তিনি ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্টের আন্তর্জাতিক আইকন। বাঙালির নিত্য ব্যবহারের সাদামাটা গামছাকে বিশ্বের ফ্যাশন দরবারে অভূতপূর্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সদ্য সত্তরে পা দেওয়া সেই বিবি রাসেল এখন কেমন আছেন? প্যানডেমিকের সঙ্কটকে জয় করতে নতুন কোন কাজে হাত দিয়েছেন? বাংলার তাঁতি এবং শিল্পীরাই বা কেমন আছেন এই অস্থির সময়ে? এমনই নানান বিষয়ে এক অন্তরঙ্গ টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বিবির সঙ্গে কথা বললেন সংযুক্তা সরকার।
“সামনে অঢেল কাজ| বাংলার তাঁতিদের, হস্তশিল্পীদের খুব খারাপ অবস্থা আজ| ওঁরা আমায় প্রাণ দিয়ে ভালবাসে| তাই ওঁদের যুদ্ধটা আমারও যুদ্ধ| প্রতিদিন ওঁদের মুখে নাই নাই শুনতে শুনতে আমার অস্থির লাগে|”
কথাগুলো বলতে বলতে আবেগ আর উত্তেজনায় ফুটছিলেন সদ্য সত্তরে পা রাখা এক তরুণী| হ্যাঁ, তরুণীই বটে| তিনি একসময় চুটিয়ে আন্তর্জাতিক রাম্পে হাঁটা নামী মডেল, পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, যাঁর মনের বয়স এখনও কুড়ি পেরোয়নি| নাওয়া খাওয়া ভুলে প্যানডেমিকের পটভূমিকায় আজ এক নতুন যুদ্ধের নকশা বানাচ্ছেন তিনি| চলছে নিত্যনতুন পরিকল্পনা আর স্বপ্নের বুনন| বিবির জন্ম বাংলাদেশে| আর তাঁর নাম, যশ, খ্যাতির অনায়াস যাতায়াত গোটা বিশ্বে| তবে এ পার বাংলার মনের মনিকোঠায় বরাবরই বড় আদরের নাম বিবি| গত উনিশে অগষ্ট সত্তরে পা দিলেন এই চিরসবুজ মানুষটি|

ছোটবেলায় মা তিন বোনের জন্য যে জামা সেলাই করে দিতেন, ছোট মেয়ের তা ঠিক পছন্দ হত না। ঘ্যানঘ্যান করতেন| শেষমেশ সেই দশ বছর বয়সেই বাবা তার জন্য একটি সেলাই মেশিন কিনে আনলেন| তাতেই নিজের পছন্দমাফিক জামা সেলাই করতে শুরু করলেন বিবি| কখনও রান্নাঘরের হলুদ কাজে লাগিয়ে কাপড়ে রঙ ফুটিয়ে তুলতেন। তারপর ষোলো বছর বয়সে একদিন বাবা কোকো শ্যানেলের ছবিওলা ম্যাগাজিন নিয়ে আসেন বাড়িতে| আন্তর্জাতিক সেই পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতেই বিবির ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু|
এর পরের গল্পটুকু প্রায় সকলেরই জানা| লন্ডনের কলেজ অব ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন থেকে পড়াশোনার পাট শেষ করে পাঁচ বছর ভোগ, কসমোপলিটন-সহ বেশ কিছু নামী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের মডেল হিসেবে কাজ করেন। আরমানি, সাঁ লোরঁ, শ্যানেল এবং কেঞ্জোর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্র্যান্ডের সঙ্গে লাগাতার ফ্যাশন শোতে কাজ করে গিয়েছেন ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত| সেই বছরই বাংলাদেশে ফিরে ‘বিবি প্রোডাকশন’ নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড চালু করেন বিবি রাসেল। এরপরে একটু একটু করে শুরু হয় এক স্বপ্নপূরণের গল্প যার পোষাকী নাম, ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’| যার মূল লক্ষ্য, দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরা এবং এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি’ এক ফ্যাশন ট্রেন্ড গড়ে তোলা| প্রথমে খানিকটা ধাক্কা খেলেও ২০০৪ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ৩৫,০০০ গ্রামীন পোশাকশিল্পীকে নিজের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হন বিবি।

বিবির উড়ানের গল্পটা এভাবেই এগোচ্ছিল| সাথী ছিল সবুজে ঘেরা গ্রাম বাংলা আর সেখানকার তাঁতি ও কুটিরশিল্পীরা| ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন প্রান্তে গত কয়েক বছর ধরে যাঁদের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন বিবি| কিন্তু বাধ সাধল কোভিড ১৯| ভেস্তে দিল এতদিনের যাবতীয় পরিকল্পনা| সবকিছু আবার নতুন করে সাজাতে হচ্ছে| তাঁতিদের বোঝাতে হচ্ছে| কিন্তু তাতে ঘাবড়ে যাবেন, ভয় পাবেন, এমন মানুষ তো তিনি নন| তাই দিনে ষোল ঘন্টার বদলে এখন বাইশ ঘন্টা কাজ করছেন| ঘুরে যে দাঁড়াতেই হবে!
কেমন সেই পরিকল্পনা? ঠিক কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তাঁতিরা, কুটিরশিল্পীরা? ‘’মানুষের হাতে এখন আর অত অর্থ নেই দামি পোষাক কেনার| এবং এই পরিস্থিতিটা খুব শিগগিরিই বদলাবে এমন নয়| মানুষ খরচাপাতি করার বিষয়েও অনেক সচেতন হয়ে গিয়েছে| তাই কিনলেও অল্প দামের মধ্যে পোষাক কিনছেন’’, বললেন ‘করোনা’ পরবর্তী বাজার বুঝে নেওয়া বিবি| আরও বললেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাল্টাতে হবে নিজেদেরই| দাম রাখতে হবে রিজনেবল| তবে নতুন এই পৃথিবীতে চাহিদা রয়েছে মাস্ক, মাল্টিপারপাস ব্যাগ, ওয়াশেবল ফ্লিপফ্লপ ইত্যাদির| সেই চাহিদাকে মাথায় রেখেই নতুন করে যুদ্ধের অস্ত্র শানাচ্ছেন বিবি| তাঁতিদের পাশাপাশি মন দিয়েছেন হাতের কাজ জানা শিল্পীদের জীবন ও জীবিকা উদ্ধারেও|

একটা বিশেষ শ্রেণীর জন্য ফ্যাশন করতে চাইনি কখনও| আমি বানাতে চেয়েছি রেডি টু ওয়্যার ফ্যাশন যা সবাই কিনতে পারে| আমার দেশের গরিব মানুষ আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে| ওঁদের হাতের যে জাদু আছে সেটাই সকলকে দেখাতে চাই| তাঁদের কাজ যেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সম্মান পায় সেটাই চাই’ বললেন বিবি|
[the_ad
এক সময় বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রোডাকশনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করে আর দুই সন্তানের দেখভাল করেই হুশ করে কেটে যায় সংযুক্তার দিন। অবসর সময়ে ভালোবাসেন পরিবারের সকলের সঙ্গে বেড়াতে যেতে।
দারুন হয়েছে, কত কি জানতে পারলাম , চালিয়ে যা, শুভেচ্ছা রইল
চমৎকার লাগল সংযুক্তা
Khub bhalo laglo. Ami to etai dekhar ashay chhilam. Egiye chalo. Suvechha roilo.