‘শাক’ বলতে আমরা বুঝি নটে, পুঁই, পালং, গিমা, কলমি ইত্যাদি। সাহিত্য সংসদের অভিধান ঘেঁটে দেখলাম, তাতে রয়েছে ‘রেঁধে খাবার যোগ্য লতাবৃক্ষপত্রাদি’। কিন্তু অভিধান সেখানেই থামেনি। তারপর যোগ করেছে ‘নিরামিষ ও অকিঞ্চিৎকর আহার্য’। বাংলায় শাকের সঙ্গে সবজি যুক্ত হলে তবেই আমরা তরিতরকারির পুরো পরিসীমাটি পাই। বস্তুত ‘শাক’ এবং ‘শাকাহার’ এই দু’টি শব্দের মূল অর্থ অনেক বেশি ঘোরালো।
জগতে কে সবচেয়ে সুখী? ধর্মবকের এই প্রশ্নের উত্তরে মহাভারতে যুধিষ্ঠির জানিয়েছিলেন অঋণী ও অপ্রবাসী থেকে যে ব্যক্তি দিবসের অষ্টমভাগে শাক রান্না করে সেই যথার্থ সুখী। এই দার্শনিক উত্তরের বাকি অংশ নিয়ে গূঢ় আলোচনায় যাবার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু অল্পবয়সে মনে হত, সেই ব্যক্তি কি রোজই শাক রান্না করবে? অন্য কোনও পদ রান্না করলে কি সুখে ঘাটতি হবে? অথবা যুধিষ্ঠির কি শাক খেতে খুব ভালবাসতেন?
প্রথম পাণ্ডবের শাকপ্রীতির পরোক্ষ একটি নিদর্শনও মহাভারতে খুঁজে পেয়েছিলাম। বনবাসের সময় দ্রৌপদীর জাদুক্ষমতাযুক্ত দেবদত্ত থালা থেকে সবাইকে ভোজন করিয়ে পাণ্ডবমহিষী নিজে আহার করার পর, থালায় আর কিছু পড়ে থাকত না। আর কারও খাবার উপায়ও থাকত না। দুষ্টু দুর্যোধন এই ব্যাপারটা জেনে ক্ষুধার্ত সহস্র শিষ্য-সহ দুর্বাসামুনিকে ঠিক সময়মতো পাঠিয়েছিলেন। পাণ্ডবরা দুর্বাসাকে সেই বিজন বনে আহারে পরিতৃপ্ত করার কোনও রাস্তা পাবেন না এবং ক্রোধান্ধ মুনির অভিশাপে সবংশে শেষ হবে। মোক্ষম চাল… কারণ দুর্বাসার রাগের কথা কে না জানে! ষড়যন্ত্র সফল হলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আর দরকার হত না।
কিন্তু কৃষ্ণ থাকতে এত সহজে কার্যোদ্ধারের উপায় আছে! সখি দ্রৌপদীর কাতর প্রার্থনায় কৃষ্ণ আবির্ভূত হলেন এবং থালার কোণায় লেগে থাকা এককুচি শাক মুখে দিয়ে বললেন, বিশ্বের সবাই যেন পরিতুষ্ট হয়। ফলে নদী থেকে স্নান করে উঠে দুর্বাসা আর সহস্র শিষ্যের পেট আইঢাই। পাণ্ডবরা বেঁচে গেলেন। এই গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছিল মুখে যথেষ্ট বকাঝকা করলেও দ্রৌপদী প্রথম পাণ্ডবের খাদ্যরুচির কথা মনে রেখেই বোধহয় শাক রান্না করেছিলেন।

এইসব ভুলভাল ধারণা মাথায় নিয়ে হাওড়া স্টেশনে ‘শাকাহারী ভোজনশালা’য় ঢুকে আমি পালংশাক খুঁজেছিলাম। ও হরি! দেখি সেখানে দেদার ধোসা, ইডলি, বড়া ইত্যাদি দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্য ও মটর পনির, ডাল ফ্রাই ইত্যাদি উত্তর ভারতীয় খাবারও পরিবেশন করা হচ্ছে। তার সঙ্গে শাকের কোনও সম্পর্ক নেই। আমার গোদা মাথায় তখন ঢুকেছিল যে ‘বাঙালির শাক’ আর ‘সর্বভারতীয় শাক’ এক নয়। বৃহত্তর ভারতের কাছে সংসদ অভিধানের দ্বিতীয় অর্থটি কার্যকরী, অর্থাৎ ‘নিরামিষ’। ‘অকিঞ্চিৎকর’ শব্দটি যোগ করার মতো বুকের পাটা আমার নেই।
কর্মসূত্রে তখন পরিবার থেকে দূরে একা মালদা-তে থাকি। সেখানে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার আমার ওপর। জলাজমি বুজিয়ে মাটি ফেলে বাড়ি তৈরি করতে হবে, খুলতে হবে আরও অনেকগুলি বিভাগ। ফলে কাজের আর শেষ নেই যেন। একাই একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম। সকালে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেয়ে কর্মকক্ষে গিয়ে ঢুকতাম আর বেরতে বেরতে রাত ন’টা বেজে যেত। রাঁধুনি রাখার ইচ্ছে হত না একার জন্য। কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে রাতের খাবারটা আনানোর চেষ্টা করতাম, কারণ বাড়ি ফিরে আর রান্না করার শক্তি অবশিষ্ট থাকত না।

খাবার আনানোর ব্যাপারে নানারকম অভিজ্ঞতা হচ্ছিল। চালে কাঁকর ছাড়াও কখনও ঝালে ছটফট, কখনো ঝোলে সাঁতার দেবার অবস্থা। এই করুণ কাহিনি শুনে এক সদয় সহকর্মী বললেন, অমুক মার্কেটে একটি চমৎকার শাকাহারী ভোজনালয় আছে। খুব পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর খাবার পাওয়া যায়।
নিরামিষ খেতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। তাই পরদিনই আনালাম। সত্যিই পরিচ্ছন্নভাবে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে দিয়েছে গোবিন্দভোগ চালের ভাত, অড়হর ডাল, ঢ্যাঁড়সের তরকারি আর তেঁতুলের আচার। সব খাবারই বেশ গরম। বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। ভাবলাম, যাক রাতের খাবার আনাবার সমস্যার একটা সুচারু সমাধান অবশেষে করা গেল। যদিও পরপর সাত আটদিন ক্রমান্বয়ে ঢ্যাঁড়সের তরকারি ও অড়হর ডাল খেতে একটু কেমন যেন লাগছিল।

তবে আমাকে চমকে দিতে ওই ভোজনালয়ও যে তৎপর ছিল. সেটা ক’দিন পরে বোঝা গেল। এক রাতে ফয়েল খুলে দেখি ঢ্যাঁড়স অদৃশ্য- তার বদলে আলুর সঙ্গে সিমাইয়ের মতো কী দিয়ে যেন তরকারি রাঁধা হয়েছে। মনে একটা কূট সন্দেহ দেখা দিল, একি নুড্লসের তরকারি নাকি! এমন কোনও রান্নার কথা তো জন্মে শুনিনি। অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা আর কতটুকু! খেয়েই দেখা যাক। দুঃখের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম বস্তুটি চানাচুরের সঙ্গে যা মেশানো হয়, সেই ঝুরিভাজা। অবাঙালিরা অনেকে ‘সেউ’ বলেন। কিন্তু তা দিয়ে তরকারি রান্না করা যায়, এটি খুবই চমকপ্রদ। তরকারির স্বাদ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করব না। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে, ডাল দিয়ে ভাত মেখে কোনওমতে দু’গ্রাস খেয়ে আহার সমাপ্ত করলাম।

পরদিন থেকে ‘শাকাহারী ভোজনালয়ে’র পথ যেন আর আমার প্রেরিত ব্যক্তি না মাড়ায় এই বার্তা না দিয়ে উপায় ছিল না। বদলে ট্যুরিস্ট লজ থেকে চিকেনস্ট্যু এবং হাতরুটি আনাবার ব্যবস্থা করলাম। পরবর্তী যে তিন বছর মালদাতে ছিলাম ট্যুরিস্টলজের ভেজিটেবল বা চিকেন স্ট্যু আমার ভরসা ছিল। আমার দিদিমা বলতেন ‘আপন থেকে পর ভাল, পরের থেকে বন ভাল।’
শাকাহারী ভোজনালয়ের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছিল জাতীয়তার থেকে আন্তর্জাতিকতা অনেকসময় ভাল, অন্তত অনাহারে থাকতে হয় না। আমাকে প্রাদেশিক বলে তিরস্কার করবেন না… আমি আন্তর্জাতিক।
*ছবি সৌজন্য: youtube, facebook, cookpad.com
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
শাক নিয়ে এত সুন্দর আলোচনায় রীতিমত ৃঋদ্ধ হলাম ।