চা বাগানের প্রবীণা মহিলা আদিবাসী শ্রমিকদের মুখগুলি মনে পড়ে। খুব দীর্ঘাকৃতি তো তাঁরা হন না, বরং নেপালী শ্রমিকদের মধ্যে তেমন দীর্ঘ শরীর দেখা যায়। একজন আদিবাসী প্রৌঢ়া শ্রমিকের আদিম পুরাতন মুখশ্রীতে অজস্র কুঞ্চনের রেখা। বড় বিচিত্র সেই মুখ। কানে বড় করে ফুটো করা, তার মধ্যে শক্ত ফিতে গোল পাকালে যেমন হয়,তেমনি একটা কিছু অদ্ভুত লাল রঙের অলংকার গুঁজে দেওয়া আছে কানের ফুটোর মধ্যে। বাঙালি মহিলাদের মতোই সাধারণভাবে শাড়ি পরেছেন।

চা পাতা তোলার মাঝে অবসরটুকুতে হয়তো আমাদের বাড়ির বেড়ার বাইরের আমগাছটির ছায়ায় এরকম এক মহিলা বসেছেন দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে। চায়ের লিকার দিয়ে ভাত মেখে নিচ্ছেন তিনি। সেই খাবার তারপর দ্রুত খেয়ে নেবেন। একদিন নয়, দিনের পর দিন এই দৃশ্য দেখেছি। আজ অবাক লাগে কোনদিনও তলিয়ে ভেবে দেখিনি, কেন ওর ভাতের সঙ্গে আমাদের মতো মাছ/ডিম নেই কিংবা নিদেনক্ষে কেন নেই ভদ্রস্থ কোনও ডাল-তরকারি। ভেবে দেখিনি, ওদের চোখের তলে এত কালি এলো কোথা থেকে, আর চলে গেল কী করে শরীরের কান্তি এবং হয়তো রক্তের হিমোগ্লোবিন। এ সব কথা মনে হয়নি শুধু নয়, বিষয়টা আমাদের শিশুমনে অস্বাভাবিকও ঠেকেনি। মনে হত এমন হওয়াই নিয়ম। ওদের কাজ হল চা পাতা তোলা, হাড়িয়া খাওয়া আর রাত্রে মাদল বাজিয়ে নাচা। ওদের ছেলেমেয়েদের কাজ হল লেখাপড়া না শেখা, অকথ্য গাল দেওয়া, একটু বড় হলে চা বাগানের লেবার হয়ে যাওয়া।

আমরা তো ছিলাম শিশু। আমাদের ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মন আর পরিষ্কার শ্লেটের মতো মাথা। সেই শ্লেটে আমাদের আপন ও পড়শি অভিভাবকেরা কেউই এই দু’ধরণের জীবনের বৈসাদৃশ্যের অন্যায্যতার ব্যাখ্যা লিখে দেননি। আমার ধারণা, তাদের বেশিরভাগের কাছেও সেটাই খুব স্বাভাবিক মনে হত। ব্যতিক্রমী মানুষ কি ছিলেন না? যদি থেকে থাকতেন, তাঁদের সঙ্গে সে বয়সে আমাদের দেখা হয়নি। আমরা জানতাম আমাদের স্কুলে যেতে হবে, শিখে ফেললেও ওদের মতো  মুখখারাপ করা চলবে না। আর হ্যাঁ, সাহেবরা মদ খেলেও, লেবার বা বাবুদের সঙ্গে  খারাপ ব্যবহার করলেও, তাঁদের দূর থেকে সম্মান জানাতে হবে।

Women Labourers 1
রক্তাল্পতা আর অপুষ্টির সঙ্গে মা ও শিশুর শান্তিপূর্ণ সহবস্থান

আসলে চা বাগানের জীবনটাই ছিল নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত এক সম্পর্কের  চক্র, যেন সকলেই তাদের সামাজিক অবস্থান থেকে নির্বিকারভাবে নিজ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। উৎপাদন ঘিরে সম্পর্কের মধ্যে কোনও হৃদয়ের স্থান নেই। উৎপাদন ঋতুতে শ্রমিকদের শেষ শক্তিটুকু যিনি আদায় করে নেন, সেই ম্যানেজারই আবার আমাদের মতো শিশুদের সমবেত স্যালুটের উত্তরে গাড়ির গতি কমিয়ে সহাস্য হাত নাড়েন। আবার আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল অনেক বড় হয়ে এই খবর শুনে যে, বাবুদের মধ্যেও কয়েকজন শ্রমিকদের অশিক্ষার সুযোগ নিতেন।

চোখে ভাসে আর একটা দৃশ্য। পিঠে টুকরি, দুটো হাতের আঙুল চা গাছের পাতার উপর খেলে যাচ্ছে, হালকা হাতের ঝাঁকুনিতে পাতাগুলি প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ছে পিঠে বাঁধা টুকরিতে, আর পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে পিঠের টুকরি, সবুজ পাতায়। পিঠে  টুকরি আর বুকে? বুকে কাপড় দিয়ে বাঁধা ছোট্ট শিশুটি। মা-শ্রমিক তাকে নিরাপদে রেখে আসবে কোথায় ? তাই বুকেই আশ্রয় বুকের শিশুর। বৃষ্টিতে এবং রৌদ্রে। টুকরি ভরা পাতার বিনিময়ে যে শ্রমমূল্য তাদের দেওয়া হত তাতে উদর নামের গহ্বর তাদের কতটা পূর্ণ হত সে প্রশ্ন তোলা নাটকীয় হয় যদি, তবে ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি-সৃষ্ট এই ডুয়ার্সের মঞ্চেই অনুষ্ঠিত হত এই নাটক। কেননা রক্তাল্পতা আর অপুষ্টির সঙ্গে মা ও শিশুর ছিল শান্তিপূর্ণ সহবস্থান। এত যে মহিলা শ্রমিকদের কায়ক্লেশ সহন, তা সকলের— মালিকদের, সরকারের, সাহেবদের, বাবুদের এমনকী শ্রমিকদের নিজেদের কাছেও স্বাভাবিক মনে হত কেন? এ এক জটিল প্রশ্ন। তবে এ প্রশ্নের অনেক সরল উত্তর তখনকার প্রগতিবাদীদের কাছে পাওয়া যেত।

যে সময়ের কথা লিখছি সে সময়ে একটি উত্তরে এগিয়ে থাকা মানুষেরা সন্তুষ্ট থাকতেন– ‘মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা’। আর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন  এই বৈষ্যম্যের বিশল্যকরণী। কিন্তু মুনাফা অর্জনের শিকার তো নারী-পুরুষ শ্রমিক উভয়েই, তবে নারী শ্রমিকদের বেশি উৎপীড়ন সইতে হয় কেন? তাদের জন্য বাড়তি এক নির্যাতন আছে যা সে সময়ে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত। নারী শ্রমিকদের ঘরেও অত্যাচার বাসা বেঁধে আছে মৌচাকের মতো। বহু যুগের সঞ্চিত সংস্কৃতি ও সমাজ যে নির্যাতনকে মেনে আসছে সহজ স্বাভাবিক একটা বিষয় ভেবে। ব্যতিক্রম কী আছে? হয়তো আছে। কিন্তু অনেক ভদ্র অভিধাযুক্ত মানুষের মতো পুরুষ শ্রমিকও জানে এবং মানে যে রান্না করা, কাপড় কাচা, বাচ্চা মানুষ করা এসব স্ত্রীলোকের কাজ। বাইরের কাজ আর গৃহকোণের কাজের মধ্যে রয়েছে অসেতুবন্ধ বৈষম্য। পুরুষের রোজগার হল আসল রোজগার, মেয়েদের রোজগার যেন প্রধান আয় নয়, তা সম্পূরক এবং গৌণ।

Old Women Tea Labour
মেয়েদের রোজগারের কদর নেই পরিবারে

আমরা দেখতে পেতুম একটু বয়স্ক মহিলা কোনও শ্রমিক ঢেঁকি শাক বা সামান্য কিছু ফলমূল নিয়ে বসে আছেন সাপ্তাহিক বাজারে। কিংবা দেখেছি সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও মাথায় শুকনো ডালপালা নিয়ে তাঁরা গৃহাভিমুখে ফিরছেন, রাত্রের রান্নার প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু এইসব রোজগারের কদর নেই পরিবারে। ‘খানা পাকানো’ তো তাঁদের নির্ধারিত কাজ। তাই চুলো জ্বালাবার সরঞ্জাম জোগাড় করবেন তাঁরাই। এদিকে, ঘরে ঘরে তো জলের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি। কুলি লাইনের মাঝে একটিমাত্র শ্রমিকদের সকলের জন্য জলের কল। সেখান থেকে সংগ্রহ করে আনতে হবে জল, সংসারের সকল কাজের জন্যে। গৃহের অভ্যন্তরে যে শ্রম গৃহকোণের আধো আলোছায়ায় বসে নারী সম্পন্ন করবে, এটা সমাজগৃহীত নিয়ম। শ্রেণি, শ্রেণিবৈষম্য, শব্দগুলির যুতসই অনুষঙ্গ হিসেবে এসে পড়ে শোষণের কথা। কিন্তু সকলে খেয়াল রাখতে ভুলে যায় যে লিঙ্গের প্রশ্ন যেখানে ক্ষীণ হয়ে শ্রেণির সঙ্গে এসে মিলতে চায়, সেখানে শ্রেণি তাকে পাশে না বসিয়ে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়।

পিঠে টুকরি, দুটো হাতের আঙুল চা গাছের পাতার উপর খেলে যাচ্ছে, হালকা হাতের ঝাঁকুনিতে পাতাগুলি প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ছে পিঠে বাঁধা টুকরিতে, আর পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে পিঠের টুকরি, সবুজ পাতায়। পিঠে  টুকরি আর বুকে? বুকে কাপড় দিয়ে বাঁধা ছোট্ট শিশুটি। মা-শ্রমিক তাকে নিরাপদে রেখে আসবে কোথায় ? তাই বুকেই আশ্রয় বুকের শিশুর। বৃষ্টিতে এবং রৌদ্রে। 

দেখেছি নিরাপত্তাহীনতার ছায়া অনেক নিবিড়ভাবে প্রকট নারী শ্রমিকদের মুখে। কিশোরীবেলায় যে প্রানোচ্ছল মদেশীয়া মেয়েটিকে দেখেছিলাম, যার নাম ছিল সম্পত্তি, আমাদের বাড়ি সে একমুখ হাসি নিয়ে প্রায়ই আসত। তার বাবা একজন মদেশীয়া শ্রমিক, সীতারাম ছিল তার নাম। আমার বাবার খুব অনুগত। সম্পত্তিকে অনেক সময় সীতারাম আমাদের বাড়িতে রেখে যেত, বলতো মাইজিকে মদত করনে কে লিয়ে। একবার মা আমাদের দু’ভাইকে বল্লেন, আমরা সবাই হাসিমারা গেলে একবেলা তোরা চালিয়ে নিতে পারবি তো? আমরা দুজনে খুব রাজি। দাদা আমি মিলে ডিম, সবজি, ডাল রাঁধলাম। সম্পত্তি সে দিন বাড়িতে ছিল। সে তো হেসেই গড়িয়ে পড়ে আমাদের রন্ধনপ্রণালি দেখে। কিন্তু সে কিছুতেই খাবে না। দাদারা রাঁধবে আর সে খাবে, এটা হয় কী করে? আমরা ভাবলাম রান্নার ‘মান’-এ তার আস্থা নেই। দাদা তাকে আস্বস্ত করে বারবার বলছিল, ডাল ঔর আন্ডা বহুত বড়িয়া হুয়া। কিন্তু সে না খেয়ে দুপুরে বাড়ি ফিরে গেল।

Women Tea Workers
প্রত্যন্ত চা বাগানেও পিতৃতন্ত্র এক পরাক্রমী শক্তি, মেয়েদের শ্রম-শক্তিকে যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়

বাগান ছেড়ে চলে যাবার অনেক পরে আবার যখন একবার সেখানে গেছি, দেখি টুকরি মাথায় বিষন্ন সম্পত্তি আমাকে চিনতে পেরে লাইন ছেড়ে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু পুরনোকালের সে সারল্যমাখা হাসিটি তার কোথায় হারিয়ে গেল? জীবনযুদ্ধের ধূসরিমা মাখা তার মুখে। সে এখন চা বাগানের শ্রমিক। সন্তানদের মা। পুরুষদের প্রতিনিধি তার স্বামী হয়তো তাকে নিয়ত প্রশ্ন করে, সারাবছর তুমি কি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে? এরপর সন্তানসম্ভবা তুমি তো ঘরে বসে থাকবে? বিপরীতে আমরা পুরুষেরা বছরভর কামাবো। এখানেও, এই প্রত্যন্ত চা বাগানেও পিতৃতন্ত্র পুরুষদের এক পরাক্রমী শক্তি, মেয়েদের শ্রম-শক্তিকে যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। 

সম্পত্তিদের ঘটে কী সে বিদ্যাবুদ্ধি আছে যে বলবে, আরে, আমাদের শরীরের উপর তোমাদেরই পরিপূর্ণ দখল, তোমাদের ইচ্ছায় আমরা সন্তানের জন্ম না দিলে ভবিষ্যতে মালিকদের জন্য শ্রমিক জোগান কী করে বজায় থাকবে, আর কন্যা ঘরে না এলে কারা ঘরে বাইরে তোমরাদের জন্য খাটবে? মালিকদের শোষক বল তোমরা, ঠিকই বল। তবে তোমাদের শোষণ তো চলে আসছে আরো আগে থেকে, যখন কলকারখানাই ছিল না। বস্তুত, ধনতন্ত্রের হাত ধরে চা কারখানার মালিকদের যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের আমদানি হয়, পরিবার যদি ঐতিহাসিকভাবে ধন সমাহরণের কারণে গঠিত বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে, তবে তার অনেক আগে থেকেই পরিবারের মধ্যে চলে আসছে লিঙ্গভিত্তিক শোষণ। গার্হস্থ্য জীবনচক্রের যে সমাজস্বীকৃত শ্রম বিভাজন-ব্যবস্থা গৃহের আঙিনা ছাড়িয়ে উৎপাদনক্ষেত্রের পাঁচিলের ভেতরেও প্রবেশ করে, সেটা অপ্রতিরোধ্য। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই কি তা দূর হয়ে যাবে? তার জন্য সচেতন প্রয়াস লাগবে না?

 

আরও পড়ুন: প্যানডেমিক ডায়রি ১ – দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

 

দেখতে পেতাম চা বাগানের কাজের মাঝে খাবারের পুঁটুলি খুলছে নারী শ্রমিকেরা। খাবারের পুঁটুলির সঙ্গে হয়তো শিশুটিকেও বুকে বেঁধে এনেছে। তার স্বামী ও পরিবারের অন্যান্য ক্ষুধার্ত পুরুষ সদস্যরাও একে একে খাবারের জন্যে এসে জুটছে। পরিবারের সকলের আগে উঠে সে রান্না করেছে, নিজের জন্য নয় শুধু, পরিবারের সকলের জন্য, যারা কাজে যাবে ও যারা বাড়িতে থাকবে। কাজে যাবার পূর্বেও কিছু অন্তত জোটাতে হয়েছে সকলের জলখাবারের পাত্রে। কিন্তু মেয়েদের এই ঘরে বাইরের শ্রমের মূল্য সে পায় কতটুকু? মূল্য শুধু দেওয়া হয় চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমের মজুরিটুকুর। পারিবারিক শ্রম মূল্যহীন। মেয়েদের সাংসারিক কাজ করা তো ধারাবাহিক সামাজিক এক প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। সুতরাং মহিলা শ্রমিকদের পারিবারিক শ্রম তাদের সমুদয় কার্যধারার অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এভাবেই চা বাগানের শ্রমিক মেয়েদের দিনভরের শ্রম অবমূল্যায়িত হয়েই চলেছে। পরিবার, সেইসঙ্গে সমাজের মঙ্গলের জন্য নারীর অবদানও সেখানে গৌরবহীন, ছেঁদো। 

সেই কবে ১৮৮৬-৮৭ সালে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আসামের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বারোটি প্রবন্ধে লিখে সকলের নজরে এনেছিলেন। সে সময়ের লেখায় জানা গিয়েছিল মেয়েদের বাল্যবিবাহ ও শিক্ষা থেকে যোজন দূরে তাদের অবস্থানের কথা। তারপর স্বাধীনতা অন্দোলনে চা শিল্পের, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ,কাউকেই জড়িয়ে নেওয়া হল না। চা বাগানের নারী শ্রমিকদের সমস্যার কথাও আ্রলাদা করে উঠে এল না আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে। ট্রেড ইউনিয়ন ডুয়ার্সে জমে উঠতে উঠতে দেশে স্বাধীনতা এসে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট (১৯৫১) চালু হলে শ্রমিকদের শ্রম শর্তে ও শ্রমের বাইরের জীবনে সামগ্রিকভাবে কিছু অসুবিধার উপশম হলেও আলাদা ভাবে নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর হল কই? 

স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন পেতেন। বেতনের এই বৈষম্য দূর হতে স্বাধীনতার পরেও লেগে গেল অনেক বছর, সেই ১৯৭৬ সাল। মেয়েদের আঙুলগুলি নমনীয় হওয়াতে চা পাতা দ্রুত ও সঠিকভাবে (দুটি পাতা একটি কুড়ি) তাঁরাই তুলতে পারেন। সে কারণে পাতা তোলার কাজে মেয়েরাই নিয়োজিত হতেন বেশি। তাঁদের একটা নির্দিষ্ট পরিমান পাতা দৈনিক মজুরি হিসেবে তুলতেই হত। তারপর তার বাইরে অতিরিক্ত পাতা তোলার জন্য কেজি প্রতি আলাদা মজুরি দেওয়া হত। সুতরাং অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য তাঁদের নিজেদের নিঙড়ে দিতে হত। দুর্বহ টুকরি মাথায় এবড়ো খেবড়ো জমিতে তাঁদের দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হত। ফলে মেয়ে শ্রমিকদের ভুগতে হত পিঠ ও কোমরের ব্যাথা, গাঁটের ব্যথা ও মাথার ব্যাথায়। 

west-bengal-tea-workers-women
মেয়েদের আঙুল নমনীয় হওয়াতে চা পাতা দ্রুত ও সঠিকভাবে তোলার কাজে মেয়েরাই নিয়োজিত হতেন বেশি

মালিকপক্ষ মজুরির ক্ষেত্রে এই অনুপ্রাণনামূলক (incentive based) ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়। মহিলা শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে এ ব্যবস্থায় মুনাফা বেশি। ১৯৬৭ সালে প্রবর্তিত সম-বেতনের নীতিতে মালিকেরা করল কী, স্থায়ী চা বাগানে মহিলা শ্রমিকদের বদলে অস্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ বাড়িয়ে দিল। অস্থায়ী মহিলা শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, ক্রেশের ব্যবস্থা ইত্যাদি করার দরকার পড়ে না। কিন্তু এই সমস্ত সুযোগসুবিধা নয় কোনও দয়ার দান, ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্য়াক্টের বলে এগুলি মালিকের আইনসিদ্ধ দায়বদ্ধতা। স্থায়ী শ্রমিকদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা এবং বয়স্ক পারিবারিক সদস্যরা এই আইনের বলে বিশেষ কয়েকটি সামাজিক সুযোগসুবিধা পাবার অধিকারী। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলি পাবে কেবল চাকুরিরত মহিলা নিজে এবং তাঁর বাড়ির অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা। চা বাগানে পুরুষ শ্রমিকদের নিপীড়ণের উৎস যদি খুঁজতে যাই তবে শোষক রূপে আছে বাগানের মালিক, মহাজন প্রভৃতি আর নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বলতে হয় শোষক রয়েছে বহু রূপে সম্মুখে তোমার— রাষ্ট্র, মালিক, মহাজন এবং পরিবার। 

আদিবাসীদের যে প্রাচীন পরম্পরাবাহিত সংস্কৃতি ছিল, সেখানে নারীদের যৌনজীবন, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ কিছু অধিকার ছিল। দেশান্তরিত হবার ফলে চা বাগানে এসে তাঁরা তাঁদের গোষ্ঠী অনুসারে বাসস্থান পায়নি, সে কারণে কিছুটা এবং বাকিটা বাইরের বৃহত্তর সমাজের শক্তিশালী সংস্কৃতির সংস্পর্শ ও প্রভাবে তাদের নারীদের সামাজিক অগ্রগামী ভূমিকাগুলি ক্ষীণ হয়ে গেছে। এমনকী পুজোআচ্চা, আচার-অনুষ্ঠানেও নারীদের অগ্রাধিকার নেই, সম্পত্তি ধারণেও আজ তারা অক্ষম। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল।

একটু বয়স্ক মহিলা কোনও শ্রমিক ঢেঁকি শাক বা সামান্য কিছু ফলমূল নিয়ে বসে আছেন সাপ্তাহিক বাজারে। কিংবা দেখেছি সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও মাথায় শুকনো ডালপালা নিয়ে তাঁরা গৃহাভিমুখে ফিরছেন, রাত্রের রান্নার প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু এইসব রোজগারের কদর নেই পরিবারে। ‘খানা পাকানো’ তো তাঁদের নির্ধারিত কাজ। তাই চুলো জ্বালাবার সরঞ্জাম জোগাড় করবেন তাঁরাই। 

ওদের আচার তো ওদের সমাজেই সীমাবদ্ধ। আমাদের তা দেখার সুযোগ বা আগ্রহ তখন ছিল না। তবে ওদের একটিমাত্র অনুষ্ঠানে ওরা আসত আমাদের প্রাঙ্গণে, কালীপুজোর পরদিন। উদ্দেশ্য শুভেচ্ছা ও মঙ্গলকামনা বিনিময়। বাবুরা অবশ্য ভাবত টাকাপয়সা তোলার ফিকির। ওদের এই পরবটির নাম ছিল ‘ধৌসি’। হাতে থাকত বাঁশের দণ্ড অথবা কাঠের খুঁটি। উঠোনে প্রবেশ করেই ওরা নানা গোষ্ঠীগত যুদ্ধনাদ তুলত, সঙ্গে দন্ডগুলি দিয়ে মাটিতে তাল ঠুকত। শুরু হত এই শ্লোগানটি দিয়ে– “আয়ো পুগিও” (এসে পৌঁছেছি)। দলনেতা এই ধ্বনি তুলতেই মাটিতে দণ্ড ঠুকে অনুগামীরা ধুয়ো ধরত– “ধৌসি রে”। দলপতিদের আর একটি ধ্বনি ছিল “ঝিলিমিলি ঝিক্কা” (এর অর্থ জানি না আজও) তারপরই সমবেত ভূপৃষ্ঠাঘাত ও নভোমন্ডল কাঁপানো ‘ধৌসি রে’। এ ঘটনা উল্লেখের কারণ: এই পরবেও ছোটবেলায় দেখেছি শুধু পুরুষদের আসতে বাবু কোয়ার্টারগুলিতে। মেয়েদের বাদ দিয়েই তারা আসত। বকশিস নিত। হয়তো সে অর্থ দিয়ে আমোদেও মেয়েরা ছিল বঞ্চিত।

এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয় কী যেখানে আমাদের দেশে অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে, যেমন বয়নশিল্পে, ডকে, পোর্টে উনিশ শতকের মাঝখান থেকে ট্রেড ইউনিয়নের আবির্ভাব, সেখানে ডুয়ার্সের চা বাগানে ট্রেড ইউনিয়নের পদার্পণ হতে চা বাগান প্রতিষ্ঠার পর আরো ৭৫ বছর লেগে গেল? তাও যদি বা প্রতিষ্ঠিত হল, সেখানে একেবারে উচ্চ পর্যায়ের নেতারা কেউই চা বাগানের মানুষ নন, তাঁরা বাইরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ট্রেড ইউনিয়নের নীচের স্তরে নানা কমিটিগুলিতে চা বাগানের পুরুষ শ্রমিকেরা অবশ্য নেতৃত্বে আছেন। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রায় প্রত্যেকেই ডুয়ার্সে সংগঠন গড়েছেন। INTUC, CITU, UTUC, HMS, AITU  ইত্যাদিরা তো আছেই, স্থানীয় ছোট-বড় সংগঠনেরও অভাব নেই। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নে আদিবাসী মহিলা শ্রমিকদের ভূমিকা খুবই প্রান্তীয়।

তাবলে এই নয় যে তারা সংগঠনের সদস্যা নন। চা বাগানে ৫০/৬০ শতাংশই তো মহিলাকর্মী। তাঁরা প্রায় সকলেই কোনও না কোনও সংগঠনে আছেন। কিন্তু কোথাও তাঁরা নেতৃত্বে নেই। ট্রেড ইউনিয়ন মিটিংয়ে যেখানে বাইরের শহর/গঞ্জ থেকে আসা মধ্যবিত্ত নেতারা বক্তৃতা করেন, সেখানে মেয়ে শ্রমিকেরা শ্রোতা হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু যখন চা বাগানের পরিচালকবর্গ কিংবা সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, দরকষাকষি বা দাবি পেশ হয়, তখন সেখানে মহিলাদের স্থান হয় না। কর্মক্ষেত্রে কিংবা পরিবারে ঘটে যাওয়া জুলুমগুলি কখনোই কর্তৃপক্ষের বা সরকারি আধিকারিকদের নজরে আনা যায় না। তাছাড়া দর কষাকষি চালাতে প্রয়োজন হয় চলতি আইনকানুন, সম্পর্কে ধারণা, শ্রমিক সংগঠন সম্পর্কে সচেতনতা,  মেয়েদের অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ে ধারণা। চা বাগানে সে সমস্ত বিষয়ে তাঁদের সচেতন করার কেউ নেই। ট্রেড ইউনিয়নগুলি এ বিষয়ে নিজেদের দায়িত্বপালন করলে অবস্থার উন্নতি হত।

Women Tea Labours
সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও মাথায় শুকনো ডালপালা নিয়ে তাঁরা গৃহাভিমুখে ফিরছেন

মেয়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বে পৌঁছতে না-পারার বিশেষ কতকগুলি কারণ আছে। ন্যূনতম লেখাপড়াটুকু শিখে উঠতে না পারা তাদের মধ্যে একটি কারণ। ১৯৯১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, চা বাগানে মহিলা শ্রমিকদের সাক্ষরতা ১১ শতাংশ, যখন পশ্চিমবঙ্গের শতকরা ৪৭.১৫ জন মহিলা সাক্ষর। আদিবাসী কন্যাসন্তানদের স্কুলে লেখাপড়া শেখার প্রধান অন্তরায় ছোট ছোট ভাই বোনেদের দেখাশোনার দায়িত্ব তাদের উপর এসে পড়ে। তাদের মা বাবারা পড়ুয়া মেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে, যাতে তাদের শিশুদের দেখভালের কাজে লাগিয়ে তারা কাজে যেতে পারে। প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টে শিশুদের জন্য ক্রেশের ব্যবস্থার কথা লেখা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলির রক্ষনাবেক্ষণ এতটাই খারাপ যে সেগুলির উপর আস্থা থাকে না। তাছাড়া পরিবারের রান্না ও খাবার জল সংগ্রহের কাজেও ছোট মেয়েদের লেগে পড়তে হয় শিশুকাল থেকেই।

ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে মেয়েদের দেখা না পাবার অন্যতম আর একটি কারণ হল তাদের সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে মর্যাদার অভাব। আদিবাসী মহিলারা বর্ণহিন্দুদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে এখনও কিছুটা স্বাধীন। সেখানে পুরুষেরা প্রভাববিস্তারক ঠিকই কিন্তু মেয়েদের উপর শারীরিক জোর খাটানোর বদভ্যাস তাদের কম। কিন্তু সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক বিষয়ে পুরুষেরা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কর্মক্ষেত্রেও তাদের উল্লম্ব যাত্রার সুযোগ প্রায় নেই। সাব স্টাফের পদ পাবার যোগ্যতা পর্যন্ত তারা অর্জন করতে পারে না।

মহিলা শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে এ ব্যবস্থায় মুনাফা বেশি। ১৯৬৭ সালে প্রবর্তিত সম-বেতনের নীতিতে মালিকেরা করল কী, স্থায়ী চা বাগানে মহিলা শ্রমিকদের বদলে অস্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ বাড়িয়ে দিল। অস্থায়ী মহিলা শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, ক্রেশের ব্যবস্থা ইত্যাদি করার দরকার পড়ে না। কিন্তু এই সমস্ত সুযোগসুবিধা নয় কোনও দয়ার দান, ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টের বলে এগুলি মালিকের আইনসিদ্ধ দায়বদ্ধতা। 

১৯৯২ সালের এক সমীক্ষায় ডুয়ার্সের মহিলা শ্রমিকেরা জানিয়েছিল যে তারা কোন ইউনিয়নের সদস্য হবে তা ঠিক করে দেয় তাদের পিতা কিংবা স্বামীরা। অবিবাহিতদের পথ প্রদর্শক পিতা বা অন্য কোনও পুরুষ সদস্য, বিবাহিতদের স্বামী। এদের মধ্যে কয়েকজন জানিয়েছিল যে,পরস্পর শত্রুতাপরায়ণ একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতির কারণে তারা কোনও দলেরই সদস্যপদ নেয়নি। এরকমও অনেকে জানায় যে সকলকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা একাধিক ইউনিয়নের সদস্যপদ নিয়েছে।

আমি এ লেখা শেষ করব আমারই প্রত্যক্ষ এক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। চা বাগানের মহিলা শ্রমিকদের পরিস্থিতির ছবি আঁকতে গিয়ে যে কালো মেঘ আমি তাদের জীবনযাত্রার আশমানে জমিয়ে তুলেছি, তা আমার এই অভিজ্ঞতা হঠাৎ আসা বেগবান হাওয়ার মতো খানিকটা উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় হবে সেটা। বর্ষাকাল। পিক সিজন। পাতা তোলার ধুম লেগেছে আমাদের চা বাগানে। শ্রমিকদের উপর নাকি অসহনীয় চাপ দিতে শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। বাড়িতে বাবা কাকাদের মুখে শুনছি সে বার্তা। বেশ কিছুদিন ধরে আবহাওয়া উত্তপ্ত। অস্থায়ী নড়বড়ে তাঁবুতে কাপড়ের দোলনায় কর্মরত মায়েদের সন্তানেরা ঝুলছে। সময়মতো তাদের খেতে দিতেও হয়তো সময় দেওয়া হয়নি মায়েদের। 

এমন পরিস্থিতে একদিন শেষ বিকেলে তৎকালীন ম্যানেজার চোপড়া সাহেব এলেন পরিদর্শনে। সে সময়ে প্রতি দু’তিন বছর অন্তর শ্রমিকদের লম্বা বাঁটওয়ালা কালো রঙের ছাতা দেওয়া হত। তো সেদিন ম্যানেজমেন্টের দেওয়া ছাতা দিয়ে ম্যানেজারকেই উত্তম মধ্যম দিয়ে জমি ধরিয়ে দেওয়া হল। দিল কিন্তু বিনীত ভিতু হিসেবে পরিচিত মহিলা শ্রমিকেরাই, যারা নাকি সর্বসময় ঘরে বাইরে উপেক্ষিত। এটা কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আরো অনেক ঘটনায় দেখা গেছে তাদের খেপিয়ে তুললে ফল ভালো হয় না। ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনায় এবং কর্মসূচিতে যতই তারা উপেক্ষিত হোক না কেন, এসব ঘটনা প্রমাণ করে মহিলা শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিবাদ জানানোর ও নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা আছে।   

 

*ছবি সৌজন্য, The Guardian, YKA, Wikimedia Commons, ET
*প্রধান ছবি – পিয়া চট্টোপাধ্যায়ের বই A Time for Tea-এর প্রচ্ছদ 

অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।

2 Responses

  1. অপূর্ব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শুধুই চা শিল্পে নয় সমগ্র সমাজ ব্যবস্থায় নারী জাতির উপর শোষণ… ধন্যবাদ জানিয়ে এই মানস্তাত্বিক বিশ্লেষনের মান ছোট করা যাবে না

  2. খুব সুন্দর হয়েছে চা বাগানের মহিলা শ্রমিকদের কাহিনী টা। চালিয়ে যা যতো গুলো পারিস । শুভ রাত্রি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *