লেয়ার খুব ভালবাসেন। কাজে, মননে, ব্যক্তিত্বে তারই প্রতিফলন। সিনেমা, সিরিয়াল, ফ্যাশন শো, ক্যাফে, গান, অভিনয় — এই সবকিছু জুড়ে বিস্তৃত তাঁর ক্যানভাস। তাই তিনি ব্র্যান্ড বহুরূপীর সফল সৃষ্টিকর্তা!ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক রায়ের সঙ্গে আড্ডায় শর্মিলা বসুঠাকুর।
শর্মিলা – আপনার ছেলেবেলার কথা কিছু বলুন।
অভিষেক – আমার জন্ম কলকাতায়। বেড়ে ওঠা শান্তিনিকেতনে দাদু দিদার কাছে। আমার ছেলেবেলা তাই খোলামেলা প্রকৃতির বুকেই কেটেছে। গাছপালা, লাল মাটির রাস্তা, পাখির কলতান, গোধূলি বেলার কমলা আলোর মায়া, এইসব নিয়েই দারুণ সময় কেটেছে শৈশবে।
শর্মিলা – আপনি তো কলাভবনের ছাত্র?
অভিষেক – হ্যাঁ। গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন দু’টোই কলাভবন থেকে।
শর্মিলা – ডিজাইনকে বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন কেন?
অভিষেক – আমার দাদু শিল্পী ছিলেন, কলাভবনের অধ্যক্ষও ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশ হয়তো অজান্তেই ছাপ ফেলেছে। তবে এমনিতেই আমার বাড়ির পরিবেশ খুব খোলামেলা ধরনের ছিল। তোমার যা ভালো লাগে তাই তুমি কর। আর আমার আর্টের দিকে ঝোঁক বরাবরই।

শর্মিলা – কী ভাবে কর্মজীবনের পথ চলা শুরু?
অভিষেক – কলাভবন থেক পাশ করে বেরনোর পর ছোট একটা ছবিতে একজনকে অ্যাসিস্ট করার সুযোগ পাই। তারপর একে একে নানা ধরনের অফার আসতে থাকে। আমার আসলে বরাবরই আত্মবিশ্বাস ছিল যে কিছু একটা করবই।
শর্মিলা – আপনি তো টেক্সটাইল ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন?
অভিষেক – হ্যাঁ।
শর্মিলা – এই যে আপনি পোশাক ডিজাইনিং করেন, প্রচুর টেলিভিশন সিরিয়ালে পোশাক ডিজাইন করেন, তার কি নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি আছে?
অভিষেক – সিরিয়াল বা ছবির ক্ষেত্রেও সবার প্রথমে জানা দরকার চরিত্রটা। অর্থাৎ কার পোশাক বানাতে হবে। তারপর সেই অনুযায়ী এগনো। আমি সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াতাম। নিজের জন্যই। কোথায় কী পাওয়া যায়, কোন কাপড় কোথায় ভাল, সব জানার চেষ্টা করতাম। কোনও গল্পে চরিত্র গড়ে তোলার জন্য এটা খুব জরুরি। কস্টিউম ডিজাইনারের জন্য খুব দরকার এই পদ্ধতি।
শর্মিলা – নিজের ব্র্যান্ড কবে শুরু করলেন?
অভিষেক – ২০১৫ সালে। আমি তো টেক্সটাইল ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করেছি। অনেকগুলো টেক্সটাইল ডেভেলপ করলাম এই সময়। শ্রীরামপুরে প্রিন্টিং স্টুডিও থেকে প্রিন্ট করলাম। শো করলাম। সাড়া পেলাম ভালোই।

শর্মিলা – ব্র্যান্ডের নাম বহুরূপী দিলেন কেন?
অভিষেক – আসলে বন্ধুরা আমাকে তাই বলে। এক তো বহু রকম ব্যাপারে আমার উৎসাহ। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, বাড়ি সাজানো। সেই দিক থেকে বহু রূপ! তবে আমি মনে করি একজন ডিজাইনারের দায়িত্বই হল নতুন নতুন লুক সৃষ্টি করা, এক রকম নয়। তাই বহুরূপী। এখন অবশ্য ‘বহুরূপী শান্তিনিকেতন’ নাম হয়েছে। শিকড়ে ফেরার চেষ্টা।
শর্মিলা – হ্যাঁ, আপনার ক্যানভাস তো বিরাট। তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছি। আপনার নিজস্ব কালেকশনের সেন্সিবিলিটি আর সিনেমা-সিরিয়ালের কাজ, একেবারে আলাদা ধরনের, আলাদা মাত্রার।
অভিষেক – সেটা তো হবেই। কারণ আমি যখন সিনেমা, সিরিয়ালের কাজ করছি, সেখানে আমার ডিজাইন সেন্সিবিলিটির চেয়েও বড় দায়িত্ব হল চরিত্রটা ডেভেলপ করা। তার পরতগুলো আবিষ্কার করে। সেই এস্থেটিক ব্যালেন্সটা কাজের মধ্যে থাকা দরকার।

শর্মিলা – এই স্যুইচ-ওভারে অসুবিধে হয় না?
অভিষেক – না না। একেবারেই না। বরং নিজের এস্থেটিক সেন্সটা আরও শক্তিশালী হয়। কারণ সেই কাজটা আমাকে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের বাইরে গিয়ে করতে হচ্ছে। সেটা জীবনের এবং কাজের ক্ষেত্রে একটা খুব বড়ো শিক্ষা। আর নিজের কালেকশনে তো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে যা ইচ্ছে করার।
শর্মিলা – এখন নানা রকমের মিক্সড কাপড়ে বাজার ছেয়ে গেছে। লিনেনের নামে যা খুশি বিক্রি হচ্ছে। পাওয়ারলুমের কাপড় হ্যান্ডলুম বলে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ কিনছেও। এর ফলে খাঁটি জিনিসের কদর থাকছে না। আমাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। ফ্যাশন দুনিয়াতে এর প্রভাব কেমন?
অভিষেক – মাস স্কেলে কিছু করা মানেই কোয়ালিটি ফল করবে। এখন আসলে ট্রেন্ড ফলো করার ধুম বেশি। মানুষ লিনেন চাইছেন। তাঁদের তো তেমন জ্ঞান নেই! এ বার বিক্রেতারা বিক্রি করতে চাইছে। ফলে তাঁরা যা দিচ্ছেন মানুষ সেটাই গ্রহণ করছেন। আমার মনে হয় মৌলিক সততার একটা জায়গা থাকা দরকার, সেই সঙ্গে প্রয়োজন কিছুটা সচেতনতারও, যে কোন কাপড় কেমন, কোনটা আসল, কোনটা নকল। লিনেন থাকবে, সিন্থেটিক ও থাকবে। কিন্তু লিনেন বলে সিন্থেটিক কিনব না।
শর্মিলা – মলমল আর জামদানি নিয়ে আপনার নতুন কালেকশন। কোথা থেকে এই ভাবনা?
অভিষেক – ইট ইজ আ ভেরি পারসোনাল কালেকশন। আমি তো দিদার কাছে মানুষ। দিদার পুরনো শাড়ি, হাতে বোনা কাঁথা সব আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। এ একটা মস্ত সম্পদ। সেই সব দিয়ে কিছু রিভাইভ করা যায় কিনা, সেটা ভাবতে ভাবতেই এই কালেকশন করার কথা মাথায় এল।

শর্মিলা – আপনার পোশাকে লেয়ারের খেলা খুব নজরে পড়ে।
অভিষেক – হ্যাঁ আমি লেয়ারিং খুব পছন্দ করি। মানুষের চরিত্রেও তো কত স্তর। তাই না? তাই মাল্টি-লেয়ারড পোশাক বানাতে ভালবাসি।
শর্মিলা – এবার আপনার ক্যাফে সম্পর্কে শুনি। চায়ওয়ালা!
অভিষেক – আসলে কী জানেন, রান্না-খাওয়া ব্যাপারটাতেই আমার দারুন উৎসাহ। শান্তিনিকেতনে তো তেমন ভালো কোনও খাবার জায়গা নেই। তাই হস্টেলে থাকতে নিজেরা নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতাম। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই কলকাতায় এসে আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে খুলে ফেলি এই ক্যাফে।
শর্মিলা – দু’টো ক্যাফে তো আছেই, তিন নম্বরটাও কি খুলতে চলেছে?
অভিষেক – ঠিকই বলেছেন।
শর্মিলা – আপনার কাফের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার কি?
অভিষেক – চিলি গারলিক স্প্যাগেতি, সয়া হানি চিকেন উইংস। আর স্পেশাল চা তো বটেই।

শর্মিলা – আর আপনার প্রিয় খাবার?
অভিষেক – আমি খেতে খুব ভালবাসি। তবে খাবারের ব্যাপারটা আমার মুডের ওপর নির্ভর করে। এক্সপেরিমেন্টাল খাবার পছন্দ করি। আর কমফর্ট-ফুড আলুসেদ্ধ ভাত।
শর্মিলা – আপনার প্রিয় পোশাক কী?
অভিষেক – সাদা ধুতি পাঞ্জাবি।

শর্মিলা – এ বার একটা মজার খেলা। আমি কয়েকটা শব্দ বলব। শুনেই আপনার কী মনে আসছে বলতে হবে। মানে শব্দটা শুনেই যে ভাবনার অনুষঙ্গ মনে আসছে সেটা।
অভিষেক – বেশ, শুরু করা যাক।
মা- দিদা
হিন্দি সিনেমা- শোলে
জীবন- বলা কঠিন
সমুদ্র- খোলা আকাশ
একাকীত্ব- পাহাড়
সেলেব্রিটি- জানি না
সাফল্য- আনন্দ
সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।