কোরক বসুর কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

অজ়িল্যান্ডে “গুড ডে মাইট” বাক্যখানা হল হিব্রু শব্দ “ইয়াল্লা”–র মতো। অর্থ একটা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, তা কারও আর মনে নেই। ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রয়োগ বদলে যায়। “ইয়াল্লা” মানে গুড বাই, ধ্যাৎ, কী যে বলিস, তাড়াতাড়ি কর, আহা যদি এমন হত ধরনের অনেক কিছু হতে পারে। ঠিক তেমনি “গুডডে মাইট”-এর নেই নেই করে প্রায় দশ রকম মানে রয়েছে। যেমন মনে করুন, সকালবেলা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। আপনি তখন টুপি খুলে বন্ধুকে বললেন, “গুড ডে মাইট!” এর অর্থ হল, কী হে ভায়া, কেমন আছ! সবকিছু ঠিকঠাক তো! বন্ধুটি এর উত্তর হিসেবে একগাল হেসে আপনাকে বলল, “গুড ডে! গুড ডে!” অর্থাৎ, দিব্যি আছি ভাই। বেশ চলে যাচ্ছে। তোমাদের খবর টবর সব ভাল তো! আবার দেখুন বিদায় জানানোর সময় “ভাল থেকো সবাই। চললুম” বোঝাতেও এক কথায় বলা যায় গুড ডে মাইট!” আবার চোয়াল চেপে, চোখে চোখ রেখে “গুড ডে মাইট” বললে তার মানে দাঁড়ায়, “থাম ব্যাটা, তোকে দেখাচ্ছি মজা!” অতএব খাঁটি অস্ট্রেলিয়ানের মুখে “গুড ডে মাইট!” শুনলে সবার আগে লক্ষ্য করে দেখুন আপনার চারপাশের অবস্থাখানা কী, তারপরে দেখুন বোলনেওয়ালা আসছেন না যাচ্ছেন, এবং সবশেষে দেখুন যিনি বলেছেন তার মুখের  ভাব ঠিক কেমন। যদি বোঝেন সবকিছু ঠিকঠাক, তাহলে আপনিও টুপি খুলে বলুন, “গুড ডে! গুড ডে!”
Language
এক নজরে পিকোলো ইংরেজি। ছবি সৌজন্য – ইন্টারনেট
খাঁটি অস্ট্রেলিয়ানের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল এদেশীয় ইংরিজিতে “নির্ভেজাল” বা “খাঁটি” বোঝাতে “পিওর” শব্দটির ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। পিকোলো ইংরিজিতে খাঁটি শব্দের অর্থ হল “ট্রু ব্লু” (True Blue)। ব্যাপারটা আর একটু বুঝিয়ে বলি। নীল রংটির প্রতি এদেশীয় মানুষের পক্ষপাতিত্ব একটু বাড়াবাড়ি রকমের । বস্তুত, এ দোষে আমিও সমান দোষী। অস্ট্রেলিয়া বললেই চোখে ভেসে ওঠে নীল সমুদ্র আর ঝকঝকে নীল আকাশ। কাজেই নীল রং আমাদের কাছে বড় আদরের এবং বড় সম্মানের। “ট্রু ব্লু” শব্দবন্ধটির জন্ম হয়েছে এভাবেই। এর সঙ্গে আভিজাত্যময় “নীল রক্ত”–এর সাদৃশ্যও লক্ষ্য করার মতো। যদিও “নীল রক্ত” বা আভিজাত্যের ব্যবহারিক সংজ্ঞা এদেশে বাকি পৃথিবীর চাইতে অনেকটাই আলাদা, এবং যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় কর্মভেদ বা বর্ণভেদ দুটোরই উপস্থিতি প্রায় নগণ্য বললেই চলে, তাই এদেশীয় “ট্রু ব্লু” বলতে যে কোনও সৎ, খেটে খাওয়া মানুষকেই বোঝায়। এর সঙ্গে রাজরক্তের কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখতেও বেশ ভাল লাগে।  আপনি পাইলট হোন বা ট্রাক ড্রাইভার, নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট হোন বা ক্লিনার, ব্যারিস্টার বা কফিশপের বারিস্তা, এদেশের সমাজে আপনার সম্মান এক। আপনি মানুষ। অন্য মানুষের থেকে মানুষের মতো ব্যবহার আপনার প্রাপ্য। এর সঙ্গে আপনার ধর্ম, কর্ম বা ত্বকের রঙের কোনও সম্পর্ক নেই। আপনি সৎ নাগরিক। আরও লক্ষ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ানের মতো আপনিও সৎপথে দেশের অর্থনীতি রক্ষা করার জন্য প্রাণপাত লড়াই করছেন। কনগ্রাচুলেশনস্! বি প্রাউড অফ্ ইয়োরসেল্ফ! আপনি একজন খাঁটি নীল রক্তের “ট্রু ব্লু অজ়ি!”
অতএব খাঁটি অস্ট্রেলিয়ানের মুখে “গুড ডে মাইট!” শুনলে সবার আগে লক্ষ্য করে দেখুন আপনার চারপাশের অবস্থাখানা কী, তারপরে দেখুন বোলনেওয়ালা আসছেন না যাচ্ছেন, এবং সবশেষে দেখুন যিনি বলেছেন তার মুখের  ভাব ঠিক কেমন। যদি বোঝেন সবকিছু ঠিকঠাক, তাহলে আপনিও টুপি খুলে বলুন, “গুড ডে! গুড ডে!”
আরও কয়েকখানা আনকোরা শব্দ এবং তাদের অন্য রকমের ব্যবহার রয়েছে। যেমন “হিপ” (Heap)  বা বহুবচনে “হিপস্” (Heaps) এই হিপের সঙ্গে পশ্চাৎদেশ (Hip)- এর কোনও সম্পর্ক নেই। এদেশে হিপের অর্থ হল খুব, অনেক বা প্রচুর। যেমন মনে করুন, আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলুম, “কী রে, কেমন আছিস?”বন্ধু তাতে উত্তর দিল, “হিপস্ গুড।“ অর্থাৎ খুব ভাল। আবার মনে করুন, আপনি আমাকে শুধোলেন,“আপনার কাছে একখানা কলম হবে?” এর উত্তরে আমি বলব, “হিপস্। টেক আ পিক্।“ অর্থাৎ অনেক আছে। আপনার যেটা পছন্দ নিয়ে নিন। কেউ কিছু এনে দিলে বা সাহায্য করলে ধন্যবাদসূচক বাক্যের শেষে “টা” (Ta) বলাটাও এদেশীয় লোকের অভ্যেস। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি টা” হল “থ্যাঙ্কস্ আ লট্”– এর শর্ট ফর্ম। কিন্তু আজকাল অনেকেই এটা ভুলে গেছেন। ফলস্বরূপ “টা” হয়ে গেছে ধন্যবাদের লেজুড় মাত্র। অতঃপর লোকজনকে এক কাপ কফি দিলে তারা বিগলিত বদনে বলেন “থ্যাঙ্কস্ ফর দ্য কাপ্পা! টা!” 
Coffeeshop
এদেশে কফিশপে ইংরেজি বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। ছবি সৌজন্য – লেখক
এদেশীয় উচ্চারণের নিয়মকানুন নিয়ে আমি এখনও বেশ নাকাল হই। আমার গুরুমশাই রায়ানের কথা তো আগের পর্বে বলেছি আপনাদের। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, সমস্যাটা কোথায়! রায়ান “পুল” কে বলে “পিউল”, “গেট” কে বলে “গাইট”, “সুপার” কে বলে “সুপাহ্।” আর আমি চোখ দুটো সরু করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিয়মগুলো বোঝার চেষ্টা করি। এরই মধ্যে কয়েকখানা ফর্মুলা পেয়ে গিয়েছি। যেমন দেখুন, শব্দের শেষে থাকলে সেটার উচ্চারণ হবে হ্। এই নিয়মে  সুপার – সুপাহ্ ডিনার – ডিনাহ্ আফটার – আফটাহ্ অবশ্য শব্দের শেষে ছাড়া অন্য কোনও অক্ষর থাকলে তাকে দস্তুর মতো দুটো থাবড়া মেরে চুপ করিয়ে (মানে সাইলেন্ট) দেওয়া হয়। সেই নিয়ম মেনে, হোয়াট – হোয়া মর্নিং – মর্নিন্ মিটিং – মিটিন্ দুটো (O) পাশাপাশি থাকলে তার উচ্চারণ না হয়ে ইউ হয়ে যায়। সেই জন্যই রায়ান পুল-কে পিউল্ বলে, স্কুল কে বলে স্কিউল্।’  এতদূর পড়ে যারা ভাবছেন যে এরা এমন অদ্ভুত ভাবে ইংরিজি কেন বলে, যেমন লেখা রয়েছে তেমন বললেই তো মিটে যায়! তাদের জন্য বলি এমন ঘটনা শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, প্রতিটি ভূখণ্ডে ঘটে। “আ মরি বাংলা” ভাষাতেই এমন হাজারখানা উদাহরণ পাওয়া যাবে। 
যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় কর্মভেদ বা বর্ণভেদ দুটোরই উপস্থিতি প্রায় নগণ্য বললেই চলে, তাই এদেশীয় “ট্রু ব্লু” বলতে যে কোনও সৎ, খেটে খাওয়া মানুষকেই বোঝায়। এর সঙ্গে রাজরক্তের কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখতেও বেশ ভাল লাগে। আপনি পাইলট হোন বা ট্রাক ড্রাইভার, নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট হোন বা ক্লিনার, ব্যারিস্টার বা কফিশপের বারিস্তা, এদেশের সমাজে আপনার সম্মান এক। আপনি মানুষ।
আমার এক বাঙাল বৌদিকে কলকাত্তাই ভাষা শেখাতে গিয়ে হাসাহাসি করতুম দু’জনে। তখন আমারও বাংলা পারিভাষিক জ্ঞান কিছু বেড়েছিল। আমি বলতুম,“বৌদি বলো পেটবৌদি বলতেন,“প্যাড।“ এ-কার ও য-ফলার এবং -এর মধ্যে উচ্চারণের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে আমার যায় যায় অবস্থা। লেখার বেলা লিখছেন পেট। একদম ঠিকঠাক। অথচ বলার বেলা বলবেন “প্যাড!” ও-কার নিয়েও সমস্যা। তিনি ঝোল-কে বলেন ঝুল, মোজা কে বলেন মুজা, চোর কে বলেন চুর।  লিখছেন সব ঠিক কিন্তু বলতে গেলেই গন্ডগোল হয়ে যায়। আসলে ওঁদের কথ্য ভাষায় শুদ্ধ এ-কার বা ও-কারের কোনো প্রয়োগ নেই এই ব্যাপারটা বুঝতে আমারও সময় লেগেছিল। বৌদিকে শেখাতে গিয়ে আমার যেমন হয়েছিল, আমাকে অস্ট্রেলিয়ান ইংরিজি শেখাতে গিয়ে গুরুমশাই রায়ানেরও সেই একই দুর্দশা হয়।

যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *