মিথ্যে কথা, মিথ্যে খবর, মিথ্যে ছবি, মিথ্যে মানুষ। সত্যি খুঁজতে গিয়ে এলোমেলো আমরা, নিজের অজান্তে নিজেরাই কখন যেন মিথ্যে হয়ে যাই।

আমাদের প্রতিদিনের যে আঁশটে বেঁচে থাকা, তার মধ্যের সত্যিটা বহু দিন আগেই পাড়ি দিয়েছে এমন এক ঠিকানায়, যার নাগাল পাওয়া ভার। খবরের কাগজের পাতা উল্টোলে একের পর এক মিথ্যে। টিভির চ্যানেল পাল্টাই যখন, তখন দেখি কোনও এক মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য তুমুল লড়ছেন রথী মহারথীরা। গায়ে বারকোড ছেপে বাহারি ব্যাগবন্দি হয় একের পর এক মিথ্যে। লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে একদল মানুষ উঁচু থেকে মাইকভরা মিথ্যে আমাদের কানের মধ্যে বমি করে যান প্রতিদিন।

আদম কি ইভকে মিথ্যে বলেছিল কোনও দিন? পৃথিবীর প্রথম মিথ্যেটা কে কাকে বলেছিল? জানতে ইচ্ছে করে খুব। আমরা যারা ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ে, মনীষীদের উক্তিতে, প্রবাদ প্রবচনে, পরীক্ষার খাতার ভাব সম্প্রসারণে জেনে এসেছি সত্যিরা শুধু জয়ধ্বনিই দেয়, বড় হয়েছি যত, সত্যের যাবতীয় স্লোগান ফিসফাস হয়েছে ক্রমশ। ‘সত্যি’ লেখা যে পতাকাটার মাথা উঁচু করে ওড়ার কথা, পরে জেনেছিলাম, সেই পতাকাটা আসলে ওড়ে সবার নিচে। ওড়ে না, নেতিয়ে থাকে ভিজে ন্যাতার মতো। ছোটরা বড় হয়,  তার সঙ্গে সঙ্গেই সত্যিরা মিথ্যে হয়।

যদি নিজেকে প্রশ্ন করি আজ, মিথ্যে বলে লাভ কী, কথাটা শেষ হতে না হতেই আমার ভিতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, সত্যি বলেই বা লাভ কী? সেই গলার আওয়াজ কর্কশ, দৃপ্ত। সে উত্তরে মুখ লোকায় প্রথম প্রশ্নটা। সেই দৃপ্ত কণ্ঠ বলে ওঠে ফের, সত্যি বলে কী পেয়েছ জীবনে, প্রতিদিনের বেঁচে থাকায়? যা পেয়েছ, মিথ্যের জন্যই তো। ঠিক কি না? চারপাশ থেকে হাজার হাজার একই রকমের কর্কশ গলা চিৎকার করে বলে, ঠিক ঠিক ঠিক। গায়ে আঁচড় লাগে।

মিথ্যেরও বিভিন্ন রকমফের আছে, অন্তত ইংরিজিতে। ছবি সৌজন্য – times.nie

মিথ্যে বলে কী হয়? যেটা সত্যি বলে হয় না, সেটাই তো হয়। আর সত্যি বলে কী হয়? বেঁচে থাকতে গেলে, আজকের দিনে হয় না কিছুই। ধরা না পড়লে চুরি বিদ্যাটাই তো সবচেয়ে বড় শিক্ষা। মিথ্যে বলে ধরা পড়ে কে? হাওয়ায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলে চারপাশ দুয়ো দেয়। মিথ্যে বলা মানে তো আসলে কাউকে ঠকানো। সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর যুগে অন্যকে না ঠকিয়ে বাঁচা যায়? আমি না ঠকালে তো পাশের লোকটা ঠকাবে আমায়। জীবন বলে, ঠকাও। না হয় ঠোক্কর খাও নিজেই।

টিভির চ্যানেল পাল্টাই যখন, তখন দেখি কোনও এক মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য তুমুল লড়ছেন রথী মহারথীরা। গায়ে বারকোড ছেপে বাহারি ব্যাগবন্দি হয় একের পর এক মিথ্যে। লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে একদল মানুষ উঁচু থেকে মাইকভরা মিথ্যে আমাদের কানের মধ্যে বমি করে যান প্রতিদিন।

কুমিরের গায়ের কাঁটার মতো মিথ্যেরও বিভিন্ন রকমফের আছে, অন্তত ইংরিজিতে। বাংলায় ‘ডাহা মিথ্যে’ বলে একটা কথা আছে। ব্যস, ওইটুকুই। ইংরিজিতে এই মিথ্যে কথার অলংকার অনেক। মিথ্যের যেন নানা রং। হোয়াইট লাই, ব্লু লাই, ব্ল্যাক লাই ইত্যাদি। হোয়াইট লাই মানে যে মিথ্যেটা আসলে ক্ষতি করে না কারও। ছোটদের যেমন বলি, খেয়ে নাও, না হলে পুলিশ আসবে এক্ষুনি। লুকনো ক্যামেরার সামনে কোনও জনপ্রতিনিধিকে যদি ক্যাশের তোড়া দেখিয়ে বলা যেত, খেয়ো না, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, তাহলেও কি সেটা সাদা মিথ্যের সিলেবাসেই আসত? বড় জটিল এই প্রশ্ন। ‘ব্ল্যাক লাই’-টা হল আসল মিথ্যে। মানে খাঁটি মিথ্যে। যে মিথ্যেয় কোনও খাদ নেই। এর মাঝামাঝি পড়ে ব্লু লাই। এর অর্থ, যে মিথ্যেটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়, আবার একদম সত্যিও নয়। অর্ধসত্য কিংবা অর্ধমিথ্যা। এ ছাড়াও ‘বিগ লাই’ বলে একটা কথা আছে ইংরিজিতে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ডাহা মিথ্যে।

এ প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।’ আর জীবনজোড়া ভুলের মধ্যেও একটা সারসত্য বলে গিয়েছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। বলেছিলেন, ‘যদি কোনও মিথ্যাকে তুমি বারবার এবং সাবলীলভাবে বলতে পার, তবেই তা বিশ্বাসযোগ্য হবে।’

Lie
বায়োস্কোপ প্রোজেক্টরের মতো খটখট করে চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় একের পর এক মিথ্যে ভরা ফিল্ম। ছবি সৌজন্য – singular.magazine

এই যুক্তি খণ্ডাবে কে? দুনিয়া জুড়ে মানুষ মিথ্যেয় মজেছি আজ। শুধু মুখ নয়, সারাটা শরীর ডুবে গিয়েছে বিজ্ঞাপনে, যার সিংহভাগই মিথ্যে। ‘নায়ক’ ছবিতে টাকার চোরাবালিতে ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া উত্তমকুমারের মতো। আগেকার বায়োস্কোপ প্রোজেক্টরের মতো খটখট করে চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় একের পর এক মিথ্যে ভরা ফিল্ম। ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়া যায় না জেনেও তামাম বিশ্বে কয়েকশো কোটি ডলারের ব্যবসা করে যাচ্ছে ফেয়ারনেস ক্রিম। হাতে গোনা কয়েকটা সংস্থা প্রোডাক্টের নাম পাল্টালে কীই বা আসে যায়? ফর্সা হওয়ার মোহে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্ত্যে কোনও তফাৎ নেই।  বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো মানুষের এই মোহ নিয়ে ছক্কাপাঞ্জার দান ঠিক করে চলে প্রতি বছর।

প্রথমে ছিল শুধু কালো মেয়ের মুখে আলো দেওয়ার চেষ্টা। মানে যে ক্রিম শুধু মেয়েদের। বছরের পর বছর ধরে টেলিভিশনে দেখান হল, আত্মবিশ্বাস আসলে চামড়ার রঙের সঙ্গে সমানুপাতিক। প্রতিভা নয়, গায়ের রংটা উজ্জ্বল হলেই সাফল্য আসে। মহিলারা আনন্দে, মোহে এই ক্রিম মাথায় করে নিলেন। কোম্পানিগুলো ভাবতে শুরু করল, মেয়েদের পরে এবারে টোপটা ছেলেদের দিলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রমাণ করার চেষ্টা হল, আপনি যদি মেয়েদের পোশাক না পরেন তা হলে মেয়েদের ফেয়ারনেস ক্রিম মাখবেন কেন? সুতরাং, পেশ করা হল ছেলেদের ফর্সা করার এক দুরন্ত উপায়। ছিপ ফেললে ফাতনা তো নড়েই, ১৩০ কোটির দেশে। বিশেষজ্ঞরা বার বার বলে চলেছেন, এই ক্রিম দিনের পর দিন ব্যবহার করা ক্যান্সার ডেকে আনার রাস্তাটা আরও চওড়া করে দেয়। এ সব পরামর্শে সম্মিলিত বুড়ো আঙুল দেখাই আমরা। এই মিথ্যেটাকে মিথ্যে বলে ভাবলে যে আমাদের আশাটাই মরে যায়। ফর্সা হওয়ার সুপ্ত বাসনা!

মিথ্যের যেন নানা রং। হোয়াইট লাই, ব্লু লাই, ব্ল্যাক লাই ইত্যাদি। হোয়াইট লাই মানে যে মিথ্যেটা আসলে ক্ষতি করে না কারও। ছোটদের যেমন বলি, খেয়ে নাও, না হলে পুলিশ আসবে এক্ষুনি। লুকনো ক্যামেরার সামনে কোনও জনপ্রতিনিধিকে যদি ক্যাশের তোড়া দেখিয়ে বলা যেত, খেয়ো না, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, তাহলেও কি সেটা সাদা মিথ্যের সিলেবাসেই আসত? বড় জটিল এই প্রশ্ন। ‘ব্ল্যাক লাই’-টা হল আসল মিথ্যে।

একই রকম ভাবে সত্যি লম্বা হওয়ার ক্রিম। কিংবা চুল পড়ার সমস্যার কোনও তাক লাগানো ক্রিম। ইদানীং এক মতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। মানে মিথ্যের মোড়কে এতদিন চাপা দেওয়া কোনও তত্ত্ব থেকে আসল তথ্যটা বেরিয়ে আসছে ফের। খাওয়ার জলকে পরিশুদ্ধ, আরও পরিশুদ্ধ করতে করতে জলের আসল গুণাগুণটাই নাকি হারিয়ে যেতে বসেছিল। শুধু ফিলট্রেশনে হল না, বিশ্বজুড়ে ব্যবসা ফাঁদতে শুরু করল রিভার্স অসমোসিস নামে এক আশ্চর্য যন্ত্র। এমনই এর মহিমা, জলের মধ্যে যে প্রয়োজনীয় এবং উপকারী খনিজগুলো আছে, সেগুলোকেও ছেঁটে ফেলতে শুরু করল এই যন্ত্র। যন্ত্রের নাড়িভুড়ির মধ্যে যে মিনারেল ট্যাঙ্কটা আছে, সেটা নাকি সেই জলে আবার নতুন করে মিনারেল মেশায়, এমনই দাবি করে প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো। দেরিতে হলেও টনক নড়েছে আমাদের। খবরে পড়লাম, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে দেশ থেকে এই রিভার্স অসমোসিস মেশিনের মন ভুলনো, লোক ঠকানো ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।

এরকম মিথ্যেভরা বিজ্ঞাপণের উদাহরণ দেওয়া যায় ভূরিভূরি। মাধ্যমিকে ফার্স্ট হলেই বুঝি অমুক প্রকাশনীর সহায়িকা পড়তে হয়। এক বছরের জন্য টিভির পর্দায় তারা হওয়ার জন্য প্রকাশকরা কত টাকার চুক্তি করে এই মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে, জানতে ইচ্ছে হয়। আর এই টোপে কী ভাবে খোলামকুচির মতো বিকিয়ে যায় বোর্ড পরীক্ষার রত্নেরা। দিনের পর দিন এই প্রচারটাও তো আসলে মিথ্যে! টিভিতে একের পর এক চ্যানেলে লাইন দিয়ে বসে থাকা জ্যোতিষবাবুরা তাঁদের প্রেডিকশান ও তান্ত্রিক তির দিয়ে গ্রহের অবস্থান বদলে দিচ্ছেন। যে কাজটা নাসা কোটি ডলার খরচ করেও করে উঠতে পারল না, তা তারা অবলীলায় করে দিচ্ছেন সামান্য কিছু টোটকায়। রোজ রাত দেড়টার সময় একটা মন্ত্র চারবার বললেই আপনি শুষে নিতে শুরু করবেন পরিবেশ থেকে যাবতীয় পজিটিভ রে। আর নেগেটিভ রে-কে সোচ্চারে বলবেন, তফাৎ যাও। পদার্থবিদ্যা নিয়ে ডক্টরেট করা বেশ কিছু বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রে-র মধ্যে আবার এমন পজিটিভ বা নেগেটিভ হয় কি না। ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। অথচ দেখুন, কি সহজে আমরা সবাই বিশ্বাস করে চলেছি এমন মিথ্যে ও গাঁজাখুরি যুক্তিকে, দিনের পর দিন।

Lie
ছিপ ফেললে ফাতনা তো নড়েই, ১৩০ কোটির দেশে। ছবি সৌজন্য – incmagazine.com

মিথ্যের পরিধি শুধু বিজ্ঞাপনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেনি। প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে খবরের মধ্যেও। ভুয়ো খবর। কয়েক বছর আগে পর্যন্তও জানতাম, বিশ্বাস করতাম, খবর কখনও মিথ্যে কথা বলে না। খবর পড়া মানে তো এক রকমের আত্তীকরণ। শুষে নেওয়া। এর মধ্যেও কখন যেন ঢুকে গিয়েছে বিষ মেশানো ঘোলা জল। অবশ্য মিথ্যে ও ভুয়ো খবর ছড়ানোর দোষ খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলের যতটা, তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি সোশ্যাল মিডিয়ার। মোবাইলে মজেছি আমরা। মজেই চলেছি। আজকের দুনিয়ায়, খবর কাগজের খবর যদি ট্যাবলেট হয়, তাহলে ফেসবুক ও হোয়্যাটসঅ্যাপ মারফৎ ছড়িয়ে পড়া খবর যেন হাতের শিরায় ড্রিপ করে দেওয়া মাদকের নেশা। সোজা এসে মিশছে রক্তে। ভারতবর্ষের মতো দেশে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ছে যত, তত ডানা মেলছে ভুয়ো খবর আর এই খবর ঘিরে অন্ধ মাদকতা, পাগলামি।

একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলে ভারতে ইন্টারনেটের বিস্তার নিয়ে ধারণা করা যাবে। ২০১২ সালে যেখানে এদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন ১৩৭ মিলিয়ন মানুষ,  ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটা ছুঁয়েছে ৬০০ মিলিয়ন। কী নিয়ে মিথ্যে খবর, ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে এমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কি নিয়ে ছড়াচ্ছে না? হোয়্যাটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ নিজেরাই জানিয়েছে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার তাদের এ দেশে, ভারতবর্ষে। ২৩০ মিলিয়ন মানুষ এই প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়। মাত্র কয়েক মাস আগে ছেলেধরা সন্দেহে যে বেশ কিছু মানুষ গণপিটুনির বলি হয়েছিলেন নানা রাজ্যে, তার ইন্ধন জুগিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া ও হোয়্যাটসঅ্যাপের মতো মাধ্যম। ডেঙ্গির সময় হাজারো অবৈজ্ঞানিক টোটকার কথা মনে পড়ে? ২০১৩ সালে মুজফফরনগরের দাঙ্গায় প্রাণ যায় পঞ্চাশেরও বেশি নিরীহ মানুষের। এর মূলে ছিল হোয়্যাটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া কিছু ইন্ধনমূলক ভিডিও। চাকরির ভুয়ো খবর রটানোর সোনার মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া। বছরখানেক আগে এক ভারতীয় বহুজাতিকের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াতেই শ্লোগান উঠেছিল, তারা নাকি তাদের নুনে পটাশিয়াম ফেরোসায়ানাইডের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে দেয়। পুরোটাই এক ভুয়ো ক্যাম্পেন। লোকের মনে আবার ঠিক ধারণা ফিরিয়ে আনতে সংস্থাটিকে কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি। মর্ফড ছবি তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন, হাজারে হাজারে। কোনও টালমাটাল পরিস্থিতিতে ভিন দেশের কোনও ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কোনও দেশীয় ক্যাপশন।

ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সম্প্রতি অবশ্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে হোয়্যাটসঅ্যাপ। কোনও মেসেজ পাঁচজনের বেশি কাউকে এক বারে ফরওয়ার্ড করা যায় না এখন আর। ফরওয়ার্ড করা মেসেজের গায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে— ফরওয়ার্ডেড। কিন্তু এর ফলে ভুয়ো খবর প্রচার ও প্রসারে খুব একটা অসুবিধা হয়েছে বলে মনে হয় না। হোয়্যাটসঅ্যাপের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, এর ফলে মেসেজ ফরওয়ার্ড করার প্রবণতা প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ভুলের উপর ভর করা গণ মাদকতা সেকথা বলে না।

২০১২ সালে যেখানে এদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন ১৩৭ মিলিয়ন মানুষ,  ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটা ছুঁয়েছে ৬০০ মিলিয়ন। কী নিয়ে মিথ্যে খবর, ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে এমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কি নিয়ে ছড়াচ্ছে না? হোয়্যাটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ নিজেরাই জানিয়েছে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার তাদের এ দেশে, ভারতবর্ষে। ২৩০ মিলিয়ন মানুষ এই প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়।

একটা মিথ্যেকে বারবার দেখাতে থাকলে সেই মিথ্যেটাকেই তো সত্যি বলে মনে হয়। সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার মধ্যে এক ধরণের স্যাডিস্টিক আনন্দ আছে। আমাদের তো এখন, ভার্চুয়ালেই জন্ম, যেন ভার্চুয়ালেই মরি। যে সময়ে এই লেখা লিখছি, লকডাউন-উত্তর করোনাকালে, না চাইলেও আর অস্বীকার করতে পারছি না যে এই মৃত্যু উপত্যকা আমারই দেশ। সারা পৃথিবী জুড়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ারই একাংশে এই মৃত্যুমিছিল, এই নিষ্ঠুর সময় থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার কী আশ্চর্য প্রয়াস। তাই তো বাড়ির টানে আড়াইশো কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পরে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া মৃত লোকটা, কিংবা কাজ হারিয়ে বিষ খেয়ে পড়ে থাকা নিথর কোনও দেহের ছবির নীচেই জায়গা করে নেয়, উদ্দাম বাথটবে বক্ষবিভাজিকা দেখালেন অমুক অভিনেত্রী। কিংবা, বাড়িতেই টপলেস তমুক, খুললেন প্যান্টের চেন-ও। এমন ছবির তলায় এক লক্ষেরও বেশি লাইক পড়ে। পড়তেই পারে। কিন্তু তাই বলে এই দুঃসময়ে? সত্যি জীবন থেকে ক্রমাগত মুখ ফিরিয়ে নিলেও তো সে বেঁচে থাকাটা আসলে মিথ্যে হয়ে যায়! আশ্চর্যের কথা হল, যে সময়ে শরীরে ইনসুলিনের দরকার, তখন জোর করে পুশ করে দিচ্ছি আমোদের মেগা সিরিঞ্জ। বহুবার। এর ফলে যে ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তাটা ফুরোয় না, সেটা আমরা বুঝি না।

মিথ্যের বৃক্ষরোপণ নিয়ে পিট সিগারের একটা গানের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। গানটার নাম ছিল ‘হোয়াট ডিড ইউ লার্ন ইন স্কুল টুডে?’ এক পিতা তার শিশুপুত্রকে প্রশ্ন করছেন, আজ কী শিখলে স্কুলে? তার উত্তরে ছেলেটি বলছে, শিখলাম ক্ষমতায় আসীন যাঁরা, তাঁরা কোনওদিন মিথ্যে কথা বলেন না। শিখলাম, যুদ্ধে সৈনিকরা মারা যান না কখনও। শিখলাম, আমাদের নেতারা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মানুষ। তাঁরা সব সময় ঠিক। শেখানো হল, নেতারা ভাল মানুষ বলেই আমরা বছরের পর বছর ভোট দিয়ে তাঁদের ক্ষমতায় আনি। এই প্রশ্নোত্তরে গান নিজের ছন্দে এগোতে থাকে। ১৯৬৩ সালে ‘এ লিঙ্ক ইন দ্য চেইন’ নামের অ্যালবামে গানটি প্রকাশিত হলেও আজকের দিনে এর প্রতিটা শব্দ কি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। ছোটদের মধ্যেই তো মিথ্যের বীজটা পুঁতে দেওয়া সবচেয়ে সোজা। আজও।

রাজনীতির কূটকচালির মধ্যে যাচ্ছি না। সারা পৃথিবীর নেতারা দিনের পর দিন কী ভাবে রচনা করে যাচ্ছেন একের পর এক মিথ্যে অমনিবাস, তার মধ্যে ঢুকছি না। তা দিয়ে প্রবন্ধ হয় না, উপন্যাস হয়। শিশুদের কেমন করে মিথ্যে শেখাচ্ছি, দেখি। কয়েকটা ছোট উদাহরণ। আজকের দিনেও স্কুলে বাচ্চাদের চিনের প্রাচীরের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, এই ভুবনবিখ্যাত দেওয়াল নাকি খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদ থেকে, এমনই বিশালকায় এই স্থাপত্য। নাসা এমন ধারণা নস্যাৎ করেছে বহুবার। তাও আমরা শেখাই। বাল্ব আবিস্কার করেছিলেন কে? আমরা শেখাই, টমাস আলভা এডিসন। ডাহা মিথ্যে। বাগানে বসে একটু আরাম করছিলেন যখন, তখনই নাকি স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাথার উপরে আপেল এসে পড়ে। আর তারপরেই মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার। ন্যাড়ার মাথায় বেল পড়তে পারে। কিন্তু নিউটনের মাথায় আপেল পড়েনি কখনও। আমরা শেখাই! একইরকম ভাবে শেখাই মিথ্যে গাড়ি আবিস্কারক হিসেবে হেনরি ফোর্ডের নামও। আর একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। পাঠ্যবইয়ে দেশের কিংবা রাজ্যের নয়, রূপকারের নামও পাল্টে যায়, মসনদে গদি বদলের সঙ্গে। এড়াব বলেও এড়িয়ে যেতে পারলাম না! নতুন সিলেবাসের নতুন নতুন বইয়ে ইতিহাসও কিভাবে পাল্টে দেওয়া হয়, তা নিয়ে বিরোধীরা তো মাঝেমধ্যেই গলা চড়ান। অভ্যেসটা জারি থাকে, শুধু বিরোধী বদলে যায়।

মোবাইলে মজেছি আমরা। মজেই চলেছি। আজকের দুনিয়ায়, খবর কাগজের খবর যদি ট্যাবলেট হয়, তাহলে ফেসবুক ও হোয়্যাটসঅ্যাপ মারফৎ ছড়িয়ে পড়া খবর যেন হাতের শিরায় ড্রিপ করে দেওয়া মাদকের নেশা। সোজা এসে মিশছে রক্তে। ভারতবর্ষের মতো দেশে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ছে যত, তত ডানা মেলছে ভুয়ো খবর আর এই খবর ঘিরে অন্ধ মাদকতা, পাগলামি।

হোয়াইট হাউসে কুড়ি মাস পূর্ণ করার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েকটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘(আজকের দিনের)এই পৃথিবীটা হল সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর, সবচেয়ে দূষিত। এতে এখন শুধু কাদা, মিথ্যে আর শঠতা।’ এক ঘর সাংবাদিকদের সামনে জানিয়েছিলেন, ‘সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। হোয়াইট হাউসেও আমি সবাইকে আর বিশ্বাস করি না।’ আসলে, আজকের সময়টা এমনই। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান নেতার গলার আওয়াজেও এই বিপন্নতা ফুটে উঠেছিল। আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের জনপ্রতিনিধিদের। ওঁরা বিশ্বাস করেন না আমাদের, যাঁরা তাঁদের ক্ষমতায় আনে। এক রাজ্যের অবিশ্বাস অন্য রাজ্যকে। এক রাষ্ট্রের কাছে অন্য রাষ্ট্র মিথ্যেবাদী ছাড়া আর কিছু নয়।

একটা চলতি কথা আছে। তুমি যদি কোনও সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে না পারো, তা হলে ওই সিস্টেমের মতো করেই নিজেকে পাল্টে নাও। কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু ভাবতে ভয় হয়। কবীর সুমনের গানে ‘মগজে কারফিউ’ লাইনটার কথা মনে হয়। সত্যের জয় হউক বলে যদি আজকের দিনে কেউ রাস্তায় স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায়, তাকে মনে হবে হীরক রাজার দেশের সেই মগজধোলাই খাওয়া অপ্রকৃতিস্থ মানুষগুলোর মতো। এরা বলে কী! যারা এখনও পুরোপুরি পাল্টাতে পারিনি নিজেদের, যারা এখনও অন্যের উপরে বিশ্বাস রাখি, যারা আজও মনে করি দুনিয়াজোড়া মিথ্যের জাল কেটে সত্যিটা বেরোবেই, তারা নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে এ বারে খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের বদলে নিই।

শিশুদের কেমন করে মিথ্যে শেখাচ্ছি, দেখি। কয়েকটা ছোট উদাহরণ। আজকের দিনেও স্কুলে বাচ্চাদের চিনের প্রাচীরের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, এই ভুবনবিখ্যাত দেওয়াল নাকি খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদ থেকে, এমনই বিশালকায় এই স্থাপত্য। নাসা এমন ধারণা নস্যাৎ করেছে বহুবার। তাও আমরা শেখাই। বাল্ব আবিস্কার করেছিলেন কে? আমরা শেখাই, টমাস আলভা এডিসন। ডাহা মিথ্যে।

‘শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক, সত্যের জয় হোক জয় হোক’ বলে একটা নজরুলগীতি আছে। জানি অলীক শেষ, তাও ভাবলাম শেষ যদি করতেই হয় এই লাইনগুলো দিয়েই শেষ করব। ইন্টারনেটে পুরো গানের লিরিকটা পড়ার ইচ্ছে হল একবার। একটা ওয়েবপেজ খুলতেই আমার ল্যাপটপের ব্রাউজার বলল, দিস পেজ ইজ পোটেনশিয়ালি আনসেফ।

ঠিকই আছে!

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

3 Responses

  1. ভীষণ প্রাসঙ্গিক লেখা। এ সমস্যা বোধ হয় চিরকালই ছিল, তবে দিনকে দিন তা বাড়ছে। চকচকে মোড়কগুলোর উপর অন্ধের মতো বিশ্বাস রাখা কবে যে শেষ হবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *