বর্ণপরিচয়
আমার এক মামা জার্মানি থেকে সুকিয়া স্ট্রিট আসতেন আড্ডা দিতে। ফি বছর তাঁর কলকাতাতে আসা চাইইই– যার মূল কারণ, আড্ডা বলেই জানতাম। কিছু বছর আগেও ‘ন্যাপা ইন্ডিয়া’র ভাগ্নে’ বলে ওই পাড়ায় আমায় লোকে জানত, চিনত।
তখন ইস্কুলে পড়ি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট খেলা চলছে। টিভিতে সেটার সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। আমি বায়না ধরলাম, আমাকে সকালেই দিদির বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে শুরু থেকে খেলা দেখতে পারি। মায়ের ইস্কুল শুরু বেলা এগারোটায়। মায়ের সঙ্গে গেলে দিদির বাড়ি পৌঁছনোর খানিক বাদেই খেলার লাঞ্চ-ব্রেক হয়ে যাবে। আমার এই প্রভাতী বায়নাক্কার মাঝেই নৃপেনমামা বাড়িতে ঢুকলেন। মায়ের সমস্যার কথা শুনে অভয় দিলেন যে তিনি আমাকে দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেবেন, এই সুযোগে দিদির সঙ্গেও ওঁর দেখা হয়ে যাবে। সেই সকাল ন’টায় নৃপেনমামা আমাকে নিয়ে মানিকতলা থেকে বেরিয়ে পড়লেন বাদুড়বাগানের উদ্দেশে। আট-দশ মিনিটের হাঁটা-পথ।
শেষমেশ দিদির বাড়ি পৌঁছেছিলাম খেলার টি-ব্রেকের সময়। দিদিদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। আমিও খেয়েছি পথে। তিনটে অমলেট আর চারটে মিষ্টি। দিদি অবাক হয়ে নৃপেনমামার দিকে তাকাতে বিব্রত হাসি হেসে মামা বলেছিলেন– “আর বলিস না! এতদিন বাদে এই রাস্তায় আসা! পুরনো লোকজনদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তোর বাড়িতে আসার পথে… একটু আড্ডা দিয়ে ফেললাম আর কি!” সেই বয়েসেই মামার হাত ধরে আড্ডার জগতে ব্যাপ্টিজম আমার।
প্রথম ভাগ
আমার যে পাড়ায় জন্ম আর বড় হয়ে ওঠা, সেখানে শিশু অবস্থা থেকে লক্ষ্য থাকে রকে আর চায়ের দোকানে বসা। ঘড়ি ধরে সেখানে মানুষগুলো বদলে যায়, কিন্তু আড্ডা নিরন্তর চলতে থাকে। দেশের অবস্থা থেকে বাজারদর থেকে ফুটবল হয়ে সাহিত্য ছুঁয়ে জাতীয়, পাড়াতুতো আর অফিসতুতো রাজনীতি, কিছুই বাকি থাকে না। আড্ডা কি পরিকল্পিত হয়? নির্দিষ্ট দিনে? নির্ঘণ্ট মেনে? আমার জানা নেই। জীবনে তা পারিনি, আর কোনওদিন পারব বলে মনেও হয় না।
আড্ডা মানে জমিয়ে গপ্পো করা বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয়দের সঙ্গে। যেখানে কোনও পরিকল্পিত স্রোত নেই। আড্ডা ভেসে চলে নিজের মতো ধ্রুপদী খেয়ালে। পরিকল্পনা থাকলে সেটা কিসের আড্ডা? শচীনদাকে আঙুল-কাটা যে লোকটার কাঁধে কনুই রেখে আড্ডা দিতে দেখেছি, তার আঙুলগুলো তো শচীনদার সোর্ডের কোপেই কেটেছিল দশ বছর আগে, তাই বলে কি ওরা আড্ডা দেবে না? উদয়দা তো বাঘাদার সাথে আড্ডা দিতেই গিয়েছিল- থোড়াই জানত বাঘাদা ওকে খুন করবে!

ইস্কুল জমানার আড্ডা হত কোনও বন্ধুর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে। আড্ডা শেষ হত হাতাহাতিতে। লড়াই হত শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে– মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, গাওস্কর না বিশ্বনাথ, ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা। রাস্তায় আড্ডা শুরু হল টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে। আর হঠাৎ করে মাঠের খেলাধুলোয় আটকে থাকা পৃথিবীটা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে।
সন্ধ্যেবেলা মনকে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করার সময় জমা হত জোয়ন বেজ়-বব ডিলান-সাইমন গারফাঙ্কলের সঙ্গে প্রিন্স-ম্যাডোনা-মাইকেল জ্যাকসন। আর তার সঙ্গে অমিতাভ-মিঠুন-জন ট্রাভোল্টা-ক্লিন্ট ইস্টউড নামের পাকিয়ে যাওয়া কিছু সুতো, যাদের আলাদা করা যেত না। আটকে থাকত পড়ার বইয়ের মধ্যে। আর থাকত টিউশন ক্লাসের তিলোত্তমার মুখ, যাকে নিয়ে আজ টিউশন থেকে ফেরার পথে স্নেহাশিসের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। ও সত্যিই কার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, এই তর্কে সেদিনের আড্ডা শেষ হয়েছিল।
দ্বিতীয় ভাগ
ইস্কুল ছাড়ার পর কয়েকটা উপলব্ধি হল। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে না পারলে আড্ডা সম্পূর্ণ হয় না। আড্ডারও তীর্থক্ষেত্র আছে। তাই পায়ে পায়ে একদিন কফি হাউসে পৌঁছে গেলাম। ওরেব্বাস! এ তো যে সে তীর্থ নয়, এক্কেবারে পঞ্চমুণ্ডির আসন! দুপুরে ঢুকে পড়ে সন্ধে পার করে বেরনো যায়। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। মাথায় উষ্ণীষ পরা বিজয়দা, রামুদা, সুলতানদারা রাজার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চার বন্ধুর পকেটে দুটো করে টাকা থাকলে ফুল অন বিন্দাস। ইনফিউশন থেকে ইসমাইলের বিড়ি সবকিছু মিলে যাবে ঘণ্টা ছয়েকের জন্যে। আড্ডার বিষয় ক্রমে আরও বিস্তৃত হয়েছে। ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ায় তখন দাস ক্যাপিতাল সবচেয়ে বেশি আলোচ্য। চে, ফুচিক, মাও! বিপ্লব ট্রাম লাইনের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে, এই এসে পড়ল বলে!

বিজয়দা আবার নকশাল করে। ওকে নিয়েই কিউবা যাওয়ার পরিকল্পনা হয় আড্ডার মধ্যে। প্রেসিডেন্সির ‘মিলিউ’তে বাউলগান হয়। হেয়ারের মাঠে বসে গান শুনি। আড্ডা চলে। ধোঁয়া ততদিনে নিরামিষ থেকে আমিষ হয়ে গিয়েছে। আর তার আবার দুটো সন্তান। রিফার আর সনাতনী। বাউলের গান, বিপ্লব, গদার-ত্রুফো-আইজেনস্টাইনকে টুকরো টুকরো করে শক্তি-তুষার-শঙ্খকে মনে মাখামাখি। কৃত্তিবাসী আর হাংরি জেনারেশনকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতে করতে কখনও সনাতনী কখনও রিফার। রেনোয়াঁ দূরে থাক, একটা গিন্সবার্গ পর্যন্ত জুটল না জীবনে, এই আলোচনা করতে করতে একসময় ঢিশশ।
এই তান্ত্রিক আড্ডা বেশিদিন হজম হল না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে শান্তি। কফি হাউসের বদলে হেদুয়ার মোড়ে বসন্ত কেবিন। শ্বেতপাথরের চৌকো টেবিলের চারপাশে বসে সকাল থেকে বিকেল। সন্ধের পর ও বাড়ির ছাদ। তখন চায়ের বদলে ‘টা’। আড্ডা চলছে চলবে! মাঝেমাঝে পুলিসের সঙ্গে কুমিরডাঙা খেলা- “কুমির থুড়ি পুলিশ তোমার জল্কে নেমেছি!”
আর কলেজের সামনে বৌদির চায়ের দোকান, পাশে আর সামনে খালি ব্যাটারির সারি। সেখানে অ্যাব্লা-র হেড অফিস। বৌদির চায়ের দোকানের ঠেকে সদস্যপদ পাওয়ার প্রাথমিক শর্ত: প্রেমে ল্যাং খেতে হবে। এই আড্ডায় সবকিছু নিয়ে আলোচনা চলবে। শুধু প্রেম-ভালোবাসা সম্বন্ধীয় আলোচনা নৈব-নৈব-চ।

এই আড্ডায় সদস্য সংখ্যা বাড়ে কমে। কিন্তু কেউ কেউ ছিল স্থায়ী সদস্য। ব্যাটারিগুলো ছিল উদ্ধারনপুরের ঘাটের অবধুতের গদি। সেখানে বসে নির্লিপ্তভাবে চারপাশ দেখার জায়গা। কেউ বৌদির দোকানে বিনোদ মেহরা আর মিনাকুমারীর ছবি এনে সেঁটে দিয়েছিল। সেটা ব্যাটারিগুলোর গাম্ভীর্য আর দীর্ঘশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কেউ এসে উপস্থিত সবাইকে চা-বিড়ি খাওয়ালে বুঝতাম অ্যাবলা-র সদস্য বাড়ল। এটাই ছিল নতুন সদস্যের এন্ট্রি ফি।
আর কেউ বেশ কিছুদিন ধরে এই ঠেকে অনুপস্থিত থাকলে বুঝে নেওয়া হত সে আর সদস্য নেই। তার আবার পাখনা গজিয়েছে। অ্যাবলা’র সদস্যসংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, যে স্থায়ী সদস্যরা কলেজের প্রিন্সিপালকে আর্জি জানিয়েছিল কলেজ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতির জন্যে। প্রস্তাব শুনে প্রথমে প্রিন্সিপাল হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন আর তারপর অ্যাবলা-র পুরো নাম শুনে দারোয়ান ডেকেছিলেন। অ্যাবলা-র ফুল ফর্ম: অল বেঙ্গল লাথখাওয়া এ্যাসোসিয়েশন।
কলকাতার বাইরে ইন্টারকলেজ ফেস্টে অংশগ্রহণ করতে দুর্গাপুর চলেছি চার বন্ধু। গিয়ে মন দমে গেল। সব্বার আলাদা আলাদা হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা। আব্বুলিস! এইরকম থাকা হলে আড্ডা হবে কখন! হঠাৎ শিবেদার সঙ্গে দেখা। রেডিওতে কলেজ ফেস্ট নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করবে বলে এসেছে। ফেস্টিভালে কী হয়, কেমন আড্ডা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার থাকার জন্যে এলাহি ব্যবস্থা। গেস্টহাউসের একতলার একটি ঘরে একা থাকবে, অ্যাটাচ্ড টয়লেট পর্যন্ত আছে। আর আছে এক ফালি বারান্দা।
রাতে খেয়েদেয়ে ফিরে বারান্দা টপকে দরজায় টোকা মারতে শিবেদা ঘুমের ঘোরে বেশি না ভেবে সদর দরজা মনে করে বারান্দার দরজা খুলে দিল। আর আমরা চারজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ঘরে। সারারাত ধরে আড্ডা মারার এইরকম সুযোগ ছাড়া যায় নাকি! পরেরদিন সকালে ওরই বাথরুমে ওরই সাবান মেখে স্নান করে, ওরই তোয়ালে দিয়ে গাহাতপা মুছে চললুম প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে। কে ফেরত যাবে হোস্টেলে? আড্ডার সময় কম পড়ে যাবে না!
এই ঘটনার পর শিবেদা বেশ কিছুদিন কথা বলেনি আমাদের সঙ্গে, কারণ সে জানতে পেরেছিল পরের দিন কম্পিটিশনে পরার জন্য পরনের গেঞ্জি-জাঙিয়া কেচে বারান্দায় মেলে শুকিয়েছিলাম রাতে, পাছে হোস্টেলে গিয়ে নতুন সেট পরে আসতে গিয়ে আড্ডার অমূল্য সময় নষ্ট না হয়!
ভাগ-গো
একসময়ে বাকি বিপ্লবীদের মতো আমিও গোয়ালে গিয়ে হাম্বা ডাক দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে পার্ক স্ট্রিটে আমার গোয়াল। শীতকালে নিয়মমাফিক বইমেলার মাঠে বাকিদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। অফিস থেকে থাব্বি-থাব্বা দিয়ে এক দৌড়ে চৌরঙ্গী পার। ইতিমধ্যে একটা জিনিস গজিয়েছে। যজ্ঞে যেমন ঘি না দিলে আগুন বাড়ে না, আড্ডাতে নেশা না হলে সেই ‘মাখো-মাখো’ ব্যাপারটা আসে না। ততদিনে সুমন এসে গিয়েছেন গিটার হাতে। তাই অনেকের হাতেই গিটার। মমার্তের অদূরে মর্মাহতদের মধ্যে বসে আড্ডা চলে। “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?” শর্মি রিফার বানিয়ে চলে।
এরই মধ্যে প্রবীরকে খুঁজতে খুঁজতে নতুন এক আড্ডার পীঠস্থান খুঁজে পাওয়া গেল। আর.জি.কর হাসপাতালের একটা হস্টেল, যেটা কর্পোরেশনের ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ তকমায় পেয়েছে বহুবছর আগেই, প্রবীর সেখানে আস্তানা গেড়েছে। প্রবীরের রুমমেট যশদা প্রায় কোনওসময়েই থাকে না। ফলে প্রবীরের ঘর হয়ে গেল নতুন ঠেক। অফিস ফেরতা ঢুকতাম, পরের দিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরে স্নান করে জামাকাপড় বদলে আবার অফিস বেরিয়ে যেতাম। বাবা খবরের কাগজ মুখের ওপর থেকে সরিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, “সারা রাত কী করলে?” উত্তরটা “আড্ডা” হবে জেনেও করতেন আর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে আবার কাগজ মুখের ওপর ধরতেন।
একবার দুর্গাপুজার পঞ্চমীর সন্ধেতে বিলু আর আমি প্রবীরের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। প্রবীর পুজোতে ওর জামশেদপুরের পাড়ায় খাবারের স্টল দিয়েছে। পুজোয় থাকবে না। তাই ‘বাই’ বলতে গিয়েছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিয়ে বেরিয়ে যাব। পরের দিন ভোরবেলা প্রবীরের ট্রেন, আড্ডার চোটে রাত হলে প্রবীর বেচারা ট্রেন মিস করবে। প্রবীর ট্রেন ধরেছিল, কিন্তু নবমীর দিন সকালে। আমাদের পাল্লায় পড়ে তিনদিন দিবারাত্র আড্ডা দিয়ে আর ল্যাদ খেয়ে। আমাদের হাতে পায়ে ধরে প্রবীর আমাদের অষ্টমীর দিন রাতে হস্টেল থেকে বার করেছিল যাতে দু’দিন অন্তত ব্যবসা করতে পারে। স্টলের পয়সা যেন অন্তত উসুল হয়।
রাতে খেয়েদেয়ে ফিরে বারান্দা টপকে দরজায় টোকা মারতে শিবেদা ঘুমের ঘোরে বেশি না ভেবে সদর দরজা মনে করে বারান্দার দরজা খুলে দিল। আর আমরা চারজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ঘরে। সারারাত ধরে আড্ডা মারার এইরকম সুযোগ ছাড়া যায় নাকি!
মাঝেমাঝে আড্ডার রকমফের হত। একবার উড়িষ্যার গোপালপুরে এইরকম একটা ‘মাখো-মাখো’ আড্ডায় লিলুয়ার ছেলেদের প্রতাপ বেশি, না উত্তর কলকাতার– সেই নিয়ে তর্ক লাগল। তর্ক যখন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে আর একের পর এক বিক্রমগাথা ছলকে ছলকে পড়ছে, হঠাৎ খেয়াল হল লিলুয়ার রামরাজুকে দেখা যাচ্ছে না। রাতের অন্ধকারে টলমল পায়ে সব্বাই বেরিয়ে পড়লাম ওকে খুঁজতে। ওকে পাওয়া গেল সমুদ্র তীরে। আগুয়ান ঢেউগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে চেঁচাচ্ছে, “একবার এগোচ্ছিস, একবার পিছোচ্ছিস- মাজাকি হচ্ছে! জানিস আমি লিলুয়ার ছেলে!”
আমরা সবাই সেই রাতে লিলুয়ার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছিলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রামরাজু দক্ষিণ ভারতীয় না, খাস বাঙালি। রাজুর রামের বোতলের প্রতি আকর্ষণের জন্যে ওকে সবাই রামরাজু বলেই চিনত।
আরেকটা এইরকম ‘মাখো-মাখো’ আড্ডাতে সব্বাই গোল হয়ে বসে গল্প করছে। হঠাৎদীপকে উদ্দেশ করে বুড়ো বলল “অ্যাই তোর নেশা হয়ে গেছে।“ দীপ প্রবলভাবে আপত্তি জানাতে বুড়ো এবার বলল, নেশা হয়নি প্রমাণ করার জন্যে দীপকে গাছে উঠতে হবে। দীপ তরতর করে গাছে উঠে গেল। তাই দেখে বুড়ো গম্ভীরভাবে বলল “আমার কথায় গাছে উঠলি যখন, তার মানেই তোর নেশা হয়েছে।” এর খানিকবাদে দেখা গেল দীপ গাছে উঠছে আর নামছে, উঠছে আর নামছে।
একবার মিরানগর থেকে মুম্বই চার্চগেট যাচ্ছি লোকাল ট্রেনে, একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। কলকাতা ছাড়ব তখন মনস্থির করে ফেলেছি। আড্ডার নেশা না ছাড়লে সামনে যে গভীর গাড্ডা, মানসচক্ষে দেখতে পেয়ে গিয়েছি ততদিনে। অদ্ভুতভাবে বেশি ভিড় নেই ট্রেনটাতে, মানে দাঁড়ানোর আর মাথার ওপরে রড ধরার সুযোগ পেয়ে গিয়েছি। যারা বসে আছে, একা হলে কাগজ পড়ছে, যারা দোকা তারা পাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। কিছু মানুষ ব্রিফকেস থেকে কাগজ পেন বার করে কীসব হিজিবিজি লিখছে, কানে ফোন দিয়ে ব্যবসায়িক কথা বলছে। চার্চগেট আসতে বেশ কিছু মানুষ ট্রেন থেকে নামল। অনেকের মতো আমিও বসার জায়গা পেয়ে গেলাম।
এইবার আড্ডা জমানোর জন্যে সামনের যাত্রীটির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সে মরা ছাগলের মতো চোখ তুলে একবার আমার দিকে চেয়ে জানালার বাইরে উদাসভাবে চেয়ে থাকল। আমি বুঝে গেলাম, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। এখানে খেজুরে আলাপ নেই। আড্ডা নেই। মুম্বইতে আমার আর থাকা হবে না, সেদিনই বুঝে গিয়ে রইল ঝোলা, চলল ভোলা নিজের শহরে পত্রপাঠ ফেরত।
ভাগশেষ
প্রবীর এখন এক মস্ত কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। বিলু ব্যস্ত ব্যবসায়ী। আমরা এখন বছরে একবার অন্তত কলকাতার বাইরে চলে যাই। আগেকার মতো বাসে বা ট্রেনে নয়। গাড়িতে করে। পৌঁছে সবাই নিজেদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তারপর একসময় হাঁপিয়েও যাই। যজ্ঞে ঘি ঢালা শুরু হতেই আস্তে আস্তে সেই ‘মাখো-মাখো’ ভাবটা ফেরত আসে। হাসির দমকে আর গলার আওয়াজে রাতপথের কুকুর অবধি চমকে যায়। একসময় নেশা আর আড্ডা মেশানো ঘুমে আগের মতো দলা পাকিয়ে যাই।
সকাল হতে দেখি সবাই এক বিছানায় শুয়ে আছি। চোখাচুখি হলে এক অচেনা লজ্জা মেশানো হাসি… “কাল রাতে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল!” আবার আড্ডা শুরু হয়। আবার সবাই মিলে হ্যাহ্যা-হিহি করি। সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মতো। দীপের কথা ঘুরে ফিরে আসে। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে না পারলেও দীপ রোদ্দুর হয়ে গিয়েছে। আমাদের জন্য বাঞ্ছিত উষ্ণতা ফেলে রেখে। আড্ডাতে জল থাকে সেইদিনগুলোর ছায়া দেখার জন্যে। আর বিষম খাওয়ার জন্যে।
বিষম আসলে খুব ভাল জিনিস। ভারী কাজের জিনিস। হারিয়ে ফেলা আড্ডা-দিনগুলোর কথা মনে করে আচমকা চোখে চলে আসা জলকে লুকিয়ে ফেলতে তার জুড়ি নেই।
*লেখার ভিতরের ছবি সৌজন্য: gellerist.in, saatchiart.com, Youtube
পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।
দারুণ লিখিছিস
Khub Bhalo Pinaki… reminiscent of those days of unbridled joy of giving adda…Tobey ekta Kotha…there was a start time of adda which was uncompromising like pujor nirghonto…. adda was a part of the being….but somehow over the years the romance of adda has been lost…you indulge if you only have time, earlier you made time for adda
As usual দারুন হয়েছে। তোর লেখা পড়লে অনেক মজার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু মনে পড়লেও সেই নিয়ে গ্যজানোর মতো কাউকে পাওয়া মুশকিল!
দারুণ লাগলো পড়ে, যে আড্ডার মজা জানেনা তার জীবনে আছে টা কি?