‘পুরাণ’ মানে চিরন্তন, আদিম, অনাদিসিদ্ধ। ‘প্রেম’ হল প্রিয়ভাব, ভালবাসা, অনুরাগ, যুবক-যুবতীর ধ্বংসরহিতভাববন্ধন।

ভারতীয় পুরাণ হল বিশাল এক সমুদ্র। সাধারণত তার দু’টি ধারার কথা জানা যায়। একটি সূর্যবংশ এবং অন্যটি চন্দ্রবংশ। সূর্যের প্রেম দিয়ে শুরু করা যাক। 

এই সূর্য কিন্তু জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড নন, তিনি সৌরমণ্ডলের প্রধান দেবতা। পুরাণ বলে, ঊষা সূর্যের জনয়িত্রী, সূর্য প্রণয়ীর মতো এই সুন্দরীকে অনুগমন করেন। তিনি ঊষার কোলে দীপ্তি পান আবার ঊষা তাঁর স্ত্রী। বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার সঙ্গে সূর্যের বিবাহ হয়, কিন্তু সংজ্ঞা সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে তাঁর অনুরূপ একজনকে সৃষ্টি করে সূর্যের কাছে রেখে উত্তরকুরুবর্ষে পালিয়ে যান। অনুরূপার নাম ছায়া, তাঁরই সঙ্গে প্রেম-প্রণয় চলতে থাকে সূর্যের। ছায়ার গর্ভে সূর্যের দু’টি সন্তান হয়। কিছুদিন পর সূর্য বোঝেন, ছায়া সংজ্ঞা নন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি প্রণয়িনী সংজ্ঞাকে খুঁজতে বের হন। 

Mythological love stories
পুরাণ অনুসারে সূর্যদেবের দুই পত্নী – সংজ্ঞা ও ছায়া

ওদিকে উত্তরকুরুবর্ষে সংজ্ঞা অশ্বিনীর রূপ ধরে আত্মগোপন করে রয়েছেন। সূর্য অশ্বের বেশে গিয়ে তাঁর সঙ্গে রমণ করেন ও যমজ পুত্রের জন্ম দেন। তারপর শ্বশুর বিশ্বকর্মা সূর্যের তেজ অনেকখানি কমিয়ে দিলে সংজ্ঞা তাঁর সঙ্গে পুনরায় ঘর করতে থাকেন। ছায়া ও সংজ্ঞা দুই সপত্নী সূর্যের প্রেমে মগ্ন ছিলেন। সূর্যের প্রেমিকার সংখ্যা অনেক। কুন্তী তাঁর ঔরসে পুত্র উৎপাদন করেছেন। ঋক্ষরজা সূর্যের বীর্য ধারণ করে সুগ্রীবের জন্ম দেন। সূর্যবংশের রাজা দিলীপ মারা গেলে তাঁর দুই সপত্নী মিলে ভগীরথের জন্ম দেন। ভগীরথ রামের পূর্বপুরুষ। সূর্য-ছায়ার কন্যা তপতী প্রেম ও বিবাহ করেন চন্দ্রবংশীয় রাজা সংবরণকে।




পুরাণে সবচেয়ে বড় প্রেমিকপুরুষ হলেন চন্দ্র। রাজা দক্ষের সাতাশটি কন্যা ছিল তাঁর সঙ্গিনী। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন রোহিণীকে। তাই বাকি ছাব্বিশ কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যান। দক্ষরাজ চন্দ্রকে তিরস্কার করে ছাব্বিশ কন্যাকে পুনরায় চন্দ্র ভবনে পাঠালেন। কিন্তু চন্দ্রের রোহিণী-প্রেম এত প্রবল, যে আবার বাকি কন্যারা বাপের বাড়ি চলে গেল। এইভাবে বারবার দক্ষ কন্যাদের পাঠানো সত্ত্বেও যখন চন্দ্র মুখ তুলে অন্যদের দিকে তাকালেন না, তখন দক্ষ চন্দ্রকে যক্ষ্মারোগগ্রস্থ হওয়ার অভিশাপ দিলেন। পরে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর চেষ্টায় তাঁর শাপমুক্তি ঘটে।

শুধু কমনীয়তা নয়, শৌর্য-বীর্যেও চন্দ্র হয়ে উঠলেন অপরাজেয়। দেবতাদের স্ত্রীরা চন্দ্রের প্রেমে পড়তে লাগলেন। প্রজাপতি কর্দমের স্ত্রী সিনীবালী, বিভাবসুর স্ত্রী দ্যুতি প্রভৃতি বহু দেবতাপত্নী চন্দ্রভবনে এসে চন্দ্রপ্রেমে মাতোয়ারা হলেন। এমনকি নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মীও চন্দ্র-অনুরাগে ভেসে গেলেন। 

Mythological love stories
চন্দ্রদেবের প্রেম ছিল দক্ষরাজদুহিতা রোহিনীর সঙ্গে

মদমত্ত রোম্যান্টিক চন্দ্র একদিন বাগানে এক অসামান্য শারীরিক গঠনসম্পন্ন, আকর্ষণীয়া এক নারীকে দেখে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। সেই রমণীও চন্দ্রের বাহুডোরে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন। চন্দ্র তাঁকে চিনতে পারলেন, তিনি আর কেউ নন; গুরুপত্নী— দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারা। তারা ও চন্দ্র প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেলেন। শুধু তাই নয়, তারাদেবী পতিগৃহে ফিরলেন না, থেকে গেলেন চন্দ্রভবনে। বৃহস্পতি তাঁর এক শিষ্যকে পাঠালেন, কিন্তু চন্দ্র তারাকে ফিরিয়ে দিলেন না। বারবার দূত পাঠানো হল। লাভ হল না।

শেষমেশ ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি নিজেই গেলেন চন্দ্রভবনে। তিনি চন্দ্রকে জানালেন, গুরুপত্নী মাতৃস্থানীয়া। চন্দ্র বললেন, তারা আমার কাছে সুখেই আছেন, পালিয়ে যাওয়া একজন স্ত্রীলোকের প্রতি এত ভালবাসা দেখে আপনার উপর আমার মায়া হচ্ছে গুরুদেব। নীতিশাস্ত্রে আছে, কোনও মহিলা যদি স্বেচ্ছায় কোনও পুরুষের সঙ্গে রমণ করেন তবে সেই পুরুষের কোনও পাপ হয় না। বৃহস্পতি তারার স্বামী হলেও চন্দ্র তাঁর প্রেমিক, অতএব তারাকে ত্যাগ করার প্রশ্নই ওঠে না।  সুতরাং তারার কথা ভুলে যান। 




ব্যাস। চন্দ্র-তারার প্রেম নিয়ে যুদ্ধ হওয়ার উপক্রম। ইন্দ্র-মহাদেব রয়েছেন বৃহস্পতির পক্ষে, অসুরগণ ও শুক্রাচার্য রয়েছেন চন্দ্রের দিকে। যুদ্ধ হল। এরই মধ্যে চন্দ্রপিতা অত্রি এসে তারাকে মুক্তি দিতে বললেন। চন্দ্র তারাকে ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু তত দিনে তারা গর্ভবতী। বৃহস্পতির গৃহে তিনি সযত্নে গর্ভরক্ষা করলেন। যথাকালে একটি পুত্র প্রসব করলেন তারা। লোকজন বলল, এই পুত্র বৃহস্পতির নয়, সে চন্দ্রের ঔরসজাত। বৃহস্পতি সে কথা মানলেন না। তারা ব্রহ্মাকে জবাব দিলেন, এই পুত্র চন্দ্রের। সেই নবজাতকের নাম রাখা হল ‘বুধ’। চন্দ্র পুত্রকে নিয়ে চলে গেলেন। বুধ এবং কিম্পুরুষ ইলা-সুদ্যুম্ন (যিনি আদতে ছিলেন সূর্যবংশীয় রাজা)-র পুত্রের নাম হল পুরূরবা। বুধ এবং ইলার প্রেমও সুবিদিত। 

পুরূরবা-ঊর্বশীর প্রেমও পুরাণ-বিখ্যাত। মিত্র ও বরুণের শাপে ঊর্বশী মর্ত্যে এলে পুরূরবা তাঁর প্রেমে পড়েন। ঊর্বশী কোনওভাবেই ধরা দিতে চান না। শেষমেশ কয়েকটি শর্তে ঊর্বশী তাঁর সঙ্গে সহবাস করতে সম্মত হন। ১) ঊর্বশী যেন কোনও দিন পুরূরবাকে নগ্ন না দেখেন। ২) ঊর্বশী কামাতুরা হলে তবেই মৈথুনক্রিয়া হবে। ৩) ঊর্বশীর বিছানার পাশে দু’টি ভেড়ার বাচ্চা থাকবে যারা কখনও অপহৃত হবে না এবং ৪) তাঁরা দু’জনে এক সন্ধ্যা শুধু ঘি খেয়ে থাকবেন। পুরূরবা প্রেম ও বিবাহের এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে দীর্ঘদিন এক সঙ্গে প্রেম, প্রণয়, সঙ্গম ইত্যাদিতে মত্ত রইলেন। ওদিকে স্বর্গে ঊর্বশীকে পাওয়ার জন্য দেবতারা ছটফট করছেন। 

Mythological love stories
স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী আর পুরূরবার প্রেম ছিল দেবজগতে বহু-আলোচিত

একদিন বিশ্বাবসু নামক এক গন্ধর্ব ভেড়া দু’টিকে চুরি করেন, ঊর্বশী তাদের উদ্ধার করার জন্য কাঁদতে লাগলে, পুরূরবা নগ্ন অবস্থায় উঠে বিশ্বাবসুকে ধাওয়া করেন। সেই সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকায় এবং ঊর্বশী পুরূরবাকে নগ্ন দেখতে পান। শর্ত অনুযায়ী ঊর্বশী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিরহকাতর পুরূরবা ঊর্বশীকে খুঁজতে লাগলেন দেশেবিদেশে। একদিন ঊর্বশীকে স্নানরত অবস্থায় কুরুক্ষেত্রে দেখতে পেলে পুরূরবা তাঁকে প্রত্যাবর্তনের কাতর অনুরোধ জানান। ঊর্বশী জানান, না; তবে তোমার ঔরসে আমি গর্ভবতী, এক বছর পর এস, তোমাকে সন্তান উপহার দেব আর বছর শেষে এক রাত্রি তোমার সঙ্গে যাপন করব।




এইভাবে সাত বছর তাঁদের রাত্রিযাপন চলতে থাকে। তাঁদের যাপনের সন্তানরা আসতে থাকেন পৃথিবীতে—আয়ু, বিশ্বায়ু, শতায়ু, অমাবসু, শ্রুতায়ু, দৃঢ়ায়ু, বলায়ু প্রভৃতি। পুরূরবার এহেন প্রেম দেখে গন্ধর্বরা তাঁকে বর দিতে চাইলেন। তিনি জানালেন, ঊর্বশীর সঙ্গে চিরজীবন যাপন করতে চান। পুরূরবা গন্ধর্বলোকে জায়গা পেয়ে ঊর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক হয়ে বাস করতে লাগলেন। 

পুরূরবার এক বংশধর হলেন যযাতি। যযাতি যাঁকে বিবাহ করেছিলেন সেই শুক্রকন্যা দেবযানী আসলে ছিলেন কচের প্রেমিকা। বৃহস্পতিপুত্র কচ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার পর ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর সঙ্গে বিবাহ হয় যযাতির। যযাতি ছিলেন অসুরগুরু বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাতে আসক্ত। সেই নিয়ে যযাতির সঙ্গে দেবযানীর তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়।

যযাতির পুত্রদের থেকে যদুবংশ ও পুরুবংশের সূচনা হয়। পুরুবংশের এক পরাক্রমশালী রাজা হলেন দুষ্মন্ত। তাঁর সঙ্গে শকুন্তলার প্রেম ও গান্ধর্ববিবাহ পুরাণে অমর হয়ে আছে। দুষ্মন্ত ভুলে গিয়েছিলেন শকুন্তলাকে, তার পর শকুন্তলাপুত্র সর্বদমন ওরফে ভরতকে নিয়ে যখন দুষ্মন্তের কাছে গেলেন তখন একটি অঙ্গুরীয় তাঁদের আবার মিলন ঘটায়। ভরতের নাম থেকে ভারত— এমন একটা কথা শোনা যায়। 

Mythological love stories
মহাভারতে অর্জুন আর কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার প্রেমকে তুলিতে ফুটিয়েছিলেন রাজা রবিবর্মা

যদুবংশের প্রেমিকপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কে সকলেই অবহিত। পুরু বা পৌরব বংশের শান্তনু, অর্জুন, ভীম— তাঁরাও প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন বারবার। শান্তনু-গঙ্গার প্রেম এবং শান্তনু-মৎস্যগন্ধার প্রেম স্মর্তব্য। ভীম-হিড়িম্বার প্রেম, ভীমের সঙ্গে কালী ও বলন্ধরার প্রণয় মহাভারতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে ঊলূপী, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রার প্রেম অমর হয়ে আছে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির প্রেম করেছেন গোবাসন-দুহিতা দেবিকার সঙ্গে, বিবাহও হয়েছিল তাঁদের। তাঁদের একমাত্র পুত্র যৌধেয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রয়াত হন।




দ্রৌপদী মহাভারতের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রেমিকা। পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিনী হলেও তাঁর অধিক প্রেম ছিল অর্জুনের প্রতি। এমনকী এ কথাও তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে, ‘তথাপি মনো মে ষষ্ঠং প্রতি ধাবতি’— অথচ আমার মন ষষ্ঠ পানে ধায়। কে সেই ষষ্ঠ পুরুষ? তিনি হলেন কর্ণ। শ্রীকৃষ্ণ ও কুন্তী কর্ণকে বলেছেন, ষষ্ঠকালে দ্রৌপদী তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। সূর্যপুত্র তাতে সাড়া দেননি। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন দ্রৌপদীর বন্ধু, তাতে কোনও কাম বা প্রণয়ের গন্ধ ছিল না।

পুরাণের প্রেম শাশ্বত, আদিম ও ধ্বংসরহিতভাববন্ধন। সেখানে প্রেম শুধু পরিণয়ে আবদ্ধ থাকেনি, তা প্রতিষ্ঠা করেছে দার্শনিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক মিত্রতা এবং সাম্রাজ্যবিস্তার।    

শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *