বাড়িতে দুর্বৃত্ত হামলার অভিজ্ঞতা সবার হয় না। কিন্তু যদি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই হামলাকারীদের শত্রু মনে হবে আমাদের। চাইব, মরণ হোক ওদের। অভিশাপ দেব, গুষ্টিশুদ্ধু মরে যাক। ওদের সামনে বিপদ দেখলে নিশ্চয়ই আমাদের মনে কোনও সহানুভূতি জাগবে না। বরং হাততালি দিয়ে ভাবব, কেমন মজা, কেমন মজা! যেমন কর্ম, তেমন ফল।
পূর্ব মাদারিহাটের গ্রামবাসীরা কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলেন। নিজেদের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও হানাদারদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। পুরো দলটাই না হলে মারা পড়তে পারত। ঘটনাচক্রে দিনটা ছিল ৪৫ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির বর্ষপূর্তি। ১৯৭৫-এর ২৫ জুন মধ্যরাতে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের এক ঘোষণায় কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মানুষের প্রায় সব মৌলিক অধিকার। সাড়ে পাঁচ দশক পর ২০২০-র ২৫ জুন ভোর রাতে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুদের জীবন বাঁচালেন পূর্ব মাদারিহাটের বাসিন্দারা। একবারও ভাবলেন না, ওদের মরণ হলে বাঁচি।
শত্রুরা কিন্তু কেউ মানুষ নয়। একপাল হানাদার এসেছিল গ্রামটিতে। একটা বাড়ি তছনছ করছিল ভেঙে। বাড়ির পাশে একটার পর একটা সুপারিগাছ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল ওদের তাণ্ডবে। গাছ ভাঙার পটপট শব্দ আর ওদের চিৎকারে গ্রামে তখন ঘরে খিল দিয়ে ইষ্টনাম জপছেন স্থানীয় মানুষ। তাণ্ডব চলাকালীন একটা সুপারিগাছ ভেঙে পড়ার সময় ছিঁড়ে পড়ল বিদ্যুৎবাহী তার। মুহূর্তে প্রাণসংশয় এক হানাদারের। অন্যদেরও বিপদ হতে পারত যে কোনও সময়। পূর্ব মাদারিহাটের মানুষ কিন্তু “মরলে মরুক শত্রু” ভেবে ঘরে চুপ করে বসে ভগবানকে ধন্যবাদ দেননি। বরং একদিকে হানাদারদের সামনে পড়া, অন্যদিকে ছিঁড়ে পড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন। দৌড়ে গিয়ে গ্রামের বাইরে থেকে বিদ্যুৎকর্মীদের ডেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করিয়েছিলেন। একজন হানাদারের ততক্ষণে প্রাণ গিয়েছে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে। অন্যদের কোনওমতে বাঁচানো গেল। মরতে দেওয়ার বদলে, সেফ প্যাসেজ তৈরি করে গ্রাম থেকে অন্য হানাদারদের কিছুক্ষণের মধ্যে সরিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। প্রাণে বেঁচে নিজেদের আস্তানায় ফিরেছিল না-মানুষ হানাদাররা।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পেরেছেন পূর্ব মাদারিহাট গ্রামে এই বহিরাগতরা কারা? নিজেদের জীবন বিপন্ন করে কাদের প্রাণ বাঁচালেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা! ঠিক ধরেছেন, সেদিন পূর্ব মাদারিহাটে চড়াও হয়েছিল একদল হাতি।
খবরটা নিশ্চয়ই অনেকে সংবাদপত্রে পড়েছেন, টেলিভিশনে দেখেছেন। হাতির প্রতি উত্তরবঙ্গের মানুষের ভালোবাসার নানা ঘটনা আগেও এই কলামে বলা হয়েছে। আবার হাতিরা অনেক সময় কী ভাবে মানুষকে আগলে রাখে, তার নিদর্শনও দিয়েছি। কিন্তু সবসময় বনের খবর এমন ‘ফিল গুড’ থাকে না।
পূর্ব মাদারিহাটের এই ঘটনার পক্ষকাল আগে আলিপুরদুয়ার জেলায় রায়ডাক বনের কাছে মারাখাতা গ্রামেই অন্য ঘটনা নজরে এসেছিল সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে। ওই ঘটনায় একটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই। আর সে জন্য দায়ী মানুষ। বিদ্যুতের তার থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎবাহী বেড়া বানিয়েছিল এক পরিবার। বাড়ি ও জমির সুরক্ষায় এই ব্যবস্থা অনৈতিক হলেও খুবই প্রচলিত এখন। আর এই বেড়ার সংস্পর্শে এসে হাতি-মৃত্যুও আকছার ঘটে। মারা না গেলেও এর ফলে অনেক সময়ই মারাত্মক আহত হয় হাতি। এবং সেই জখম হাতিরা পরবর্তী সময়ে মানুষের কাছে মূর্তিমান যম হয়ে ওঠে।
শুধু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট নয়, আরও নানা ভাবে হাতিদের উত্যক্ত করা হয়ে থাকে। কখনও ঢিল জুড়ে, কখনও গায়ে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে মেরে বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। রক্তাক্ত হলেও সেই আঘাত নিয়ে বেঁচে থাকা হাতিও হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। সে সময় ওদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা অনেক ক্রাইম থ্রিলারকে হার মানাতে পারে। হাতিদের জীবন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন সম্পৎ সিং বিস্ত। এ রাজ্যের প্রাক্তন চিফ ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন পদে থেকে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পে। হাতিদের সম্পর্কে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল মানুষ। বেশ কয়েক বছর পেশাগত কারণে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি জঙ্গলে। তাঁর সঙ্গে থাকা মানেই জঙ্গল ও জীবজগৎ নিয়ে আর রোমহর্ষক বা রোম্যান্টিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনা। হাতিদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার দু’টি গল্প তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম।

একটি ডুয়ার্সের এক গ্রামের। বন-লাগোয়া গ্রামে বন্যপ্রাণির হাত থেকে ফসল বাঁচানোর তাগিদে জমিতে উঁচু মাচা বেঁধে পাহারা দেওয়ার রীতি আছে। ওইরকম এক মাচায় স্থানীয় তিন গ্রামবাসী পাহারা দেওয়ার জন্য উঠেছিলেন। গভীর রাতে পাশাপাশি শুয়ে তিনজনেরই চোখ লেগে গিয়েছিল। কেউ টের পাননি, কখন মাচার কাছে চুপিসারে হাজির হয়ে গিয়েছে হাতি। আচমকা কোনও কিছুর ধাক্কায় সকলের ঘুম ভাঙল। হাতিটি ওই তিনজনের একজনকে শুঁড়ে জড়িয়ে টেনে নামিয়েছিল মাচা থেকে। তারপর আছড়ে মাটিতে ফেলে পায়ে পিষে মেরে ফেলে নির্বিবাদে ফিরে গিয়েছিল জঙ্গলে। মিস্টার বিস্ত খবর পেয়ে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। খোঁজখবর করতে গিয়ে বুঝলেন, দাল মে কুছ কালা হ্যায়। এমনি এমনি অকারণে তিনজনের মধ্যে একজনকে মারেনি হাতি। তার রীতিমতো প্রেক্ষাপট আছে।
কিন্তু কী থেকে সন্দেহ হল বিস্ত সাহেবের? একটা বিশেষ তথ্য তাঁকে কৌতূহলী করে তোলে। সেটা হল, হাতি যাঁকে মেরেছিল, তিনি শুয়েছিলেন অন্য দু’জনের মাঝে। এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক, কারণ সাধারণ জ্ঞান বলে, দু’পাশে যাঁরা শুয়েছিলেন, তাঁদের টেনে নামানো হানাদার হাতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল। তা না করে, এমনকি অন্য দু’জনের কোনও ক্ষতিই না করে মাঝের জনকে নামাতে হাতিকে বাড়তি কিছুটা কসরত করতে হয়েছে বৈকি! কিন্তু কেন সে এটা করল? অনুসন্ধান করে বিস্ত জানলেন, বেশ কয়েক বছর আগে এই হাতিটি তিরবিদ্ধ হয়েছিল। তির যিনি মেরেছিলেন, তাঁরই ইন্তেকাল ঘটিয়েছে হাতিটি। অন্য দু’জনকে ছুঁয়েও দেখেনি। হাতিটি চিনে রেখেছিল ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। এই চিনে রাখার ব্যাপারে ওস্তাদ হাতি। কথায় বলে এলিফ্যান্টাইন মেমোরি! তারই সাক্ষাৎ উদাহরণ ছিল ওই ঘটনায়। আর ক্ষতি না করলে হাতি যে সহজে কাউকে মারে না, সেটারও প্রমাণ ডুয়ার্সের ওই গ্রামের ঘটনাটি।
এরকম একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমারও আছে। আমি তখন আলিপুরদুয়ার জেলায় মহাকালগুড়ি গ্রামে আমার পৈতৃক বাড়িতে থাকি। সালটা ১৯৯১। রায়ডাক জঙ্গল থেকে হাতি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। হাতির এরকম পাড়া বেড়ানো উত্তরবঙ্গের জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। হাতি একাই এসেছিল নিঃশব্দে। আমরা টের পাইনি। আমাদের সেপটিক ট্যাংকটা ছিল বাড়ির পিছন দিকে। এখনকার মতো বাড়ির তলায় নয়। হাতি হেলতে দুলতে পিছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে আসছিল। পথে পড়ে সেপটিক ট্যাঙ্ক। হাতি তো আর জানে না যে, ওর গোদা পায়ের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ট্যাংকে কংক্রিটের নেই! ফলে ওর পায়ের চাপে গুঁড়িয়ে যায় ট্যাংকের ওপরটা। তারপর সে গাছের ডালপালা ভেঙে পাতা খেয়েছে, কলাগাছ খেয়েছে রাতভর। আমরা কিছুই টের পাইনি। বাবা একসময় টের পেলেন হুড়মুড় হুড়মুড় শব্দে। বাবার মনে হয়েছিল, মাটি কাঁপিয়ে যেন বিশাল বপু কোনও দৈত্য দানব চলে গেল। খানিকটা ভয় পেয়েই বাবা চুপ করেছিলেন। রাতে কাউকে বলেননি। পরদিন সকালে মা রান্নাঘরের জানালা খুলে দেখেন, পিছনের বাগানে যেন কেউ তাণ্ডব করে গিয়েছে। শুনে আমরা গিয়ে দেখি, বাড়ির সামনে ইলেকট্রিক পোস্ট থেকে বাড়ির মিটার বক্সের সঙ্গে সংযোগকারী তারটা ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে আছে। শুকনো বাঁশ দিয়ে তার সরাতে যেতে শুকনো পাতার ঘষায় বিদ্যুতের ঝলকানি দেখলাম। বুঝলাম, এই কারণেই রাতে লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল। তখন অবশ্য ভেবেছিলাম, গ্রামে তো এসব স্বাভাবিক। যখন তখন বিদ্যুৎ হাওয়া হয়ে যায়। সকালে ছেঁড়া তার দেখে আদত কারণটা বুঝলাম।
কিন্তু কী থেকে সন্দেহ হল বিস্ত সাহেবের? একটা বিশেষ তথ্য তাঁকে কৌতূহলি করে তোলে। সেটা হল, হাতি যাঁকে মেরেছিল, তিনি শুয়েছিলেন অন্য দু’জনের মাঝে। এটা অত্যন্ত অস্বাভাববিক, কারণ সাধারণ জ্ঞান বলে, দু’পাশে যাঁরা শুয়েছিলেন, তাঁদের টেনে নামানো হানাদার হাতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল। তা না করে, এমনকি অন্য দু’জনের কোনও ক্ষতিই না করে মাঝের জনকে নামাতে হাতিকে বাড়তি কিছুটা কসরত করতে হয়েছে বৈকি! কিন্তু কেন সে এটা করল?
এরপর বাড়ির পিছনে মাটিতে হাতির পায়ের ছাপ দেখে বোঝা গেল, আগের রাতে মহাকালবাবা (এভাবেই সম্বোধন করা হয় ওই এলাকায়) দয়া করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ডালপালা ভাঙার সময় সম্ভবত ইলেকট্রিক তারটা ওর শুঁড়ে ঠেকেছিল। উনি সম্ভবত সেটাকেও ডাল ভেবে ভাঙতে গেছিলেন। তার তো আর ভাঙে না। মোটা তার ছিঁড়ে গিয়েছে শক্তিমানের শুঁড়ের টানে। তখনই বোধহয় ইলেকট্রিক শক খেয়েছিলেন মহাকাল। তাই রাগে সব লন্ডভন্ড করে ফিরে গেছিলেন। যেখানে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়েছিল, তার পাশের ঘরেই ছিলেন বাবা। হাতি ইচ্ছে করলে সামান্য দোলা দিয়ে ঘরটা ভেঙে ফেলতে পারত। ও কিন্তু নিজে ব্যথা পেলেও আমাদের কারও কোনও ক্ষতি না করে ফিরে গিয়েছে। পরে অভিজ্ঞ বনকর্মীরা আমাকে বলেছিলেন,আমরা ওর কোনও ক্ষতি করিনি বা বাধা দিইনি বলে হাতিও আমাদের কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে গিয়েছিল।
অথচ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে হাতির কী ভয়ঙ্কর চেহারা হতে পারে, তা-ও আমার নিজের চোখেই দেখা। আমার তখন কাঁঠালগুড়ি চা বাগানে নিয়মিত যাতায়াত। থাকিও সেখানে। জলপাইগুড়ি জেলায় বানারহাটের কাছে ভুটানের সামচির পথের বাঁ ধারে ছবির মতো দেখতে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগানটি। তখনও বাগান বাঙালি মালিকানায়। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত রায় গ্রুপ কাঁঠালগুড়ির তখনকার মালিক। বাগানের মূল ডিভিশনের শ্রমিক মহল্লার পাশে নদীর বাঁধ। কালাপানি নদী। সারা বছর তেমন জল না থাকলেও অনেকটা চওড়া। এক কিলোমিটার তো হবেই। দৌড়ে নদী পার হলেই ভুটান পাহাড়। পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই বিদেশ ঘুরে আসা যায়। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই কালাপানি নদীর বাঁধ-ঘেঁষা সামান্য জমিতে চা-শ্রমিকদের কেউ কেউ ধান আবাদ করেন। পাকা ফসল উঠলে প্রথমে গাদা করে রাখেন। এ রকমই এক ধানকাটার মরশুমে হঠাৎ কানে এল বাঁধের দিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি। মশালের আলোও দেখলাম। আমি বাঁধের কাছে শ্রমিক ক্লাবে থাকতাম। চিৎকার শুনে গেলাম দেখতে। গিয়ে দেখি, হাতি এসেছে গাদা করা ধানের আঁটি টেনে খেতে। স্বাভাবিক ভাবেই পরিশ্রমের ফসল এভাবে নষ্ট হতে দেখলে কারই বা মাথার ঠিক থাকে। সবাই তো আর গণেশবাবাকে বাৎসরিক খাজনা দেওয়ার জন্য মাঠে কিছু ফসল ফেলে রাখে না! কাজেই উপস্থিত সবাই যে যার মতো করে হাতিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কেউ পাথর ছুড়ে মারছে, কেউ পটকা ফাটাচ্ছে, কেউ টিনের বাক্স পেটাচ্ছে, কেউ আবার মশাল হাতে চিৎকার করছে। হাতি কিন্তু নট নড়নচড়ন। সে একমনে গাদা থেকে আঁটি টেনে ধান খেয়ে চলেছে। শেষপর্যন্ত উঠতি বয়সের একটি ছেলে মরিয়া হয়ে জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে দিল হাতির দিকে। মশালটা হাতির পিঠ ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ততক্ষণে আগুনের তাপ পিঠে ভালোই লেগেছে মহাকালবাবার। বিরক্ত হাতি কিন্তু তেড়ে এল না। মাটি থেকে শুঁড়ে মশালের ডান্ডাটা পেঁচিয়ে ওপরে তুলল। তারপর জোরে ছুড়ে দিল ধানের গাদায়। মুহুর্তে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শ্রমিকদের ঘাম, অর্থে তৈরি হওয়া ধানের মজুত ভাণ্ডার। হাতি ততক্ষণে কালাপানি নদী পেরিয়ে জঙ্গলের পথ ধরেছে। ভাবটা যেন, “দ্যাখ কেমন লাগে। আমাকে তো খেতে দিলি না। এখন তোরাও আর পেলি না এই ধান!”
একই সঙ্গে হাতির প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেখে অন্ধকার রাতে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর গমনপথের দিকে। গজেন্দ্রগমনেই হাতি ফিরছিল নিজের আস্তানায়। ওই পথের একধারে ভূটানের ঘন জঙ্গল। অন্যদিকে, বান্দাপানি, মাকড়াপাড়া পর্যন্ত ভারতের বনভূমি। এ যে ওদেরই বাসভূমি। আদি, অনন্তকাল ধরে। এ পথ ওদেরই। হাতি চলাচলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটা পথ অনুসরণ করে। ফেরেও সেই পথে। এর নড়চড় হয় কদাচিৎ। কোনও দুর্বিপাকের ফেরে। সেই জন্যই বলা হয় হাতির করিডর। সেই করিডর কিন্তু ছিন্ন করেছে মানুষ।

সভ্যতা যত এগিয়েছে, তত শুধু হাতি নয়, সমস্ত বন্যপ্রাণি, এমনকি বনবাসীদের আমরা নিজভূমে পরবাসী করেছি। ওদের করিডর দখল করে তৈরি হয়েছে একের পর এক চা-বাগান। শ্রমিক মহল্লাগুলোও অনেক ক্ষেত্রে হাতিদের করিডরের ওপরেই। সেই জন্যই শ্রমিক মহল্লায় ফিরে ফিরে আসে হাতির দল। ওদের করিডরের গাছ কেটে বসানো হয়েছে রেললাইন। এমনকি বিন্নাগুড়ি মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টটাই হাতির আদি করিডর। সেই জন্য এখনও মাঝে মাঝে হাতি হানা দেয় ক্যান্টনমেন্টে। মিলিটারি যত বলশালীই হোক না কেন, হাতি নিজে থেকে বিদেয় না হওয়া পর্যন্ত তটস্থ থাকেন বিশাল ক্যান্টনমেন্ট চত্বরের সামরিক কর্তা, জওয়ানরা। হাতিকে মোকাবিলা করার চেয়ে তখন ওঁদের মনে হয়, পাক সেনাকে রোখা বেশি সহজ। যাদের আমরা ছিন্নমূল করেছি, তারা যদি মাঝে মাঝে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, তবে খুব দোষ দেওয়া যায় কী? তাও তো সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এগিয়ে আসে না! দলবদ্ধ হয়ে থাকলে ওরা বরং বেশি নিরীহ। দলবিচ্ছিন্ন দু’একটা হাতি মাঝে মাঝে উপদ্রব করে।
এর দায় তো আমাদের! একে তো নিজ বাসভূমি থেকে ওদের উৎখাত করেছি আমরা। চলাচলের পথ কেড়ে নিয়েছি। আমাদের ট্রেনের ধাক্কায় হাতির ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া তো এই অঞ্চলে প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার। তার ওপর কারণে অকারণে উপদ্রব তো কম করি না! ঢিল মারি, তির ছুড়ি, মশালের আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করি, কখনও সুযোগ পেলে ধারালো অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষতও করি। তারপরে হাতিরা যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে কখনও কখনও, সে দোষ কী মানুষের নয়? প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হাতি কিন্তু ঠিক চিনে রাখে, কে তার শত্রু, কে তার মিত্র। সকলের যেমন ক্ষতি করে না হাতি, তেমনই সবাইকে আগলেও রাখে না। তাই এই না-মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত জীবটি সম্পর্কে আমাদেরই অতিরিক্ত সাবধান থাকা জরুরি।

এই লেখাটি শেষ করব হাতির আরও একটি প্রতিহিংসাপরায়ণতার গল্প দিয়ে। এ গল্পটিও আমার শোনা হাতি বিশেষজ্ঞ সম্পৎ সিং বিস্তের কাছ থেকে। গল্পটি অবশ্য বাংলার নয়, উত্তরাখণ্ডের। বিস্ত নিজেও উত্তরাখণ্ডের মানুষ। গাড়োয়ালি। তরতরিয়ে পাহাড় বাইতে পারেন। বক্সা পাহাড়েও ওঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমি হিমশিম খেতাম। সে সব অন্য কাহিনি। হাতিকথনে আসি।
উত্তরাখণ্ডে এক যুবক কোনও এক হাতিকে ঢিল মেরেছিল। মেরে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঢিলে বোধহয় ভালোই চোট পেয়েছিল হাতিটি। ঢিলটি সে শুঁড়ে তুলে নিয়েছিল। কখনও কাছছাড়া করতো না পাথরখণ্ডটিকে। খাওয়ার সময় শুধু শুঁড় থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখত। খাওয়া হয়ে গেলে আবার পাথরটা শুঁড়ে তুলে পথ চলতো। বিশ্রাম নেওয়ার সময়েও পাশে থাকত পাথরটা। প্রায় বছর দু’য়েক পর ঘটনাচক্রে হাতিটির সামনে পড়ে যায় সেই ঢিল ছোড়া যুবক। মুহুর্তে তাকে চিনতে পেরে সে আর দেরি করেনি। শুঁড় থেকেই সোজা পাথর ছুড়ে মেরেছিল যুবকটির মাথায়। আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি ওই যুবক। সেখানেই ভবলীলা সাঙ্গ। আমাদের বোধহয় সময় থাকতে সাবধান হওয়া ভালো!
কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।
good story on elephant character