এক ইউনিভার্সিটি শহরের পুজোর গল্প বলব আপনাদের। শহরটির নাম ওয়েস্ট লাফায়েত। ওয়েস্ট যখন আছে তখন ইস্টও থাকার কথা কিন্তু নেই। আমাদের হাওড়া ও কলকাতার মাঝে যেমন হুগলি নদী তেমনি লাফায়েত আর ওয়েস্ট লাফায়েতের মাঝে আছে ওয়াবশ নদী। খুব বড় নয় তা-ও এই দেশের তুলনায় বড়। নদীর পশ্চিমপাড়ে ইউনিভার্সিটি। নাম হল জন পারডুর নামাঙ্কিত পারডু ইউনিভার্সিটি। আর এখানের যে মানুষটি চাঁদে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি এই পারডু ইউনিভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছিলেন। একবার তাঁকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ঘটেছিল নীল আর্মস্ট্রঙ বিল্ডিঙের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার পঞ্চাশ বছরের অনুষ্ঠান হয়ে গেল কদিন আগে। দেখতে দেখতে প্রায় বাইশ বছর পার।এই শহরে আসি উনিশ সাতানব্বই সালে। সেই বছর দেশে পুজো কাটিয়ে এই শহরের মাটিতে পা রেখেছিলাম।পরের বছর পুজোর সময় জানলাম এই রাজ্যের পুজো অন্য তিনটি রাজ্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে হয়।তাই সেই পুজোর নাম tristate দুর্গাপূজা। আর প্রতি তিন বছর অন্তর আমাদের রাজ্যে পুজো হবে। তাই সই। যে তিনটি রাজ্য মিলিয়ে পুজো হয় তারা হল ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি আর ওহাইও কিছু অংশ। যখন নিজের রাজ্যে হয় তখন এক ঘন্টার ও কিছু বেশি সময় ড্রাইভ করে পুজোয় যাই। আর প্রতিবেশী রাজ্যে হলে তিন চার ঘন্টার বেশি লেগে যায়। এইসব ছোট ছোট শহরে যাতায়াতের জন্য দেবদেবীদের মত ছাপোষা লোকেদের ও নিজস্ব বাহনের দরকার। এই করে সময় কেটে যায় দশ বছর। দু হাজার সাতে পুজো পড়ল কেন্টাকির লেক্সিংটনে।যেতে সময় লাগবে চার ঘন্টারও বেশি। প্রমাদ গুনলাম। ছোট ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে সকাল সকাল বেরোতে না পারলে পুজো দেখব কি করে? আর অনেক ছাত্রছাত্রীর নিজের গাড়ি নেই। তারা যাবে কী করে? পুজোর দিনে বাড়িতে বসে মন খারাপ করবে সবাই। নাই বা থাকল শরতের শিউলি, সাদা সাদা কাশফুল আর জল টলটলে পুকুরের পদ্ম কিন্তু বুকের ভিতর জুড়ে যে সেই আনন্দময়ী আর তার উৎসব বাঙালি তাকে ভুলবে কী করে? জগতের আনন্দযজ্ঞে সামিল হওয়ার জন্য তার ভিতরে আকুলিবিকুলি চলছে নিরন্তর। সে তো দেশ ছেড়েছে কিন্তু দেশ তো তাকে ছেড়ে যায়নি। সে বরং বুকের মধ্যে গেড়ে বসেছে তল্পিতল্পা নিয়ে। কত্ত ছোট্ট ছোট্ট অকিঞ্চিৎকর জিনিসের জন্য মন কেমন করে তার। ভেবে দেখলাম যদি নিজেদেরই ছোট্ট একটা পুজো করা যায়। তাতে যত না পুজো তার চেয়ে বেশি হবে ওই পুজো পুজো ভাবটা। ভাবলে তো আর হবে না। তার জন্য অনেক কিছু চাই।

প্রথমে দরকার একটা প্রতিমা। তা এক বন্ধু বলল দেশ থেকে একটা ছোট্ট ডোকরার দুর্গামূর্তি এনে দেবেন। তাই সই। এ বার রান্নাবান্না। দায়িত্ব নেব বলে দিলাম। এ বার দরকার পুজোর সরঞ্জাম আর পুরোহিত। আমাদের অর্থবল আর লোকবল দুটোই খুব কম। ইউনিভার্সিটি শহর তো। তাই বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী, গবেষক আর কিছু মাস্টারমশাই। তাই দূর থেকে পুরোহিত আনা বা পুজোর সামগ্রী কেনা বেশ কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। এর ওর বাড়ি থেকে সংগ্রহ হল সামগ্রী। আর পুজো করবে এক গবেষক। প্রথমে সে খুব গাঁইগুঁই করল। বলল আমার সেই ছোটবেলায় পৈতে হয়েছিল। তার পর সেই সুতো যে কোথায় ঝুলছে কে জানে? আর পুজোর কিছু জানি না। ভুলভাল পুজো করলে দেবী যদি অসুরের বদলে আমায় তেড়ে আসে? তার সে সব কথায় পাত্তা না দিয়ে তার বউকে ধরলাম। তার বউ বলল সেই সামাল দেবে সব কিছু। এ বার দরকার একটা বড় জায়গার। যেখানে পুজো আর খাওয়াদাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। বেশির ভাগ বড় বড় পুজো এখানে স্কুল ভাড়া করে পুজো করে। কিন্তু তার ভাড়া “ঢাকের দায়ে মনসা বিকোয়” এর মত। আমরা এত খরচ করতে পারব না। ভাবতে ভাবতে খুঁজে পাওয়া গেল চার্চ। কিন্তু তারও ভাড়া অনেক। তাই তাদেরকে অনেক ভুজুংভাজুং দিয়ে বোঝান হল লাদেনের মত এক অসুরকে নিধন করতে দেবী দুর্গার মর্তে আগমন। টোপটা তাঁরা খেলেন। এবং কম পয়সায় দিলেন। শর্ত একটাই পরের দিন রবিবার। তাদের চার্চ যেন সাফসুতরো করা থাকে।

আমেরিকান নিয়মকানুনের বেড়াজালে (প্রদীপ জ্বালানো আর ধুনো দেওয়া নিয়ে অনেক নিয়মের নিগড় আছে এদেশে) পুজো হল। ভেবেছিলাম খুব বেশি লোক হবেনা । নেই নেই করেও পচাঁত্তর জন লোক। দুবেলার খাওয়ার বানানোর দায়িত্ব সব পরিবারগুলি আর ছাত্রছাত্রী মিলে নিল। ঢাকের বদলে বাজাল আফ্ৰিকান ড্রাম। এখানে একটি দলকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের বাজনার তালে তালে পায়ের ছন্দ মেলাল পড়ুয়াদের দল। কী সুন্দর সহাবস্থান! চার্চে পুজো, ঢাক বাজছে আফ্রিকার। একেই বলে সর্বজনীন। আর সেই বছর এখানে স্থানীয় সংবাদপত্রে ফলাও করে ছবি ও পুজোর খবর বেরোল। আমাদের খুশি তো আর ধরে না।একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা এত জনের কাছে পৌঁছে গেছে এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে? এখন লোকসংখ্যা বেড়ে দুশোর কাছাকাছি প্রায়।

তার পর থেকে গড়গড়িয়ে চলছে পুজো। এ বারে তের বছরে পড়ল। তারমানে টিনেজে ঢুকে গেল।গুটি গুটি পায়ে যে পথচলা শুরু হয়েছিল তা এখন অনেক শক্তপোক্ত। সেই ছোট ডোকরার মূর্তি দেখে প্রথম বছর ছেলেপুলেরা একটু ব্যাজার মুখ করেছিল। যারা দেশের বড় বড় প্যান্ডেল আর ঠাকুর দেখে অভ্যস্ত তাদের এই ছোট মূর্তিতে মন ভরবে কেন? তাই তারা বায়না ধরল বড় ঠাকুরের। কিন্তু চাইলেও তো হবে না। বড় ঠাকুরের খরচ অনেক। সেই পয়সা দেওয়ার জন্য তো কোন গৌরী সেন বসে নেই। তাই ঠিক করা হল তারা ঠাকুর কেনার দায়িত্ব নেবে আর আমরা লোকের কাছ থেকে পয়সা তোলার দায়িত্ত্ব। কুড়িয়ে বাড়িয়ে পয়সা তোলা হল। কিন্তু ঠাকুর জুন বা জুলাই মাসে কলকাতা থেকে জাহাজে ভাসতে ভাসতে নিউইয়র্ক বন্দরের কাস্টমসে আটকে গেলেন। আসলে তিন এজেন্ট মারফত তিনি এসেছিলেন। কোন এক রাঘব বোয়াল এজেন্ট বেশি টাকা গিলে নেন। তাই শেষের জন তাঁকে নমঃ নমঃ করে ওই খানের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। এ দিকে সেখানে তো ওই ঠাকুর ক্লেম করে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। তিনি চলে গেলেন নিউ জার্সির এক গুদামঘরে। আমরা খবর পেয়ে তোড়জোড় করে আবার তাঁকে ওয়েস্ট লাফায়েতে নিয়ে এলাম। খরচ আরও বাড়ল নিয়ে আসার জন্য। তিনি আছেন। এখানে তো নদীতে বিসর্জন হয় না। এত আর পাতিতপাবনী গঙ্গা নয়, যেই আসবে তাকে বুকে তুলে নেবে। তাই পুজোর পরেই তিনি চলে যান এক বাড়ির গ্যারাজে সম্বৎসরের জন্য। আর পুজোর অন্যান্য সামগ্রী তা থাকে আমাদের কাছে। আর পুরোহিতের কথা ভুলে চলবে না। আমাদের তের বছরে চারজন পুরোহিত। দেবীর ভাগ্য খুবই ভালো। তিনি নিজেই ” যে খায় চিনি তাকে যোগায় চিন্তামণি” র মত পুরুত জোগাড় করে নেন। আমরা যখন মাথায় হাত দিয়ে বসি এই বছরের পুরোহিত কে হবে, মানে আগের জন Ph D শেষ করে অন্য কোথায় পাড়ি দিয়েছে তখন মুশকিল আসানের মত কেউ এক জন এসে পড়ে। সে এসে আবার পুরোহিতের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। নিষ্ঠাবান না হলেও বিদ্বান পুরোহিত আছে আমাদের। তারা কোন পয়সা কড়ি নেয়না। ভালোবেসে অল্প কিছু দেওয়া হয় তাকে।

পুজো হবে আর খাওয়াদাওয়ার কথা আসবে না তাই কি হয়? আগে দুপুর ও রাতের সব খাওয়ার বাড়িতে বানানো হত। কিন্তু লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য রাতের খাবারটা বাইরে থেকে আনাতে হয় । আর কিছু হোক বা না হোক পাঁঠার মাংস চাই-ই চাই। যতটা ভাত বা পোলাও কেনা হয় তার চেয়ে বেশি কেনা হয় গোটমিট। যাতে কারুর কোনও অভিযোগ না থাকে মাংস নিয়ে। নারকেল নাড়ু, সন্দেশ, মিষ্টি দই আর চাটনি সব ঘরে বানানো। এক এক জন দায়িত্ত্ব নেয় সেগুলির। আর দুপুরের খিচুড়ি রান্না হয় পুজোর ওখানেই। প্রতি বছর দল বদল ঘটে। আসলে যে ছেলেটি বা মেয়েটি সাহায্য করে পরের বছর সে চলে যায় অন্য কোথাও। আবার নতুন কেউ এগিয়ে আসে। আমাদের স্থায়ীদের এই ভাবে মানিয়ে নিতে হয় অস্থায়ীয়েদের সঙ্গে। কারুর ঝুরঝুরে আলুভাজা হলে কারুর ফোলা ফোলা বেগুনি পছন্দ। চেষ্টা করা হয় এই ছোট্ট ছোট্ট ভালোলাগার জিনিসগুলো করতে। যাতে প্রবাসে থেকেও মনে হয় উৎসবের দিনে ভাল আছি, আনন্দে আছি।

দেশে যেমন তিথি ধরে পুজো হোক না কেন আমাদের কাছে তা উইকএন্ডের পুজো। কোন কোন সময় দেশের পুজোর পরে পুজো হয়েছে। নিয়নকানুন আচার নিষ্ঠা কোনও কিছু প্রাধান্য পায়নি আমাদের কাছে। যা পেয়েছে তা হল উৎসব। ওই যে সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হই হই করে পুজোর সব কাজ করা, যাতে মনে হবে এটা আমাদের পুজো, যা একান্ত ঘরোয়া, আড়ম্বরহীন কিন্তু আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। কাছাকাছি জায়গা থেকে কিছু কিছু মানুষ আসেন আমাদের পুজো দেখতে। আর পুজো শেষে সবাই বলি ‘আসছে বছর আবার হবে’।
ওয়েস্ট লাফায়েতের তরফ থেকে সমস্ত মানুষজনদের সাদর আমন্ত্রণ রইল আসার জন্য।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *