তাঁত, বালুচরি বা ঢাকাই শাড়ির নাম আমরা বাঙ্গালিরা সবাই অল্প বিস্তর জানি। কিন্তু কুনবি শাড়ি? দংরিয়া? পাত্তেদা আঞ্চু? তেলিয়া রুমাল? শোনেন নি তো? এগুলো আসলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাড়ির নাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ও জানতাম না কয়েক বছর আগে। একসময় শাড়ি ছিল একটা আবেগ। ছোটবেলায় মায়ের শাড়ি পরে সরস্বতী পুজো বা রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বেরনোর উত্তেজনা ছিল অন্যরকম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই আবেগে ভাঁটা পড়েছিল। আমার মতো অনেকেই শাড়ি কে তুলে দিয়েছিলেন আলমারির একদম ওপরের তাকে। সালওয়ার কামিজ, পালাৎজো প্যান্ট বা জিনস টপকেই প্রতিদিনের পোষাকে প্রথম সারিতে রাখতে শুরু করেছিলন। বিয়ে বাড়িতে লেহেঙ্গা, পার্টি তে লঙ ড্রেস বা গাউন, অফিসে ফর্মাল শার্ট আর ট্রাউজারস, কেনাকাটা করতে বেরিয়ে জিনস আর কুর্তা, এই দিয়েই চলে যাচ্ছিল। শাড়ি পরতে অনেক সময় লাগে, স্বচ্ছন্দ হওয়া যায় না, দৌড়োদৌড়ি করা যায় না, সব অনুষ্ঠানে পরা যায় না, শাড়ি মানেই ভারি জরি চুমকির কাজ, এসব ওজর আপত্তি আমরা অনেকেই দিয়ে আর শুনে অভ্যস্ত।

এসবের মধ্যেই কয়েক বছর আগে ফেসবুকে হঠাৎ দেখলাম আমার এক বন্ধু রোজ রোজ শাড়ি পরে ছবি দিচ্ছে। ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হল। বন্ধু কে ফোন করে জানলাম সে 100 saree pact এ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। শুনে ধন্দে পড়ে গেলাম। আমি তো এসব কিছুই বুঝি না। শাড়ি পরব তাও আবার কারুর সঙ্গে প্যাক্ট করে? তখন সে বুঝিয়ে বলল, এটা একটা গ্রুপ, যাদের উদ্দেশ্য বছরে অন্তত ১০০ বার শাড়ি পরা। অঞ্জু কদম ও আয়ালি ম্যাথান বলে দুই বন্ধু ২০১৫ তে ভেবেই ফেললেন কী করে নিজেদের আলমারি তে পড়ে থাকা শাড়ি গুলোকে বের করে আনা যায়, পরে ফেলা যায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তারা নিজেদের কিছু বন্ধুকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। শাড়ি পরলেই একটা ছবি দিতে হবে, আর সেইসঙ্গে সেই শাড়ির গল্প ও বলতে হবে সবাইকে। এভাবেই স্মৃতি তে ফিরে এল মায়ের বিয়ের বেনারসির গল্প বা জীবনে প্রথম নিজের রোজগারে কেনা শাড়ির গল্প। দিদার আঁচলের গন্ধ আর সরস্বতী পুজোর দিনের প্রথম প্রেমের গল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
নেটিজেনদের মধ্যে শাড়ি জনপ্রিয় করে তুলত এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন বেশ কিছু গ্রুপ রয়েছে। মিডিয়া ব্যাক্তিত্ত্ব সুনিতা বুধিরাজার তত্তাবধানে তৈরি sixyardsand365days গ্রুপ ২০১৫ থেকে কাজ করে চলেছে ভারতের বিপুল হ্যান্ডলুম শাড়ির সম্ভার কে জনপ্রিয় করে তুলতে। হ্যান্ডলুম ছাড়া অন্য শাড়ি এঁদের কাছে ব্রাত্য। শুধু ভারতেই নয়, সুদূর আমেরিকা, ব্রিটেন এমন কি সাউথ আফ্রিকা থেকেও শাড়ি পরে অনেকে এই গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন, মতামত বিনিময় করছেন। এরকম আরও রয়েছে saree speak বা saree saga গ্রুপ। রয়েছে Be ethnic be beautiful। ২০১৯ সালের দুর্গা পুজোতে, মহম্মদ আলি পার্ক এ প্রায় ১০০ জন শাড়ি পরিহিতাকে নিয়ে এঁরা সিন্দুর খেলার অনুষ্ঠান করেছেন। প্রচুর মানুষ শুধু শাড়িকে কেন্দ্র করে এরকম অনেক গ্রুপ বানিয়ে যোগাযোগ রাখছেন। নিয়মিত পরছেন, কিনছেন বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম থেকে, চর্চা করছেন আমাদের দেশের বিভিন্ন কোণায় লুকিয়ে থাকা বা লুপ্তপ্রায় বুনন বা ছাপার পদ্ধতি নিয়ে।

নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে শাড়ি নিয়ে। সরাসরি চেষ্টা করছেন বুননশিল্পিদের কাছে পৌঁছতে। এঁরা সেই যেন আগেকার দিনের সই পাতানোর প্রথাটিকে ফিরিয়ে এনেছেন। ধর্ম, ভাষা, দূরত্ব, কোনওটাই বাধা হয়ে দাঁড়়ায়নি এঁদের কাছে। শাড়িকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ। শাড়ি সই বা সখি হিসেবে রোজ চিনছেন, জানছেন, অসংখ্য নতুন মানুষকে। এঁরা একে অন্যকে উৎসাহ দিচ্ছেন, সুখ দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছেন। শাড়িকে ঘিরে হচ্ছে আলাপ বা চলছে মেলামেশা, গেট টুগেদার। কলমকারি থেকে ইক্কত, পোচমপল্লী থেকে কাঁথা বা খেশ, শাড়ির জগতে সব গল্পই সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। উড়িষ্যার আদিবাসী সম্প্রদায় এর হাতে তৈরি দংরিয়া শাড়ির আখ্যান বা লুপ্তপ্রায় কর্ণাটকের পাত্তেদা অঞ্চু শাড়ী, যা নাকি বোনা হত দেবদাসীদের জন্যে, কি ভাবেই বা বিশ্বের বাজারে মন জয় করল গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলের আজরখ, এমন সব গল্প এখন উঠে আসছে শাড়ীর আঁচল বেয়ে। বাংলার বেগমপুরী থেকে গোয়ার কুনবি, সবাই এখন নিজেদের সংগ্রহে রাখতে চাইছেন। কৌলীন্য ফিরে পেয়েছে ধনেখালি। GI ট্যাগ পেয়েছে তেলেঙ্গানার তেলিয়া রুমাল। এই সব গ্রুপে সদস্যারা কেউ ডাক্তার, কেউ বুটিক চালান, কেউ শিক্ষিকা আবার কেউ কর্পোরেট কর্মী, কেউ আবার গৃহবধূ, তবু সবাই কে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে শাড়ির প্রতি প্রেম। নাচ থেকে পথ সফর, স্কুল থেকে অফিস, সব জায়গাতেই শাড়ি বা অন্য ভারতীয় পোশাকেতে যে স্বচ্ছন্দ হওয়া যায়, তা এঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এখানেই তাঁদের সাফল্য।

যারা সব অনুষ্ঠানে শাড়ি পরেন তারা ওল্ড ফ্যাশনড, এই ধারণা এখন পালটেছে। এখন কুড়ির কোঠায় পৌঁছান কলেজ পড়ুয়া তরুণী স্বচ্ছন্দেই শাড়ি পরে বন্ধুদের আড্ডায় যাচ্ছেন। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবার জন্য মায়ের আলমারি ঘাঁটছেন শাড়ি বাছতে। আর এখন তো শুধু চিরাচরিত সায়া, ব্লাউজ এর সঙ্গেই নয়, লেগিংস, ক্রপ টপ বেল্ট নানান আধুনিক পোষাকের সঙ্গে যুগলবন্দি বেঁধে, শাড়িতেও একদম কন্টেমপোরারি লুক দেওয়ার চল। এমনকি বুট বা স্নিকার্স এর সঙ্গেও। ইউটিউব এ হাজার একটা চ্যানেল আছে যারা আপনাকে শাড়ী পরার নানা ধরন শিখিয়ে দেবে সহজে। ডলি জৈন বলে কলকাতার একজন গৃহবধূ শুধু বিভিন্ন শাড়ি পরার পদ্ধতি শিখিয়েই সেলেব্রিটি হয়ে উঠেছেন। তাঁর ডাক পড়ে ঈশা আম্বানি কিম্বা দীপিকা পাদুকোনকে শাড়ি পরাতে। নাম উঠেছে লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এও।
গত এক দশকে শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অনেক বিখ্যাত মানুষকেই কখনও না কখনও শাড়ি পরতে দেখা গেছে। সব্যসাচী বা তরুণ তাহিলিয়ানি বা রিতু কুমার এর তৈরি শাড়ি বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে দিয়েছে শাড়ির মহিমা। ওপ্রাহ উইনফ্রে থেকে জুলিয়া রবার্টস, ম্যাডোনা থেকে পামেলা অ্যান্ডেরসন বিভিন্ন সময়ে শাড়ি নজর কেড়েছেন। তেমনই আবার প্রবাল গুরুং বা জন গালিয়ানো, নিজেদের পোশাকে ব্যবহার করেছেন বেনারসি বা ইক্কত এর মত বুনন শৈলী। লুই ভিতঁ সেই কবেই বের করে ফেলেছে নিজদের ইন্ডিয়া ইন্সপায়ারড পোশাক। আর সেই নীল বিদ্রোহে শত শত মানুষের রক্তে রাঙ্গা নীল রং ফিরে এসেছে নতুন অবতারে “ঈন্ডিগো” হয়ে। যা প্রায় গোটা বিশ্বে ভারতের সৃষ্টির বিশেষ দ্যোতনা বহন করে। যখন নোবেল এর মঞ্চে সবুজ শাড়ি পরে পুরস্কার নিতে উঠলেন বিদেশিনী এস্থের দুফ্ল, তখন সব শাড়ি প্রেমীর হৃদয় আনন্দে উদ্বেল হয়েছিল সন্দেহ নেই।

এত গেল বিশ্বের খবর। কী বলছেন আমাদের আসে পাশের বন্ধুরা? শাড়ি পরে মন খারাপ করে থাকা সত্যি মুশকিল, তাই কলকাতার আইটি কর্মী শুভশ্রী সরকার সুযোগ পেলেই নানা রকম ডিজাইনের ব্লাউজ দিয়ে শাড়ি পরে ফেলেন। হায়দ্রাবাদ-এর কৃষি গবেষক আত্রেয়ী ঘোষ মনে করেন স্টাইল স্টেটমেন্ট হওয়ার সঙ্গেই শাড়ি একটু বাড়তি সম্ভ্রম এনে দেয় আশপাশের মানুষের চোখে। বহু বছর আমেরিকা নিবাসী রিচা সরকারের কাছে শাড়ি আসলে শেকড়ের টান ধরে রাখার তাগিদ। দেশ আর শাড়ি যেন সমার্থক।
তাহলে আর অপেক্ষা কীসের? আপনিও যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখা শাড়িগুলো বের করে পরে ফেলুন। নিজেকে উদ্বুদ্ধ করার এমন উপায় কেউ ছাড়ে? আর বাড়ির লোক কে গোটা কতক ছবি তুলে দিতে বলতে ভুলবেন না যেন।
কর্পোরেট সংস্থায় এইচ আর-এর ভূমিকায় যুক্ত সিলভার পছন্দ গান, খাওয়াদাওয়া আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। লেখালেখি করেন শখে আর অনুরোধে।
Khub bhalo laglo lekha ta.onek kichu janlam
Samay kore porar jonye dhonnobad
Osadharon…. Eta vebe bhalo lagche j tumi amar porichito ekjon…
That was a lovely write up…sine i have dealt with sarees for the last 35 years….i rejoiced even at the thought that at least somebody took the pain of writing about sarees!!keep writing
Wow Silva
Beautifully penned…
Congratulations ❤️
Darun hoeche … Ami du bar kore porlam ❤️❤️👍👍
Very well written. Informative for Saree lovers like me…
Darun likhecho …very informative .
Khub bhalo laglo ekhata Silva!
Khub valo laglo ma’am. . Onek talent apnar
. U r sach an inspiration ❤❤
Loved it thoroughly!! As if I was living every moment captured in each line,, cud visualise every minute detail as I progressed reading,,, all d best dear👍🏻 Keep writing n inspiring lyk dis😊❤️
Really informative. This write up reminds me of Maa’s evergrowing saari collection that she still treasures way more than her jewellery & how it used to be no less than a treasure to you & Didibhai. 😊❤️
Bah! khub bhalo laglo. koto saree r naam jana holo….