পুরুলিয়া জেলা তার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির বরণডালা সাজিয়ে বসে রয়েছে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য। সেই জঙ্গলমহলে একদিকে যেমন বসন্তে লাগে পলাশ-শিমূল-অশোকের আগুন, অন্য দিকে শীতের হাওয়ায় নাচন লাগলে লাল সুরকির রাস্তা দিয়ে, সোনালি ধানখেতের ভরভরন্ত রূপ দেখে চোখ সার্থক করা যায়। অযোধ্যা পাহাড়ের নিসর্গকে পাশে রেখে ডুব দেওয়া যায় কংসাবতী নদীর ধারে অতি প্রাচীন এক অরণ্যের মন্দিরময়তায়।

হাজার বছরের প্রাচীন এক প্রত্নস্থল দেউলঘাটা। দেউলঘাটা মন্দিরের দক্ষিণের পাহাড় থেকে গোরা নদী উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমে কংসাবতীর সঙ্গে মিশেছে যে সঙ্গমে, সেই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়েই এই তীর্থস্থান। এখানেও নাকি এককালে সিন্ধুসভ্যতার মতো এক প্রাচীন সভ্যতা ছিল। গোরা নদীর তীরে চাষি লাঙল দেবার সময় আজও সেই সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পায়। আড়শা থানার, বড়াম মৌজার অন্তর্গত দেউলঘাটা বৌদ্ধ, জৈন তথা হিন্দুদের অন্যতম উপাসনাকেন্দ্র ছিল একসময়।

দেউলঘাটার প্রাচীন মন্দির

অনেক আগে এই জায়গা পরিচিত ছিল বোড়াম নামে। পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে কংসাবতীর দক্ষিণ পাড়েই দেউলঘাটা। জয়পুর গ্রাম এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। ২০০২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এখানকার তিনটে দেউলের মধ্য়ে সবচেয়ে বড় দেউলটা ভেঙে পড়ে যায়। সেটার উচ্চতা ছিল প্রায় ১৮ মিটার। যে দু’টো দেউল সংস্কার করানোর ফলে এখনও রয়েছে স্বমহিমায়, তার দৈর্ঘ প্রায় ১৫ মিটার। অপূর্ব তাদের গায়ের টেরাকোটার অলঙ্করণ।

টেরাকোটার সু‌উচ্চ মন্দির দুটি শিখরদেউল নির্মাণ পদ্ধতিতে তৈরি। বাইরের দেওয়ালের স্থাপত্য যেটুকু বেঁচে আছে তা অভিনব। প্রবেশদ্বার ত্রিভুজাকৃতির। শিবমন্দিরের বাইরে মকর অথবা হাতির মুখ দিয়ে জল বেরবার ব্যবস্থা রয়েছে। মূল মন্দিরে শিবলিঙ্গ নেই। একটা ঘরের মধ্যে মন্দিরের প্রাচীন মূর্তিগুলি আর্কাইভ করে রাখা রয়েছে। সেখানেই নিয়মিত পুজো হয়। বিগ্রহের কারুকার্য অনবদ্য। কালো কষ্টিপাথরের জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি থেকে মহিষাসুরমর্দিনী, জগদ্ধাত্রী থেকে হংসবাহিনী সরস্বতী, রণচণ্ডী থেকে ভাণ্ডারী শিবের দুষ্প্রাপ্য বিগ্রহগুলি মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করার মতো।

মন্দিরের গায়ের অলঙ্করণ

বৈদিক আশ্রম কেন্দ্রীয় সভ্যতা এবং তাকে ঘিরে এক তপোবন সংস্কৃতির আর্য জনপদ গড়ে ওঠার কথা জানালেন এক আশ্রমিক।সম্ভবত গুপ্তযুগ পর্যন্ত দেউলের ওপর বৌদ্ধ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার প্রমাণ হল এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা অজস্র ভগ্নপ্রায় বুদ্ধমূর্তি। বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান এই দুই শাখায় বিভক্ত হতে থাকায় মহাযানী তান্ত্রিকদের হাতে চলে যায় এই দেউল। তারপর সপ্তম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যের আমলে হিন্দুদের পুজো পার্বণ শুরু হতে থাকে। হয়ত তখন থেকেই নাম হয় দেউলঘাটা।  

দেউলের ত্রিকোণাকৃতি প্রবেশদ্বার বৌদ্ধ বা জৈন সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। আবার কংসাবতী নদীতীরে একদা জৈনধর্ম প্রসার লাভ করে। বারেবারে ভিনদেশিদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেউলঘাটা তীর্থক্ষেত্র ছিল একদিকে বৌদ্ধ অন্যদিকে জৈন এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রসার লাভের পর হিন্দুধর্মের  উপাসনাস্থল। 

বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান এই দুই শাখায় বিভক্ত হতে থাকায় মহাযানী তান্ত্রিকদের হাতে চলে যায় এই দেউল। তারপর সপ্তম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যের আমলে হিন্দুদের পুজো পার্বণ শুরু হতে থাকে। হয়ত তখন থেকেই নাম হয় দেউলঘাটা। 

সমগ্র মন্দির চত্বরে এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাথরের স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ। কাঁসাই বা কংসাবতী নদীতীরটি বড় মনোরম। বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে জল ছুঁয়ে আসা যায়। বসন্তে নদীর তীরের পলাশগাছে ফুল ফুটলে কেমন লাগবে তা অনুমান করা যায়। এই ঘাট, সিঁড়ি নাকি আর্য ঋষিরাই নির্মাণ করেছিলেন। উত্তরবাহিনী নদীর তীরেই সে যুগে তীর্থস্থান কিংবা আশ্রম নির্মিত হত এটি তার প্রমাণ স্বরূপ। মহাযানী বৌদ্ধধর্ম প্রসারের দাপটে চাপা পড়ে গেছিল সাময়িক ব্রাহ্মণ্যধর্ম। সম্ভবত গুপ্তযুগ অবধি এই দেউলের ওপর বৌদ্ধ প্রভাব ছিল।  

কংসাবতী নদীর তীরে এই দেউল নিয়ে সেখানকার বর্তমান সিদ্ধেশ্বর সেবাশ্রমের সংরক্ষক এক মহিলা তান্ত্রিকের কাছ থেকে জানা গেল কিছু গল্প। তিনি তার আগের রাতেই সমারোহে কালীপুজো করেছেন মন্দির চত্বরে। যাগযজ্ঞের নমুনাও পড়ে আছে। প্রসাদ দিলেন আমাদের। বেশ আপন করে নিয়ে গল্প শোনালেন তিনি। দেউলঘাটা থেকে প্রায় ন’মাইল দূরে গহীন অরণ্যে জাবড় পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় শিলাদেবীর অধিষ্ঠান। সেখানকার পূজারী ব্রাহ্মণের কন্যার নাম ছিল কংসাবতী। পাহাড়ের নীচে ছিল তাঁদের কুটির। জাবড় পাহাড়ের পাশে চুনডুংরি পাহাড়ে থাকত দেবব্রত নামে এক যুবক। সে সাধনভজন করত। কংসাবতী এবং দেবব্রতর ঘনিষ্ঠতা হয় যা আশেপাশের লোকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।  একদিন পুজোর ফুল তুলতে গিয়ে কংসাবতী পা পিছলে পড়ে যায়। দেবব্রত তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা নিন্দেমন্দ করে। কংসাবতীর কানপাতলা পিতাও মেয়েকে ভুল বোঝেন। দুঃখ পায় মেয়েটি। 

দেউলঘাটা মন্দিরের অভিনব ত্রিভুজাকৃতি স্থাপত্য

কংসাবতী বলে ওঠে, “বাবা, দেবব্রত আমার বিপদে যদি আমায় স্পর্শ করে থাকে তাহলে তো নির্জন স্থানে আমার সঙ্গে তোমার বাস করাটাও খারাপ দেখায়। আমি আর থাকব না এ ঘরে।” মেয়ের ক্রোধদীপ্ত চোখমুখ, নাক-কান দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। সেই শোণিতস্রোত পাহাড়ের অভ্যন্তর দিয়ে মাটির মধ্যে প্রবেশ করে তিরতির করে। তারপর জল হয়ে বেরিয়ে নদীস্রোত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কংসাবতীর তীরে প্রথম তীর্থস্থান দেউলঘাটা, এমনই বিশ্বাস তার।  

এখানে রয়েছেন অনাদি সিদ্ধেশ্বর। যাঁর কোনও তল পাওয়া যায়না। শোনা গেছে নদীতে জল বাড়লে নদী নিজেই এসে শিবের চরণ ছোঁয়। আছেন অষ্টদল শিব। এই শিলাখণ্ড পদ্মের ওপর বেষ্টিত, যার কোনও গৌরীপীঠ নেই। ব্রহ্মা নাকি এমন শিবলিঙ্গের উপাসনা করতেন। আর আছেন ভাণ্ডারী শিব। আটা পেষাই জাঁতাকলের মতো দেখতে অনেকটা। এখানে মা ভৈরবী মূর্তিতে বৌদ্ধদের তান্ত্রিক উপাসনার প্রমাণ।

দশভুজা সিংহবাহিনীর সঙ্গে আমাদের দুর্গার বিস্তর ফারাক। প্রচলিত দুর্গার মূর্তিতে তাঁর বাঁ পা থাকে মহিষাসুরের ওপর। এটি সারা বিশ্বের মধ্যে নাকি একমাত্র ব্যতিক্রমী দশভুজা যাঁর ডান পা মহিষাসুরের গায়ে, বাঁ পা সিংহের ওপর। এই মূর্তি বা মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে বিষয়ে দ্বিমত আছে। তবে মূর্তিগুলি তে জৈন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রকট।  এছাড়াও সংরক্ষণাগারে রয়েছে চতুর্ভুজা জগদ্ধাত্রী, আর্যযুগের এক অষ্টভুজা রণচণ্ডী, যাঁর পাশেই পদ্মাসনে উপবিষ্ট এক শিবমূর্তি। কালের স্রোতে হারিয়ে গিয়েও মুছে যায়নি দেউলঘাটার প্রত্নরাজি। 

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।