এতবড় পৃথিবী। অথচ ইচ্ছেমতো কোথাও যাওয়ার উপায় নেই এখন। অতিমারী আমাদের কূপমণ্ডুক বানিয়ে দিয়েছে। এই বিশ্বব্যাপী সঙ্কটকালে নতুন দেশ দেখার আগ্রহ বা মানসিক তাগিদ কোনওটাই অনুভব করছি না। বেড়ানো মানেই তো ফুর্তি, আনন্দ, উত্তেজনা, রুটিনের বাইরে দু’দিনের খোলা হাওয়া। সেই ফুরফুরে মনটাই তো এখন আমাদের একেবারে অচেনা!

কিন্তু আমার সঞ্চয় অতীতস্মৃতি। সঞ্চয়ই তো আমাদের ভরসা! আমার সেই স্মৃতি-সঞ্চয়ের ঝুলিতে রয়েছে বৃষ্টিভরা লবঙ্গের জঙ্গল, গোধূলির আলোমাখা মেঠো বাঁশির সুর, হাতছোঁয়া দূরত্বে বরফে ঢাকা পাহাড়। আর তার সঙ্গে নানা মানুষজন। মনে পড়ছে প্রেম যোশির কথা। বিনসরের ভিলেজ ওয়াকে সে ছিল আমার গাইড। ছোটখাটো, হাসিখুশি চেহারা, ছটফটে মানুষ। জলের বোতল আর ব্যাগ কাঁধে পাহাড়ি জঙ্গল পথে গল্প করতে করতে চললেন আমার সঙ্গে। তাঁর কথাতেই চিনলাম, জানলাম আখরোট, আপেল, পিচ, প্লাম, আর রডোডেনড্রনের দেশ বিনসরকে।

Binsar
বিনসরের ঝকঝকে নীল আকাশ আর পাইনের বন। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

কাঠগোদাম থেকে বিনসর পৌঁছতে গাড়িতে সময় লাগে ঘণ্টা তিনেক। সে রাস্তায় একটুকরো প্লাস্টিক চোখে পড়ে না। চারিদিকে লক্ষ্মীশ্রী ঝকঝক করছে। চা-তেষ্টা মেটাতে রাস্তার চায়ের দোকানে গাড়ি থামিয়েছিলেন ড্রাইভারজি। দোকানির নাম হরিশ্চন্দ্র পণ্ডিত। জানালেন, এ জায়গাটার নাম দোপাখি! অর্থাৎ কিনা দুই পাহাড়ের মাঝখানের জনপদ। সামনেই আছে আর এক গ্রাম, তার নাম গরম পানি। গপ্পো করতে করতেই দেখলাম হরিশ্চন্দ্রের দোকানটিও ঝকঝকে পরিষ্কার। চায়ের সঙ্গে স্টিলের ছোট্ট থালায় পকোড়ার তুরন্ত সার্ভিস।

Binsar
বিনসরে জঙ্গলের ফাঁকে ছোট্ট গির্জা। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ওক, পাইন আর দেবদারুরও সমারোহ এই অঞ্চলে। ভিলেজ ওয়াকের পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রেম বলেছিলেন, “ওক আর পাইনের পাতা যত্ন করে খাওয়ানো হয় গোরুকে। তাতে গোরুর দুধ ভালো হয়।” মনে পড়ে গেল, এই অঞ্চলের ঘি, পনির, মিষ্টির খুব সুনাম। বিনসর আসবার পথে খেয়েছিলাম এখানকার স্থানীয় মিষ্টি সিনোরি! কলাপাতায় মোড়া পানের খিলির মতো দেখতে। পাতায় মোড়া সেমি-সলিড রাবড়ি বলা যেতে পারে। টাটকা দুধ আর খোয়ার ভাবভালোবাসায় সেই অপূর্ব স্বাদ ভুলতে পারিনি! কারণটা বোঝা গেল এতক্ষণে! রাস্তার ধারে দেখি হেলায় হয়ে আছে হলুদ, অরিগ্যানো। চিনিয়ে দেন গাইডসাহেব। হাতে নিয়ে সামান্য ঘষতেই সুগন্ধ ভরপুর! ভাবলাম, শহরে আমাদের কত কসরত করে সংগ্রহ করতে হয় এই মশলা, তা-ও আবার শুকনো! চলতে চলতে আচমকাই কুণ্ঠাভরে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রেমজি। জিজ্ঞেস করে, “মেরে ঘরমে খানা খাওগে? মামুলি খানা পর শান্তি বহোত হ্যায়!” আমি তো আহ্লাদে আটখানা। জিজ্ঞেস করি, “কতদূর তোমার গ্রাম?” শুনলাম আমাদের যাওয়ার রাস্তাতেই পড়বে।

Binsar
প্রেম যোশির (একেবারে বাঁয়ে) সঙ্গে লেখক (মাঝখানে) ও তাঁর বান্ধবী। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

প্রেমের গ্রামের নাম দল্লার। অনেকটা হাঁটার পর পৌঁছলাম ওঁর বাড়িতে। এত হাঁটার অভ্যেস তো নেই। হা-ক্লান্ত আমি দাওয়ায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। ঠান্ডা জল খেয়ে শান্তি হল। বেঁটে কাঁসার গ্লাসে অনেকটা দুধ দেওয়া চা এল। প্রেমের বৃদ্ধ বাবা ওই দাওয়াতেই বসে শাক বাছছিলেন। আমাকে পেয়ে নানান গপ্পো জুড়লেন। প্রেম এখনও বিয়ে করেননি। তাই তিনি মহা চিন্তিত। আমাকেও বললেন, যদি পাত্রী সন্ধানে থাকে আমার! বাড়িতে আছেন প্রেমের দাদা-বৌদি। সামনের ছোট্ট জমিতে সরষে শাক ফলেছে। মাচায় বাইছে আমাদের উচ্ছে গাছের মতোই কী একটা গাছ। ফলটা দেখতে কুঁদরির মতো।

Binsar food
প্রেমের বাড়ির উঠোনে বসে দুপুরের খাওয়া। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

খানিক পরেই খাবার এল। রোদে পিঠ দিয়ে গল্প করতে করতে খেলাম পেল্লায় এক ডেলা দেশি ঘি মাখানো উনুনে সেঁকা মোটা মোটা আটার রুটি, মুলো দিয়ে খেতের সর্ষে শাকভাজা, ঘন পাঁচমিশালি ডাল, কম তেলে পোড়া পোড়া আলুভাজা, মেথিফোড়নের সামান্য তিতকুটে স্বাদে অসামান্য। সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা আর মোটা দানার নুন, তাতে লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো। এত তৃপ্তি করে এত সুস্বাদু খাবার শেষ কবে খেয়েছি মনে পড়ে না। সেই খাবারের স্বাদ আর প্রেমের চোখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক আজও ভুলতে পারিনি।

কী করে ভুলি সূরয আর মিনাকে! অহলদারায় ৩১শে ডিসেম্বর রাতের পার্টি। আমি, আমার বান্ধবী, সূরয আর মিনা। বাগডোগরা থেকে দু’ঘণ্টার দূরত্বে অহলদারা। পাহাড়ের চূড়ায় গোলাকার ন্যাড়া ছাদ যেন। সেখানে বসে পা দোলাতে দোলাতে হাতছোঁয়া দূরত্বে বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। পাহাড়ের এমন ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ আগে পাইনি। আর এহেন অলীক, অবাস্তব ন্যাড়া ছাদে ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায়, ঝোড়ো হাওয়ায়, বেশ কয়েক প্রস্ত গরমজামা চাপিয়ে আগুনে ঝলসানো মাংস আর ওয়াইন খেতে খেতে গপ্পো জুড়েছিলাম সূরয আর মিনার সঙ্গে।

Ahaldara
অহলদারা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ! ছবি সৌজন্য – 100miles.co.in

অহলদারায় তিনটেই কটেজ আছে। একেবারে রূপকথার গল্পে পড়া বাড়ি। ছোট্ট কটেজ, তার সামনে কাঠের রেলিং দেওয়া আরও ছোট বারান্দা। পাহাড়ের একদিকে মংপু, একদিকে চটকপুর। পিছনে তাগদা-তিনচুলে। ভোরের চা থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা, রাতে ঘরে আলো দেওয়া সবকিছুর দায়িত্বেই সূরয। হাসিমুখ কর্মঠ ছেলেটি সবদিক সামলায়। আর মিনা হেঁশেলের দায়িত্বে সদাতৎপর। ওখানে একটা ছোট দোকানও চালায়। চিপস-চানাচুর-বিস্কুট-সাবানের বিকিকিনি চলে টুকটাক।

Latpanchor
অহলদারা ভিউপয়েন্ট থেকেই দেখা যায় লাটপাঞ্চোরের বিখ্যাত স্যালামান্ডার লেক। ছবি সৌজন্য – facebook.com

শ্যাম্পু করা খোলা চুলে সুন্দরী মিনা এসে হাজির ৩১শে রাতে নতুন বছরের ইনফর্মাল পার্টিতে। আমিই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ওদের দু’জনকে। ভালো গান গায় সূরয। পাহাড়ি ছেলেরা যেমন হয় আর কি…। গিটার হাতে গান জুড়েছিল – “কী করে বোঝাই তুমি যে আমার!” কলকাতা থেকে এসেছি শুনে ভেবেছিল এই গান আমার মন ভালো করবে। সে রাতে মিনা বানিয়েছিল ঝাল ঝাল লালচে রঙা ফ্রায়েড রাইস, ডাল, মটরশুঁটি দিয়ে আলু-ফুলকপির তরকারি, আলু দিয়ে চিকেন কারি, পাঁপড় আর স্যালাড! মিনার হাতে জাদু আছে, একবাক্যে মেনেছিলাম।

সূরযের গিটারের সুরের মতোই আজও মনে পড়ে রাজস্থানে টাঙ্গাওয়ালার গান – মেরে নয়না সাওন ভাদো! আজ থেকে অন্তত পঁচিশ বছর আগে। টাঙ্গাওালার নাম ছিল ছোটেলাল। ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঘোড়ার পায়ে বাঁধা ঘুঙুরের আওয়াজ আর ছোটের গলায় কিশোরের গান, রাজস্থানের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। এই প্রেম-মিনা-সূরয-ছোটেলালরাই আমার বেড়ানোর স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রাখে। এদের অতীতের স্মৃতি থেকে ধার করা রঙিন ভালো লাগাই এই করোনাকালে আমাকে সজীব রেখেছে।

সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *