খাদের উপর সমুদ্রসৈকতের ধার ধরে ভিলেফ্রাঞ্ছ-সুর-মের, বিলিউ-সুর-মের ছাড়িয়ে মিনিট তিরিশেক চলার পরে আমরা পৌঁছলাম এজে প্রদেশের প্রধান রেল স্টেশনের সামনে। এর মাঝে আমরা বারকয়েক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা করেছি। বেশ কয়েকটি এলাকায় পাহাড়ি রাস্তায় এমন জায়গা পড়ে, যেখানে মনে হয় উপরের পাথর গড়িয়ে যে কোনও সময় নেমে আসতে পারে। আবার অন্যত্র, আমাদের গাড়ি একেবারেই সমুদ্রের পাশের রাস্তা দিয়ে চলেছে, সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়।
আমরা কেউই বিশেষ কথা বলিনি। এজে এস-এন-সি-এফ পৌঁছে জিপিএস-এর কথায় আমরা বাঁ হাতি একটা রাস্তা ধরেছি। এবার আমাদের এজে গ্রামের দিকে ওঠার পালা। প্রায় মিনিট কুড়ি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে যে জায়গাটায় এসে গাড়িটা থামল, সে জায়গাটা ছোট হলেও বেশ জমজমাট। মৃদু কুয়াশার আবরণে ঢাকা পাহাড়গুলোর তলায় একফালি সমতল। এক মেঘবালিকার অবয়ব।

গাড়ি পার্ক করে সোজা হেঁটে চললাম। মিনিটখানেকে বড় রাস্তা পার করে দুটো বেঁটেখাটো থাম দেওয়া ফটক। একটা পাথরের টালির রাস্তা বাঁ হাত ঘুরে উপরে উঠে গেছে। এই আমাদের গন্তব্য। এখান থেকেই এজে ভিলাজের শুরু।
মিটার দু’য়েক এগিয়েই একটা ছোট্ট পর্যটন বিভাগের দফতর। একটা ম্যাপ পাওয়া গেছে। ম্যাপটায় ১, ২ করে গ্রামের প্রধান দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখিয়ে দেওয়া। তাতে খানিকটা সুবিধা হয় ঠিকই, তবে আমরা এ গ্রামের যাপনে আগ্রহী। তার ইতিহাসে আবিষ্ট হতে এসেছি। কাজেই পর্যটন বিভাগের দেগে দেওয়া জায়গার গুরুত্ব থাকলেও, তা কেবলই বাকেট লিস্টের আওতায় পড়ে। তার চাইতে বরং একটু নিজেরা ঘুরে দেখা যাক।

গাছ-গাছালি-ফুলে মোড়া একটা পাথুরে রাস্তা পাহাড়টাকে ঘিরে উঠে গেছে উপরের দিকে। এমনিতেই মোন্যাকোর দিকে যেতে গাছপালা নীস অঞ্চলের থেকে একটু বেশিই। তার কারণ অঞ্চলটা পাহাড়ের উপরে হওয়ায় সমুদ্রের নোনা জল এখানকার মাটি বিশেষ ছুঁতে পারেনি। আর তাছাড়া ফেব্রুয়ারি মাস বসন্ত-আগমনের আশ্বাস নিয়ে আসে। সব মিলিয়ে এক অপার মুগ্ধতা, আমার মেঘবালিকার সবুজ ওড়নার নিষ্পাপ স্খলন।

আরও মিটার পঞ্চাশেক এভাবেই ঘুরে একটা উঁচু মিনার দেখতে পেলাম। গায়ে একটা ফটক। গাছপালায় ঢাকা দেওয়ালের গায়ে নীল “কোট অফ আর্মস।” ফটকটায় কোনও পাল্লা নেই, আর ঢোকার ঠিক মুখে দেওয়ালে গর্ত করে একটা কামান রাখার জায়গা। দরজা দিয়ে ঢুকে বেশ অনেকখানি পথ। চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি পাথুরে দুর্গ একের পর এক ছোট ছোট সুড়ঙ্গে ভরা। এই জায়গাটার নাম পোটের্নে, আর রাস্তার বাঁ হাতে যে দেওয়াল, তার খানিক দূরেই খাদ। এবং সেই খাদে চোখ পাতলেই ভূমধ্যসাগরের ছবির মতো নিসর্গ। আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে চললাম। হাতে যতটা সময়, তাতে পুরো গ্রাম ঘুরে আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া ক্যাথেড্রাল একেবারে পাহাড়ের উপরে। তার থেকে যে জায়গাগুলোয় সাধারণ মানুষের বাস ছিল, সে জায়গাগুলোই দেখা সহজতর। শহরের ভিতরে গুচ্ছের দোকান পাট, সবই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা।

আসতে আসতে গ্রামের অন্দরমহল শুরু হল। সরু পাথুরে রাস্তার দু’ধারে গা ঘেঁষে মধ্যযুগীয় বাড়িঘর, অনেকটাই যেমন তুরস্কের সিরিঞ্জে বা সাফ্রানবলুতে দেখেছি তেমনই। ছোটখাটো, আন্তরিক, নান্দনিক। মজার ব্যাপার হল, প্রায় সবগুলো বাড়িরই বেশ কিছু জানলার কপাট পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া। এ আসলে কিছুই নয়, উনিশ থেকে বিশ শতকের ভিতর ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস ও ফ্রান্সের বিস্তৃত জায়গায় “উইণ্ডো ট্যাক্স” বা “জানলা কর” বসানো হয়েছিল। কাজেই সে সময়ে এই করের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই নিজেদের বাড়ির বেশিরভাগ জানলা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। তারপর থেকে সেগুলোকে আর পালটানো হয়নি।
একটা জায়গায় পৌঁছে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা পথ পুরনোটাকে ধরেই আরও উপরে উঠে গেছে ক্যাথেড্রালের দিকে। আরেকটা, বাঁ হাতে নেমে গেছে একটু নীচের দিকে। এ রাস্তাটা আসলে এজের নামকরা হোটেল শেভরেডরের দিকে গেছে। তবে যাওয়ার পথটা শুনেছি ভীষণ সুন্দর, কারণ সেখানে মধ্যযুগীয়-মধ্যবিত্তের বাড়িঘর এখনও কিছু আছে। কিন্তু নিতান্তই হোটেলে থাকতে না-গেলে বিশেষ কেউ ওদিকটায় যায় না। আমরা নেমে পড়লাম। খানিকটা যেতেই একটা পাড়া। এ জায়গাটা নিয়ে এখনও দিব্যি জমজমাট কলোনি গড়ে নেওয়া যায়। অপূর্ব ফরাসি নান্দনিকতার নিদর্শন। দু’তলা ছোট ছোট বাড়ির ঝুল বারান্দা জুড়ে লতাপাতা ফুলগাছের সারি। কোথাও কোথাও মাথার উপর ঝুলবারান্দা অনেকটা এগিয়ে এসে চিবুক রেখেছে খাদের উপর। আরও খানিক এগিয়ে আমাদের চোখ পড়ল একটা অর্ধেক জানলা অর্ধেক দরজা-মার্কা কাঠামোর উপর। তার মধ্যে ঢুকতেই ছোট্ট এক চিলতে ঘর, আর তার দেওয়ালে একটাই খুপরি জানলা। সে জানলা দিয়ে বেশ খানিকটা নীচে চোখে পড়ে একটা পায়ে হাঁটা এবড়োখেবড়ো রাস্তা। বেশ খেয়াল পড়ছে, আমরা গাড়ি নিয়ে যেদিকটা দিয়ে উঠেছি এ রাস্তা তাকে এক-আধবার প্রতিচ্ছেদ করেছে।
তবে কি এই সেই পথ, যে পথে ঈশ্বরের মৃত্যু?
সে প্রশ্নের উত্তর মিলল পাশেই ছবি তোলা থেকে খানিকক্ষণ বিরতি নেওয়া এক জার্মান পথিকের কাছ থেকে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছি।

গল্পটা বিশ্ববিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎশেকে নিয়ে। ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবার ফ্রেঞ্চ রিভিরায় আসেন নিৎশে । বছরখানেকেরও বেশি নীস এবং এজে-তে বাস করেন। এ এমন সময়, যখন তাঁর মনোবল একেবারে তলানিতে: বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, বইয়ের বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে। তাছাড়া কয়েক মাস আগে বন্ধু রিচার্ড ওয়াগনার মারা গিয়েছেন। হেনকালে রিভিয়েরা যাপন তাঁকে দু’দণ্ড শান্তি এনে দেয়। লেখার জন্য প্রয়োজনীয় যে সৃজনশীলতা, নিৎশে তা পুনরায় এই এজে ভিলেজেই খুঁজে পান। এজে রেল স্টেশন থেকে যে কাঁচা রাস্তা একেবারে ঈগল নেস্ট পর্যন্ত উঠে এসেছে, সে রাস্তায় একসময় বারংবার হেঁটে উঠেছেন নিৎশে। সেই শারীরিক শ্রম তাঁর অমর সৃষ্টি “Thus spoke Zarathustra” র তৃতীয় ভাগের জন্ম দিয়েছে। ওঁর নিজেরই কথায়,
“My muscle tone was always greatest when my creative energies flowed most abundantly.”
অথবা
“The body is spirited – let us leave the ‘soul’ out of play. One could often have spotted me dancing.”
এবং সব শেষে
“The following winter, under the Alcyonian sky of Nice, which for the first time then shone in my life, I found the third Zarathustra- and so I was done.”
এ রাস্তারই নাম “লে কেমিন দে নিৎশে”, সেই নিৎশে যিনি “ভগবানের মৃত্যুর জনক”। নব্যপ্রস্তরযুগ, মধ্যযুগ, বা বারবারোসার এজেকে দেখতে এসে এই যে আধুনিকতার এতটুকু ছোঁয়া, এই ইতিহাসব্যাপী সমসাময়িকতাই আমার পরম প্রাপ্তি।

এবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। মোন্যাকো হয়ে, মেন্টন হয়, নীস ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে যাবে।
* এজে গ্রামের ছবি: শারদীয়া রায় বর্ধন
নিৎশের ছবি: sites.google.com
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।