গত বছর নভেম্বর মাসে খবর এল চিনের উহানে এক নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তার থেকে যে মারণব্যাধি হচ্ছে, তা স্পর্শের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। তা অমন রোগ তো মাঝে মাঝেই আসে। এই শতাব্দীতেই সার্স, মার্স, ইবোলা, জিকা কত কিছু এল। চিনে হয়েছে, ঠিক আছে। কিছুদিন বাদে কমে যাবে অন্য সব রোগের মতোই। কারো কল্পনাতেই আসেনি এ রোগ সারা পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই স্তব্ধ করে দেবে, একবছর বাদে শুধু যে মৃতের সংখ্যা গুনতে হবে তাই নয়, তার থেকেও বেশি হিসেব করতে হবে অর্থনীতির বেহাল দশার।
এ দেশে এখন বাজেট পেশ হয় ফেব্রুয়ারির এক তারিখ। তাই প্রথামতো তার আগের দিন, অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল। তারিখটা কিন্তু ভাইরাসের খবর মেলার প্রায় আড়াই মাস বাদে, চিনে তখন এ রোগ নিয়ে রীতিমত হইচই, এশিয়া ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইতালিতে। সে সময়ে অর্থনৈতিক সমীক্ষাতে বলা হয়েছিল, ভারতীয় অর্থনীতি সাম্প্রতিককালের দুরবস্থা কাটিয়ে উন্নতি শুরু করবে, সামগ্রিক দেশীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ হবে আশা প্রকাশ করা হয়েছিল।
আজ প্রায় এগারো মাস বাদে এসে দেখছি, এদেশে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ঘোষণা করেছে মন্দা, কারণ পর পর দুই ত্রৈমাসিকে সামগ্রিক দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলি ভারতের অর্থনীতি নিয়ে ভীতিপ্রদ ভবিষ্যতবাণী করছে, রেটিং নেমে যাবে আরও। এভাবে চলে আসছে মহামন্দা। কেউ অত ভয় না দেখালেও বলছেন মহামন্দা না হলেও ভারতীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে, ২০২০-২১-এর তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আগে ঊর্ধ্বগতি আশা না করাই ভাল।

কেন এমন হল?
এ কথা ঠিক, যে কোভিডের কারণে একমাত্র তার জন্মস্থান চিন ছাড়া এপ্রিল-জুন ২০২০ ত্রৈমাসিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আটটি অর্থনীতির (দেশের) সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের। প্রায় ২৪ শতাংশ। মার্চের শেষে লকডাউন শুরু হয়েছে, অর্থনৈতিক কাজকর্ম পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেছে, সেটা অবশ্যই একটা কারণ। কিন্তু মে মাসে বিশ্বব্যাঙ্ক করোনার কারণে সংকোচনের যে আভাস দিয়েছিল, তাতেও এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে আসন্ন, তা মোটেই বলা হয়নি। তাতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতকে রাখা হয়েছিল নিট আমদানিকারী দেশের মধ্যে, এবং বলা হয়েছিল যেহেতু সার্বিক বন্ধের কারণে তেলের আমদানি কম থাকবে ও বিশ্ববাজারে তেলের দামও নিম্নগামী, এই ধাক্কা খুব বেশি হবে না। সামগ্রিক দেশীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার বড় জোর ২.৩% কমতে পারে! সেখানে এতখানি সঙ্কোচন কেন, বুঝতে গেলে শুধু করোনাকাল নিয়ে আলোচনা করলে হবে না, একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
স্বাধীনতার পরে ভারতীয় অর্থনীতির যাত্রা তার শ্লথ গতির জন্যই বিখ্যাত। দীর্ঘদিন বৃদ্ধির হার ছিল ৩%-এর এদিক-ওদিক। ঠাট্টা করে একটি ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে বলা হত ‘হিন্দু বৃদ্ধির হার’। পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে মুক্তির উড়ান শুরু হল ১৯৯১-তে, অনেক রকম ছাড় দেওয়া হল, অনেক ভর্তুকি তুলে দেওয়া হল। বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে, কিন্তু সরকারি এবং সরকার-পোষিত যে ক্ষেত্র অর্থনীতির ভিত্তি ছিল, সেই কাঠামো কিন্তু খুব একটা পালটাল না। নতুন দাঁত ওঠার সমস্যা সামলাতে সামলাতে এক দশক কেটে গেল। এই মুক্ত অর্থনীতিতে যে ক্ষেত্রটির ওপরে সবচেয়ে আশা করা হয়েছিল, সেই শিল্পক্ষেত্র তেমন কিছু আহামরি বৃদ্ধি পেল না, বরং তথ্যপ্রযুক্তির চাকাতে ভর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করল সেবাক্ষেত্র। সে চলন এমন যে তা ভারতীয় অর্থনীতির কাঠামোটাকেই পালটে দিল। যে কৃষিক্ষেত্র জাতীয় আয়ের সিংহভাগ যোগাত, তাকে পেছনে ফেলে সেবাক্ষেত্র এগিয়ে গেল। মাঝে শিল্পক্ষেত্র যেমন ছিল, তেমনই রইল। শিক্ষিত মানুষ বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরি পেল, গ্রামের চাষির ছেলে চাষ ছেড়ে সেবাক্ষেত্রে এল। কিন্তু তার স্থান হল তলার দিকে, সে ভিড় বাড়াল তথাকথিত অসংগঠিত ক্ষেত্রে। আর এই শতাব্দীর প্রথম দশকে শুরু হল ভারতীয় অর্থনীতির স্বপ্নের উড়ান। ২০০৩-৮ সময়কালের মধ্যে বৃদ্ধির হার প্রায় ৯% হল। কবে দুই সংখ্যাতে পৌঁছবে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হল। না, তা হবার ছিল না । আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার কারণে ২০০৮-এ বিশ্বব্যাপী মন্দা ভারতীয় অর্থনীতিকে খুব একটা বেকায়দাতে ফেলতে পারেনি। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগ-নির্ভর অর্থনীতি ঘা খেল তার পরে, যখন নানা রকম বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে গেল, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর বসানোর কারণে সে দেশ থেকে আউটসোর্সিং কমে গেল।

ব্যক্তিমালিকানা ভিত্তিক সংস্থার মুনাফা কমা বা ক্ষতির দায় এসে পড়ে ব্যাঙ্কব্যবস্থার ওপরে, যার বেশিটাই রাষ্ট্রায়ত্ত। তাদের অনুৎপাদক সম্পদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। দেশকে বাঁচিয়ে রাখে তার গ্রাম, খুব পরিষ্কার করে বলতে গেলে ২০০৫ সালের জাতির জনকের নামাঙ্কিত জাতীয় কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প। অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যর্থতার ফলে উদ্ভূত উৎপাদন কমা, কাজ হারানো, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ইত্যাদির প্রভাব পড়ে রাজনৈতিক স্তরে, ২০১৪তে কেন্দ্রে হয় পালাবদল।
এই পালাবদলের পরেই কিন্তু পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। প্রথনেই যোজনা কমিশনের বদলে নীতি আয়োগ তৈরি হয়, এতদিনের গড়ে-ওঠা সরকারি এবং সরকার-পোষিত নানা সংস্থাকে নানাভাবে সংকুচিত করা হয়, যাতে কর্পোরেটরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। দেশের অর্থনীতির ৯০ ভাগ ধরে আছে যে অসংগঠিত ক্ষেত্র, তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এমন দু’টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়ে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ল। একটি হল নোটবন্দি। যে দেশের শতকরা পঁচাশি ভাগ লেনদেন নগদ অর্থে হয়, সেখানে আকস্মিকভাবে কালোটাকা উদ্ধার করার জন্য বড় মূল্যের নোট বাতিল করা হল। দেশের সাধারণ মানুষের অপরিসীম দুর্ভোগ সত্ত্বেও কালো টাকা মোটেই বিশেষ পাওয়া গেল না। বরং ছোট উৎপাদক এবং ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হল। বাজারে সচলতা থেকে বেরিয়ে গেল কারণ তাদের বেশিরভাগ লেনদেনই নগদে। তাদের কর্মচারীরা হয় কাজ হারাল, নয়তো আয় কমে গেল। আর একটি হল দ্রব্য এবং সেবা কর। তত্ত্বগতভাবে এই করের সুযোগ ছিল সারা দেশকে এক ছাতার তলায় আনার, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রকে সংগঠিত করার। কিন্তু ভুলভাল করের হার, ততোধিক খারাপ ব্যবস্থাপনা আবারও দেশের উৎপাদন এবং ছোট ব্যবসাকে সুরাহার বদলে সমস্যায় ফেলে দিল।
তাই অর্থনৈতিক সমীক্ষা যাই বলুক, ২০২০ সালে ভারতীয় অর্থনীতি খুব একটা ভাল অবস্থায় ছিল না। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার আগে থেকেই কমছিল, বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ভোগব্যয়ও অধোগামী। সারা দেশে চাহিদার অভাব প্রকট। যোগানের দিকে ব্যক্তিমালিকানার কর্পোরেটদের হাল বিশেষ সুবিধার নয়, মাত্র কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে বা প্রভাব বাড়ছে। জাতীয়করণের পরের চার দশকে ব্যাঙ্কব্যবস্থার এত খারাপ হাল আগে কখন হয়নি। সরকারের হাতে মোকাবিলা করার মতো আর্থিক বা করনীতি খুব একটা কিছু অবশিষ্ট ছিল না। রাজকোষ ঘাটতি প্রায় ৩.৮ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন যতই ভাল হোক, চাহিদার অভাবে চাষিরা দাম পায় না। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কম বলে মাঝারি শিল্পও ঝিমিয়ে পড়েছে আর সেবাক্ষেত্র পুরোটাই নোটবন্দির ধাক্কায় তখনো ধরাশায়ী। এইসময়ে মার্চের শেষে আবার চার ঘণ্টার নোটিসে এল লকডাউন।
এটি একেবারে দেওয়ালের মতো অর্থনীতির চলনপথকে আটকে দিল। একমাত্র অত্যাবশ্যকীয় চলাফেরা ছাড়া সব বন্ধ, তা পণ্য বা মানুষ যাই হোক। আর সব আবরণ ছিন্ন করে ইনডিয়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ভারত। পরিযায়ী শ্রমিকের মরিয়া হয়ে হাঁটা দেখিয়ে দিল আধুনিক নাগরিক করপোরেট ভারত কত ঠুনকো, যেখানে মানুষকে শেষ অবধি ফিরতে হয় গ্রামে, খোঁজ করতে হয় একশোদিনের কাজের, বেঁচে থাকার জন্য।

না, তাও চোখ খুলল না। বারে বারে নানাভাবে জানানো সত্ত্বেও চাহিদা বাড়ানোর কোনও চেষ্টা হল না। লকডাউনের মধ্যে এবং তারপরেও যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করা হল তা শুধু যোগানের দিকে তাকিয়ে, শিল্পক্ষেত্রকে নানারকম সুবিধা দিয়ে। যদিও বারে বারে প্রমাণ হয়েছে এই ক্ষেত্রের অর্থনীতির গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা কত কম। পণ্যের চাহিদা যদি না থাকে, তাহলে পণ্য উৎপাদনে উৎসাহভাতা দিয়ে কী লাভ? সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ, অতিমারীর কারণে জনগণ দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্যপণ্য বা বাড়িঘর কেনার সিদ্ধান্ত পালটেছেন, এখনি এসবে বিনিয়োগ চাইছেন না।
অর্থনীতিতে বাণিজ্যচক্র বলে একটি বিষয় আছে, সে তত্ত্ব অনুযায়ী আয়ের গতি চক্রাকার, সে নামে আবার ওঠে। চাহিদা ঝিমিয়ে থাকলে মন্দা আসে, আয়ের বৃদ্ধি তলানিতে পৌঁছয়, তারপরে আবার বাড়ে। অতিমারীর কারণে পৃথিবীর সব দেশেই আয়ের সঙ্কোচন হয়েছে, মারীজনিত অর্থনৈতিক কাজকর্মের স্তব্ধতার জন্য এটা খুব স্বাভাবিক, অসুখ কমলে আবার চাকা ঘুরবে। ভারতের সমস্যা হল একদিকে সে global value chain-এর সঙ্গে যুক্ত, সেখানে আন্তর্জাতিক ব্যাপারের অভিঘাত তার ওপরে পড়েছে। অন্যদিকে, তার কর্মীদলের বৃহদংশই অসংগঠিত, সরকারি নীতির অভিঘাত তার ওপরে কেমন করে পড়ে, অধিকাংশ সময়ে আন্দাজ করা মুশকিল। ভুল নীতির কারণে আয়বৃদ্ধির হারের অধোগতি চলছিল, অতিমারী এসে খাঁড়ার ঘা দিল। তাই পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতির আয়বৃদ্ধির হার কমল সবচেয়ে বেশি। চাহিদাবৃদ্ধি না হলে রোগ সহজে সারবে না।
তবে সবাই বোধ হয় খারাপ নেই, অন্তত কামাখ্যা মন্দিরের নতুন সোনার পাত তো তাই বলছে!
মহালয়া চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক। নগর অর্থনীতি, মহিলা শ্রম এবং লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে ওঁর লেখা একাধিক দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। ইকোনমিকস অফ আরবান ল্যান্ড ইউজ, এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ওঁর লেখা গবেষণামূলক কিছু বই।
যুক্তিনিষ্ঠ তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ।