মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বস্তুত, এক বৈদগ্ধ্য। এই কমাপ্রধান প্রথম বাক্য দিয়েই তাঁকে চিহ্নিত করতে চাইলাম, কারণ, তিনিই বাংলা ভাষার বাক্যে খবরের কাগজের আধিপত্য খারিজ করে তার শোষণ ক্ষমতা পরখ করেছিলেন। আমার এবং আমার মতো অনেকেরই মফস্বলের বড় হওয়ার বাংলা লেখনরীতি একেবারেই খবরের কাগজ শাসিত, দাঁড়িপ্রধান, ছোট বাক্যে তৈরি করা।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রথমবার আক্রমণ করলেন মগজে — স্পষ্ট জ্ঞান হবার পরেকার পড়া অনুবাদে, টের পেলাম বাংলা বাক্যের ও তার অণ্বয়ের বিস্তার ক্ষমতা। একটা উদাহরণ দিই তাঁর অনুবাদ করা ভাসকো পোপার কবিতার উপসংহার প্রবন্ধ থেকে। “যথেচ্ছাচার নয়, স্বাধীনতা; আর এই স্বাধীনতায় তিনি পৌঁছেছিলেন ধীরে-ধীরে, অনিবার্যপ্রখর গতিতে, যেন পরাবাস্তব কবিতার ধরণকে আত্মসাৎ ক’রে, অপ্রত্যাশিত উপাদানগুলোকে তাকলাগানোভাবে মিলিয়ে দিয়ে, তিনি গড়ে তুলতে চাচ্ছেন কবিতারই এক নতুন সংজ্ঞার্থ।” হ্যাঁ তিনি আলাদা করতে শেখাচ্ছেন। বাংলা ভাষার প্রতিটি শিক্ষানবীশকে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, যে ভাষার প্রকাশক বেস্ট সেলার ও লিটেরারি উপন্যাসকে আলাদা করতে পারে না, এবং যে ভাষার খবরের কাগজ দাগিয়ে দেয় সাংবাদিক গদ্যকে সাহিত্যিক গদ্য বলে, সেই ভাষাকে। তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধ আমাদের শেখায় ন্যাকামি যে ভাষার মজ্জাগত তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে।

হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র
হুয়ান রুলফোর কবিতার অনুবাদ

১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলা ভাষায় কবিতা বলতে বোঝায় কিছু ইনিয়ে বিনিয়ে বলা কলেজ কলিজায় আলোড়ন তোলা ক্যাচি লাইনের সমাহার, যা বস্তুত স্বভাব কবিতার চরম প্রয়োগ। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পছন্দ করে তুলে আনা কবিতালিকায় রেখেছেন সেই কবিদেরই যাঁরা নির্মাণদক্ষ, নিজেদের দেশ ও ভাষার সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ। যে কবিতা থেকে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা হতে পারে কবিতা আসলে শুধুমাত্র কিছু আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। কাদের কবিতা তুলে এনেছেন মানববাবু? চেসোয়াভ মিউশ, ভাসকো পোপা, মিরোস্লাভ হোলুব, এমে সেজেয়ার, নিকানোর পাররা, ডেরেক ওয়ালকট, কামাউ ব্রাফেট, ভিসওয়াভা শিম্বোরস্কা। এঁরা প্রত্যেকেই কলাকৈবল্যবাদী কবিতার গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে, অথচ খবরের কাগজ থেকে টোকা স্মাজিক কবিতা না লিখে চলে উন্মুক্ত করেছেন এক নতুন দুনিয়া, যা আসলে বিশ শতকের এক প্রধান ধারা।

চেসোয়াভ মিউশের কবিতা

 

তিনি আমাদের চিনিয়েছেন অনুবাদ মানে সাহেবদের শেখানো কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কবিদের অনুবাদ নয়, অনুবাদ মানে সন্ধান। নিজের ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নতুনতর রাস্তার সন্ধান। যেমনটা করেছেন তাঁর অনুবাদ করা কবিরা। বাঙালি কবিতা বলতে বোঝে হালকা ফুলকা মনের রং। জাতির গুরুভার ঔপন্যাসিকের হাতে। কারণ বাংলা ভাষায় কবিতা সবাই লেখে। তার কারণ কবিতা কোনও “ শ্রম” বা “সময়” দাবি করে না। কিন্তু মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ করা কবিরা আসলে তাঁদের জাতির প্রতিভূ। অসহায়ভাবে কবিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকার প্রতিভূ। তিনি অনুবাদের জন্য তৈরি করলেন এক স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলা ভাষার তরুণ কবিরা শিখতে পারে এমন ভাষা প্রবণতা। তৈরি করে নিলেন কবিতার উপযুক্ত শব্দ। যেমন ধরা যাক চেশোয়াভ মিউশের কবিতা “মধ্য-বিংশ শতাব্দীর ব্যক্তি চিত্র” কবিতাটি পড়তে গিয়ে নজরে পড়বে “সুখবিনোদ” শব্দটি।

ইংরেজি অনুবাদে পোল্যান্ডের কবি মিউশকে পড়তে গিয়ে দেখি শব্দটি সেখানে pleasure । মানব বাবু নিজেকে কখনও পোলভাষাজ্ঞানী বলে বলে দাবি করেন নি। যদিও তিনি ভাষাটি বেশ খানিকটা জানতেন, তাই ধরে নিই মূল এ pleasure এর কাছাকাছি কোনও শব্দই থাকবে। অনুবাদক এখানে প্রচলিত কোনও আভিধানিক শব্দ না বেছে বসালেন একটি তৈরি করা শব্দ। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর যে কোনও অনুবাদ কবিতা পড়লে কবিতার বিশ্ব কবিতার বামপন্থী ধারাটির (যদিও মিউশ আগ মার্কা কমিউনিজম বিরোধী, কেন্দ্রীয়-গণতান্ত্রিক) সঙ্গে আমাদের পরিচিতি সম্যক হয়। এবং সে ধারা যে বিপ্লব ঘটিয়ে জোতদারের ঘরে আগুন লাগায় না তার প্রমাণ রাখে। প্রমাণ রাখে স্বভাবকবিতা, বা “যুবাবয়সের ধারণাই” সারাজীবন বহন করাই কবিতা নয়।

জুলভার্ন অমনিবাস
জুলভার্নের অনুবাদ সংকলন

 

আলেহো কারপেন্তিয়ের গোটা এস্পানিওল ভাষার এক প্রধানতম লেখক। তিনি ঔপন্যাসিক। তিনি সঙ্গীতবেত্তা। তিনি পরবর্তিতে দুনিয়া কাঁপানো জাদু বাস্তবতার জনক এবং মিশ্রজাতিবাদের এক প্রবল প্রচারক। বাঙালির কখনওই তাঁর নাম শোনার কথা নয় যদি না এস্পানিওল ভাষার সাহিত্যের চর্চা না করেন। ১৯৯১ সালে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালির সামনে হাজির করলেন তাঁর রচনা, তখন অবধি জানা ছিল গার্সিয়া মার্কেস এর নাম, হয়ত বা বার্গাস যোসা বড়জোর কার্লোস ফুয়েন্তেস। কিন্তু আমরা এঁদের আগের প্রজন্মের লেখকদের চিনতাম না। আমাদের চেনালেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। চেনালেন খুয়ান রুলফোকে। চেনালেন খুলিও কোর্তাসার এর অণুগল্প। আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, খবরের কাগজের গদ্যভাষা আর সাহিত্যিক গদ্যভাষা আলাদা।

আলেহো কার্পেন্তিয়ের
আলেহো কার্পেন্তিয়েরের কবিতা

সে ভাষার প্রমাণ আমরা তাঁর নিজের মৌলিক লেখাতেও পাই। মনে রাখা দরকার তবুও তিনি নিজের লেখায় সময় অতটা না দিয়ে, ছাত্রবয়সে অর্থাভাবে শুরু করা অনুবাদ চালিয়ে গেছেন নিজের মনন জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটাতে। তাঁর মৃত্যু বাংলাভাষার সম্ভবত একমাত্র বিশ্বকবিতার মানচিত্রকরকে কেড়ে নিল।

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৮ সালে, কলকাতা। প্রকাশিত কবিতার বই ৪টি। বৌদ্ধলেখমালা ও অন্যান্য শ্রমণ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমির যুব পুরস্কার, পেয়েছেন মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কারও। স্পেনে পেয়েছেন আন্তোনিও মাচাদো কবিতাবৃত্তি, পোয়েতাস দে ওত্রোস মুন্দোস সম্মাননা। স্পেনে ওঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। মেদেইয়িন আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব ও এক্সপোয়েসিয়া, জয়পুর লিটেরারি মিট সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *