নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের এই গল্পটা আজকের তারিখে বললে হয়ত ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ শোনাবে। তবু। সাংবাদিক জীবনের গোড়ায় এক নবীন দৈনিকে কাজ করতাম। সেখানে এক ভদ্রলোক আসতেন কাছের কোনও জেলা থেকে, যিনি নিয়মিত কর্মী নন। স্ট্রিঙ্গার গোছের। খবর ছাপা হলে পয়সা পেতেন। কিন্তু তাঁর দেওয়া খবর প্রায় প্রতিটাই ছাপা হত। তার কারণটা, জনান্তিকে তাঁর যে ডাকনাম, সেটা বললেই বোঝা যাবে। নেহাতই ভালমানুষ লোকটিকে ডাকা হত ‘ধানক্ষেতে ধর্ষণ’ বলে। তাঁর নাকি অসম্ভব পারদর্শিতা ছিল এই ধরনের খবর জোগাড়ে। এবং খবরের কাগজের পাতা সাজাতে গিয়ে প্রায়শই এমন এক চিলতে ছোট জায়গা বাকি থেকে যেত, যেখানে অমন একটি খবর একেবারে মাপসই হয়ে যেত।

যেটা তখন মনে হয়নি, কিন্তু পরে প্রশ্ন জেগেছে, যে ছোট মাপের আর কোনও খবর কি থাকত না, যে ওই ধরনের খবরই বার বার দিতে হত? না, তা বোধহয় নয়। কিন্তু বাংলা খবরের কাগজের ধর্ম মেনে আপাদমস্তক রাজনীতি এবং শেষ তিন–চার পাতা খেলার খবরে ঠাসা একটা জমজমাট পরিবেশনে মশলার কাজ করত অকিঞ্চিৎকর ওই ধর্ষণের খবর। নয়ত শিক্ষিত বাঙালির কবেই বা কী এসে গেছে, কোন গন্ডগ্রামে কে মেয়ে ধর্ষিত হল, তার বয়ানে? কিন্তু খবরটা পড়ত নিশ্চয়ই। যত ছোট খবরই হোক, এ ধরনের টাকনা আলুনি রান্নাকেও একটু সুস্বাদু করে তোলে। ফলে প্রতি রাতে যাঁরা পাতায় খবর সাজানোর কাজ করতেন, তাঁরা অবলীলায় হাঁক পাড়তেন— এই দেখ তো, কোনও ছোটখাট ধানক্ষেতে ধর্ষণ আছে কি না।
দোষটা কখনওই কেবল সংবাদ মাধ্যমের নয়। খেয়াল করে দেখবেন, অতি বড় মর্মান্তিক মৃত্যুতেও আত্মীয়বন্ধু কেমন হামলে পড়ে জানতে চায়, ঠিক কী হয়েছিল? মানে, ঠিক কীভাবে মারা গেলেন? শেষ সময় কারা পাশে ছিল?
এই যে ধর্ষণের মতো বিষয়কেও লঘু করে দেখার প্রবণতা, সংবাদদাতা এবং পাঠক, দু’ তরফেই, এটাই শেষ পর্যন্ত মশলাদার, মুখরোচক খবরের মূল উৎস হয়ে ওঠে। পাঠক জানতেও পারে না, কখন সে আদর্শ ‘টার্গেট’ হয়ে গেছে। এবং দোষটা কখনওই কেবল সংবাদ মাধ্যমের নয়। খেয়াল করে দেখবেন, অতি বড় মর্মান্তিক মৃত্যুতেও আত্মীয়বন্ধু কেমন হামলে পড়ে জানতে চায়, ঠিক কী হয়েছিল? মানে, ঠিক কীভাবে মারা গেলেন? শেষ সময় কারা পাশে ছিল? ছেলে আসতে পেরেছিল? মেয়ে–জামাই? চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছিল তো? কোন ডাক্তার দেখছিলেন? ভাল? একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেওয়া হয়েছিল নিশ্চয়ই? একজন মৃত মানুষের শোকগ্রস্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে এই একটা প্রশ্নের উত্তরও জরুরি নয়। তাও লোকে জিজ্ঞেস করে। অদম্য কৌতুহল তাদের। ঠিক কী হয়েছিল? আসলে ঠিক–টা নয়, তারা জানতে চায়, কোথায় ভুল হয়েছিল!
আর এই ভুল খুঁজে আনন্দ পাওয়ার বিকার থেকে কী হয় জানেন? লোকে চূড়ান্ত অস্বাভাবিকতার মধ্যেও বিনোদন খুঁজে ফেরে। ভয়ঙ্কর ধর্ষণের ঘটনাতে যখন জানা যায়, গণধর্ষণের পর মেয়েটির যৌনাঙ্গে লোহার রড গুঁজে দেওয়া হয়েছে এবং তাতেও রাগ না মেটায় হাত ঢুকিয়ে ছিঁড়ে বের করে আনা হয়েছে ভেতরের প্রত্যঙ্গ— লোকে সেই বর্ণনা বার বার পড়ে। যখন আলোচনা হয়, ওই বিষয়গুলোই ঘুরে ফিরে আসে। যদি আপনি ভাবেন, যে না, আমি বিভৎসতা এড়িয়ে চলি, আমি অতটা খারাপ নই, তা হলেও কিন্তু আপনি সকালে উঠে পড়েন, ধর্ষণের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলার আগে অপরাধী রাতের খাবারে কী খেয়েছিল! পোস্তর বড়া, নাকি কুমড়োফুল ভাজা। একটা জঘন্য অপরাধ, এমনকী তার কঠোরতম সাজাও মুহূর্তে গুরুত্বহীন হয়ে যায় ওই অশ্লীল কৌতুহলের কাছে। ফাঁসির দড়িটা গলায় পরানোর সময় ডাক ছেড়ে কেঁদেছিল কি? আর বাড়িতে? বৃদ্ধ বাপ–মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? আর কমবয়সি বউটা? সে কী করেছিল?

এবং এই সমস্ত প্রতিক্রিয়ার কোনওটা যদি আপনার চেনা ছকে না পড়ে, তা হলে আলোচনায় নতুন ফোড়ন পড়ে। নতুন মশলা আপনি নিজেই খুঁজে নেন। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কাণ্ড। বাবা, দিদি এবং প্রিয় পোষ্যরা মারা যাওয়ার পর একজন, যিনি নিশ্চিতভাবেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন, প্রিয়জনেদের কঙ্কালের সঙ্গে সহবাস করছিলেন। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম সে’সময় যেভাবে ওই পচে গলে শুকিয়ে যাওয়া লাশগুলো নিয়ে মোচ্ছবে মেতেছিল, যেভাবে বাবা, মেয়ে এবং ছেলের সম্পর্কের মধ্যে সম্ভাব্য যে কোনও রকমের বিকৃতির পোকা খুঁজে পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, স্বঘোষিত মনস্তত্ববিদ আর সমাজতাত্ত্বিকরা যেভাবে আবর্জনা ঘাঁটতে নেমে পড়েছিলেন কোমর বেঁধে, তার তুলনা মেলা ভার। এগুলোই কিন্তু মশলা, হে পাঠক, যা আপনি খোঁজেন। স্বাভাবিক মনোবিকলনে আপনার মন ভরে না, যেহেতু আপনি গভীরতর কেচ্ছাপ্রত্যাশী।
একটা জঘন্য অপরাধ, এমনকী তার কঠোরতম সাজাও মুহূর্তে গুরুত্বহীন হয়ে যায় ওই অশ্লীল কৌতুহলের কাছে। ফাঁসির দড়িটা গলায় পরানোর সময় ডাক ছেড়ে কেঁদেছিল কি? আর বাড়িতে? বৃদ্ধ বাপ–মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? আর কমবয়সি বউটা? সে কী করেছিল?
অথবা একেবারে হালের উদাহরণটাই ধরুন। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত–এর আত্মহত্যা। একজন প্রতিভাবান অভিনেতার মৃত্যুতে আপনি যতটা দুঃখিত, তার থেকে অনেক বেশি কৌতুহলী জানতে, যে কী হয়েছিল? ভেতরের গল্পটা কী? সুশান্তের পরিবার একটি টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যারা পাটনা গিয়ে সুশান্তের বাড়ির ঠিক বাইরে, প্রতিটা দরজা–জানলা ক্যামেরার সতর্ক নজরে বন্দি রেখেছিল স্রেফ এটা আপনাদের জানাতে, যে ছেলের মৃত্যুতে বাবা, বা পরিবারের অন্যরা ঠিক কতটা দুঃখিত। এখনও বিরাম নেই জানানোয়, যে সুশান্তের বান্ধবী সঙ্গেই ছিল, না ছেড়ে গিয়েছিল। মেয়েটির সঙ্গে এক প্রবীণ পরিচালক, যিনি পুরনো খেলোয়াড়, তাঁর একটা সমান্তরাল ঘনিষ্ঠতা ছিল না? এই মশলাগুলো না পেলে আত্মহননের খবরটা ঠিক জমছে না। কাজ পাচ্ছিল না, স্রেফ হতাশ হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে গেল— এটা কি একটা মুখরোচক খবর হল নাকি!
ফলে সদ্য সন্তানহারা মায়ের মুখের সামনে ধরা হয় টিভি–র ‘বুম’। জানতে চাওয়া হয়, আচ্ছা, শেষ আপনাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল? যেন একজন শোকসন্তপ্ত মায়ের থেকে সেটা জানা এবং জানানোটা খুব জরুরি। যে নবীন পুলিশকর্মী জঙ্গি দমন অভিযানে গিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন, তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর আছাড়ি পিছাড়ি কান্না দেখিয়ে যাওয়া, লাগাতার দেখিয়ে যাওয়া জরুরি। মজার কথা হচ্ছে, সেই মেয়েটিই যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়, যেহেতু তার সাজপোশাক, চালচলন অকালবিধবার চেনা চেহারার সঙ্গে মিলছে না, আবার ক্যামেরা তার পিছু ধাওয়া করে। খোঁজ নিতে যাওয়া হয় মেয়েটির শ্বশুরবাড়িতে। ঠারেঠোরে জানতে চাওয়া হয়, ওদের সম্পর্কটা আদৌ ঠিক ছিল তো? নাকি ওই শোকে মূর্ছা যাওয়া আসলে কুশলী অভিনয়? আর এখন? কার সঙ্গে আশনাই চলছে?
আর এসবের বাইরে যে মশলাদার খবর তৈরি হয়, আপনি ধরে নিতে পারেন, সে সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাধারণত কাউকে বেকায়দায় ফেলতে। যার সুনাম নষ্ট হওয়ার ভয় আছে। একটা কেচ্ছা বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দাও। তার পর সে ব্যাটা নাজেহাল হোক সেটা মিথ্যে প্রমাণ করতে। ইদানিং সোশাল মিডিয়া হয়ে কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। সেই ভার্চুয়াল বিশ্বে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সবাই ন্যায়নীতির পরাকাষ্ঠা। সবাই বিচারক, সবাই ঘাতক। শাস্তিবিধান হয়ে যায় নিমেষে। মুহূর্তে ছিন্ন শির ধূলায় লুটায়।
এই মশলাগুলো না পেলে আত্মহননের খবরটা ঠিক জমছে না। কাজ পাচ্ছিল না, স্রেফ হতাশ হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে গেল— এটা কি একটা মুখরোচক খবর হল নাকি!
হে নেটিজেন, সে আয়োজনও আপনার নিত্যকার সামাজিক বিনোদনকে সুস্বাদু করে তুলতে। শুধু আপনাকে বুঝতে দেওয়া হবে না, যে এত মশলা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। হয়ত মারা যাবেন না, মানে এক্কেবারে মরে যাবেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পচে গলে চলমান লাশ হয়ে যাবেন এক একজন। জীবন্মৃত। পচে ভূত হবে আপনার সমাজ, আপনার সভ্যতা। এত মশলা খেয়ে যে অজীর্ণ রোগ হবে আপনার, ক্রমাগত যে চোঁয়া ঢেঁকুর তুলবেন, সেটাকেই তৃপ্তি বলে মেনে নিতে শিখবেন একদিন। আর বিনা প্রশ্নে, প্রতিবাদহীনভাবে চারপাশে এই নৈরাজ্য চলতে দিলে? তখন আর খেতেও হবে না, স্রেফ ঝাঁঝেই মরে যাবেন!
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় সাংবাদিক। একাধিক বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল এবং জার্মান রেডিওর বাংলা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস শার্দূল সুন্দরীর বিপুল জনপ্রিয়তার পর লিখেছেন একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চোদ্দ। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে শার্দূল সুন্দরীর ইংরেজি অনুবাদ।
টিভি দেখা ছেড়েছি বহু আগেই। দেখলেও শুধুমাত্র গানের অনুষ্ঠান বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। এখন খবরের কাগজের পাতা উল্টে উল্টে চলে যাই। মনেই হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই- এই কাটাছেঁড়া নিতে পারছি না।
আজ বুঝলাম- কেন।