“বিয়ে হল রামচন্দ্রর
হল অধিবাস-
পিতৃসত্য পালিতে রাম
গেলেন বনবাস।
আগে চলে রামচন্দ্র
পশ্চাতে জানকী,
তাহার পশ্চাতে চলে
লক্ষ্মণ ধনুকী”
খাস কলকাতায় বসে নব্বইয়ের দশকে মেদিনীপুর জেলার হবিচুক গ্রামের নিরঞ্জন পটুয়ার গলায় রামায়ণের এই গান শুনেছিলাম। সঙ্গে পট দেখা। আমার জীবনে সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। প্যারিসের ফিলিপ বেনোয়া তখন কৃত্তিবাস ও বাল্মীকি রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করছিল কলকাতায়। গবেষণার পাশাপাশি বাংলার গ্রামীণ শিল্পকলার প্রতি ফিলিপের আকর্ষণ ছিল প্রবল। তারই বাড়ির ঘরোয়া আসরে নিরঞ্জন চিত্রকরকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। শুনেছিলাম তাদের লুপ্তপ্রায় পটশিল্পের কাহিনি।

এর পর থেকে নিরঞ্জন কলকাতায় এলে চলে আসত আমার বাড়ি। ওর কাছেই শুনেছি প্রাচীনকালে এই বঙ্গভূমিতে যখন কোনও প্রথাসিদ্ধ শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না, তখন এই পটই ছিল বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের একমাত্র বাহক। পট শব্দের প্রকৃত অর্থ বস্ত্র বা কাপড়। কাপড়ের উপরে আঁকা একপ্রকার লোকচিত্রই হল পট। পট দেখিয়ে গান শুনিয়ে বংশপরম্পরায় মেদিনীপুরের পটুয়ারা গ্রামেগঞ্জে, মেলা, পালা-পার্বণে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন।
পট দেখা ও গান শোনার বিনিময়ে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা পটুয়াদের ঝুলিতে ঢেলে দিতেন চাল-ডাল। সম্পন্ন গৃহস্থেরা ও লোকশিল্পের অনুরাগী জমিদারেরা দিতেন মোটা অঙ্কের অর্থ- এতেই পটুয়াদের দিন গুজরান হয়ে যেত। কিন্তু কালের পরিবর্তনের কারণে একদিন জমিদারি প্রথা লোপ পেল, মানুষ হলো শহরমুখী। শিল্পায়নের জোয়ারে অনেক গ্রামীণ শিল্প ভেসে গেল খড়কুটোর মতো।
নিরঞ্জনের কাছেই শুনেছি, হাজার বছরের পুরনো বাংলার পট শিল্পকে টিঁকিয়ে রাখতে কীভাবে পটুয়ারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ওদের ঘরের শিশুরা মুখে বোল ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে বাপ-পিতামহের মুখে শোনা পুরাণের গান কণ্ঠস্থ করে। তাদের খেলার উপকরণ তুলি আর রং। বংশানুক্রমে এই শিল্পের দায় মাথায় তুলে নিয়েছে নিরঞ্জনদের মতো পটুয়ারা।

অভাব অনটনের সংসারেও বহু দিন পর্যন্ত তারা এই প্রাচীন পেশা আঁকড়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের ঢেউ এসে পৌঁছেছে গ্রামেগঞ্জেও। রুজি রোজগারে আরও টান ধরেছে, দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করাও কঠিন হয়ে পড়েছে নিরঞ্জনের মতো পটশিল্পীদের পক্ষে।
হবিচক গ্রামে যে পঞ্চাশটি পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল এক সময়ে, তাদের অনেকেই অন্য পেশা নিতে বাধ্য হয়েছে। গ্রামে ভ্যান চালিয়ে, মাটি খোঁড়ার কাজ করে, দিন-মজুরি খেটে বা শহরে কল কারখানা অথবা নানাবিধ কাজ করে যা অর্থ উপার্জন হয়, সারা বছর পট এঁকে, গান গেয়ে তার অর্ধেকও যে আয় হয় না, সে সত্য তারা বুঝেছে। যে অল্প সংখ্যক পটুয়া তাদের পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যায়নি, নিরঞ্জন চিত্রকর তাদেরই একজন। নিরঞ্জনের স্ত্রী ও ছেলে তার কাজের প্রধান সহায়ক। নিরঞ্জন গান বাঁধে আর পরিবারের বাকিরা ছবি আঁকায় সাহায্য করে।

কাগজ অথবা কাপড়ের ওপরে যে উজ্জ্বল রং ওরা ব্যবহার করে, সেটা ওরা নিজেরাই তৈরি করে। প্রধানত ব্যবহার করে ভেষজ রং- যেমন শুনশিম গাছের পাতা থেকে সবুজ রং, পুঁইশাকের ফল থেকে লাল রং, কাঁচা হলুদ থেকে হলদে রং, উনুনের পোড়া মাটি থেকে গেরুয়া রং এবং পোড়া কয়লার ছাই থেকে সাদা রং। শুধু কী তাই? নিরঞ্জনের কাছেই শুনেছিলাম, কী করে তারা ইটের গুঁড়ো, কাজল, সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা দিয়ে রং বানায়, জীবজন্তুর লোম দিয়ে বানিয়ে ফেলে পট আঁকার তুলি।
ফিলিপের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময়ে নিরঞ্জন কলকাতার নানা মেলাতেও অংশগ্রহণ করেছে। এরকমই এক মেলায় ফরাসি দূতাবাসের এক উচ্চপদস্থ কর্মীর চোখে পড়ে যায় সে। তার পট দেখে আগ্রহী সাহেব ঠিক করেন নিরঞ্জনকে দিয়ে তিনি ফরাসি বিপ্লবের ওপরে পট আঁকাবেন।
দোভাষীর সাহায্যে বিপ্লবের ইতিহাস নিরঞ্জনকে সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া হল। ফিলিপও কোথা থেকে কিশোরদের জন্য বাংলায় লেখা বিপ্লব সংক্রান্ত বই জোগাড় করে দিল। সপরিবার নিরঞ্জন শুরু করে দিল পট আঁকা ও গান রচনার কাজ। বেশ প্রশংসিত হয়েছিল ওর এই কাজ। সাহেবরা শুধু যে পট কিনলেন তাই নয়, নিরঞ্জনের গানও রেকর্ড করে নিলেন। এই সূত্র ধরে পুরাণের ওপরে নিরঞ্জনের আঁকা বেশ কিছু পটও কিনে নিলেন বিদেশিরা।
ফরাসি বিপ্লব নিয়ে নিরঞ্জন যে গান রচনা করেছিল তা শুনে বুঝেছিলাম যে পুরো ব্যাপারটি সে কতটা চমৎকারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। নিরঞ্জন তার গান শুরু করেছিল–
“চতুর্দশ লুই নামে ফরাসির রাজা
প্রজা অত্যাচারে তার বংশ পেয়েছিল সাজা।
রানি ছিল সুন্দরী মহা বিলাসিনী
তারি বাক্যে বাক্যে চলে রাজা শুন সে কাহিনি।”
উপসংহারে সে গেয়েছিল-
…“তারি হতে গণতন্ত্র, প্রজার উন্নতি-
রাজপুত্র রাজা হবে এ নহে সম্মতি।
নির্বাচনের পূর্বে গাই বিপ্লবের গান,
ঐক্যবদ্ধ হয়ে করি আহ্বান”।।
এই ধরনের কাজ করে নিরঞ্জন কত খুশি হয়েছে, বারবার সে কথা শুনেছি তার মুখে। ফরাসি সাহেবরা নিরঞ্জনের সেই পট যথেষ্ট সমাদর করে দেশে নিয়ে গেছেন। বিদেশে তার কিছু খ্যাতিও হয়েছে, হয়েছে কিছু অর্থ সমাগমও। কিন্তু সে সবই সাময়িক। অর্থাভাব, অনটন তাতে চিরতরে তো মেটেনি। কারণ সব বিদেশি কূটনীতিকই ফরাসি নন, আর সব ফরাসিরা একইরকম শিল্পদরদী নন। আর যদিও বা হন, তাঁদের নাগাল পাওয়া নিরঞ্জনদের পক্ষে খুব একটা সহজ ছিল না। ফলে পটুয়াদের চিরস্থায়ী আর্থিক সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি।

ক্রমশ:ই নিরঞ্জনদের মত গ্রামীণ শিল্পীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। পটুয়াদের সমস্যা নিয়ে সে সময় ওরা সরকারি দফতরে কম ছুটোছুটি করেনি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুদিন হবিচক গ্রামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ছ’মাস বাদেই কেন্দ্রটিতে তালাচাবি পড়ে যায়। এই ছ’মাসে নিরঞ্জন যে ক’টি পট তৈরি করেছিল তার মধ্যে এইডস ও বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ওপরে দু’টি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল বলে শুনেছি। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় এসে দুটি অনুষ্ঠানও করে গিয়েছিল নিরঞ্জন। এই সুবাদে কিছু অর্থ উপার্জনও হয়েছিল। তবে এই খুচরো উপার্জন, খবরের কাগজের পাতায় দু’ লাইন প্রশংসায় আখেরে তো খুব লাভজনক কিছু হয়নি তাদের মতো গেঁয়ো যোগীদের পক্ষে।
বিস্মিত হতাম যখন দেখতাম, এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও নিরঞ্জন একটুও দমে যেত না। কলকাতায় যখনই এসেছে আমার কাছে, সব সময়ে তার মুখের হাসিটি দেখেছি চির অম্লান। কাজ নিয়ে ওর কত নতুন ভাবনা, কত উৎসাহ।
অবাক হয়েছি দেখে যে সমাজের নানা সমস্যা, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, নিরঞ্জনের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না আর তার প্রতিফলন ওর শিল্পচর্চায়। তাই পটে স্থান পেয়েছে এইডস, পণপ্রথা, নারী নির্যাতন, ১৯৯৩ সালে মহারাষ্ট্রের লাটুরের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা। মনে আছে, ১৯৯১ সালে শ্রীপেরাম্বুদুরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ড নিয়েও নিরঞ্জন পট এঁকে গান বেঁধেছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুরের অবদান নিয়েও নিরঞ্জন পালাগান-সহ দশটি পট এঁকেছিল আর এ কাজে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন মেদিনীপুরের ৪২-এর আন্দোলনের অন্যতম নেতা ‘বিদ্যুৎ বাহিনী’র প্রধান ও ছয়ের দশকের যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী সুশীল ধাড়া। সুশীলবাবু নিজেও নাকি সেই সময়ে নিরঞ্জনের পটের উপযোগী কয়েকটি গান রচনা করে দিয়েছিলেন।
আজ আর মনে পড়ে না শেষ কবে নিরঞ্জনের সংগে দেখা হয়েছিল আমার। শেষের দিকে নিরঞ্জনকে একটু ম্রিয়মান দেখতাম– একটু যেন হতাশ। শরীরটাও ভেঙে আসছিল। তারপর একদিন বন্ধ হয়ে গেল ওর কলকাতায় আসা। প্রথম দিকে যোগাযোগ থাকলেও পরের দিকে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগের সূত্র। কলকাতার জনঅরণ্য থেকে মুছে গেল হবিচকের নিরঞ্জন পটুয়ার নাম।

ইতিমধ্যে পটশিল্পের উন্নতি সাধনে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মেদিনীপুর, বীরভূমের পটুয়ারা তাদের কাজ নিয়ে হাজির হচ্ছে শহরে লোকসমক্ষে। পট তৈরির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরে আয়োজিত কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যাচ্ছেন দেশবিদেশে প্রদর্শনী করতে। অনেকের মধ্যে এমনই এক কৃতী চিত্রকর হলেন বীরভূমের কলম পটুয়া।
হবিচকের নিরঞ্জনের মৃত্যুসংবাদ স্থান পায়নি কলকাতার কোনও সংবাদপত্রে। কিন্তু তার অসম্পূর্ণ আরব্ধ কাজ, তার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কলম পটুয়ার মতো নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা। নিরঞ্জনের প্রতি এর থেকে সার্থক শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কী করতে হতে পারে?
*নিরঞ্জন পটুয়ার আঁকা পট ও ছবি: লেখকের সৌজন্যে
* কলম পটুয়ার আঁকা: Facebook-এর সৌজন্যে
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।