গভীর রাত। মাঘ মাসের প্রবল শীত উপেক্ষা করে সেদিন রাতে অন্তত হাজার চারেক মানুষ ভিড় জমিয়েছেন কলকাতার নজরুল মঞ্চে। কান পাতলে চারিদিকে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। প্রত্যেকের কণ্ঠেই উদ্বেগ ও উত্তেজনা মেশানো এক বিচিত্র অনুভুতি– ‘খানসাহেব এসে গেছেন?’, ‘আজও তো শুনলাম ওঁর ডায়ালিসিস হয়েছে, বাজাবেন?’, ‘খানসাহেবকে বোধহয় আগে বসিয়ে দেবে’, ‘কতদিন পর খানসাহেবকে শুনব।’
কিছুক্ষণ পর মঞ্চে যিনি উঠলেন, তাঁকে দেখলেই মনে অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। ছ’বছরের আমাকেও তাঁর উপস্থিতি মোহিত করেছিল। স্বরসম্রাট উস্তাদ আলি আকবর খান তাঁর জীবনের সর্বশেষ মঞ্চ উপস্থাপনা শুরু করলেন রাগ জয়জয়ন্তী দিয়ে। তাঁকে সেদিনের অনুষ্ঠানে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী।
আরও পড়ুন: শিশিরকণা ধর চৌধুরীকে নিয়ে লেখা: ছড়ের টানে শিশিরের শব্দ
সেই রাত্রের কথা আজও পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। দূরভাষেও উত্তেজিত শোনাচ্ছিল তাঁর গলা।
“শেষ যে অনুষ্ঠান করেন, তার আগে উনি এতই অসুস্থ ছিলেন যে চার মাস যন্ত্র ধরতে পারেননি। ডায়ালিসিস চলছিল। তা সত্ত্বেও যখন উনি রাগ জয়জয়ন্তী শুরু করলেন, প্রথম দুটো স্বর লাগানোমাত্র সারা প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিল। সেদিনের বাজনা কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে বাজানো সম্ভবই নয়। ওঁর যদি ঐশ্বরিক প্রতিভা না থাকত, তাহলে সেদিনের ঐ বাজনাটা বাজাতে পারতেন না। আমি এখনও সত্যিই ভাবি, কী করে উনি সেদিনের বাজনাটা বাজিয়েছিলেন!”

পণ্ডিতজির এখনও মনে আছে কীভাবে উস্তাদ আলি আকবর খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। যখন খানসাহেব ১৯৫৫ সালে মুম্বই (তখন বোম্বাই) থেকে কলকাতায় ফিরে আলি আকবর কলেজ অব মিউজ়িক প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজের কথায়:
“আমার এক মাস্টারমশাই খান সাহেবের পরিবারের সঙ্গে খুব পরিচিত ছিলেন। সেই সুবাদেই আমি যাই ওঁর বাড়িতে আশীষদার (উস্তাদজির জ্যেষ্ঠপুত্র, উস্তাদ আশীষ খান) সঙ্গে বাজাতে। ১৯৫৬ সাল নাগাদ, যখন আমার দশ-এগারো বছর বয়স, যখন আমি একটু একটু বাজাই, তখন একদিন আশীষদার সঙ্গে বাজাতে গিয়ে প্রথম আলাপ হয় খান সাহেবের সঙ্গে। তখন থেকেই খান সাহেব আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, এবং আমি ওঁর পরিবারের একজন হয়ে যাই। এরও পরে যখন আমি যাদবপুর থেকে পাশ করি, তখন একদিন তানসেন সঙ্গীত সম্মেলনে আমাকে উনি ওঁর সঙ্গে বাজাতে বলেন। এটাই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম বাজনা।”
উস্তাদ আলি আকবর খানের সঙ্গে তবলায় পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর অনবদ্য সঙ্গত বোধহয় সকল সঙ্গীতরসিকের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী ছাড়া যিনি খানসাহেবকে সবচেয়ে বেশি সঙ্গত করেছেন তবলায়, তিনি তবলা, তথা ভারতীয় সঙ্গীতের এক প্রাণপুরুষ আচার্য শঙ্কর ঘোষ, আমার গুরুজি। তাঁর পুত্র, বিশ্বসঙ্গীতে সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতার পুরোধা, আমার বর্তমান গুরু, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষেরও অভিজ্ঞতা হয়েছিল খানসাহেবকে তবলায় সঙ্গত করার। তিনি এই পরিবারের তিন প্রজন্মকেই মঞ্চে সঙ্গত করার বিরল অভিজ্ঞতার অধিকারী। সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসব।
খান সাহেবের যে বিশেষ বাদনশৈলী, তা রাগসঙ্গীতের প্রেক্ষাপটে ‘মাইহার বাজ’ বলে পরিচিত। এই মাইহার বাজ বা ঘরানার জন্মদাতা খানসাহেবের পিতৃদেব বাবা আলাউদ্দিন খান। মাইহার ঘরানার ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় কীভাবে এই ঘরানার সূচনা হয়েছিল। বাবা আলাউদ্দিন খান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মানুষ ছিলেন। বহুকষ্টে তিনি পৌঁছন রামপুর দরবারের রাজ-সঙ্গীতজ্ঞ মিয়াঁ ওয়াজ়ির খানের কাছে। সে সময় রামপুরের নবাব ছিলেন হামিদ আলি। বাড়ি থেকে পালানো বাবা আলাউদ্দিনকে বেশ কিছু কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, এবং বহু সাধ্যসাধনার পর ওয়াজ়ির খান তরুণ আলাউদ্দিনকে তালিম দিতে রাজি হন।
মিয়াঁ ওয়াজির খান তানসেনের জামাই নওবত খানের বংশধর। ঘরানার সঙ্গে তানসেনের নাম যুক্ত। সুতরাং, মিয়াঁ ওয়াজির খানের ঘরানাকে বলা হত ‘সেনিয়া রামপুর ঘরানা’। বাবা আলাউদ্দিন খান রামপুর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মাইহারের রাজার দরবারে নিযুক্ত হন এবং মাইহার ঘরানার পত্তন করেন। তানসেনের সঙ্গে ঘরানার যোগাযোগের ফলে অনেকের মতে ‘মাইহার ঘরানা’ আসলে ‘সেনিয়া-মাইহার ঘরানা’। মিয়াঁ ওয়াজির খানের কাছে বর্তমান ভারতের অন্যতম সরোদিয়া উস্তাদ আমজাদ আলি খানের বাবা, উস্তাদ হাফিজ আলি খানও তালিম নেন। হয়তো সেই সূত্রেই তাঁর ঘরানাকেও বলা হয় ‘সেনিয়া-বঙ্গাশ ঘরানা’।
বাবা আলাউদ্দিন খানের পুত্র উস্তাদ আলি আকবর খান, কন্যা অন্নপূর্ণা দেবী, প্রিয়তম শিষ্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর; উস্তাদ আলি আকবরের পুত্রেরা, উস্তাদ আশীষ খান, উস্তাদ ধ্যানেশ খান, আলাম খান, মানিক খান; এবং পৌত্র সিরাজ আলি খান সেনিয়া-মাইহার ঘরানার নাম আজও উজ্জ্বল করে রেখেছেন। এছাড়া, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছেন উস্তাদজি, অন্নপূর্ণা দেবী ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের অগণিত ছাত্রছাত্রী, যাঁরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেনিয়া-মাইহার ঘরানার বাদনশৈলীকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে আমার বর্তমান গুরু পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ আমায় বলেছিলেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ ও উস্তাদজির যুগান্তকারী যুগলবন্দির সূচনা কীভাবে হয়েছিল। তাঁর কথায়:
“বাবা প্রথম খানসাহেবের সঙ্গে বাজান ১৯৬২ সালে বরানগরে, কাচের মন্দিরে। উস্তাদ কেরামতুল্লা খানের আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তখনও এসে না-পৌঁছনোয় স্বামী সত্যানন্দ মহারাজ উস্তাদজিকে অনুরোধ করেন বাবাকে নিয়ে বাজাতে। তারপরে তো যা হয়েছে, তা ইতিহাস। বাবার সঙ্গে খানসাহেবের অসম্ভব হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তাঁরা একসঙ্গে বিদেশ সফর শুরু করেন এবং একসময়ে বাবা গিয়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে থাকা শুরু করেন। খানসাহেবের কলেজে শেখাতেনও বাবা, মা (কসুর-পাতিয়ালা ঘরানার কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী বিদুষী সংযুক্তা ঘোষ) দু’জনেই। খানসাহেবকে বাবা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং বাবার কাছে তিনি ছিলেন গুরু-সমান। মঞ্চের পাশাপাশি জীবনেও দু’জনের অসামান্য রসায়ন ছিল। বাবা খানসাহেবকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতেন।”

আর তাঁর নিজের খানসাহেবকে সঙ্গত করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ বললেন:
“আমি ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বাজাই খানসাহেবের সঙ্গে। অনুষ্ঠানটা দক্ষিণ কলকাতার চৌধুরী হাউসে হয়েছিল। প্রথমার্ধে আমি বাজিয়েছিলাম, আশীষকাকাও ছিলেন সঙ্গে। দ্বিতীয়ার্ধে বাবা বাজিয়েছিলেন খানসাহেবের সঙ্গে। আমার সেই সময়ে এমএ পরীক্ষা চলছিল। হঠাৎ একদিন খানসাহেব বাবাকে ফোন করে বলেন, যে উনি চান আমি বাজাই ওঁর সঙ্গে। ওঁর সঙ্গে বাজানো একটু মুশকিল ছিল, কারণ ওই পুরো অনুষ্ঠানটি উনি অত্যন্ত বিলম্বিত লয়ে বাজিয়েছিলেন। দ্রুতে শুধু গতিই দ্বিগুন করেছিলেন, লয় একই ছিল। কিন্তু কোনওভাবে বাজনাটা খুব ভাল হয় এবং তিনি আমাকে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন।”
পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী ও পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ দু’জনেই খানসাহেবের আধ্যাত্মিক চেতনার কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে খানসাহেবের অন্যতম শিষ্য পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলা খুব জরুরি। খানসাহেবের কাছে তাঁর নিজের শেখার অভিজ্ঞতা এবং খানসাহেবের ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন:
“শেখানোর সময়ে উনি কখনই বকাবকি করতেন না; ছাত্ররা অসুবিধা বোধ করলে উনি সামান্য বিরক্ত হতেন মাত্র। বেশিরভাগ সময়েই উনি বলতেন যে, যখন উনি শেখাতেন, ওঁর বাবা তখন ওঁকে শেখাতেন, আর উনি ছাত্রদের সেটা ‘রিলে’ করে দিতেন। ওঁর আধ্যাত্মিক চেতনার কথা বলতে গেলে একথা বলতেই হয়, উনি খুব উপমা দিয়ে কথা বলা পছন্দ করতেন, অনেকটা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতন। তেহাই বাজানোর সময় আগে থেকে মাপজোক করায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বলতেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় কখনই আমরা যেমন আগে থেকে পা টিপে টিপে রাস্তা পার করে প্রতিটা পা গুনে ফিরে এসে রাস্তা পার করি না, সেরকমই তেহাই বাজানোর সময়ও আমাদের মনই বলে দেবে কখন রাস্তাটা পেরতে হবে, অর্থাৎ কোথা থেকে তেহাই তুলতে হবে এবং কীভাবে সমে ফিরতে হবে।”

উস্তাদ আলি আকবর খানের সঙ্গীত ভারতের তামাম মার্গসঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। খানসাহেবের মধ্যম পুত্র উস্তাদ ধ্যানেশ খানের পুত্র সিরাজ আলি খান তাঁর প্রজন্মে মাইহার ঘরানার প্রধান পতাকাবাহক। তিনি একই সঙ্গে যেমন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এই মহান বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে, তেমনই তিনি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তিনি ক্রমাগত নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছেন, জন্ম দিচ্ছেন নিত্য নতুন ইতিহাসের, যা ক্রমোজ্জ্বল করে তুলবে আলি আকবর খানের উত্তরাধিকারকে।
ছবি সৌজন্য: পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ
সুভদ্রকল্যাণ বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র। বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই তাঁর লেখা সংগীত ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন, সেগুলিও প্রকাশিত ও সমাদৃত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরাজি ভাষায় কবিতা লেখেন সুভদ্রকল্যাণ। তাঁর আরেকটি পরিচয় রাগসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সংগীতশিক্ষা করেছেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, ডঃ রাজিব চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুর কাছে। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।