বাড়িতে বাবা, মা, দুই বড় দাদা, আর কনিষ্ঠ আমি। বড়দাকে দাদা বলতাম, কিন্তু ছোড়দাকে নাম ধরেই ডেকে এসেছি চিরকাল। বাবা সরকারি চাকরিতে ছিলেন। সংসারে দারিদ্র্য ছিল না, ছিল মধ্যবিত্তের টানাটানিকে পরিপাটি দেখানোর শিল্প। এর মূল শিল্পী ছিলেন আমার ছোটখাটো, কলেজে না-পড়া মা। খাওয়াদাওয়ায় পারিপাট্য ছিল, আর মনোযোগ ছিল পড়াশুনোয়, বইপত্রে। জামাকাপড়ে কোনও ব্যয়বাহুল্য ছিল না। আবার, ট্রামে চড়লে ফার্স্ট ক্লাসেই চড়তে হবে, কারণ সেকেন্ড ক্লাসের ঘন্টি নাকি ড্রাইভার কেবিন থেকে শোনা যায় না, ফলে দুর্ঘটনা। এর সুযোগ নিয়ে বড়দা যে দীর্ঘদিন সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে ভাড়া বাঁচিয়ে বিস্কুট কিনে খেত, তা জানা গেছিল অনেক পর, যখন ও কলকাতা মেডিক্যালে ঢুকল। কেন যে এটা করত তা স্পষ্ট নয়, কারণ বাড়িতে তো বিস্কুট ঠাসা।
শোনা যায়, বিয়ে করে সংসারে এসে মা আবিষ্কার করেছিলেন, বাজারে-দোকানে বাবার প্রচুর ধার। তৎক্ষণাৎ গঙ্গাস্নান করিয়ে এনে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, জীবনে আর ধার করবেন না। চোদ্দো বছরের নববধূর এমন কড়া আচরণ, দশ বছরের বড় স্বামীর প্রতি, শুনলে ডাকসাইটে আধুনিকারাও পুলকিত হবেন। যাই হোক, মায়ের একনায়িকাতন্ত্রে প্রতিটি পয়সা গুনে খরচ হত। অথচ তা বাইরে থেকে বোঝা যেত না। একমাত্র উপার্জনকারী বাবা রোজ অফিস যাওয়ার সময় গুনে পয়সা নিতেন এবং হিসেবের গরমিল হলে তাঁকে মায়ের কাছে জবাবদিহি করতে হত। এ নিয়ে মায়ের কোনও সঙ্কোচ ছিল না। অক্লেশে বলতেন, ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। কলেজে পড়তাম। চাকরি করতে পারতাম। বিয়ে করে আমি কিছু করতে পারলাম না জীবনে। হিসেব তো চাইবই। সংসার তো আমিই চালাই।
চোদ্দো বছর বয়সে নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার দুঃসাহসে মায়ের নাম কাটা যায় স্কুলের খাতা থেকে। হেডমিসট্রেস ছিলেন নামী সমাজকর্মী, পরে কংগ্রেসনেত্রী হয়েছিলেন। স্কুলে তাঁর উপস্থিতির কুপ্রভাব বাকিদের উপর পড়বে, এই কাল্পনিক অভিযোগ মা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। আজীবন কষ্ট পেয়েছেন। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে সন্তানদের মধ্যে জাগিয়ে রাখার চেষ্টায় মা বই ও পড়াশুনোকে জরুরি বলে মনে করতেন। ঠিক সময়ে পাঠ্য বই কেনা, তাতে যত্ন করে ব্রাউন পেপারের মলাটে লেবেল লাগানো, আমাদের পড়াশুনোর দৈনিক তত্ত্বাবধান রান্নাঘর থেকে করা, এসবই তাঁর দায়িত্ব ছিল। আর ছিল সাহিত্যপ্রেম। আশুতোষ কলেজের পাশের বইয়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝেই গল্পের বই কিনে আনতে আমরা সপরিবার যেতাম, যেমন যেতাম হাজরা মোড়ের শরবতের দোকানে প্রচুর চিনি ও রোজ় সিরাপ মেশানো দইয়ের শরবত খেতে। সে দোকানগুলিও আশির দশক থেকে অন্তর্হিত হয়েছে, জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তুচ্ছ আনন্দ উপভোগের কলধ্বনি।
মনে পড়ে, আমার অক্ষর পরিচয় না-হওয়া শিশুবেলায়, ঘরের কাজ ফেলে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে দু’দিন ধরে পড়ে শুনিয়ে ছিলেন লীলা মজুমদারের ‘হলদে পাখির পালক’। সে বইয়ের মায়া আজও জড়িয়ে আছে আমার জীবনে, মনে। যেমন লেখা, তেমন মায়াভরা ছবি! ময়ূর-মেয়ে লখনিয়াকে বলছে, এ ভাবে কী পাওয়া যায়? অথবা, দেয়াল ঘেঁষে চোরের মতো আসছে ভুলো। সাদাকালো, ছাই রঙের আশ্চর্য সিম্ফনি। ১৯৫০-এর দশক থেকেই অলঙ্করণ শিল্পীরা শিশু মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। লেখা আর আঁকা পরিপূরক হয়ে কল্পনাকে দেয় ওড়ার ডানা। এরপর অলঙ্করণ মন দিয়ে দেখতে শিখলাম সত্যজিতের আঁকায়। শিশুকে সাহিত্যে দীক্ষিত করতে এর চেয়ে ভাল পথ কী আছে আর!
চশমা ভেঙে যাবে খেলতে গেলে। ভাঙলে আবার সারাতে হবে বা নতুন কিনতে হবে। খরচের কথায় বিপন্ন বাবার মুখের উপর নেমে আসবে মেঘের ছায়া। তাই আমার ছোটবেলা কাটল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে, মাঠে নামা আর হল না। কোনও খেলার নিয়ম না জেনেই কাটিয়ে দিলাম সারা জীবন।

বই পড়া, বই শোনা, দুটোই চলত বাড়িতে। আমার আর বড়দার মধ্যে বয়সের তফাৎ ছ’ বছর। কাজেই আমাদের পাঠের গতিবেগ এক নয় তা বুঝেই এই ব্যবস্থা। বাবা রবীন্দ্রনাথের নানা কবিতা পড়ে শোনাতেন। ‘বাঁশি’ কবিতা শুনে উদ্বেল হয়েছি, কী বুঝেছিলাম জানি না। একদিন অফিস থেকে পড়ে শোনাতে বসলেন ‘ছেলেটা’। গদ্য কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে যখন নতুন করে চিনছি, আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। সাহিত্য পাঠের পরিবেশ নিশ্চয়ই কল্পনাকে বিকশিত করে। দুই দাদাই কবিতা লিখত, ছবি আঁকত। আমিও আঁকতাম। তার সঙ্গে কবিতা আর গান। একটা টুকরো কাগজ বা খাতার পাতা কুড়িয়ে নিলেই কারও না কারও আঁকা, লেখা হাতে উঠে আসত। প্র্যাকটিকাল খাতার সাদা পাতায়, বইয়ের মার্জিনে, মেঝেতে চকখড়ি দিয়ে, আলমারির গায়ে — আমাদের লেখা, আঁকার নমুনা থাকবেই। দু’জন ব্যস্ত ডাক্তার তাদের ছোটবেলার শখ থেকে অনেক দূরে এখন, আর আমি বাংলা থেকে দূরে ঘুরতে ঘুরতে ভাষার সঙ্গে অন্তরের বাঁধনে জড়িয়ে আছি।
হয়তো আমার কবিতাপ্রেমের অন্যতম সহায়ক ছিল অকাল মায়োপিয়া। অনেক ছোট বয়সেই জানা গিয়েছিল দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। বড় রাস্তার ওপারে, উল্টোদিকের বাড়ির বন্ধুরা নালিশ করত, তুই হাত নাড়লে চেনা দিস না কেন? আসলে আমি তো সবই ঝাপসা দেখি। শীতের সকালে কয়লা বোঝাই গোরুর গাড়ি — সাদা চাদর জড়ানো মানুষ টানছে না গোরু, মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েই ধরা পড়ে যাই। তারপর পিজি হাসপাতাল, অক্ষিতারা সম্প্রসারক ঔষধ, চশমার পাওয়ার মাইনাস আড়াই ও মায়ের কান্নাকাটি। বুঝতে পেরেছিলাম, এবার আমার বই পড়ার উপর আক্রমণ আসছে। তাই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি বই পড়তে পারব তো? দয়ালু ডাক্তার নীলমাধব সেন বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পড়বে, মা। না হলে শিখবে, জানবে কী করে, কেবল দেখো যেন ঘরে আলো থাকে।
চশমা ভেঙে যাবে খেলতে গেলে। ভাঙলে আবার সারাতে হবে বা নতুন কিনতে হবে। খরচের কথায় বিপন্ন বাবার মুখের উপর নেমে আসবে মেঘের ছায়া। তাই আমার ছোটবেলা কাটল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে, মাঠে নামা আর হল না। কোনও খেলার নিয়ম না জেনেই কাটিয়ে দিলাম সারা জীবন।
তবে এত সাবধানতা সত্ত্বেও একদিন ঝগড়া হল বিশের দলের সঙ্গে। ওরা চারজনেই গুন্ডা প্রকৃতির, বয়স আমারই মতো। অথবা কিছু বড়। কাছাকাছি কোনও বস্তিতে থাকত। কাজেই মুখ চেনা। রোগা হলেও আমার কথায় ধার ছিল। কাটা কাটা কথায় চটে গুন্ডা বিশেরা একদিন খুব পিটিয়ে আমার চশমা ছাতু করে দিয়েছিল। ঠোঁটের আর ভুরুর রক্তের চেয়েও আমাকে বেশি করে বিঁধেছিল ভাঙা চশমার অজস্র কাঁচের টুকরো যা আমি ফ্রকের কোঁচড়ে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। বাবা বলেছিল, মাসের শেষেই ভাঙলি চশমাটা?
ক্লাস থ্রি-তে ওঠার পর আমার পার্কে যাওয়া হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। নির্দেশনামার বিশ্লেষণে মায়ের কোনও আগ্রহ ছিল না। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে খুব মিল। শুনলাম, বড় হয়ে গেছ, আর খেলতে যেতে হবে না। রাক্ষসী পার্কটা, যে আমাকে ভরদুপুরে ডাক দিত রোজ, তার হাঁমুখ থেকে আমাকে নামিয়ে দিল। প্রকৃতির সঙ্গে আদ্যোপান্ত জড়ানো নাড়ি-কাটা হয়ে আমি সভ্যতার শান বাঁধানো চাতালে ভূমিষ্ঠ হলাম।
লিখতে লিখতে অথৈ দূর: পর্ব ৩ – স্কুলের রাস্তা
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
অসাধারণ লেখা। ছোটবেলা থেকে বিদেশে থাকার দরুন আমি অনেককেই চিনি না। বাংলালাইভ কে অনেক ধন্যবাদ জানাই এই লেখা প্রকাশ করার জন্য। প্রত্যেকটি পর্ব খুব ভালো লাগছে। পরের পর্বগুলির জন্য অপেক্ষায়।
অসাধারণ লেখা
ভীষণ ভালো লাগে অনিতা দির গদ্য। চলুক।
অসাধারণ
কি সুন্দর লিখেছেন। ছেলেবেলার মায়া, গাছের ছায়াশীতল ভালবাসা মেশা।
“নির্দেশনামা বিশ্লেষণে….. সরকারের সাথে খুব মিল।” একটু ফাঁক থেকে গেল নাকি? মায়ের কারণ না দর্শানো নির্দেশনামার পিছনেও কিন্তু একধরনের স্নেহ,মায়া,ভালবাসাজনিত ভয় থাকে,সরকারের তা থাকে কি? মা আর রাষ্ট্রের নিয়ামককে এক করাটা এই মায়াময় লেখটির সাথে মানানসই লাগলো না।
অসম্ভব সুন্দর। ছোটবেলা কে মনে করায়। মা এর স্নেহের কথা, বাবার আয় সব কিছুই মনে পড়িয়ে দেয়। এটাও প্রমাণিত হয় যে, একটি শিশু বিকশিত হবার জন্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি তার ঘরের পরিবেশ।