয়ের মাঠে দেখা হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। খেলা শুরু হওয়ার আগেই হেরে যাওয়া আছে। একটা ৫১২ জিবির পেনড্রাইভ নাকি ৩ লক্ষ ৬৪ হাজারটারও বেশি ফ্লপির অন্তরাত্মা পুরে নিতে পারে নিজের চিপ-শরীরে। টিকে থাকার লড়াইয়ে কোনির মাস্টারমশাইয়ের মতো ‘ফাইট, ফ্লপি, ফাইট’ বলার কোনও লোক ছিল না এই দুনিয়ায়। বিশ্বজোড়া ফ্লপির বাজারে ৭০ শতাংশেরও বেশি শেয়ার ছিল যে সংস্থার, সেই সোনি ইনকরপোরেশন ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে ফ্লপির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

 

আরও পড়ুন: অনুপ রায়ের কলমে: নারায়ণ দেবনাথ দি গ্রেট!

নব্বই দশকের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ফ্লপির স্বর্ণযুগের সময় যা বছরে পাঁচশো কোটিরও বেশি বিক্রি হত, তার অধ্যায় শেষ হল ২০১০-এ। যে কয়েকশো কোটি ফ্লপি তখনও টিকে ছিল দুনিয়ায়, তা দেখে পেনড্রাইভ প্রেমীরা বলতে শুরু করলেনএ বর্জ্য লইয়া কী করিব? পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা প্রস্তাবের বন্যা বয়েছিল তখন। ১.৪৪ মেগাবাইটের শরীরকে ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছি’ বলতে বলতে নিন্দুকরা পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে কোনও আংশিক প্রতিবন্ধী সোফাসেট কিংবা চেয়ার নেই? কিংবা এক পা নড়বড়ে টেবিল? তাকে ঠিকঠাক ‘লেভেল’ করার জন্য ফ্লপির বিকল্প আর কীই বা আছে? ডিফেক্টিভ পায়ের নিচে গুঁজে দাও। টেবিলে লিখতে বসতে তা আর কাঁপবে না।

Floppy Pen holder
অকেজো ফ্লপি দিয়ে তৈরি পেনস্ট্যান্ড আর প্যাডের কাভার

রেফ্রিজারেটারের স্ট্যান্ডের তলায় দুটো ফ্লপি ঢুকিয়ে রেখে দাও আরামসে। সাধের ফ্রিজ আর হেলে থাকবে না। কেউ বললেন, পাঁচটা ফ্লপি এভাবে জুড়ে বানিয়ে নাও নিজের মনের মতো পেন-হোল্ডার। ফ্রিজ ম্যাগনেট বানানোর ব্যবসা করেন যাঁরা, তাঁরা শুধোলেনপুরনো ফ্লপি সব করে রব? এক্ষুণি পাঠিয়ে দিন আমার কারখানার গর্ভগৃহে। ফ্রিজের গায়ে লাগানোর চুম্বক বানানোর জন্য এর চেয়ে ভাল ধাঁচা নাকি আর দুটি নেই।

ফ্যাশন ডিজাইনাররা বললেন, বাহারি কাপড়ের আনাচে কানাচে কায়দা করে ফ্লপি লাগিয়ে বানিয়ে ফেলব ভিনটেজ পর্দা। আমার কাছে ফ্লপি দিন। আর যাঁরা এর সন্ধান পেলেন না একটাও, তাঁরা হিরণ্যকশিপুর মতো নখ দিয়ে দুভাগ করে দিলেন ফ্লপি শরীর। ম্যাগনেটিক টেপটা বের করে কাঁচি দিয়ে ফালাফালা করে দিলেন। খাল্লাস।

নিজের শুদ্ধতা প্রমাণ করার পরীক্ষা ফ্লপি ড্রাইভের মতো অন্য কোনও স্টোরেজ মিডিয়াম দিয়েছে কিনা জানা নেই। ১.৪৪ মেগাবাইটের শরীর বহুবার অগ্নিপরীক্ষায় বসতে বাধ্য হয়েছে। মাউসের এক ক্লিকে ভুলেছে সব। ফর্ম্যাট। অধুনালুপ্ত যে ড্রাইভের মধ্যে ফ্লপির প্রাণ পোরা থাকত, সেই এ ড্রাইভ সামান্য গড়বড় করলেই তার মূল্য চোকাতে হত ফ্লপিকে। যা শিখেছ ভুলে যাও এক্ষুণি।

রাইট ক্লিক করে ফর্ম্যাটে লেফ্ট ক্লিক করলেই এক কাতর বার্তা ফুটে উঠত কম্পিউটারের স্ক্রিনে। যেন বলত, আবার মুছে ফেলবে সব? আর কতবার? কীভাবে নিজেকে ফের নিঃস্ব করব বলতাড়াতাড়ি না পুরোপুরি? মনে পড়ে যায় কুইক ফর্ম্যাট আর ফুল ফর্ম্যাটের কথা। কেন জানি না, ধারনা ছিল, কাজ হয়ে যাওয়ার পরে ফুল ফর্ম্যাট মেরে দিলেই ফ্লপি আবার শুদ্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভ থেকে ভেসে আসা সেই ঘড়ঘড়ের মধ্যে দুঃখবিন্দু মেশানো থাকত কেন? বাইনারি পাতাগুলো এভাবে ফিনাইল দিয়ে ধুতে ধুতে দেহ রাখতে বেশি সময় নিত না। তখনও ফের দোষ পড়ত ফ্লপিরই ঘাড়ে। 

Office Floppy
ফ্লপি নিজে মরে গিয়েও সেভ করার প্রতিভূ হয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন

চিপের পরে কী আছে জানি না। ক্লাউড? আর মেঘেরও পরে? জিনের মধ্যে কি কোনওদিন মিশে যাবে মনে রাখার ম্যাজিক অস্ত্র? বায়ো-সুলুকসন্ধান? আমার মরচে পড়ে যাওয়া জ্যামিতি বাক্সের মধ্যে রাখা বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ, একাবোকা ফ্লপিটা হয়তো এর উত্তর জানতে চাইবে না কোনওদিন। দু’দশক আগের ১.৪৪ মেগাবাইটের সিন্দুকে শেষ কী স্মৃতি জমিয়ে রেখেছিলাম তার খোঁজ পেতে বড় ইচ্ছে হয়।

থাক। 


*ছবি সৌজন্য: Facebook, Wikipedia, Alchetron

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *