আপনি বাঙালি !
অবাক হচ্ছেন?
না, এমনিই বললাম।
আসলে বাঙালি মানেই তো পায়ের তলায় সরষে। একটু ছুটি পেলেই দে ছুট। কখনও পাহাড়ে কখনও সমুদ্রে। আর আমবাঙালির আটপৌরে বেড়ানোর পরিকল্পনা এখনও পাহাড় মানেই ডুয়ার্স-দার্জিলিং-কালিম্পং-কার্শিয়ং। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই আপিসে কর্তৃপক্ষের কাছে দিনকয়েকের ছুটি মঞ্জুর হতেই নিজের ছোট্ট বাহনটিতে চেপে বসলাম সপরিবার। গন্তব্য কালিম্পং। সেখানে আছেন আমাদের বন্ধু দেবদুলাল আর জুলি। কাজেই আতিথেয়তার কোনও অভাব হবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্দি।
ফোনেই দেবু বলেছিল, “কালিম্পংয়ে আসবে আর গৌরীপুর হাউজ়ে যাবে না, সেটা হয় নাকি!” তাই ওর কথামতো সিধে গৌরীপুর হাউজ়ে চলে এলাম গাড়ি নিয়ে। আর ঢোকার মুহূর্ত থেকেই পদে পদে বিস্ময়! প্রকৃতির কী অকৃপণ দান, অকৃপণ সাজ চারিধারে। কিন্তু তার মাঝে এটা কী? একটা ভাঙাচোরা পোড়োবাড়ি! সঙ্গীরা জানালেন, এখানে কিছুদিন বাস করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! আমাদের তো বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না কিছুতেই। আগাছায় ভর্তি, জংলি গাছ আর লতাগুল্মে বোঝাই, এবড়োখেবড়ো রাস্তাওলা এ বাড়িতে কিনা পা পড়েছিল বিশ্বকবির? সাবধানে ঝোপঝাড় ভেঙে সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে করার চেষ্টা করছিলাম, কোনও বইতে কি কখনও পড়েছি এ বাড়িটির বৃত্তান্ত? রবি ঠাকুরের কোনও কবিতায়, কোনও লেখায়?

এমন সময় সহধর্মিনী আবিষ্কার করলেন বাড়িতে ঢোকার মুখেই সামনের দেওয়ালে রয়েছে একটা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ফলক। সেখানে লেখা, ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে ‘‘জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন।’ ফলক কে কবে বসিয়েছে তার কোনও চিহ্ন বা লেখা নেই। তবে দেখে মনে হল খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। ফলকের প্রায় গায়েই টেলিফোনের পোস্ট। কিছুটা তারও জড়ানো সেখানে। তার সামনেই বারান্দা। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে একটা আধপোড়া ফায়ারপ্লেস।

খোঁজখবর শুরু করলাম আশপাশে। জানতে পারলাম, এই ফায়ারপ্লেস লাগানো ঘরে বসেই কবি ৭৮তম জন্মদিনে আবৃত্তি করেছিলেন। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতেই আছে, সে বছর পঁচিশে বৈশাখের কদিন আগে মংপুতে পাহাড়ি, আদিবাসী শ্রমিকদের সকলকে নিয়ে এক উৎসবের আয়োজন করেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী ও তাঁর স্বামী ডাঃ মনমোহন সেন। তারপরেই নেমে গিয়েছিলেন কালিম্পংয়ের গৌরীপুর হাউজ়ে, যেখানে ছিলেন প্রতিমাদেবী। কবির সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীও সপরিবার গিয়ে থেকেছিলেন গৌরীপুর হাউজ়ে সেবার। কলকাতা থেকে এসেছিলেন সাহিত্যিক প্রবোধ সান্যাল।
কবির হাতেই উদ্বোধন হয়েছিল টেলিফোনকেন্দ্রের। ঠিক হয়েছিল কবি ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করবেন আর বেতারে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সেজন্য ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র কলকাতা শাখার অধ্যক্ষও হাজির ছিলেন কালিম্পংয়ে। বারবার করে টেকনিশিয়ানরা টেলিফোন পরীক্ষা করে নিলেন। কবি তখন গৌরীপুরের সেই ঘরে বসে। জানালা–দরজা বন্ধ। বাইরে রেডিও নিয়ে প্রত্যেকে অপেক্ষা করছেন। ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা ৪০মিনিট…। কবিকণ্ঠে ভেসে এল –
‘আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে কী জানি
পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি
সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা
নব জন্মদিন।’

মিনিট পনেরো। সবাই শুনলেন মন ভরে। সাক্ষী থাকল গৌরীপুর বাড়ির বাগান, ফুলের গুচ্ছ, গাছপালার সারি আর কাঞ্চনজঙ্ঘা। পরে রবীন্দ্র রচনাবলি খুলে দেখলাম, ‘জন্মদিন’কবিতাটি ১৩৪৫ সালের ২৫শে বৈশাখ গৌরীপুর ভবনে বসেই লিখেছিলেন কবিগুরু। এখানে বসে আরও বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন তিনি। কবির জন্মোৎসব উপলক্ষে সেদিন থেকেই কালিম্পং শহরে শুরু হয়েছিল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির এই বেহাল দশা দেখে মনখারাপ হয়ে গেল। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, এ বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কারও বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। কিছু রবীন্দ্রানুরাগী এখনও অবশ্য চেষ্টা চালাচ্ছেন নিজেদের মতো করে। সাংবাদিক হিসেবে রাজ্যের প্রশাসনিকমহলে কিঞ্চিৎ জানাশোনা থাকায় ফোন লাগালাম দায়িত্বপ্রাপ্ত এক মন্ত্রী মহোদয়কে। সরাসরি জানতে চাইলাম, কেন এ বাড়ির এই অবস্থা? সরকার কিছুই কি করতে পারে না? উত্তরে তিনি জানালেন, এটা ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পত্তি। মালিকের খোঁজই নাকি পাওয়া যাচ্ছে না!
কালিম্পংয়ের তথ্যকেন্দ্র-সহ নানা দফতর আর নথিপত্র ঘেঁটে জানতে পারলাম, এই গৌরীপুরের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এসে থাকলেও এটি তাঁর নিজের বাড়ি নয়। সরকারি নথিতে উল্লেখ, এ বাড়িটি, যার প্লট নম্বর এইচ/১২১, যে পাট্টার মাধ্যমে লিজ় দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তারিখ রয়েছে ১২ মার্চ ১৯৪২। বার্ষিক খাজনা একরপ্রতি দেড়শো টাকা। সেলামি দু’শো টাকা। সেই সময়ে লিজ় দেওয়া হয়েছিল প্রতিমাদেবীকে। কবির পূত্রবধূ প্রতিমা ঠাকুরের নামের পাশে ঠিকানায় লেখা রয়েছে, পোস্ট অফিস – শান্তিনিকেতন, জিলা বীরভূম। ১৯৪২ সাল থেকে ৯০ বছরের লিজ় কার্যকর হয়েছিল। কবির মৃত্যু ১৯৪১ সালে। তারপর প্রতিমাদেবীর চেষ্টায় এ বাড়ির কাজ শেষ হয়।

মৈত্রেয়ী দেবীর লেখাতেও পাই, ‘কালিমপঙে গৌরীপুর ভবন বিরাট অট্টালিকা। কিন্তু পাহাড়ি দেশের মতো কাঠের নয়… — বেশির ভাগ সিমেন্টের, তাই একটু ঠাণ্ডা।’ শেষবার কবি গৌরীপুরের এই বাড়িতে এসেছিলেন ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। সেবারও ইচ্ছে ছিল মংপুতে স্নেহের মৈত্রেয়ীর বাড়িতে কিছুদিনের আতিথ্য গ্রহণ করবেন। কিন্তু এ বাড়িতেই চরম অসুস্থ, অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। মৈত্রেয়ী দেবী সে সময় ছিলেন গৌরীপুরের এই বাড়িতেই, রাতভর অচেতন কবির সেবায় নিয়োজিত। প্রভাত হতে কলকাতা থেকে প্রশান্ত মহলানবীশ, সুরেন কর, ডাঃ অমিয় বোস, ডাঃ সত্যসখা মৈত্র, ডাঃ জ্যোতিপ্রকাশ সরকার ও কবিকন্যা মীরাদেবী এসে পৌঁছন। রথীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন পতিসরে জমিদারির কাজে। কলকাতা থেকে আসা এই দলটিই শেষবারের মতো কবিকে নামিয়ে নিয়ে যান পাহাড় থেকে।
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল গৌরীপুরের এ বাড়িটি কেনার। কিন্তু কবির মুত্যুর আগে সেটা হয়ে ওঠেনি। কবির ইচ্ছের মান রাখতেই তাঁর পূত্রবধূ প্রতিমাদেবী বাড়িটি পরে লিজ় নিয়েছিলেন। প্রতিমাদেবী নিজে শেষ বয়সে এ বাড়িতেই থাকতেন। নিজের হাতে বাড়ি ঘিরে তৈরি করেছিলেন ফুলের বাগান। শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথের যে স্টুডিও রয়েছে, তার নামেই বাড়ির নামকরণ করা হয় ‘চিত্রভানু’।

যে বাড়ি ঘিরে এত স্মৃতি, যে বাড়ির আনাচকানাচে কবির পদস্পর্শ, সে বাড়ি তাহলে এমন পোড়োবাড়ি হয়েই থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। সরকার কি চাইলে পারে না এ বাড়ির মালিকের খোঁজ নিতে? অথচ ইতিমধ্যে বাড়িটি নাকি হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে। সেটা তাহলে কীভাবে সম্ভব? ব্যক্তিমালিকানার বাড়ি হেরিটেজ ঘোষিত হলে কেন সরকার তা অধিগ্রহণ করতে পারছেন না? এ প্রশ্নের একরকম জবাব পেয়েছিলাম স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এ প্রতিবেদনে তার প্রাসঙ্গিকতা তেমন নেই। তাই বাদই রাখলাম।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য এই দোতলা বাড়িটির উপরের তলায় লোকজন থাকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কিছুটা জবরদখল করেই রয়েছেন তারা। ২০১১ সালে ভূমিকম্পের পরে এ বাড়ির দেওয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। মেরামত হয়নি। কতদিন বাড়ির শরীরে পড়েনি রঙের পোঁচ। অপরূপ প্রকৃতির বুকে অবহেলায়, উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে প্রতিমাদেবীর সাধের ‘চিত্রভানু’।
ত্রিশের দশকে বেশ কয়েবার দীর্ঘ কয়েকমাস ধরেই কবি এই বাড়িতে থেকেছেন গ্রীষ্মের সময়ে। ১৯৪০-এর ২০ সেপ্টেম্বর শেষবারের মতন কালিম্পংয়ে আসেন কবি। যদিও তাঁর সেদিন মংপুতে যাওয়ার কথা ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীকে কবি কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও গৌরিপুরে একবার আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কবির আসার ১৮ দিন আগে চিত্রভানুতে এসেছিলেন প্রতিমাদেবী। গৌরীপুরে কবির পছন্দের ঘরগুলি সযত্নে সাজিয়ে তুলতে।
তখন অসুস্থ কবি। শরীর অশক্ত, পাহাড়ে চড়ার ধকল নেবার পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত। তাঁর চিকিৎসক নীলরতন সরকার, বিধানচন্দ্র রায়ও কবিকে পাহাড়ে আসতে নিষেধ করেছেন বারেবারে। কিন্তু কবি বরাবরই স্বাধীনচেতা। শুনলেন না কারুর নিষেধ। চলে এলেন কালিম্পংয়ে। তখন শরতকাল। সেজে উঠেছে পাড়ার আনাচ-কানাচ। গৌরীপুরের দোতলার ঘরে ভোরবেলা আরাম কেদারায় বসে উপভোগ করতেন নিসর্গশোভা, খোলা জানলা দিয়ে।

এ বাড়িতে বসেই ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ এ ‘জন্মদিনে’ শীর্ষক কবিতাগুচ্ছের মধ্যে শেষ কবিতায় তিনি লিখেছেন –
‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে
শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে।
বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি।
হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি।
মাঝখানে আমি আছি,
চৌদিকে আকাশ তাই দিতেছে নিঃশব্দ করতালি।
আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ,
জানে তা কি এ কালিম্পং।
ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে পর্বতশিখর
অন্তহীন যুগ যুগান্তর।
আমার একটি দিন বরমাল্য পরাইল তারে,
এ শুভ সংবাদ জানাবারে
অন্তরীক্ষে দূর হতে দূরে
অনাহত সুরে
প্রভাতে সোনার ঘণ্টা বাজে ঢঙ ঢঙ,
শুনিছে কি এ কালিম্পং’
সে রাতেই অসুস্থ হন কবি। পরদিন তাঁকে নামিয়ে আনা হয় পাহাড় থেকে।
২০১১ সালের ভূমিকম্পে রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ‘চিত্রভানু’তে ফাটল ধরে। সেই থেকেই শুরু ভাঙনের। আজও এখানে এসে একমনে বসলে অনেকটা সময় কেটে যাবে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে। কিন্তু ক্রমেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে চিত্রভানু। সেই রূপ, রং আর নেই। কালিম্পং থেকে ক্রমেই কষ্টে মুখ ঢাকছে কবির সাধের ঘর। দূরে দাঁড়িয়ে লজ্জা পাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘাও। ঘন কুশায়ার চাদরে মুখ ঢাকছে সেও।
এ লজ্জা কার?
আমার, আপনার না সরকারের?
আমরা সবাই বছরের দু’টো দিনে রবীন্দ্রপ্রেমী হয়ে উঠি। আমাদের বাঙালির রবীন্দ্রপ্রেম কি তবে এই রবীন্দ্রজয়ন্তীতেই আটকে থাকবে? আমরা কি পারব না একবার জোটবদ্ধ হয়ে বলতে, গৌরীপুরের রবীন্দ্রস্মৃতিজড়িত ‘চিত্রভানু’তে ফিরিয়ে আনা যাক সবুজের ছোঁয়া! নতুন করে গড়ে তোলা হোক কবির সেই প্রিয় নিরালা পর্বতকুলায়!
*ছবি সৌজন্য: লেখক
পথিক মজুমদার পেশায় সংবাদজীবী। কিছুটা পেশার সূত্রে এবং কিছুটা নেশার খাতিরে, ঘুরে বেড়ানো তাঁর রক্তেহাড়েমজ্জায়। যখন তখন যেখানে সেখানে পা বাড়াতে তাঁর জুড়ি নেই। অবসরে ভালবাসেন গান, আবৃত্তি, শ্রুতিনাটক। আর ভালবাসেন নিজের দুই সদ্য-কৈশোর টপকানো ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিতে।