হাতে লেখা চিঠির মৃত্যু হচ্ছে কয়েকবছর ধরেই। পশ্চিমি দুনিয়ায় হাতে লেখা চিঠি এখন বিরল, প্রাচ্যও ধীরে ধীরে একই পথে। এখন ইমেলের যুগ। লোকে বানান লেখা ভুলে যাচ্ছে। কী হবে জেনে? অটোকারেক্ট করে দেবে কম্প্যুটার। কী হবে হাতের লেখা ভাল করে? সব এখন টাইপ করে লেখা। সবাই তো টাইপ করে। শিশুরা এখন আর গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করে না। কিন্তু আগে যে বাড়িতে হলুদ পোস্টকার্ড আসত- প্রাইভেসির বালাই তাতে থাকত না, যে নীল রঙের ইনল্যান্ড লেটার ঘরে এলে বেশ একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হত, সেটা কি একটা ইমেল দিতে পারে?
জন ম্যাক্সওয়েল কোয়েটজ়ি আর পল অস্টার, দুই দিকপাল লেখক। দু’জনেই টেকনোলজি এড়িয়ে চলেন। তাঁদের টেকনোলজি বলতে শুধু ফ্যাক্স মেশিন। হাতেলিখে চিঠি ফ্যাক্স করে দেন- হাতে না লিখলে চিঠির কি কোনও মাধুর্য থাকে? জন কোয়েটজ়ি দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক। ২০০৩ সালে নোবেল প্রাইজ পান, তার আগে প্রায় সব নাম করা প্রাইজই তাঁর পাওয়া হয়ে গেছে। বছর বারো আগে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করেন। দু’বার বুকার পুরস্কার পেয়েছেন ‘লাইফ অ্যান্ড টাইম অফ মাইকেল কে’ আর ‘ডিসগ্রেস’-এর জন্য। ‘ডিসগ্রেস’ আমাদের সময়ের এক যুগান্তকারী উপন্যাস। ‘ডিসগ্রেস’ উপন্যাসে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের অসারতা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
নেলসন ম্যন্ডেলার স্বপ্ন ছিল যে, স্বাধীনতার পর কোনও প্রতিহিংসার আগুনে দক্ষিণ আফ্রিকা জ্বলবে না। এক ব্যতিক্রমী দেশ হিসেবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে বিকাশের পথে। বলাই বাহুল্য তাঁর সেই স্বপ্ন সম্পূর্ন সফল হয়নি। বর্ণবৈষম্যের পরের দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক বদলেছে- এখন ওখানকার সাদা মানুষেরা কেমন আছেন? যাঁরা ওখানেই জন্মেছেন, ওখানেই বড় হয়েছেন? নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা কি তাঁদেরও দেশ নয়? তাঁদের পূর্বপুরুষেরা বর্ণবৈষম্যের সমর্থক বলে সেই অপরাধের বোঝা তাঁদেরও বয়ে বেড়াতে হবে? তাঁদের এখনও কৃষ্ণাঙ্গরা ঘৃণার চোখে দেখবে? তাহলে যে বর্ণবৈষম্যবাদের পাঁকে ডুবে ছিল এতদিন এই দেশ, সেই পাঁক থেকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা? বৃথা তাঁর ছাব্বিশ বছরের কারাবাস?
এই প্রশ্ন আমাদের সবকালে সবদেশেই একই রকম প্রাসঙ্গিক। এবং প্রশ্নটা অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। সমালোচক ইসিডর ডায়ালা বলেন কোয়েটজ়ি, আন্দ্রে ব্রিঙ্ক আর নাদিন গর্ডিমার – এই তিনজন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিখ্যাত শ্বেতাঙ্গ লেখক, যাঁদের লেখায় বর্ণবৈষম্যবাদের প্রতি মুখর প্রতিবাদ পাওয়া যায়।
পল অস্টার আমেরিকার লেখক এবং চিত্র পরিচালক। পল অস্টারের বিখ্যাত ‘নিউ ইয়র্ক ট্রিলজি’র পর তাঁর খ্যাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় গোয়েন্দা গল্পের ছলে বলা এই বইগুলোয় পোস্ট মডার্নিজ়মের ছাপ সুস্পষ্ট। অস্টার এই ডিটেকটিভ গল্পের মধ্যে সময়, স্থান এবং পরিচিতির মতো অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো অন্বেষণ করেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি চিত্রনাট্য এবং সহনির্দেশক হিসেবে সিনেমা করেন ‘স্মোক’ – সিনেমাটি অনেকগুলো প্রাইজ পায়। সমালোচকদের মতে অস্টারের লেখায় লাকান, দেরিদা, বেকেটের প্রভাব অনস্বীকার্য।

কোয়েটজ়ির সঙ্গে পল অস্টারের প্রথম আলাপ হয় অস্ট্রেলিয়া বইমেলায়- দুজনেই আমন্ত্রিত ছিলেন সেখানে ২০০৮ সালে। এই দুই বিপরীত চরিত্রের লেখক প্রথম দর্শনেই এক গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েন। জুলাই থেকে এই চিঠি আদান প্রদান আরম্ভ হয়। সবচেয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা পাই, যা দুই লেখককে রক্তমাংসের মানুষ করে তোলে, যখন তাঁরা আলোচনা করেন বয়স নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে, একাকিত্ব নিয়ে।
যখন হাতে লেখা চিঠি বিরল, বিশেষত পাশ্চাত্য সভ্যতায়, তখন এই দুই দিকপাল লেখকের চিঠির আদানপ্রদান এক বিরল ঘটনা নিশ্চিত।
কোয়েটজ়ির প্রথম চিঠিতে তিনি বিষয় হিসেবে আলোচনা করেন- বন্ধুত্ব। পল অস্টারের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব করতে চান। অবশ্য এর আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। চকমকি দিয়ে যেমন আগুন জ্বালানো যায়, ঠিক তেমনি করে যদি “ to strike spark off each other”। যেহেতু তিনি জন কোয়েটজ়ি, এবং পৃথিবীর সেরা আধুনিক লেখকদের একজন, তাই বন্ধুত্ব করার আগে এই বিষয় নিয়ে একটু পড়াশোনা করে নিয়েছেন। তাঁর সম্যক ধারনা হয়েছে যে মানুষ কোনও বস্তুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না (অ্যারিস্টটল)।
আবার চার্লস ল্যাম্বের লেখা থেকে পেয়েছেন, যে বন্ধুত্ব করার জন্য যে সর্বদা বন্ধুকে চাক্ষুষ দেখতে হবে তার কোনও মানে নেই। অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ব্যাপার হল যে, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের লেখায় পাই, একজন পুরুষ একজন মহিলাকে শয্যাসঙ্গিনী করেন তাঁর সঙ্গে ভাল করে কথা বলার জন্য। অর্থাৎ প্রথমে তাঁকে শয্যাসঙ্গিনী করে তারপর বন্ধুতে রূপান্তরিত করেন।
এর উত্তরে পল অস্টার বন্ধুত্ব সম্বন্ধে তাঁর নিজের চিন্তা ব্যক্ত করেন। তিনি দেখছেন সম্পূর্ন অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি ভাগ করেছেন প্রাপবয়স্ক পুরুষ বন্ধু, শৈশব বা কৈশোরের বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্ব এবং প্রেম। তিনি উল্লেখ করছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক জুবার্তের কথা– “এমন কোনও মহিলাকে বিয়ে কোরও না, যে ছেলে হলে তুমি তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে না।” কথাটা অবাস্তব কিন্তু ঠিক যেন ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের উল্লেখের সঙ্গে মিলে যায়।
দুই নিঃসঙ্গ এবং মুখচোরা লেখক কিন্তু খেলায় প্রবলভাবে আগ্রহী এবং তাঁদের এই চিঠিগুলোর বেশ কিছু জায়গা জুড়ে আছে খেলা নিয়ে আলোচনা। তাও খেলা নিয়ে কোন উগ্র আবেগ নয়, সময়ে সময়ে খেলা দেখাটা সময়ের অপচয় কিনা, তাও বিস্তারে বিবৃত করেছেন দুজনে। পল অস্টারের পছন্দের খেলা বেসবল আর কোয়েটজ়ির পছন্দ ক্রিকেট– কিন্তু দু’জনেই রজার ফেডেরারের অন্ধ ভক্ত।

পত্রসাহিত্য সাহিত্যের এক বিস্মৃতপ্রায় ঘরানা (genre)। এখন অনেক লেখকই হয়তো বেশ কিছু স্মরণীয় ইমেল জমিয়ে রাখেন, কিন্তু হাতে চিঠি লেখার সময় কারওই নেই। তাহলে কেন এই লেখা আর কেন এই বই?
পরবর্তী তিন বছর ধরে এই দুই প্রখর ব্যক্তিত্ব নিজেদের চিন্তাভাবনা একের পর এক চিঠিতে লিখে রেখেছেন। অস্টার থাকেন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে আর কোয়েটজ়ি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। কখনও খেলা, কখনও রাজনীতি, কখনো দর্শন– ঋদ্ধ হই বারবার তাঁদের এই মননশীলতায়। দু’জনে সম্পূর্ন বিপরীত মেরুর লোক। এর মধ্যে পল অস্টারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। প্রাণশক্তিতে টগবগে, রাজনৈতিক মতামত দিতে কুণ্ঠিত নন। কেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অবিলম্বে সরান উচিত, তাই নিয়ে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিতে কোনও সঙ্কোচ নেই। সিনেমা আর সাহিত্যে সমান বিচরণ তাঁর।
আর তাঁর চেয়ে সাত বছরের বড় কোয়েটজ়ি একজন মুখচোরা চিন্তাশীল মানুষ। সচরাচর বইমেলা বা অন্যান্য ফাংশন এড়িয়ে যান। কয়েটজ়ির কাছে এথিক্স, নীতিবোধ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতির থেকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই বইতে দু’জনের চিন্তার মিলই বেশি চোখে পড়ে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্পোর্টস সম্বন্ধে পল অস্টারের মতামত, এটা একরকমের পারফর্মিং আর্টস।
আর কয়েটজ়ির ধারণা “মোর এথিক্স দ্যান এস্থেটিক্স।” সবচেয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা হয়, যখন দু’জনে, বিংশ শতাব্দীর দুই প্রচণ্ড শক্তিশালী লেখক, আলোচনা করেন আরও দুই শ্রেষ্ঠ লেখক- ফ্রানৎস কাফকা আর স্যামুয়েল বেকেট সম্পর্কে। কোয়েটজ়ির দুঃখ হল তিনি কয়েক দশক ধরে জমিয়ে রাখা কল্পনা প্রকাশ করতে পারছেন না আর পল অস্টার জমিয়ে রাখা স্মৃতিগুলি হারানোর কথা ভেবে চিন্তিত। এই চিঠিগুলো স্বতন্ত্রভাবে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ন, অবিশ্বাস্যরূপে আকর্ষণীয়, এবং চিঠির দুই চিন্তাবিদকে চিনতে সাহায্য করে।
এবার আসি এই বিশেষ সংস্করণটির কথায়। পল অস্টারকে বই উৎসবে পাওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু কোয়েটজ়িকে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কোয়েটজ়ি মদ ছুঁয়ে দেখেন না, মাংস খান না, পার্টিতে যান না এবং প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক ঘণ্টা লেখার টেবিলে কাটান। তাই তাঁর স্বাক্ষরিত বই পাওয়া প্রায় স্বপ্নের মতো এবং তা অত্যন্ত মূল্যবান।
কোয়েটজ়ি কারও সঙ্গে দেখা করেন না, এমন কি বুকার পুরস্কার নিতে দু’বার যান নি। তাঁর সই করা বই থেকে পাওয়া অর্থ তিনি দান করেন আফ্রিকার শিশুদের আর বন্যপ্রাণীদের উন্নতিকল্পে। এই বিশেষ সংস্করণটিতে পল অস্টার এবং জন কোয়েটজ়ি দু’জনেই স্বাক্ষর করেছেন- শুধুমাত্র একশো দশ কপি ছাপা হয়েছিল, যার মধ্যে একশো কপি বিক্রির জন্য। শুধুমাত্র মেম্বারদের কাছে বিক্রির জন্য, আর দশ কপি লেখকদের নিজেদের জন্য।

অবশ্যই সদ্য ভাজা কচুরির মতোই তা উবে যায়। চামড়ার বাঁধাই, ‘মাঙ্কেন ক্রিম’- যা বইয়ের জগতে শ্রেষ্ঠ পাতা হিসেবে পরিগনিত হয়, সেই পাতায় ছাপা প্রতিটা বই নম্বর দেওয়া এবং দু’জনেই স্বাক্ষর করেছেন। এই অসাধারণ পত্র বিনিময়ে দু’জনের চিন্তাজগত সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। সমস্ত রকম বিতর্কিত বিষয় থেকে তাঁরা দূরে সরে থেকেছেন- এমনকী অর্থনীতির সঙ্কট সম্বন্ধেও তাঁরা উদাসীন। পড়তে গিয়ে মনে হওয়া অসম্ভব নয়, কোনও অবস্থাতেই মনান্তর হোক দু’জনে চান নি। দু’জনেই বন্ধুত্বকে সযত্নে আগলে রেখেছেন।
সমালোচক মারটিন রাইকার লিখছেন “Because friendship is really the point of “Here and Now.” They did not set out to make a book, but to make a friendship, and this fact accounts for many of the book’s weaknesses as well as its strengths.”
আলোচিত বই:
Here and Now – Letters – 2008-2011
Paul Auster, J.M Coetzee
প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০১৩
প্রকাশক: Penguin Books
মূল্য: ৩২৫ টাকা (শুধুমাত্র কিন্ডল সংস্করণ)
*ছবি সৌজন্য: Amazon.com, Wikipedia, লেখকের সংগ্রহ
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।
অগতানুগতিক, আকর্ষণীয় বিষয়। খুব ভালো লাগল।