সে বেশি আগের কথা নয়।
অফলাইন থেকে অনলাইনের কামরায় ক্রমশ ঢোকার মুখে অনেক ক্রেতার মধ্যেই এক ‘ভয়ঙ্কর’ লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
সাবেকি ইঁট-কাঠ-পাথর অর্থাৎ ব্রিক অ্যান্ড মর্টার দোকান মালিকরা দেখেছিলেন, খদ্দের আসছেন, দোকানে ঘোরাঘুরি করছেন টুকটাক আর এক একটা প্রডাক্ট উঠিয়ে দামের জায়গাটা দেখে নেওয়ার পরেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে কী সব স্ক্রল করছেন।
কিছুক্ষণ পরে দোকান ছেড়ে ধাঁ।
খদ্দেরদের এই মতিগতি বুঝতে বুঝতে সেলের একটা বড় অংশ চুন সুরকির দোকান থেকে বাইনারি দোকানে ঢুকে যায়।
খদ্দেররা আসতেন, দোকানের কোনও জিনিস চোখে লেগে গেলেই দোকানদারের বদলে গুগলকে শুধোতেন, ‘এই জিনিসটা এর থেকে সস্তা হবে গো?’
গুগল হরেক সাইটের সন্ধান দিয়ে মাথায় আদরের বিলি কেটে দিত।
আমার এক পিসিকে পাড়ার সুপার মার্কেটের দোকানদারেরা প্রায় বয়কট করেছিলেন বলা চলে।
কোনও এক সেপ্টেম্বরে পিসির সঙ্গে পুজোর শাড়ি কেনার ‘মিশন’-এ যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
অমুক বস্ত্রালয়ে ঢুকলেন প্রথমে।
মনে করতে পারি, দোকানের স্টকে যা শাড়ি ছিল, তার নব্বই শতাংশই দেখে ফেললেন।
দোকানি একটা করে শাড়ি মেলে ধরেন আর পিসিমা ঠোঁট উল্টে বলেন, ‘আরও দেখাও’।
এটার রং ক্যাটক্যাটে, এর পাড় চওড়া, এর জমি খারাপ, এ তো ধুলেই গামছা, এর আঁচল ছাড়া বাকি অংশে কাজ নেই, এটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রং উঠবে, এর জরিটা ম্যাড়ম্যাড়ে—এমন নানা উপমায় শাড়িগুলোর গায়ে তকমা দেগে দিচ্ছিলেন। সঙ্গে সেই ক্রমাগত ‘আরও দেখাও’।

দোকানদার শেষে পিসির পায়ে হুমড়ি খেয়ে বলেছিলেন, ‘আমারে ক্ষমা করে দ্যান মাসিমা। আমারে বাঁচান।’
‘হুঁঃ, কোনও স্টকই নেই’, বলতে বলতে পিসি ঢুকলেন পাশের তমুক শাড়ি এম্পোরিয়ামে। সেখানেও মোটামুটি একই কাণ্ড হল।
দু’টো দোকানে সময় গেল সাড়ে তিন ঘণ্টা।
পরের দিন আবার ওই বাজারে তমুক এম্পোরিয়ামের পাশের দোকানে শাড়ি দেখতে ঢুকতেই দোকান মালিক বললেন, ‘ম্যাডাম। মাফ করবেন। ফুলিয়ায় তাঁতকলের পাশে বসে মনের মতো শাড়ির অর্ডার দেবেন। আমায় দয়া করেন। প্লিজ।’
সেই পিসিমাও গত কয়েক বছর হল শাড়ি কেনেন অনলাইনে। তিন দিন ধরে বাছেন।
তিন হাজার শাড়ি দেখে একটা পছন্দ করেন। বুক বাজিয়ে বলেন, ‘কী ভদ্র ব্যবহার! এত শাড়ি দেখি। ওয়েবসাইটের মুখে তবু কোনও রা নেই। ওই সুপার মার্কেটে আর কে যায়? দু’টো শাড়ি দেখানোর পরেই মুখ হাঁড়ি। হুঁঃ!’
শপিং মলে জামাকাপড়ের যে ঝিনচ্যাক দোকানগুলো আছে, তার গেটের সামনে লেখা থাকে, আপনি সিসিটিভি ক্যামেরার অধীন। দোকানে ঢোকার পরে বোঝা যায়, শুধু সেই ক্যামেরা নয়, আপনি দোকানের সেলসবয় আর সেলসগার্লদেরও অধীন।
কোনও দিকে চোখ মেলে তাকালেই সেখান থেকে কেউ না কেউ এসে জিজ্ঞেস করবেন, ‘মে আই হেল্প ইউ?’ নিজের মতো করে বেছে নেওয়ার কোনও উপায় নেই।
খেয়াল করে দেখবেন, দোকানে আপনি যেমন ভাবে এগোবেন, ঠিক তেমনভাবে আপনার ছায়ার মতো এগিয়ে যেতে থাকবেন ওই ব্র্যান্ড প্রোমোটাররা। আপনাকে মেপে দেওয়া ও মেপে নেওয়ার জন্য হাতে ইঞ্চিছাপ মেজারমেন্ট টেপ নিয়ে তাঁরা সব সময় রেডি।
হয়তো একটা প্যান্ট পছন্দ করলেন। তারপরেই, ‘স্যার এই প্যান্টটা বাই টু গেট ওয়ান’।
প্রমাণ করার চেষ্টা হবে, এমন ধমাকেদার অফার যে ছাড়ে তার মতো মূর্খ বিশ্বে আর দু’টি নেই। ফলে আরও একটা কিনতে বাধ্য হলেন। ফ্রি-টাও পাওয়া গেল।
এবার বিলিং কাউন্টারে গেলেন। ধরা যাক, বিল হল ২১২১ টাকা।
এবারে বিলিং-এর ছেলেটি বলা শুরু করবেন, ‘স্যার আর ৩৭৯ টাকার মার্চেন্ডাইজ অ্যাড করে দিলেই আপনি পেয়ে যাবেন তিন জোড়া মোজা, মাত্র এক টাকায়।’
ফলে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আবার ‘অ্যাড’ করার জন্য ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়।
যে জামাটা বাস্কেটে ঢুকিয়ে নিলেন, তার দাম ধরা যাক ৬৯৯ টাকা। ওখানে আবার বাই থ্রি গেট টু।
৪২১৮ টাকা বিল ভ্যালু হলে বিলিং কাউন্টার থেকে আবার টোপ দেওয়া হবে, আর ২৮২ টাকা যোগ করে সাড়ে চার হাজার টাকা হলেই একটা টাই পাওয়া যাবে পঞ্চাশ পয়সায়।
আমার এক বর্ষীয়ান আত্মীয় এহেন পুজো শপিংয়ে সকাল এগারোটায় একটি আউটলেটে ঢুকে দিনভর এক টোপ থেকে অন্য টোপের কল্যাণে দৌড়ে বিকেল চারটে নাগাদ নাকাল হয়ে ‘এই রইল তোর বাস্কেট আর কার্ট’ বলে দৌড় মেরেছিলেন।
শপথ নিয়েছিলেন, এবার থেকে পেহলে অ্যাপ। মোবাইলের পর্দায় আঙুল বুলিয়ে এখন দিব্যি পুজোর বাজার করেন। সেদিন দেখি একটা গান আওড়াচ্ছেন, ‘কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা স্ক্রিনে স্ক্রিনে।’

অনলাইন বাজার, যাকে বলে এক্বেবারে সেল্ফ সার্ভিস।
এই বাজারে বাজার করার আবার নিজস্ব আদব কায়দা আছে।
পুজোয় চাই নতুন জুতো।
দিন কয়েক আগে এক মেসোমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখি, মুখে মাস্ক পরে ল্যাপটপ খুলে কী সব করছেন।
হঠাৎ ছুট্টে গিয়ে একতাড়া কাগজ নিয়ে এলেন প্রিন্টারের পেপার ট্রে থেকে। মাটিতে একটা কাগজ রাখার পরেই তার উপরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
মাসিমার হাতে স্কেচপেন। দেখি মেসোর পা বরাবর দাগ কাটছেন।
কাটা হয়ে গেলে এ বারে মেসো একটা স্কেল নিয়ে বুড়ো আঙুল থেকে গোড়ালির শেষ পর্যন্ত মেপে নিলেন।
সংখ্যাটা কুটকুট করে টাইপ করলেন ল্যাপটপে। তারপরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে এক হাতের মুঠো দিয়ে অন্য হাতে এক ঘুষি মেরে বললেন, ‘ইয়েস, আমি জানতাম, সাত।’
জানতে পারলাম, পায়ের মাপ নিয়ে প্রথমেই কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল ওয়েবসাইট।
মেসোমশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাউস নিয়ে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করার সময়ই ওরা দেখিয়ে দিল ‘নিজের মাপ নিজেই জানুন’-এর আশ্চর্য সমাধান।
পুজো-স্পেশাল সানগ্লাস অর্ডার করার সময় আমার এক বন্ধুকে দেখেছিলাম ডেবিট কার্ড নিয়ে নিজের চোখের সামনে ঘোরাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কার্ডটা লম্বালম্বিভাবে ধরে এক প্রান্ত নাকের মাঝখানে রাখল। অন্য প্রান্ত চোখের কোণায়।
জানলাম, কার্ডের অন্য প্রান্ত যদি চোখের কোণা ছুঁয়ে ফেলতে পারে তাহলে চশমার সাইজ নাকি স্মল।
‘ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলাম আর পেলাম না’ গোছের কিছু হলে চশমার সাইজ মিডিয়াম। আর একেবারেই না ছুঁতে পারলে লার্জ।
কোন প্রকাশনীর সহায়িকায় এমন আশ্চর্য ফর্মুলা দেওয়া আছে জানতে চাওয়ায় ও একটা তাবড় চশমার ওয়েবসাইটের নাম বলল। ইন্টারনেট খুলে দেখি, একেবারে সত্যি।

অফলাইন বাজারের বিস্কুটে অনলাইন একটা বড় কামড় বসাতে না বসাতেই করোনাকাণ্ড এল।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে লোকে আরও বেশি করে হামলে পড়তে লাগলেন অনলাইনে বাজার করার নানা প্ল্যাটফর্মে।
এ বারের পুজোর বাজারের যে অনেকটাই তাদের দখলে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
জামা-জুতোর শেল্ফ থেকে শুরু করে বিলিং কাউন্টার, ট্রায়াল রুম থেকে ফেরৎ নেওয়ার ডেস্ক— এখন সবকিছুই স্ক্রিনে।
টেকনোলজির মাহাত্ম্যে ভার্চুয়াল ট্রায়াল রুমের মহিমা বেড়ে গিয়েছে অনেক। ট্রায়াল রুম হয়ে উঠেছে এক কথায় মনস্কামনা ভাণ্ডার। নিজেকে মুহূর্তে সাজিয়ে নেওয়া যাচ্ছে ইচ্ছেমতো।
দোকানে পাঁচশো টাকার উপরে যে শার্টগুলো ছুঁতে নিজের হাত কেঁপে এসেছে এত দিন, আজ মাউস-হাত অবলীলায় তিন হাজার টাকার জামা অনলাইন শেল্ফ থেকে পেড়ে নিয়ে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টকে প্রশ্ন করছে, ‘হাউ ডু আই লুক?’
প্রতিটা প্রোডাক্টের তলায় মোহমাখা তিন চারটে শব্দ খেলা করে— ট্রাই দিস অন মি। আমাকে দেখুন।
সেলফি ক্যামেরা মুখের ছবি তুলে নেয়। মুহূর্তের মধ্যে কোনও হিসেবি শরীর আলো করে দেয় কোনও বেহিসেবি জামা।
রিক্সা চালানো কর্তার জামা টেনে, পরের বাড়িতে কাজ করা যে মালতীর মা পুজোর সময় একটা হালকা সোনার হারের জন্য স্বপ্ন-আকাঙ্খা করে গেলেন সারা জীবন, তিনি আজ ইচ্ছে করলেই মোবাইল স্ক্রিনে নিজেকে পরিয়ে দিতে পারেন জড়োয়া হার।
গয়নার দোকানের অ্যাপগুলো এই আহ্লাদ দেয় বিনা খরচে।
আর এই দেখার আনন্দের মধ্যেই মহাষ্টমীর ঢাকের বাদ্যি বাজতে শুরু করে তাঁর সারা শরীরে। পুজোর আগেই পুজো আসে।
আমার এক অনলাইন শপিং পাগল বন্ধুর কথা বলে শেষ করি।
গত বছর মহাষষ্ঠীর দিনে বাবা হয়েছিল ও।
পুজোর জন্য গুচ্ছের জামাকাপড় অর্ডার করেছিল যে ওয়েবসাইটে, তারা আবার সেদিনই সকালবেলা ওকে এসএমএস করে জানাল, জিনিসপত্র আজই আসছে ওর কাছে, আউট ফর ডেলিভারি।
বন্ধু ওই ওয়েবসাইটের কাস্টমারকেয়ারে পত্রপাঠ মেল করে লিখেছিল, “কালকে পাঠান প্লিজ। মাই ওয়াইফ ইজ অলসো আউট ফর ডেলিভারি।”
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
অবস্থার সঠিক ও সটীক মূল্যায়।
অবস্থার সঠিক ও সটীক মূল্যায়ন।
sudhu retail er sathe jukto lok i emon lekha likhte parbe.