‘গোয়ান চার্মার’ বলা হত তাঁকে। পুরনো গোয়ার নোনা মাটিতে লেগেছিল তাঁর জাদুদণ্ডের স্পর্শ। আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাশন ডিজাইনার হয়েও ভারতের ফ্যাশন রাজধানী মুম্বই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারেনি। শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছিলেন নিজের জন্মভূমিতে – উত্তর গোয়ার ছোট্ট গ্রাম কোলভালে-তে। সেখানে নিজের পূর্বপুরুষের সাড়ে চারশো বছরের ভিটেটা মেরামত করে সাজিয়েছিলেন নিজের মনের মতো করে। কাসা ডোনা মারিয়া নামের সেই বাড়িতেই থাকতেন নিজের সঙ্গী জেরোম ম্যারেলের সঙ্গে। নিজের শর্তে, নিজের আনন্দে। কেউ ভাবতে পারেনি যে উনষাটে আচমকাই থেমে যাবে হৃদযন্ত্র। ওয়েন্ডেল রডরিক্সের অকালমৃত্যু হঠাৎই ফাঁকা করে দিল তাঁর সেই গোয়ার পুরনো বাড়ি, সেই একফালি গ্রাম।
গোয়াকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন সার্কিটে পাকাপাকি জায়গা করে দিয়েছিলেন ওয়েন্ডেলই। উত্তর গোয়ার ভূমিপুত্র ওয়েন্ডেল বরাবর তাঁর পোশাকের নকশায় বজায় রাখতেন গোয়ানিজ জীবনযাত্রার সারল্য আর মাধুর্য। নব্বইয়ের দশকে মুম্বইতে কেটারিং টেকনোলজি পড়তে শুরু করেন ওয়েন্ডেল। বুঝতে কি আর পারেননি, যে ভালো লাগছে না এই জীবন? তবু সিদ্ধান্তটা নিতে নিতে কেটে গিয়েছিল আরও কয়েকটা বছর। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ভূত যখন স্থায়ী হয়ে ঘাড়ে জমিয়ে বসল, চলে গেলেন পারি। সেখান থেকে লস এঞ্জেলেস। তারপর চাকরি নিলেন ওমানে। আর সেই চাকরি করতে করতেই দেখা এমন একজনের সঙ্গে, যিনি আমৃত্যু ওয়েন্ডেলের আঙুল ছাড়েননি। তবে সে গপ্পো পরে।
পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে মুম্বইয়ের ওবেরয় গ্র্যান্ডে ওয়েন্ডেল জীবনের প্রথম ফ্যাশন শো করলেন। ১৯৮৯-তে। সঙ্গী মডেল মেহর জেসিয়া। অতি কষ্টে টাকা জমিয়ে গোটা ছয় সাত অরগ্যানজার টিউনিক তৈরি করেছিলেন। সেই শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আজ দুবাই ফ্যাশন উইক, কাল পারি ফ্যাশন উইক, তার পরের দিন ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিলে বক্তৃতা… ওয়েন্ডেলের কেরিয়ারগ্রাফ সাঁই সাঁই করে উপর দিকে উঠতে লাগল।
কিন্তু মুম্বইয়ের ফ্যাশন দুনিয়ার ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি তাঁকে আটকাতে পারল কই? ১৯৯৩ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন, অনেক হল মুম্বই। এ বার ফিরে চল মাটির টানে। উত্তর গোয়ার কোলেভালেতে নিজের পূর্বপুরুষের ভিন্টেজ বাড়িতে এসে বাসা বাঁধলেন। তাকে সারিয়ে সুরিয়ে নতুন রূপ দিলেন। কাজ করা শুরু করলেন গোয়া থেকে। ডুব দিলেন গোয়ার ইতিহাসে। ওই বাড়িতেই নিজস্ব স্টুডিও তৈরি করে কাজ করতে থাকলেন গোয়ার স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে। গোয়ার সমুদ্র জগদ্বিখ্যাত। ওয়েন্ডেলও তাই শুরু করলেন ডিজাইনার বিচওয়্যার বানানো। গোয়ানিজ আদিবাসীদের তৈরি কুনবি শাড়ি নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। তাকে নিয়ে এলেন বিশ্বের দরবারে। প্রতিভা পাটিল থেকে সোনিয়া গান্ধী – ওয়েন্ডেলের কুনবির রংরূপে মজলেন সবাই।
দুনিয়া কাঁপানো ফ্যাশনিস্তা আর ডিজাইনাররা বলেন, ওয়েন্ডেলের সহজ সরল নকশাই তাঁর পোশাকের বৈশিষ্ট। নদীর মতো তরতরিয়ে ভেসে চলা এক ধরনের আবছা আবেগ থাকে তাঁর নকশা ঘিরে। শেপ-কাট-স্টাইলে মিনিম্যালিজম বরাবরই ওয়েন্ডেলের সিগনেচার স্টাইল। এবং একইসঙ্গে চূড়ান্ত পরিবেশবান্ধব। গোয়ার অলস, ধীরে ধীরে বয়ে চলা, স্তিমিত জীবনযাত্রার স্পিরিটই খুঁজে পাওয়া যায় ওয়েন্ডেলের অধিকাংশ পোশাকে। ঝকমকে পুঁতি, সিক্যুইন, মুক্তো তাঁর বিলকুল না-পসন্দ। কখনও কুনবি, কখনও খাদি, কখনও লিনেন… হাতে বোনা কাপড়ের পশরা নিয়ে কোথায় না কোথায় পাড়ি দিয়েছেন! বলিউডেও ওয়েন্ডেলের ভক্তের সংখ্যা বিপুল। মালাইকা অরোরা থেকে শুরু করে অনুষ্কা শর্মা সকলেই মজেছেন তাঁর পোশাকে। দীপিকা পাডুকোন তো কেরিয়ার শুরুই করেছিলেন ওয়েন্ডেলের মডেল হিসেবে। তাঁর মুখে দীপিকার প্রশংসা শুনেই মালাইকা দীপিকার নাম প্রস্তাব করেন ফারাহ খানের কাছে, যিনি তখন ওম শান্তি ওমের নায়িকা খুঁজছেন। ব্যাস! দীপিকার জয়যাত্রা শুরু।
ওয়েন্ডেলের সবচেয়ে পছন্দের নায়িকা রেখাকে অবশ্য সাজানোর সুযোগ মেলেনি তাঁর। তবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৪ সালের ইন্ডিয়া ফ্যাশন উইকে নিজের একটি গোটা কালেকশন তাঁকে উৎসর্গ করেন ওয়েন্ডেল। কিন্তু রেখা রাম্পে হাঁটতে লজ্জা পান। তাই শো-স্টপার হতে রাজি হননি। সে কথা হাসিমুখে জানিয়েছিলেন ওয়েন্ডেল নিজেই। বলেছিলেন, “রেখা আমার নিজের দিদির মতো। ওঁরও সাদা রং পছন্দ। তাই আমার সাদা পোশাকের কালেকশন ওঁকে উৎসর্গ করলাম। আমরা দুজনেই খুব পজিটিভ মানুষ। যোগব্যায়াম আমাদের ধ্যানজ্ঞান। উনি সবসময়ই আমার মনের কাছাকাছি থাকেন। তাই ওঁর ৬০ বছরের জন্মদিনে এই কালেকশন ওঁকে উপহার দিলাম।”
এর মাঝে মাঝে কত কিছু যে করেছেন, তার হিসেব রাখা দুষ্কর। গোয়াকে চিনতেন হাতের তালুর মতো। তার ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে বই লিখেছেন। গোয়ানিজ খাবার তো তাঁর গবেষণার অন্যতম বিষয়। উনিশ শতকে গোয়ার ক্যাথলিক সমাজে এক বিশেষ ধরনের নাচগানের চল ছিল যার নাম মান্ডো। যে পোশাক পরে এই নাচগান করা হত তার স্থানীয় নাম পানো ভাজু। ওয়েন্ডেলের খেয়াল হল এই পোশাকের ইতিবৃত্ত জানবেন। কিন্তু গোয়া তো তখন ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ! সব বইপত্র, কাগজ সবই তো পর্তুগিজ ভাষায়! ওয়েন্ডেল নাছোড়। চলে গেলেন লিসবনে। পর্তুগিজ ভাষা শিখে এসে শুরু করলেন গবেষণা। চলল পড়াশোনা। শেষমেশ লিখে ফেললেন ‘মোদা গোয়া – হিস্ট্রি অ্যান্ড স্টাইল’। পরে আত্মজীবনীও লিখেছেন – ‘দ্য গ্রিন রুম’ নামে।

এহেন ওয়েন্ডেল ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা। নিজের যৌনতা বিষয়ে সব সময় ছিলেন খোলামেলা, অকপট, দুনিয়াকে থোড়াই কেয়ার। নিজে সমকামী ছিলেন বলে শুধু নয়, বরাবরই এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের পুরোভাগে দাঁড়িয়েছেন ওয়েন্ডেল। ওমানে চাকরি করতে গিয়ে যাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ার কথা বলেছিলাম প্রতিবেদনের গোড়ায়, সেই জেরোম ম্যারেলকে বিয়ে করেন ২০০২ সালে পারি শহরে। পরিবার দূরে সরে গিয়েছিল। তোয়াক্কা করেননি। আঠারো বছর ধরে সুখময় দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন দুজনে। ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা দুনিয়া। যদিও স্থায়ী আস্তানা ছিল কোলভালের বাড়িই। সাড়ে চারশো বছরের পুরনো বাড়িটায় অবশ্য তৈরি করেছিলেন সংগ্রহশালা। নিজেরা সরে গিয়েছিলেন কাছেই এক ছোট্ট বাড়িতে। তবে কোলভাল থেকে ওয়েন্ডেলকে আমৃত্যু কেউ সরাতে পারেনি। সেই বাড়ি থেকেই শেষবারের মতো কফিনবন্দি হয়ে যাত্রা করলেন, জেরোমকে একলা ফেলে।
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!