সেবার ঠিক হল, ঘুরে আসি মিশর। পিরামিডের দেশ। তার মাসকয়েক আগেই অবশ্য গুলি-বন্দুক চলেছে কায়রোতে। খানিকটা ভয়, তারপর অনেক অনেক সাহস সঞ্চয় করে সবকিছু ঠিক করা গেল।  

সপরিবার চললাম মিশরেমধ্যবিত্তের ভ্রমণ তো, একবারই যাওয়া হবে হয়তো একটা জায়গায়, অতএব নতুন দেশের রূপ রস গন্ধ কোনও কিছু যেন বাদ না যায়!…

The Giza Pyramid
গিজ়ার পিরামিডের সামনে মরুজাহাজের শোভা

কোথায় কোথায় যাব, সেই তালিকা তো সর্বাগ্রেতার সঙ্গে একটু আধটু ওদেশের ভাষা শেখা। আর সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো ওদেশের খাবারের তালিকা বানাতে আর সেসব চেখে দেখতে। কী জানিসবাই মানবে কিনাআমার কিন্তু মনে হয়খাবারেরও একটা নিজস্ব ভাষা আছেতাই দিয়েও অনেক কিছু জানিয়ে দেওয়া ও জেনে নেওয়া যায়। 




খাবারের তালিকা ক্রমাগত লম্বা হতে থাকল। কুশারী
, হাওয়াওশি, মুলুখিয়া, শিশ কাবাব… এরকম করতে করতে আটকে গেলাম একটা নামে… “বাসবুসা”! ওদেশের মিষ্টি! এ মিষ্টি নাকি খাবারের অষ্টম আশ্চর্যের একটি! বাকলাভা, কুনাফা, বালাহ এল্ শাম– মিষ্টির তো কত রকমফের এখানে। কিন্তু সবার সেরা নাকি বাসবুসা। 

বাঙালিরা হল গিয়ে মিষ্টি-পাগল জাত। তবে তো রসগোল্লা রসমালাই সরভাজা ল্যাংচা-খাওয়া জিভ দিয়ে চেখে দেখতেই হবে বাসবুসার স্বাদ!

যথাসময়ে তো গিয়ে পৌঁছলাম সবুজের দেশ থেকে ধূ ধূ মরুভূমির দেশে। তবে এ লেখা ভ্রমণকাহিনি তো নয়, কাজেই রোমাঞ্চ ও উত্তেজনার কথা ছেড়ে, আসি বাসবুসার গল্পে। যেখানে বাসা করেছিলাম, সেখানে ভারতের মতো রাস্তার ধারে ধারে গণেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রাধাবল্লভ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নেই। সত্যি বলতে কি, বাসস্থানের ত্রিসীমানাতেও নেই। অতএব প্রথমদিন বহু অপেক্ষার পর, ডিনার-শেষে হোটেলেই দেখা পেলাম বাসবুসারতখনও প্রথমবার পিরামিড দেখার ঘোর কাটেনি। খাবারের শেষ পর্বে এসে কেতাদুরস্ত শেফের কাছে শুনলাম বাসবুসার ইতিহাস

Basbousa
মিশরীয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে বাসবুসা খরিদ

কয়েক হাজার বছর আগে, সম্ভবত অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনকালে এ মিষ্টির সৃষ্টি। মিশর থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা পশ্চিম এশিয়ায়, নানা নামে। কোথাও নামুরা (namoura) কোথাও হারিসা (haresah) কোথাও রেভানি (revani)। যদিও কেউ কেউ আবার বলেএ খাবারের উৎপত্তি তুরস্কে, মিশর সে কথা মানতে নারাজ। ওই রসগোল্লার জন্মস্থল নিয়ে বাংলা-ওডিশার টানাটানির মতো আর কী। শেফ গল্প বলতে বলতে নিজের হাতে তুলে দিলেন এক টুকরো অমৃত! আহা কী যে খাইলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!




তবুও
বাঙালি তো! মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি খাব না, তা কী হয়? কায়রোতে স্বাধীনতার হাত-পা বাঁধা ছিলতারপর কয়েকদিন ধরে নীল নদের বুকে জাহাজে ভেসে এসে পৌঁছলাম নীলনদ-তীরবর্তী শহর লাক্সারে (Luxor)। সে স্নিগ্ধ শহর আর তার বর্ণনা অন্য কোনওদিন হবে।

The Blue Nile
নীলনদবক্ষে জাহাজভ্রমণ

লাক্সারে ঘোরার শেষ দিন, ওদের ছোট্ট পাবলিক বাসে চেপে বেরলাম প্যাপিরাস কিনতে, ঠেলাওলার কাছে কুশারী খেতে, আর বাসবুসা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের খোঁজ করতে। অনেক রহস্যময় মোড় পেরিয়ে, অনেক নতুন মানুষের সঙ্গে রোমাঞ্চকর আলাপপর্ব সেরে পাওয়া গেল বেশ কয়েকটা মিষ্টির দোকান। থরে থরে সাজানো বাকলাভা, বাসবুসা, বুঘাসা ইত্যাদি। নীল নদের তীরে মিষ্টি শহর লাক্সারে,  এক সন্ধ্যেয় ওদেশের ময়রার কাছে শিখলাম বাসবুসার রেসিপি। আর সঙ্গে নিলাম, বেশি নয়, আসারা ডলারে ওয়াহিদ কিলো বাসবুসা!

A Sweet shop in Luxor
লাক্সার শহরের মিষ্টির দোকান

যা শিখলাম, তাতে বাসবুসা বানাতে গেলে এই সব জিনিস কিনে ফেলতে হবে সবার আগে। 

বাসবুসার জন্যে:

ঘি বা মাখন ১/২ কাপ (ওরা ঘি বা সামনা ব্যবহার করেছিল, উটের দুধের কিনা প্রশ্ন করিনি!), সুজি এক কাপ, নারকেল কোরা ১/৪ কাপ, টক দই এক কাপ, চিনি এক কাপ, একটু দুধ, মাখাটা একটু তরল করতে, বেকিং পাউডার ১ চামচ, একটু কাঠবাদাম কুচি।

চিনির রসের জন্যে: 

চিনি আর জল তো বটেই, সঙ্গে দারচিনি কয়েক টুকরো, লেবুর রস আর পারলে লেবুর পাতাও।

তারপর ভাঙা আরবি, ভাঙা ভাঙা ইংরিজি আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে যে প্রণালী উনি বললেন সেটাই লিখি…।




চিনি আর দই ভাল করে মিশিয়ে, সেই মিশ্রণে দিতে হবে সুজি আর নারকেলের গুঁড়ো। তার সঙ্গে মাখন বা ঘি আর বাকি জিনিসও এক এক করে মেশাতে হবে ভাল করে। মেশানো হলে চাপা দিয়ে রেখে দিতে হবে
, যাতে সুজি সব কিছু টেনে নেয়  আস্তে আস্তে। ব্যাসফেটানোর দরকার নেই একদমই।

Homemade Basbousa
বাড়িতে বানানো বাসবুসা

ততক্ষণে চিনির রস বানাতে হবেখুব গাঢ় নয়। খুব পাতলাও নয়জল, চিনি, দারচিনি আর লেবুর পাতা দিয়ে ফুটিয়ে শেষে একটু লেবুর রস।

তারপর বাসবুসা ব্যাটারটা বেকিং ট্রে-তে পৌনে এক ইঞ্চি লেয়ার করে ঢেলে দিয়ে, বেকিংয়ে যাবে। ১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে, প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট মতো লাগবেওপরটা বেশ রঙ ধরবে বাদামি। আর কাটলে ভিতরটা ঠিক সাহারার বালির মতো সোনালি। সব শেষে, বাসবুসাকে মিষ্টিমুখ করানোর পালাএক কাপ ঠান্ডা করা চিনির রস ওপর থেকে ঢেলে। আর সাজানোটা তো নিজের ওপর।

তারপর? অপেক্ষা করা কেন! তবে হ্যাঁ, বাড়ির সব লোকজন মিলে এই শীতের সন্ধ্যেয় একসঙ্গে জমিয়ে বসে আড্ডা দিতে দিতে খেতে হবে।  এ স্বাদের যত ভাগ হবে, ততই কিন্তু মজা!!!

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক

 

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

8 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *