‘মুরলী বাজিত যো রাধা কাঁদা সুরে সেই যমুনার তীরে।’

আমার দেখা সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি ‘ঢুলি।’ এক শান্ত স্নিগ্ধ শিল্পীকে দেখেছিলাম সেখানে। এরপর তো সেই মেয়েটি তার আকর্ষনীয় চেহারা, ব্যক্তিত্ব, সংবেদনশীল অভিনয় করে সবার মন জয় করে নিয়েছিল। চিরকালের রোম্যান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা। একের পর এক মনোমুগ্ধকর ছবি– ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাগরিকা’, ‘সবার উপরে’, ‘সূর্যতোরণ’ আরও অনেক ছবি। তবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, এইসব কমেডি ছবিতে সুচিত্রার ভূমিকা খুব একটা বেশি ছিল না। পরবর্তীকালে তাঁর দৃপ্ত চাহনি আর ভুবনভোলানো হাসি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই হৃদয় স্পর্শ করেছিল।

আজ আমি সুচিত্রা সেন সম্পর্কে যে কথাটি লিখতে চাই, সেটা হচ্ছে তাঁর অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে। অনেককেই কটাক্ষ করতে শুনেছি সুচিত্রা সেনের ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানো নিয়ে। অভিনয়ে নাকি তিনি তেমন দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারেননি, বলে থাকেন এইসব সমালোচকেরা।

Suchitra Sen Filmfare
ফিল্মফেয়ার পত্রিকার প্রচ্ছদে সুচিত্রার বিখ্যাত চাহনি

এবার বলুন তো, সুচিত্রা সেন যখন নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে এসেছিলেন, তখন বাংলা ছবির প্রসার কতটা ছিল? প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের গল্প নিয়ে যে সব ছবি তৈরি হয়েছিল তাতে নায়িকার কতটা সুযোগ ছিল নিজেকে মেলে ধরবার, নিজের অভিনয় দক্ষতা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করবার? সুচিত্রা সেন কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দির নানা ধরনের ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।

আমরা বৈষ্ণব ধর্মে শ্রীচৈতন্য এবং বিষ্ণুপ্রিয়ার কাউকেই চোখে দেখিনি, কিন্তু এখনও শ্রীচৈতন্য আর বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা মনে হলেই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে প্রতিভাত হয় বসন্ত চৌধুরী এবং সুচিত্রা সেন। মনে করে দেখুন তো, যেখানে চৈতন্য সংসার ত্যাগ করছেন, সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিনয়! শুনেছি প্রখ্যাত পরিচালক দেবকীকুমার বসু বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাবটি যাতে সত্যিকারের আন্তরিকতায় সবার হৃদয় স্পর্শ করে, তার জন্যে সুচিত্রা সেনকে এক বছর নিরামিষ আহার করিয়েছিলেন এবং তিনি সেটি মেনেও নিয়েছিলেন, অভিনয়ের প্রতি এতটাই তাঁর শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল। 

Suchitra-Sen
নানা মুডে নানা রঙে মহানায়িকা

এরপর মার্গসঙ্গীতে তাঁর লিপ মেলানো এমনকী সরগমের দৃশ্যে লিপ দেওয়ার কথা। ‘শাপমোচন’ ছবিতে ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’ গানটি গেয়েছিলেন চিন্ময় লাহিড়ী এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধায়। সেই অসম্ভব কঠিন সুরের চলনেও ক্লোজ় আপ শটে লিপ দিতে সুচিত্রার এতটুকু জড়তা দেখা যায়নি। এরপর আসি ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবির প্রসঙ্গে। এই দু’টি ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণা বসুর কণ্ঠে নানা রাগের মার্গসঙ্গীতে সুচিত্রা সেনের লিপ সিংক এবং তার পাশাপাশি অভিব্যক্তিমূলক অভিনয় দক্ষতা আমাদের অবাক করে দেয়।

‘সপ্তপদী’ ছবিতে ‘ওথেলো’ নাটকের দৃশ্যের কথা কি আজও ভুলতে পেরেছি? সুচিত্রা সেন তাঁর পরিণত বয়সেও যেভাবে রিনা ব্রাউনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তা অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখে। সেই স্মার্টনেসের কোনও তুলনাই হয় না আজকের যুগের প্রেক্ষিতে। এই প্রসঙ্গে সুশীল মজুমদারের ‘হসপিটাল’ ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় সুচিত্রা সেনের সাজ, চিকিৎসকসুলভ আচার আচরণ অনবদ্য। বিশেষ করে যখন তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত, বহুদিন পরে শৈবালকে দেখে রোগশয্যায় তাঁর ক্লান্ত মুখশ্রী, অশ্রুসজল দৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে দেয়।  

Suchitra Sen Actress
রূপের ছটা ম্লান করতে পারেনি অভিনয়ের দীপ্তি

অন্যদিকে ‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবিতে মা-মেয়ের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়ের বিশেষ মুহূর্তের কিছু দৃশ্যও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা ছবির ইতিহাসে। ‘সাতপাকে বাঁধা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় যে কোন স্তরের, তা আন্তর্জাতিক স্তরে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’-র সম্মানপ্রাপ্তি থেকেই উপলব্ধি করা যায়।

অমরকথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবিগুলি- ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘দত্তা’ ইত্যাদিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় সে যুগের নারী চরিত্রগুলিকে আমাদের সামনে অতি সহজে অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে একান্তভাবে সাহায্য করেছিল। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির সিস্টার রাধা মিত্রের সেই মর্মস্পর্শী সংলাপ ‘আমি অভিনয করতে জানি না’ আজও আমাদের কানে বাজে।

তাঁর অভিনয় সুষমার এরকম অগনিত মুহূর্ত আছে যা দিয়ে কালের যাত্রাপথে চাঁর আসনটি অটল হয়ে থাকতে পারে। তাহলে তাঁর অভিনয় প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে এত দ্বিধা কেন? কেনই বা তাঁর রূপকে অভিনয়ের আগে স্থান দিয়ে অভিনয় দক্ষতাকে খাটো করে দেখানোর এই প্রচেষ্টা?  একজন শিল্পীর সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না। হতে পারেই না। সুচিত্রা সম্পর্কেও সে কথা প্রযোজ্য।

Suchitra Sen posters
সুচিত্রা সেনের বিখ্যাত ছবিগুলির অরিজিনাল পোস্টার

শেষের দিকে তাঁর অভিনীত ছবিগুলি ‘ফরিয়াদ’, আলো আমার আলো’, ‘প্রণয়পাশা’ বক্স অফিসে যেমন সাফল্য পায়নি, তেমন তাঁর অভিনয়ও প্রশংসিত হয়নি। তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। এবং ঠিক সেই সময়েই তিনি নিজের প্রস্থানের মুহূর্তটি চিনে নিয়েছিলেন অক্লেশে। একবারও দ্বিধা করেননি আগামীকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে। অন্তরালে গিয়ে নিজের চারদিকে রচনা করে নিয়েছিলেন এক নির্মোহ বলয়। অভিনেত্রী হিসেবে এও কি কম কৃতিত্বের?   

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Twitter, The Statesman, Hindu Business Line

মধুশ্রী মৈত্র তাঁর কর্মজীবনে ছিলেন কলকাতা দূরদর্শনের প্রোগ্রাম এগজিকিউটিভ। অবসর নিয়েছেন অনেক বছর হল। এখন এই সাতাত্তরে পৌঁছে লেখালিখি আর গানই তাঁর মুখ্য অবলম্বন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত গীতিকার অমিয় বাগচি। তাই লেখা ও সুর দুইই তাঁর রক্তে। একাধিক লিটল ম্যাগাজ়িন ছাড়াও মনোরমা, সাপ্তাহিক বর্তমান, যুগশঙ্খ, বাংলা স্টেটসম্যানে নিয়মিত লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *